পরিণাম
এক কৃষকের বাড়ির ধানের গোলার নিচে বাস করত একটি ইঁদুর। কৃষকটি ছিল সচ্ছল। তাই তার গোলাভরা ধান ছিল, মাচাভরা সিম ছিল আর পুকুরভরা মাছ ছিল। সচ্ছল কৃষকের বাড়িতে সেই ইঁদুরটিও মহাসুখে কালাতিপাত করছিল। একদিন ইঁদুরটির বাড়িতে বেড়াতে এল তার বন্ধু মাঠের ইঁদুর। ঘরের ইঁদুর তার বন্ধুকে দেখে বলল, কিহে বন্ধু তোমার এই অবস্থা কেন? চোখমুখ শুকনো, হাতেপায়ে ধুলো আর গায়ের রং গেছে জ্বলে। অথচ দেখ, আমি কেমন সুখে আছি। মাঠের ইঁদুর বলল, ঠিকই বলেছ ভাই, এখানে এসে তোমার খুব উন্নতি হয়েছে। তোমার স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। গায়ের চামড়া চকচকে হয়েছে এবং চোখমুখ ভরাট হয়ে উঠেছে। ঘরের ইঁদুর খুশি হয়ে বলল, তাহলে আমার এখানে কদিন বেড়িয়ে যাও। খাবার দাবারের কোনোই অভাব হবে না। এখানে কদিন থেকে গেলে তোমারও চেহারা ফিরে যাবে। মাঠের ইঁদুর ঘরের ইদুরের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করল এবং ধানের গোলার নিচে আস্তানা গাড়ল।
ঘরের ইঁদুর যখন একা ছিল তখন সে দিনের বেলায় খুব একটা বাইরে বেরুত না। এখন বন্ধুকে পেয়ে কিছুটা আনন্দ আর কিছুটা বন্ধুকে দেখানোর জন্য সে দিনের বেলায়ও গর্ত ছেড়ে বেরুতে লাগল। মাঠের ইঁদুর যতই নিষেধ করে ঘরের ইঁদুর ততই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর বিষয়টি কৃষকবউ এর নজরে পড়ে গেল। সে চুপিচুপি ধানের গোলার নিচটা পরখ করে দেখল, সর্বনাশ! ইঁদুর এসে ডেরা পেতেছে ধানের গোলার নিচে। রাতে যখন কৃষক ফিরল বউ তাকে সব বলল। কৃষক বলল, দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি। কালই এর বিহিত করব। পরদিন হাট থেকে আসার সময় কৃষক কিনে নিয়ে এল ইঁদুর-ধরা ফাঁদ। সন্ধ্যার পর তাতে কিছু গোশতের টুকরা দিয়ে কৃষকবউ ফাঁদটি পেতে রাখল গোলার নিচে। ওদিকে কিছুক্ষণ পর ঘরের ইঁদুর হাই তুলতে তুলতে মাঠের ইঁদুরকে বলল, চল বন্ধু, এবার কিছু পেটে দিয়ে আসি। সারাদিন তো ঘুমিয়েই কাটালাম। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। একথা বলে ঘরের ইঁদুর আগে আগেই বের হয়ে গেল গর্ত থেকে। বের হতেই তার নাকে এসে লাগল গোশতের ঘ্রাণ। ইঁদুর ভাবল, আহা, কৃষক বুঝি আজ গোশত এনেছে। কিন্তু আমার ভাগ্যে কি আর গোশত আছে? এসব ভাবতে ভাবতে ইঁদুর আরও কিছু দূর অগ্রসর হল। আরে গোশ্ত তো এখানেই দেখা যাচ্ছে। খুশিতে লাফাতে লাফাতে ইঁদুর আবার ছুট লাগাল গর্তের দিকে। বন্ধুকে ডেকে বলল, বন্ধু এদিকে আস। আজ তোমাকে গোশ্ত খাওয়াব। মাঠের ইঁদুর কিছু বুঝতে না পেরেই বেরিয়ে এল গর্ত থেকে। কিছু না বুঝলেও বন্ধুর উপর তার অগাধ আস্থা।
এখানে এসে সব কিছুই তার স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। মাথার উপর ধানের গোলা। আর ওই খাটের নিচে থরে থরে সাজানো রয়েছে আলু, পেয়াজ, টমেটো, আরও কত নাম না জানা আহার। সব কিছু একদম হাতের কাছে। আর পরিবেশটাও কত আরামদায়ক। সূর্যের খরতাপ নেই, বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হওয়ার ভয় নেই। শুধু সুখ আর সুখ, ভোগ আর ভোগ। এখন যদি ধারে কাছে গোশ্তেরও ব্যবস্থা হয় তাতেও বা আশ্চর্যের কী? মাঠের ইদুরের ভাবনা শেষ না হতেই তার কানে এল খুট করে একটি আওয়াজ। পরক্ষণেই বন্ধুর আর্তচিৎকারে মাঠের ইদুরের প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। সে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে এবং একেবারে মাঠের গর্তে পৌঁছা পর্যন্ত আর কোনো দিকে নজর দিল না। গর্তে ঢুকে সে বলতে লাগল, বন্ধু, তোমার দুদিনের সুখ যদি এমনই কঠিন পরিণতি ডেকে আনে তবে সেই সুখের আমার প্রয়োজন নেই। সূর্যের তাপ, বর্ষার পানি আর কষ্টার্জিত আহার নিয়ে এই খোলা প্রান্তরেই আমি বেশ আছি। এই আকাশের সূর্যের আলো কত সুন্দর, এই বাতাস কত ঠান্ডা আর এই যে আমার ঘর, এখানেই সুখ, এখানেই শান্তি।
(একটি আরব্য গল্প অবলম্বনে)