Zilhajj 1443   ||   July 2022

নবীজীর প্রতি কটূক্তি : মুসলিম দুনিয়ায় প্রেম ও প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ

Mawlana Sharif Muhammad

আলোর বিভা ও কল্যাণে সবাই মুগ্ধ ও অনুগৃহীত অনুভব করলেও অন্ধকারের জীবদের তা সহ্য হয় না। আলোর প্রতি বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ তারা অন্তরে লালন করে; অন্তরের সেই বিতৃষ্ণা কখনো কখনো উগড়ে দিতে বিষোদ্গার ও কটূক্তির পথ বেছে নেয়। গত মে মাসে প্রতিবেশী হিন্দু-প্রধান রাষ্ট্র ভারতে এমনই বেদনাদায়ক একটি ঘটনা ঘটেছে। ওই দেশটির কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসক দল বিজেপির এক নারী মুখপাত্র একটি প্রকাশ্য টেলিভিশন টকশোতে খাতামুন্নাবিয়্যীন সায়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কটূক্তি করে এবং প্রিয় নবীজীর চরিত্র হনন করে বক্তব্য দেয়। এরপর তার ওই বিষোদ্গার-বক্তব্য সমর্থন করে ওই দলেরই আরেক পাপিষ্ঠ। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ-মাধ্যমের ভাষায়-ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির নুপুর শর্মা গত মে মাসের এক টেলিভিশন বিতর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন। আর দলের দিল্লি শাখার মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নাভিন জিন্দাল এ বিষয়ে টুইটারে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এই বিষোদ্গারের বেদনার্ত প্রতিক্রিয়া প্রথমে প্রকাশ পায় ওই দেশটির নবীপ্রেমিক মুসলিমদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদে। ভারতের বিভিন্ন শহরে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ মুসলিমরা পথে নেমে আসেন। কিন্তু কটূক্তিকারীদের দল ও সরকার এ প্রতিবাদ গায়ে মাখতে চায়নি। কিন্তু এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আরববিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ ও ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হলে ভারতের বিজেপি সরকার কটূক্তি বিষয়ে তাদের অ-সম্পৃক্ততাতুলে ধরার চেষ্টা শুরু করে। প্রতিবাদ ও ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ আরো দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়লে হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের আরেকটু গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ভেতরে ভেতরে বিজেপি নেতা ও সরকারের ইসলাম-বিদ্বেষ-বিষোদ্গারের বিষয়টি গোপন করে হলেও তারা আরব ও মুসলিম বিশ্বে নিজেদের সাফাই-বার্তাদেওয়ার চেষ্টা করে। দলের দুই নেতা-মুখপাত্রকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত ও বহিষ্কার করে একটি সাফাই বিবৃতিও দেয়।

দুই।

ইসলামের একদম শুরু যুগ থেকেই ইসলামের বিরোধিতার ঘটনা ঘটে এসেছে। আঘাত-হামলা-গালমন্দ চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মানবতা ও সভ্যতা-বিরোধী জঘন্য প্রক্রিয়ার একটি ক্ষীণ ধারা চালু ছিল- হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিষোদ্গার-কটূক্তি। আরব-আজমের প্রায় সব দুশমনই যেখানে প্রিয়নবীর জীবন-চরিত্র ও সদাচারের প্রশংসা-বাক্য উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছে, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু অন্ধকারের জীব নবীর চরিত্র হননমূলক কটূক্তি উগরে দেওয়ার কাজটি করে এসেছে।

অসভ্য ও অযৌক্তিক উপায়ে চালু এই নোংরা বিদ্বেষী ধারার অন্যতম উদ্দেশ্য, ইসলাম-অনুসারী মানুষের অন্তরে রক্তক্ষরণ ঘটানো এবং মুসলমানদের নবীপ্রেম ও মহব্বতের চাদরে অশ্রদ্ধার কালিমা লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা; আদর্শিক শুভ্রতার আঙিনায় নোংরা ছড়িয়ে দেওয়া। এজন্য নবুওতের কাল থেকেই নবীজীর প্রতি কটূক্তির অসভ্যতাকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ অনেক বড় বেদনা, ক্ষোভ ও চ্যালেঞ্জের সাথে গ্রহণ করে এসেছে। এবার ভারতে সরকারি দলের নেতানেত্রীদের কটূক্তির ক্ষেত্রেও সেই মনোবেদনা ও প্রতিক্রিয়ার স্ফুলিঙ্গই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এখনও যার কিছু কিছু রেশ বিভিন্ন দেশে সক্রিয় আছে।

তিন।

বর্তমানে হিন্দুত্ববাদ প্রভাবিত ভারতে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষের চর্চা একটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। উপনিবেশ-সমাপনী সময় ও তার পরবর্তী কালের ভারতে মুসলিমদের প্রতি বে-ইনসাফি ও হিন্দু কর্তৃক মুসলিম বিদ্বেষের বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালু ছিল। বহুবার মুসলমানদের উপর হামলা হয়েছে, মসজিদ-মাদরাসা, ধর্মীয় স্থাপনা দখল করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দু গোষ্ঠী ক্ষমতায় বসার পর ওখানে মুসলমানদের জীবন ও ধর্ম, সম্মান ও অস্তিত্ব একটি সার্বক্ষণিক উদ্বেগের পাঁকে আটকে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানে এমন কটূক্তির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

নবীজীর প্রতি কটূক্তি হচ্ছে মুসলমানদের আবেগের সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গায় বর্শাবিদ্ধ করা। ক্রুসেড-উত্তর যুগে একশ্রেণির পশ্চিমা প্রাচ্যবিদের বিদ্বেষবাদী চর্চার ধারা থেকে এই কটূক্তির বিষাক্ত ও অন্যায় ধারাটি দেশে দেশে ইসলাম-বিদ্বেষীরা ধার করে নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। বিদ্বেষী ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি নাস্তিক্যবাদী হিসেবে পরিচয়দানকারী চক্রগুলিও এ বিষয়ে একইরকম স্বর ও ভাষায় কথাবলার চেষ্টা করে। তাদের চিন্তা ও চর্চার গোড়াটা অভিন্ন। ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ভারতের বর্তমান কট্টর হিন্দু ক্ষমতাবলয়ে এই নোংরা চর্চার চেষ্টার মূলেও সেই উৎস ও ধারার প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলমানদের উপর আঘাত, বাবরী মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদ ধ্বংস ও দখলের ঘটনার পর কোনো দিক থেকে বাধাপ্রাপ্ত না হতে হতে তাদের মধ্যে সীমা অতিক্রম করার দুঃসাহস বেড়ে গেছে। এজন্যই সংবেদনশীল জায়গায় তারা আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে, উদ্ধত হতে পেরেছে।

চার।

এবার নবীজীর প্রতি কটূক্তির ঘটনায় ভারতীয় মুসলমানদের পাশাপাশি আরব দেশগুলোতেও বড় রকমের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদের ঘটনা ঘটতে পারে-হিন্দুত্ববাদী নীতি-নির্ধারকরা তা মনে করেনি। আরব দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিছক একদেশের সঙ্গে আরেক দেশের সৌজন্যমূলক সম্পর্কের সূত্রে সম্পর্ক নয়; বরং সেসব দেশের সাথে লেন-দেন ও অর্থনীতির অনেক বড় রকম নির্ভরতার বন্ধনে আবদ্ধ হিন্দুত্ববাদী এই রাষ্ট্রটি। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে-

গত দুই দশকে উপসাগরীয় এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে, সেটি অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত উভয় দিক থেকেই।

এই মুহূর্তে ভারতের মোট আমদানির অর্ধেক আসে উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সদস্য ৬টি দেশ থেকে।

ইরান ও ইরাককে যোগ করলে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকেই আসে ভারতের পেট্রলের ৮০ শতাংশ। ভারত বছরে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানী করে তার অর্ধেক আসে কাতার থেকে। এসব দেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কও খুব জোরালো।

ইউএইতে বছরে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি করে ভারত। এছাড়া জিসিসির সদস্য উপসাগরীয় ছয়টি দেশে ৮৫ লাখের বেশি ভারতীয় কাজ করেন।

বাকি আরব দেশেও বহু ভারতীয় কাজ করেন। আরব দেশগুলো থেকে প্রবাসী ভারতীয়রা বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠান।

এসব কারণেই ভারতের অর্থনীতি উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল- বলেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়া কর্মসূচির এক পরিচালক।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের সেই আরব দেশগুলির মধ্যে কুয়েত-কাতার এবং এমনকি ইরান তাদের দেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কাতার বলেছে, তারা প্রত্যাশা করে, ভারত যেন প্রকাশ্যে ক্ষমা চায়। সৌদি আরবও কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, মালদ্বীপ, জর্ডান, সিরিয়া, পাকিস্তান ও বাহরাইনসহ বিভিন্ন আরব-অনারব দেশ সরকারিভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ না জানালেও প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর।

নবীজীর প্রতি কটূক্তির শাস্তি ইসলামের বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ। সেই কটূক্তিকারী মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম। এইসব ক্ষোভ ও প্রতিবাদের একটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে, কটূক্তিকারীকে সর্বোচ্চ শাস্তির দিকে নিয়ে যাওয়া এবং শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু ভারত কটূক্তিকারীদের ব্যাপারে কৌশলী পদক্ষেপ নিলেও তাদেরকে কোনো শাস্তির আওতায় নিয়ে আসেনি। বরং বিভিন্ন খবরে জানা গেছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে মনের মধ্যে বিদ্বেষ ও গোস্বা থাকলেও হিন্দুত্ববাদী বিজেপি একটি সাফাই বিবৃতি দিয়ে বলেছে-

বিজেপি কঠোরভাবে যে কোনো ধর্মের যে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে অপমানের নিন্দা করে। বিজেপি কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে অপমান করে বা হেয় করে- এমন কোনো আদর্শেরও বিরুদ্ধে। বিজেপি এধরনের মানুষ বা দর্শনকে সমর্থনও করে না।

ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি কোনো আঘাত-আক্রমণ-বিষোদ্গারের পর হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নরম হয়ে এতটা সাফাই-প্রবণহয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্ভবত এটাই প্রথম। এই উগ্র বিদ্বেষবাদী দল ও গোষ্ঠীকে সংযত ভাষায় আগে কথা বলতেই দেখা যায়নি।  হঠাৎ তার এই সুর নরমের পেছনে মূল ব্যাপারটি কী? অনেকেই বলেছেন, এর পেছনে মূল বিষয় কোনো রকম সৌজন্য-সংযম নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ভরতার সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য, তেল ও রেমিটেন্সের ধারাটি অক্ষুন্ন রাখা। জোঁকের মুখে চুন পড়লে যেমন হয়- কটূক্তি ইস্যুতে আপাতত তাদের সেই অবস্থাই হয়েছে। বিদ্বেষ-নৃশংসতা থেকে তারা মোটেও সরে আসেনি।

পাঁচ।

ভারতে কটূক্তির প্রতিক্রিয়ায় এবার মধ্যপ্রাচ্যের সচ্ছল মুসলিম দেশগুলোতে দুটি কাজের কথা গণমাধ্যমে এসেছে :

এক. সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ দিয়ে নাগরিক পর্যায়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক এবং বিভিন্ন শপিংমল থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে নেওয়া।

দুই. সরকারি পর্যায়ে সেই দেশে অবস্থানরত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে  প্রতিবাদ জানানো। এছাড়া কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ভারতীয় কর্মী ছাটাইয়ের উদ্যোগ।

ব্যস, এই এতটুকুই; এর মধ্যে কোনো যুদ্ধের ডাক ছিল না, কূটনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও ছিল না এবং প্রকাশ্যে মোটা দাগে কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করার ছাপও ছিল না। কিন্তু এই সময়ে সবচেয়ে কার্যকরি অস্ত্র-বাজার ও অর্থনীতিতে ভারতকে একটু ভয় পাইয়ে দেওয়ার বুদ্ধিদীপ্ত ও তাৎক্ষণিক সংঘবদ্ধ একটি আভাস ও প্রস্তাবনা ছিল। এতেই ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী নেতারা একরকম চুপসেগিয়েছে। হতে পারে এই চুপসেযাওয়া অতি সাময়িক এবং মারাত্মক কৌশল ও ধুর্ততাশ্রয়ী তবু এই পরিস্থিতিটিও গোটা মুসলিম উম্মাহর সামনে পাঠ গ্রহণের একটি নতুন দরস উপস্থিত করেছে। দেশে দেশে মুসলিম শাসক ও নাগরিকদের সেই দরস থেকে পাঠ গ্রহণ করা উচিত।

ইসলাম ও উম্মাহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যদি মুখের কথা ও মনের ভাষায় দেশে দেশে মুসলিম শাসক ও জনতা ঐক্যবদ্ধ ও সংহতিশীল হয়ে ওঠেন তাহলে তার নগদ সুফল পাওয়া যায়। বিশেষত অর্থবিত্তে সচ্ছল ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কেরা যদি উম্মাহর প্রয়োজনীয় ইস্যুতে দূরদর্শী কৌশল-কূটনীতি এবং ঠান্ডা মাথায় ঐক্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বিরাজমান বিচ্ছিন্নতা, মজলুমিয়্যাত ও হতাশার অনেক কিছুতেই আশাজাগানিয়া ফলাফলের দেখা মিলতে পারে। হয়ত সব দেশের সব শত্রুর সাথে, সব অঞ্চলের সব বেদনার ইস্যুতে একসঙ্গে সমাধান বেরিয়ে আসবে না, কিন্তু একটি-দুটি করে অনেক জায়গাতেই কষ্টের ক্ষতে মলম দেওয়া যাবে। বিরানভূমিতে ফুলের চারা লাগানো যাবে।

এসকল আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের শাসকরা গত এক যুগে অনেক বর্বরতার পরও ভারতের উগ্র শাসকদের কিছু বলেনি, টু শব্দটিও করেনি। বাবরি মসজিদ, কাশ্মীর, সিএএ-এনআরসি, নামায-হিজাবে বাধাদান, পিটিয়ে মুসলিম হত্যার মতো বেদনাগুলো দুনিয়াজুড়ে পোস্টারের মতো প্রচার হয়েছে। আর আরব শাসকরা গুজরাটের কশাইকেডেকে নিয়ে লালগালিচা সংবর্ধনার সাথে পদক-খেতাবের মালা পরিয়েছিল। এসব দৃশ্য দেখে দুঃখী উম্মাহ কষ্ট পেয়েছে, চোখ মুছেছে। কিন্তু এই একটি ইস্যুতে তারা একটু নড়েচড়ে বসেছে, তাতেই কশাইদেরবাড়িতে সতর্কতার ফিসফিসানি শুরু হয়েছে। দেশে দেশে নবীজীর উম্মতিরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটাই এগিয়ে যাওয়ার জায়গা, বোধ-উপলব্ধি ও সংহতির জায়গা।

ছয়।

ইসলামী ইস্যুতে বাংলাদেশে প্রতিবাদ ও জাগরণের পরিমিত একটি ধারা বরাবর সচল ছিল। সংগ্রামী আলেম ও দাঈদের অব্যাহত মেহনতের এটি একটি সুফল। কিন্তু সাধারণত এসব সক্রিয়তায় অংশ নিতে দেখা যায় ইসলামী সংগঠন, আলেম-উলামা, মাদরাসা-ছাত্র, সাধারণ দ্বীনদার মানুষ ও মহলকে। কিন্তু এবার জুন মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রিয় নবীজীর প্রতি কটূক্তির প্রতিবাদে আবেগ ও ভালবাসার পথ-পদচারণার নযরানা লক্ষণীয়ভাবে পেশ করেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সর্বসাধারণ মানুষ এবং পূর্ব থেকেই দ্বীনী কোনো মহল-বলয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নন- এমন নবীপ্রেমিক মুসলিমরা। এদেশে ইসলাম ও নবীজীর প্রতি মহব্বত ও আবেগের এ এক নতুন ও সম্ভাবনার নজির। ইসলামী সংগঠন, আলেম-উলামা, মুসল্লি সমাজও রাস্তায় প্রতিবাদী হয়েছেন, কিন্তু বহু জায়গায় ইউনিফর্ম পরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নবীজীর প্রতি কটূক্তির প্রতিবাদ জানাতে নবীপ্রেমের মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। এখানে কটূক্তি ইস্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। অনেকেই অবশ্য এর পেছনের নতজানু রাজনৈতিক সংশ্লেষ ও সম্পর্কের সূত্র খুঁজে পান, বেদনাও অনুভব করেন। কিন্তু জনগণ পর্যায়ে কোনো নির্লিপ্ততা ছিল না, বরং এদেশের পথঘাট নবীপ্রেমের তরঙ্গ দেখেছে এবং এসব আবেগ ও প্রতিবাদের সবকিছুই প্রায় শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

কয়েক মাস আগে আমাদের দেশের জাতীয় সংসদে কপালে টিপনিয়ে টিজ করার মিথ্যাঘটনা নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য হতে পেরেছে, কিন্তু ভারতে নবীজীর প্রতি বিষোদ্গারের জবাবে সরকারদলীয় কোনো সাংসদ মুখ খোলার গরজবোধ করেননি।  ছোট বিষয়ে, নাই বিষয়ে কথাপ্রবণমন্ত্রীদের বাক্যমালা প্রতিদিন শোনা যায়, কিন্তু নবীজীর প্রতি কটূক্তি ইস্যুতে এদের মুখচুপঅবস্থা। কেউ একজন তো বলেই বসেছেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, সেটা নিয়ে এখানে উত্তেজনা তৈরি করা যাবে না। শুধু এই বক্তব্যটুকুই নয়, জুমার দিন এক মসজিদে ইমাম সাহেবের বয়ান থামিয়ে স্থানীয় পুলিশ-কর্মকর্তা মুসল্লিদেরকে ভারতের ইস্যুতে উত্তেজিত না হতে বলে পরিস্থিতি উত্তেজিত করেছেন। মিছিল দ্রুত শেষ করতে বলে আরেক পুলিশ নবীপ্রেমিকদের আবেগে খোঁচাদিয়েছেন। সেখানে এরপর ধরপাকড় ও ভীতিকর পরিবেশ চলছে। এসবই পরিস্থিতি, এসবই ঈমানদার মানুষ দেখছেন, কিছু কষ্ট ও কিছু নীরবতা নিয়ে।

অথচ হতে পারত উল্টো। হওয়া উচিত ছিল অন্যরকম। নবীজীর প্রতি মহব্বতের নাগরিক-অনুভূতি আমাদের দেশের কর্তাদের মুখেও উঠে আসতে পারত। সংসদে আলোচনা-নিন্দা এবং নিয়মতান্ত্রিক শান্ত ভাষায় প্রতিবাদও জানানো দরকার ছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা তাদের নানারকম সম্পর্ক ও বন্ধনের গ্রন্থি ধরে রেখেও এটা করতে পারতেন। কিন্তু সেটা হয়নি, তবে জনগণ পর্যায়ে সেই উত্তাপ, আবেগের সেই তশতরি শূন্য থাকেনি। বরং ভবিষ্যতে এই পবিত্র আবেগ ও মহব্বতের মিনার আরো উঁচু হয়ে উঠবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

সাত।

একটি বিষয় আমাদের ক্ষমতাবলয় ও দ্বীনদারি-বঞ্চিত সুধী মহলের জানা থাকা দরকার। ইসলামের বিরোধিতার নানা  ধরন সমাজে প্রচলিত। ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি হামলা-আঘাত হয়, অবহেলা-বেইনসাফির ঘটনা ঘটে, বিদ্রুপ-টিপ্পনি ছুঁড়ে দেওয়া হয়। এগুলো সবই মুসলমানদের জন্য কষ্টের। এর মধ্যেও একটি বড় কষ্টের ব্যাপার হল, কোনো মুসলমানের মুরতাদ (ইসলাম-বিচ্যুত) হয়ে যাওয়া, নাস্তিক হয়ে যাওয়া এবং মুরতাদ কিংবা অপরধর্মীর পক্ষ থেকে ইসলামের প্রতি বিষোদ্গারের ঘটনার মুখোমুখি হওয়া। এসব কষ্ট মুসলমানের বুকে তীরের মতো বিঁধে, মুসলমানকে আহত করে। কিন্তু পেয়ারা নবী আকায়ে নামদার সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি কটূক্তি, চরিত্র হননমূলক কথা-লেখা (কন্টেন্ট) মুসলমানের আবেগের সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গাটিকে রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সব ইসলাম-বিরোধিতাই মুসলিমের জন্য কষ্টের, কিন্তু নবীজীর প্রতি কটূক্তি ঈমানদার উম্মতির জন্য মামুলি কষ্টের ঘটনা নয়, প্রেম ও যুদ্ধের ঘটনা, হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। মুমিনের মহব্বত ও গায়রতের চূড়ান্ত জায়গা হচ্ছে নবীজীর ইফ্ফত ও ইযযত, সম্মান ও সম্ভ্রম।

ইসলামের শিআর বা অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি শিআর প্রিয় নবীজীর প্রতি ভালবাসা; বরং তাঁর ভালবাসা মুমিনের ঈমান, ঈমানের অপরিহার্য অংশ। তাঁর সম্মান-শুভ্রতার প্রতি মুমিনের মন-মননের মুগ্ধ সমর্পণ, তাঁর ইয্যতের দুশমনদের প্রতি মুমিনের অস্তিত্বজুড়ে ক্ষোভ ও ক্রোধ হচ্ছে মুমিনের অস্তিত্বের ভিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اَلنَّبِیُّ اَوْلٰی بِالْمُؤْمِنِیْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ.

মুমিনদের কাছে নবী তাদের নিজেদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ।-সূরা আহযাব (৩৩) : ৬

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنّاسِ أَجْمَعِينَ.

তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয় হব।-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৪

সুতরাং নবীপ্রেমের পবিত্রতা ও গুরুত্ব, নবীপ্রেমের আবেগ ও জাগরণ মুমিনের জীবনে এক অমোঘ পর্ব। এই প্রেম ও আবেগ মুসলিম জীবনকে উন্নত করে, সভ্য করে, জান্নাতী করে। এই আবেগ ও প্রেম অস্বীকার বা দমন করা কঠিন ও ভুল কাজ। বরং উম্মাহ গঠনে, দেশ ও জাতি গঠনে এই আবেগের সুস্থ ও সমন্বিত বিকাশ ও প্রয়োগ এবং আবেগের প্রতি সম্মান ও সংহতি অনেক বেশি কল্যাণকর।

আর সাধারণভাবে দ্বীনচর্চা ও দাওয়াহর সঙ্গে জড়িত সব দ্বীনী ভাই-বোনদের জন্য নিবেদন হল, সব ধারার শিক্ষা ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত নবীন প্রজন্মের মধ্যে নবীপ্রেমের এই ফুলেল জাগরণের সময়গুলোতে এবং উপলক্ষ ও পর্বগুলিতে সীরাতুন্নবী পাঠের চর্চা করা, সীরাতের ঘটনা ও শিক্ষা বিভিন্নভাবে তুলে ধরা। নতুন প্রজন্মের বুকে আজ নবীপ্রেমের যে অঙ্কুর, সুন্নতে নববীর অনুশীলন ও চাষবাস দিয়ে সেই নবীপ্রেমকে বৃক্ষে পরিণত করা দায়িত্ব। নবীপ্রেমের পথের মিছিলগুলো সীরাতুন্নবীর পাঠ ও সুন্নতে নববীর অনুশীলনে পরিপুষ্ট হলে এই উম্মাহর ভবিষ্যত চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।

আট।

আবেগের সঙ্গে সচেতনতা-সতর্কতা মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা সব যুগের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এযুগের বাংলাদেশি মুসলিমদের (হিন্দুত্ববাদীভারতের পাশে ও প্রভাববলয়ে যাদের অবস্থান) জন্য এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা একটু বেশিই। যেই বিজেপির নেতারা জুন মাসের শুরুতে কটূক্তিইস্যুতে কিছুটা চুপসেগিয়েছিল, ১১ জুন শনিবার তাদেরই কট্টর নেতা উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদী মুসলমানদের বেশ কিছু বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। কাগজপত্রের একটা ছুতো ব্যবহার করে টার্গেট করে করে শুধু প্রতিবাদী মুসলিমদের চোখে পানি ঝরানোর ব্যবস্থা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা কটূক্তি ইস্যুতে ধাক্কা খেলেও এখন অন্যভাবে প্রতিশোধনেওয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমান ভারত এবং সেখানকার হিন্দুত্ববাদী উগ্র গোষ্ঠীগুলো এখন একটি আঞ্চলিক উগ্রতার সংকট তৈরি করেছে। পর্যবেক্ষকদের অনুমান, এটা সহজে মেটার জিনিস না। কাছের-দূরের সব মুসলিম রাষ্ট্র-কর্তৃপক্ষ ও নাগরিকদের দায়িত্ব হল এই উগ্রতা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য নানামাত্রিক সচেতন পদক্ষেপ নেওয়া।

আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, কটূক্তির কারণে বিজেপি-নেতৃত্ব অফিসিয়াল ঘোষণা দিয়ে তাদের দুই মুখপাত্রকে সরিয়ে দিলেও বাস্তবে ভারতজুড়ে এবং ভারতের ভেতরে বসবাসরত হিন্দুত্ববাদীরা এদের পক্ষে সামাজিক মাধ্যমে ঝড়তৈরি করে চলেছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, এসব কিছুর পেছনেও বিজেপির নীতি-নির্ধারকরা রয়েছে। এবং চাপের পরিস্থিতিএকটু স্বাভাবিক হলেই এসব কটূক্তিকারীদের আবার পিঠ চাপড়ে দেওয়া হবে। সুতরাং ইসলাম, মুসলিম ও নবী-বিদ্বেষী চক্রের ব্যাপারে দেশে-প্রতিবেশে সচেতন চিন্তা ও ভবিষ্যত সতর্কতা লালন করা ছাড়া উপায় নাই।

ভারতের মুসলমানরা প্রায়ই নিঃসঙ্গ মজলুম হয়ে পড়েন। কটূক্তি ইস্যুতে অনেক রাষ্ট্র সরব হলেও ভারতীয় মুসলিমদের মারখাওয়া-বাড়িঘর ধসিয়ে দেওয়ার ইস্যুতে এখন তাদের চোখের পানি মুছে দেওয়ার মতো শক্তিমান কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। আসলে দেশে দেশে মহব্বত, জাগরণ, প্রতিবাদ, সচেতনতা ও সংহতির সমন্বয় উম্মাহকে যে স্বস্তি ও সাফল্য উপহার দিতে পারে, বিচ্ছিন্নতা সেটা দিতে পারে না। আল্লাহ তাআলা নবীপ্রেমের ভিত্তিতে ও সূত্রে উম্মাহকে কার্যকর সংহতির সৌরভ দান করুন।

 

advertisement