বরকতময় জীবন লাভের উপায়
‘বরকত’ অর্থ হল কল্যাণ ও প্রাচুর্য। কোন জিনিসে বরকত হওয়ার অর্থ হল, সে জিনিসের মঙ্গলময়তা ও কল্যাণময়তায় প্রাচুর্য সাধন ও তার স্থায়িত্ব লাভ। অর্থাৎ কোন জিনিসের ইতিবাচক দিকের গুণগত মান বৃদ্ধি পাওয়াই হচ্ছে সেই জিনিসের বরকত। যেমন টাকা-পয়সার বরকত হওয়ার অর্থ, টাকা-পয়সা মঙ্গল ও কল্যাণের পথে ব্যবহৃত হওয়া। যে কাজে টাকা-পয়সা ব্যয়িত হবে সে কাজের মঙ্গলময়তা ও কল্যাণময়তায় প্রাচুর্য সাধিত হওয়া এবং তার মঙ্গলময়তা ও কল্যাণময়তা স্থায়িত্ব লাভ করা। টাকা-পয়সায় বরকত হওয়ার অর্থ পরিমাণে টাকা-পয়সা বেড়ে যাওয়া নয়। তবে কখনো সেভাবেও বরকত সাধিত হতে পারে। খাদ্য-খাবারে বরকত হওয়ার অর্থ খাদ্য-খাবার দ্বারা কাক্সিক্ষত মঙ্গলময়তা ও কল্যাণময়তা অর্জিত হওয়া এবং সেই মঙ্গলময়তা ও কল্যাণময়তার স্থায়িত্ব লাভ করা। জীবনের বয়সে বরকত হওয়ার অর্থ মঙ্গলময় ও কল্যাণময় কাজে জীবনের সময় ব্যয়িত হওয়া এবং অল্প সময়ে অনেক ভাল কাজ করতে পারা। এভাবে জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এবং প্রত্যেকটা কাজের মধ্যে বরকত সাধিত হতে পারে, বরকতময় জীবন গড়ে উঠতে পারে যদি আমরা বরকতময় জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্দেশিত কুরআন-হাদীসের পন্থাসমূহ অবলম্বন করি। নিম্নে জীবনের বেশ কিছু দিকের বরকত অর্জন করার কুরআন-হাদীস নির্দেশিত পন্থাসমূহ উল্লেখ করা হল।
জীবনের সময়ে বরকত অর্জনের পন্থা
জীবনের সময়ে বরকত অর্জিত হয় নেক আমলের দ্বারা। যে যত বেশি নেক আমল করবে, তার জীবনে তত বেশি বরকত হবে। হযরত ছাওবান রা. কতৃর্ক বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “নেককাজ ব্যতীত অন্য কিছু বয়সকে বাড়াতে পারে না। দুআ ব্যতীত অন্য কিছু ভাগ্যকে ফেরাতে পারে না, আর মানুষ তার কৃতপাপের কারণে রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়” -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৯০; তিরমিযী, হাদীস ২১৩৯
ব্যাখ্যা : দুআ দ্বারা ভাগ্য পরিবর্তন হয়, তা ভাগ্যকে পর্যন্ত পরিবর্তন করে -এ কথার অর্থ হল, যে ভাগ্য সম্পর্কে লেখা আছে যে, দুআ করা হলে তা পরিবর্তন হবে, সেগুলোরই পরিবর্তন হয়, নতুবা ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।
তদ্রূপ বয়স বাড়ার ক্ষেত্রেও ব্যাখ্যা এই যে, যদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এরূপ লেখা থাকে যে, অমুক নেক আমল করলে বয়স বৃদ্ধি পাবে, সেক্ষেত্রে সেই নেক আমল দ্বারা তার বয়স বৃদ্ধি পাবে কিংবা এখানে বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার দ্বারা বয়সের মধ্যে বরকত হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। নেক আমল দ্বারা যিন্দেগির সময়ে বরকত হয়ে থাকে।
মুস্তাদরাকে হাকিমের এক রেওয়ায়াতে আছে, যারা পিতা-মাতার খেদমত করে তাদের বয়সেও আল্লাহ তাআলা বরকত দান করেন।
সম্পদে বরকত অর্জনের পন্থা
সম্পদে বরকত অর্জিত হয় দান সদকা দ্বারা। আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী সম্পদ ব্যয় করলে, আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করলে, দ্বীনের কাজে সম্পদ ব্যয় করলে সম্পদে বরকত হয়। এতে সম্পদ কমে না; বরং বাড়ে। এর বিপরীতে অবৈধভাবে সম্পদ উপার্জন করলে সে সম্পদে আল্লাহ পাক বরকত দেন না। কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
یَمْحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَ یُرْبِی الصَّدَقٰتِ.
অর্থাৎ সুদকে আল্লাহ মোচন করে দেন আর দানসদকাকে বৃদ্ধি করে দেন। -সূরা বাকারা : ২৭৬
হযরত আবু হুরায়রা রা. কতৃর্ক বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সদকা সম্পদকে হ্রাস করে না। ক্ষমা করার দ্বারা আল্লাহ বান্দার ইযযত বৃদ্ধি করেন। আর কেউ আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাওয়াযু বা বিনয় অবলম্বন করলে আল্লাহ তার মর্যাদা উঁচু করে দেন।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২০২৯
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে বুঝা যায় আল্লাহর রাস্তায় দান ও সদকা করা হলে, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হলে, ফরজ ব্যয় হোক বা নফল ব্যয় হোক যে পর্যায়ের ব্যয়ই হোক না কেন তার কারণে সম্পদ কমে না; বরং আল্লাহ পাক সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন। কখনো সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেন, কখনো সম্পদের বরকত বৃদ্ধি করে দেন। যখন যেভাবে বৃদ্ধি করা আল্লাহ পাক মোনাসিব মনে করেন সেভাবেই বৃদ্ধি করে দেন। এর বিপরীতে যারা সুদ বা অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে, তাদের সম্পদকে আল্লাহ বরকতহীন করে দেন। তাদের সম্পদে বরকত হয় না । সম্পদ দ্বারা যে উদ্দেশ্য- সুখ শান্তি অর্জন করা, তা তাদের ভাগ্যে জোটে না।
হযরত আবু হুরায়রা রা. কতৃর্ক বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখনই আল্লাহর বান্দাগণ ভোরে উঠে আকাশ থেকে দুইজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ, দাও তুমি দাতাকে প্রতিদান। অপরজন বলেন, হে আল্লাহ, দাও তুমি কৃপণকে সর্বনাশ। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪২; মুসলিম, হাদীস ১০১০
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বলেন যে, হে আদমসন্তান তুমি দান কর আমি তোমাকে দান করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৯৩
ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকত অর্জনের পন্থা
ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকত হয় সততার দ্বারা। একজন ব্যবসায়ী মিথ্যা বলে অচল মাল চালিয়ে দিলে বা মালের গুণগত মান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাময়িকভাবে বেশি লাভ করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে ক্রেতা সঠিক তথ্য অবগত হওয়ার পর উক্ত ব্যবসায়ীকে বর্জন করে। ফলে উক্ত ব্যবসায়ী উক্ত ক্রেতা থেকে ভবিষ্যতে আরও বহু দিনে যেসব লাভ অর্জন করতে সক্ষম হত তা থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে সততা বর্জনের কারণে সে বঞ্চিত হয়। এটাই হল তার বরকত মোচন। ক্রেতাও অসততার ফলে বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। বোখারী শরীফে হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রা. কতৃর্ক বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তারা (ক্রেতা ও বিক্রেতা) উভয়ে যদি সত্য বলে এবং দোষত্রুটি পরিষ্কার করে ব্যক্ত করে তাহলে তাদের ক্রয়বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং গোপন করে তাহলে তাদের ক্রয় বিক্রয়ের বরকত মোচন হয়ে যাবে।” -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৭৯
খাদ্য-খাবারে বরকত অর্জনের পন্থা
খাদ্য-খাবারে বরকত অর্জন করার জন্য খাবার শুরু করার পূর্বের্ আল্লাহর নাম নিয়ে ও আল্লাহ কর্তৃক বরকত দানের বিষয়ে দুআ করে খাবার শুরু করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। খাবার সামনে আসলেও এরূপ দুআ রয়েছে। খাবার শুরু করার সময়ও এরূপ দুআ রয়েছে।
খাবার সামনে আসলে “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফীমা রাযাক্বতানা ওয়াক্বিনা আযাবান্নার” দুআটি পাঠ করা সুন্নত। এ দুআটির অর্থ হল, হে আল্লাহ, তুমি আমাদের যে রিযিক দান করেছ, তাতে বরকত দাও। এবং জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা কর। -কিতাবুল আযকার, হাদীস ৬৫০
খাদ্য-খাবার শুরু করার পূর্বে “বিসমিল্লাহি ওয়া বারাকাতিল্লাহ” দুআটি পাঠ করা সুন্নত। এ দুআটির অর্থ হল, আল্লাহর নামে আল্লাহর বরকতের সাথে খাওয়া শুরু করছি।
খাদ্য-খাবারে আরও বরকত হয় একত্রে খাওয়ার দ্বারা। হযরত ওয়াহশী ইবনে হারব্ রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কতিপয় সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা খানা খাই কিন্তু তাতে তৃপ্তি হয় না যে? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা সম্ভবত ভিন্ন ভিন্নভাবে খানা খাও? তারা বললেন, জী। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা একত্রে মিলে খানা খাও এবং আল্লাহর নাম নিয়ে খানা খাও। তাতে তোমাদের খাবারে বরকত দান করা হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৭৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩২৮৬
খাদ্য-খাবারে আরও বরকত হয় পড়ে যাওয়া খাদ্যের টুকরা উঠিয়ে (প্রয়োজনে ধুয়ে) খেলে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ফায়দা বয়ান করে বলেছেন, “তোমাদের জানা নেই, তোমাদের খাদ্যের কোন অংশে বরকত রয়ে গেছে।” সেমতে হতে পারে, যে অংশ পড়ে গেছে তার মধ্যেই বরকত রয়ে গেছে। অতএব সেটা তুলে খেয়ে নাও।
রিযিকে বরকত অর্জনের পন্থা
রিযিকে বরকত হয় আত্মীয়-স্বজনের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার দ্বারা। হযরত আনাস রা. কতৃর্ক বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজ জীবিকার বৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু কামনা করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে।” -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৬৭ সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫৭
উল্লেখ্য, রিযিক দ্বারা শুধু খাদ্য-খাবার উদ্দেশ্য নয়; বরং মানুষ জীবনে খাদ্য-খাবার, ধন-সম্পদ, পোশাক-পরিচ্ছদ, জ্ঞান-বুদ্ধি, শান্তি-নিরাপত্তা যা কিছুই ভোগ করে সবই রিযিকের অন্তর্ভুক্ত।
বিবাহশাদীতে বরকত অর্জনের পন্থা
বিবাহশাদীতে বরকত হয় অতিরিক্ত ব্যয় বর্জন করার দ্বারা। শুআবুল ঈমান গ্রন্থে হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় সে বিবাহ বেশি বরকতময় যে বিবাহে ব্যয় কম।” -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৬১৪৬
সম্প্রতি বিবাহশাদীতে বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় হয়। সেইসাথে গান-বাদ্য, ভিডিও বেপর্দিগী ইত্যাদি বিভিন্ন রকম পাপ কাজ করা হয়। এসব কারণে বিবাহশাদীর বরকত নষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দাম্পত্য জীবনে সুখশান্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়া এই বরকতহীনতারই বহিঃপ্রকাশ।
এভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীভাবে বরকত আসে তা শরীয়তে খুব সুন্দরভাবে নির্দেশিত হয়েছে। এ সবগুলোর মূল কথা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ। এর মাধ্যমেই জীবনের সকল ক্ষেত্রে বরকত আসে।