Muharram 1428   ||   February 2007

একজন কলাম লেখকের সাদাসিধে কথা

গোলাম এলাহী

গত ২৩ই ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও খেলাফত মজলিসের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক দেশব্যাপী আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। সাধারণ মুসলিম জনগণ এসব কর্মকাণ্ড নীরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেও কতিপয় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকে এ প্রসঙ্গে একদম মারমুখী হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সমমনা বিভিন্ন দৈনিকের উপসম্পাদকীয়গুলো তাদের ক্ষোভ ও হতাশার বাষ্পে ভারি হয়ে উঠেছিল। শেষমেষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলীল সাহেব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এটি একটি নির্বাচনী কৌশল।

কোনো কোনো ভালোমানুষবুদ্ধিজীবীকেও এসময় কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়তে দেখা গেছে। দৈনিক প্রথম আলোর একজন কলাম লেখক উপরোক্ত বিষয়ে তার বক্তব্য প্রদান করেছেন। মুরুব্বিয়ানা গোছের কথাবার্তায় অভ্যস্ত কলামটি প্রকাশিত হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয়। লেখকের গোটা লেখাটি পর্যালোচনা করা উদ্দেশ্য নয়, কিছু জিনিস তার লেখায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে সেগুলোই উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে রাখার সুবিধার্থে।

কুরআন সুন্নাহর বিভিন্ন পরিভাষা, কুরআন-সুন্নাহ চর্চাকারী ব্যক্তিবর্গ এবং এদেশের দ্বীন ও ঈমানপ্রিয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে এই ক্ষুদ্র শ্রেণীটি কী ধরনের উন্নাসিকতা পোষণ করে থাকে তার কিছু দৃষ্টান্ত ওই কলামটিতে রয়েছে।

একটি কুরআনী পরিভাষার অবমাননা

আওয়ামী শাসনামলে ফতোয়া বিরোধী যে রায় দেওয়া হয়েছিল সেই রায়ের কপি পড়ে দেখেননি এমন মানুষের মনে একটি ভুল ধারণা কাজ করতে পারে। ধারণাটি হল, এ রায় দেওয়া হয়েছিল কিছু অশিক্ষিত গ্রাম্য সালিসি মাতব্বরদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তারা মনে করেন, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতেও যেহেতু এসব লোকের সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার নেই তাই ওই রায় ইসলাম বিরোধী ছিল না। এই ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ হল অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার। বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্নভাবে এই অপব্যাখ্যা হতে দেখা যায়।

দেশের ইসলাম বিদ্বেষী কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া এই ইসলামী পরিভাষাটির উপর স্বকল্পিত মর্ম আরোপ করে সাধারণ জনগণকে এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলার অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু লেবাসী ভদ্রলোক, যারা খুব সুন্দর করে মহৎ কথা বলে থাকেন এবং কুশলী ভাষায় উদারতার কথা লিখে থাকেন, তারা কোনো বিষয়ে যে একদম না জেনেও মন্তব্য করাকে ভদ্রতা পরিপন্থী মনে করেন না কিংবা জেনে শুনে মিথ্যাচার করাকে নৈতিকতা বিরোধী জ্ঞান করেন না, এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। তাই যখন তারা কোনো কারণে খুব স্পষ্টভাবে নিজেদের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে আমাদের অবগত করেন তখন তা মনে রাখা প্রয়োজন। আলোচিত কলাম লেখক ফতোয়া প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘পাঁচ দফার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দফা ফতোয়া সম্পর্কে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রীতিমতো কাগজে কলমে স্বাক্ষর দিয়ে বলে এসেছেন যে, সার্টিফিকেট পাওয়া মাওলানা কিংবা আলেমরা ফতোয়া দিতে পারবেন। ...ফতোয়া হচ্ছে আইন। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, এই দেশে দুধরনের আইন থাকবে। পার্লামেন্টে পাশ করা রাষ্ট্রীয় আইন আর সার্টিফিকেট পাওয়া মাওলানা এবং আলেমদের আইন। তাদের তৈরি এই আইন বা ফতোয়ার কথা দেশের মানুষ অনেক দিন থেকে জানে। সাধারণত অসহায় মেয়েদের বিরুদ্ধে এটা ব্যবহার করা হয়...। আমাদের মতো মানুষদের মুরতাদ ঘোষণা করার কথা প্রায় রুটিন মাফিক কাজ। আমরা তখন কী করব? দেশের এক নম্বর আইন আমাদের রক্ষা করবে নাকি দুই নম্বর আইন?”

উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা সেই গ্রাম্য অবিচারগুলোর ভাওতায় কুরআন-সুন্নাহয় পারদর্শী বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের শরীয়াভিত্তিক সিদ্ধান্তগুলোকেও নিষিদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর। বলা বাহুল্য, এই মানসিকতা এ দেশীয় জিনিস নয়। এ উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের বিষফলরূপে যে শ্রেণীটির উদ্ভব ঘটেছে তাদের জীবন যাত্রার নানাবিধ অনুষঙ্গের মতো এটিও সেই পাশ্চাত্য থেকেই আমদানীকৃত। এখনও পর্যন্ত এ দেশীয় আবহাওয়ার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে না পারায় এ জাতীয় মানসিকতা প্রকাশ করতে তাদের বেগ পেতে হয় এবং সহজ কথায়-প্রতারণার আশ্রয় নিতে হয়।

অবশ্য কলাম লেখক যদি জেনে শুনে ইসলামী শব্দের অপব্যাখ্যা না করে থাকেন তাহলে একথা বলা ছাড়া উপায় থাকে না যে, তিনি ফতোয়া শব্দটির পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কেও অবগত নন। কিতাব-সুন্নাহয় পারদর্শী ফকীহ কিংবা আলিমের সামনে উপস্থাপিত যে কোন দ্বীনী প্রশ্নের শরীয়াভিত্তিক সমাধানকে ফতোয়া বলা হয়। এর সম্পর্ক শুধু বিবাহ-তালাকের সঙ্গে নয়। বিবাহ-তালাক প্রসঙ্গটি জীবনের সঙ্গে যতটুকু সম্পৃক্ত ফতোয়ার সঙ্গেও ততটুকু। এর বাইরে জীবনের যে বিশাল অঙ্গন-আকাইদ, ইবাদত, লেনদেন, সামাজিকতা, নৈতিকতা তথা ব্যক্তি ও সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজ্য-পরিচালনা এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সকল বিষয়ই ফতোয়ার আওতাভুক্ত। কুরআন কারীম ভালোভাবে অধ্যয়ন করা হলে কিংবা অন্ত-ত কুরআনের বিষয় অভিধান, কিছু হাদীসের কিতাবের কিছু সূচীপত্র এবং ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবাদির শুধু অধ্যায়-শিরোনামগুলোয় নজর বুলিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কিছু ধারণা অর্জন করা সম্ভব। কিছু ফতোয়া গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে এ বিষয়ে সাহায্য গ্রহণ করা কঠিন নয়।

ফতোয়া আলেমের তৈরি করা আইন নয়; বরং শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে কুরআন-সুন্নাহয় পারদর্শী ব্যক্তির উপস্থাপিত শরয়ী বিধান। শরীয়তের আদেশ অনুযায়ী তিনি তা  বর্ণনা করতে বাধ্য।

শরীয়তের দৃষ্টিতে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের অধিকার কেবল ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং এক্ষেত্রেও তারা শরয়ী সীমারেখার ভিতরে অবস্থান করতে বাধ্য। আর যেখানে বিধান প্রণয়নের ব্যাপার আসে সেখানে ফিকহে ইসলামী, যা কুরআন-সুন্নাহ থেকে উৎসারিত বিধানাবলির সুবিন্যস্ত রূপ, তাই অনুসরণীয়। যদি তারা সরাসরি ফিকহে ইসলামী থেকে বিধিবিধান আহরণ করার যোগ্যতা রাখেন তবে তো ভালো কথা, অন্যথায় তারা বিজ্ঞ আলেমদের নিকট থেকে ফতোয়া সংগ্রহ করবেন এবং সেই মোতাবেক আইনই প্রণয়ন করবেন। তাহলে ফতোয়া ও পার্লামেন্টের আইনের মধ্যে সংঘর্ষের প্রশ্নই আসবে না।

বাংলাদেশকে ধর্ম ও নৈতিকতাহীন ভুখণ্ডে পরিণত করার খায়েশ

কিছুদূর গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘... এমনটি কি হতে পারে না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে যে কয়টি দল আছে তারা সবাই একত্র হয়ে গেল-এমনকি বিএনপির আসল (আসল শব্দটি লক্ষ করুন) যে মুক্তিযোদ্ধারা আছেন তারাও সেখানে চলে এলেন। তারপর সবাই মিলে এই দেশ থেকে স্বাধীনতা-বিরোধী, ধর্ম-ব্যবসায়ীদের একেবারে সারা জীবনের মতো দেশ ছাড়া করে দিয়ে নতুন একটা বাংলাদেশ তৈরি করা শুরু করে দিলাম।

সাধারণত তিনি তার চিন্তা ও মনের ক্ষুদ্রতাকে এতটা উৎকটভাবে প্রকাশ করেন না। উদারতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং নীতি ও নৈতিকতার কথাই বেশি বেশি বলে থাকেন। সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসহিষ্ণু আচরণের জন্য তাকে অশ্রুপাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করতেও দেখেছি। কিন্তু এমন একটি সজ্জন অবয়বের ভিতরেও যে এতখানি হিংস্র ও অসহিষ্ণু একটি খায়েশ বিচরণ করতে পারে তা বোঝা কঠিন বৈকি।

তবে আসল প্রশ্নটি হল, তিনি যেসব সমমনা ও সমমতের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি সুন্দরবাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন তাদের চরিত্রও তো তিনি খুব সুবিধের বলে বিশ্বাস করেন না। তাদের স্বার্থবাদী চরিত্র যে তার হৃদয়ে কীরূপ শেলবিদ্ধ করেছে তাও তিনি অকপটে ব্যক্ত করেছেন।

আরও হৃদয় বিদারক ব্যাপার ঘটেছে। এককালের পতিত স্বৈরশাসক এরশাদকে নিয়ে একেবারে দড়ি টানাটানি খেলা। সেই খেলায় আপাতত জিতেছে ১৪ দল।তো এই পতিত রাজনীতির চর্চাকারী সমমনাদের নিয়েই কি তিনি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে আগ্রহী? তিনি যাদের ধর্ম ব্যবসায়ীআখ্যা দিয়েছেন, তাদের দেশছাড়া করে যাদের তিনি ভোট-ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়েছেন তাদেন নিয়েই কি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে ইচ্ছুক? নাকি এতসব লেখাজোখা, বয়ান বিবৃতিসবই স্রেফ কলম-ব্যবসা।

তিনি অবশ্য কলামটির শুরুতে উল্লেখ করেছেন জোট সরকার যখন ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত (কাওমী মাদরাসার ডিগ্রিকে সরকারী স্বীকৃতি দেওয়া) নিয়েছিল তখন আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা আমাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, আমি যেন এর বিরুদ্ধে একটু লেখালেখি করি।

বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের আবেগপ্রবণতা!

কলামটির শেষ পর্যায়ে এসে তিনি স্পষ্টভাবে তার বিচারনীতি উল্লেখ করেছেন এবং এটিই নাকি তার ন্যায় অন্যায়, সদা-কালো সব কিছু বিচারের একমাত্র নীতি। তিনি লিখেছেন, ‘এই দেশের যারাই যে রাজনীতিই করুক সেটা কি ঠিক না ভুল সেটা বোঝার আমার একটিই মাপকাঠি। সেটি হচ্ছে, রাজনীতিটুকু কি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের স্বপক্ষের না বিপক্ষের।বলাবাহুল্য, এই একমাত্র মাপকাঠিও বড় জটিল মাপকাঠি। যে দেশে জ্বলজ্যান্ত স্বাধীনতার ঘোষক নিয়েও এন্তার বির্তক সেদেশে এই তাত্ত্বিক মাপকাঠিগুলোর মর্ম নির্ধারণ যে কত দুরুহ ব্যাপার তা খুব সহজেই অনুমেয়। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থা ও অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এ জাতীয় স্বপ্নগুলোর ব্যাখ্যা করে থাকেন। তাদের এই সব অনাচার দৃষ্টে সাধারণ  মানুষের মনে এই ভাবনার উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, এ শব্দগুলোর নিজস্ব কোনো মর্ম নেই, এগুলো নিরাবরণ পান পাত্রের ন্যায়-ইচ্ছা মাফিক যে কোনো রঙ্গেই তা রঙ্গিন করে তোলা যায়।

সবচেয়ে বড় কথা হল, যারা এভাবে কেবল একটি আকার-আকৃতিহীন স্বকল্পিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে সকল ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দ নির্ধারনের প্রয়াস পান তাদের কি শোভা পায় অন্য কাউকে অন্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা?

তাদের বিচার-বিবেচনা ও কথাবার্তাগুলো যে যথার্থ অন্ধত্বের প্রতিনিধি তা কি তারা কখনো ভেবে দেখেছেন?

 

advertisement