Zilhajj 1427   ||   January 2007

আনন্দ ও বেদনার মুহূর্তেও ইত্তেবায়ে সুন্নত

প্রফেসর হামীদুর রহমান

আলহামদু লিল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করছি। আবার আরেক শনিবার তিনি আমাদেরকে একত্র করলেন। এমন এক শনিবার এসে যাবে যখন আমাদের কারো সম্পর্কে বলা হবে, গত শনিবারে ছিলেন এই শনিবারে নেই। আজকে আমাদের একজন অতি প্রিয় শ্রদ্ধার মানুষ চরমোনাইর পীর সাহেব হুজুর। হযরত মাওলানা সাইয়্যোদ ফজলুল করীম সাহেব রহ. আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।

আমার সৌভাগ্য হয়েছে বিগত ৩৫ বছর তাকে গভীরভাবে জানার। প্রথম পেয়েছি হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর ওখানে। ইতেকাফে ছিলেন। দেখুন! একজন রাজত্ব্কারী পীর, তিনি আবার আরেকজনের কাছে ইতেকাফ করতে আসবেন কেন? এরপরে আসল হযরতের ইলেকশনের সময়। ইলেকশনের সময় তার মেহনত অতি কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি তো বলব, হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর পরে আমার নযরে উনি দ্বিতীয় স্থানে। দিন রাত পাগলপারা প্রায় জান দিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়েন কাজে, এই একমাত্র ব্যক্তি মাওলানা ফজলুল করীম সাহেব। তিনি একজন সত্যিকারের মুজাহিদ ছিলেন। তার কোন কোন কাজের সাথে আমরা একমত না ও হতে পারি। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর দেওয়া উসূল হল, মানুষের মধ্যে খুবী দেখনয়, গুণ দেখা চাই। তার মধ্যে তো বহু খুবী।

আল্লাহ আমাকে উনার আব্বাজানকে দেখিয়েছেন। তিনি হলেন, মাওলানা ইসহাক সাহেব। সেই ঘটনা কত মজার। আমি বুয়েট থেকে মৌলভীবাজারে বাজার করতে গিয়ে। হঠাৎ দেখি সামনের রাস্তাটা বন্ধ। বেগম বাজারের মসজিদের দিকে চিপা রাস্তা, দক্ষিণ দিকে স্টেজ, রাস্তার উপরে। দাঁড়িয়ে রইলাম বাজার ব্যাগ হাতে। দেখি কখন পীর সাহেব আসেন। আসলেনতো একেবারে সাদাসিধে মানুষ। মোটেই পছন্দ হল না। কিন্তু যেই বয়ান করতে শুরু করলেন, প্রথম আয়াতেই আমার চোখে পানি এসে গেল।

وَ نَادٰۤی اَصْحٰبُ النَّارِ اَصْحٰبَ الْجَنَّةِ.

দোযখের মানুষেরা চিৎকার করে বেহেশতের মানুষদেরকে বলবে,

اَنْ اَفِیْضُوْا عَلَیْنَا مِنَ الْمَآءِ.

তোমাদেরকে আল্লাহ যে রিযিক দিয়েছেন, যে পানি দিয়েছেন সেখান থেকে কিছু পানি বা রিযিক আমাদেরকে দাও।

قَالُوْۤا اِنَّ اللّٰهَ حَرَّمَهُمَا عَلَی الْكٰفِرِیْنَۙ.

বেহেশতের মানুষেরা বলবে, দেওয়ার কোন উপায় নেই। আল্লাহ এগুলো তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন আমরা চাইলেও তোমাদেরকে দিতে পারব না। এই পানি দুনিয়াতে তোমরা খেয়েছ এক নিয়ামত খেয়েছ-এখন আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন। তোমাদেরকে দেওয়ার অনুমতি নেই। তোমাদেরকে দেওয়া হারাম। হুজুর এই কথা বলে সাদামাটাভাবে মাঝখানে বললেন, (বরিশালের কথা) মিয়া মিয়া, কিয়ামতের দিনে খাড়াইতে অইবে, মিসওয়াকটা আছেনি পকেটে? এখানে যদি বলি, মেসওয়াক আছেনি তাহলে শরম লাগবে, কিন্তু কিয়ামতের দিন লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে দাঁড়ানো লাগবে না? পর্দা করনি? সুন্নাত মোতাবেক চলনি? আমার সামনে খাড়াইতে কইলে শরম লাগবে, কিয়ামতের ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে শরম লাগবে না? উনার আব্বাজানের এই এক দিনই বয়ান শুনেছি।

তার কয়েকজন মুরিদ আমাকে কয়েকবার যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু যাওয়া হয়নি। এই পীর সাহেবের আমলে গিয়েছিলাম। তবে একটা বলতে ইচ্ছা করে, আবার ইচ্ছা করেও না। কারণ আজকে নয়টার সময় ইন্তেকাল করেছেন কিন্তু জানাযা কখন পরের দিন সকাল ১০ টায়। এজন্য অবশ্য হুজুর দায়ী নন। দায়ী যারা এখন আছেন তারা। আমাদের মাওলানা আবরারুল হক রহ. এরকম জানাযা ২৪ ঘন্টা দেরি  করা পছন্দ করতেন না। আমাদের চোখের সামনে অনেকগুলো ঘটনা গেছে। মাওলানা আবরারুল হক সাহেব মারাত্মক বেজার হয়েছেন। কেন তোমরা জানাযায় দেরি কর? হুকুম হল জলদি কবর দাও।

কর্তৃপক্ষের এমন চিন্তা করা যে, হুজুরের মুরিদান কত জায়গা থেকে আসবে। চেহারাটা দেখবে। কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা দেরি করা দরকার এ চিন্তা আদৌ ঠিক নয়।

মাওলানা আবরারুল হক সাহেব রহ. বলতেন, না এটা সুন্নাতের খোলাপ, যাক এ সম্পর্কে এখন আর বলব না। আল্লাহ তাআলা হুজুরের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন। কবর তো এখনো দেওয়া হয়নি। কিন্তু কবরের দুআ এখন থেকেই করা যায়। দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। এখন রূহ আলমে বরযখে চলে গেছে, বাইরে শরীরটা পড়ে রয়েছে। উনি এখন মধ্য জগতের মানুষ। আল্লাহ তার দরজা বুলন্দ করুন। আমীন।

মাসআলা সময় মতো বললে মনে থাকে বেশি। আজকে যেহেতু হুজুরের ইন্তেকালের দিন, তাই মাসআলাটা আমরা ভালভাবে শুনে রাখি। মাসআলা হল, দাফন ঝটপট করা। এব্যাপারে আমাদের  অনেক ত্রুটি হয়। মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব সঙ্গে থাকার উসিলায় হুজুরের অনেক কাজকর্ম এবং তার সাথে সরাসরি মাওলানা আবরারুল হক সাহেব রহ. এর কাজকর্মও দেখেছি। আপনারা মনে রাখবেন কাজকর্ম কারো সম্পর্কে মন্দ ধারণা করার দরকার নেই। আমাদের যেটা কর্তব্য এবং দ্বীনী দায়িত্ব, রাসূলের সুন্নাতকে যিন্দা করা সেটাই করতে চাই।

হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত আশরাফ আলী থানভী রহ. ইন্তেকাল করেছেন, উনার জানাযা হবে। থানাভবনে আগে রেলস্টেশন ছিল না। হাফেজ্জী হুজুর রহ. বয়ানে বলতেন, ২০ বছর থানাভবনে স্টেশন হওয়ার জন্য দুআ করেছেন। থানাভবনের আগেও একটা স্টেশনআছে, পরেও একটা স্টেশন আছে, থানা ভবনে নেই। তাই হয় আগের ষ্টেশনে নামতে হত কিংবা পরের ষ্টেশনে নামতে হত। এরপর দীর্ঘ রাস্তা েঁহটে যেতে হত। তো হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. মুরিদদের নিয়ে বিশ বছর নিয়মিত দুআ করেছেন কিন্তু আল্লাহথানা ভবনে স্টেশন বানিয়ে দাও। আমরা হলে লজ্জা পেতাম, এতজন নিয়ে দুআ করছি কবুল হয় না, শরম লাগে। কিন্তু তাঁদের মানসিকতা ছিল আমি মাবুদের কাঙ্গাল। কাঙ্গাল কি এক দিনের কাঙ্গাল, দুই দিনের কাঙ্গাল? দশদিনের কাঙ্গাল। মাবুদ কবুল করে না তাই বলে কি কাঙ্গালিপনা ছেড়ে দিব? মাবুদের উপর অভিমান করে বসে থাকব? এত দুআ করলাম আল্লাহ দেয় না! নাউযুবিল্লাহ। হাফেজ্জী হুজুর রহ. বয়ানে বলতেন; আমি মাবুদের কাঙ্গাল। মাবুদ আমারে কইছে দুআ করতে। আমি দুআ করমুই  করমুই। করমুই আমার দুআ কবুল হয় না; তাতে কী হয়েছে? আমার মাবুদ বলেছে দুআ করতে। দুআ করলে সওয়াব তো হবে। যা হোক উনি যখন ইন্তেকাল করলেন টেলিগ্রাম আসল একটি বিশেষ ট্রেন শুধু জানাযায় শিরকতকারীদের নিয়ে আসছে। অপেক্ষা করা হোক। কিন্তু হযরতের ভাতিজা মাওলানা শাব্বীর আলী সাহেবতিনি তখন দায়িত্বশীল ছিলেন। দেরি করলেন না। শাব্বীর সাহেব থানভী রহ.-এর ছোট ভাইয়ের ছেলে। হযরতরে নাম আশরাফ আলী, ভাইয়ের নাম আকবর আলী। তাদের আব্বাজানের কাজগুলো রহস্যময়। তার নাম মুন্সী আব্দুল হক সাহেব। খুব ধনী মানুষ ছিলেন। আল্লাহওয়ালাদের ছোহবতে দ্বীনী খেয়ালও খুব ভাল ছিলআশরাফ আলী যে আশরাফ আলী থানভী হয়েছেন এজন্য আব্বাজানের কত অবদান ছিল। অকল্পনীয় অবদান ছিল। আমাদের যিন্দেগীতে আমাদের আব্বাজানের অবদান নেই? মা কি শুধু কোলে কাঁধে নিয়েছেন। বাপের কি কোন অবদান নেই? আমাদের লেখাপড়া, জীবন গড়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে, কদমে কদমে আমাদের বাবা মার অবদান আছে কি নেই?

আশরাফ আলী বড় ছেলে পড়ে মাদরাসায়। ছোট ছেলে আকবর আলী পড়ে স্কুলে। সবাই বলে, আপনার বড় ছেলেকে ঠকিয়ে দিলেন। পিতার জবাব, না, আমার বড় ছেলেই সুখী হবে, ছোট ছেলে আফসোস করবে। সত্যিই বড় ভাই বড় হয়ে রইল। এরপর ছোট ভাই কি করলেন, নিজের ছেলেকে বড় ভাইয়ের হাতে সোপর্দ করলেন। ভাইজান, আমার ছেলে তোমাকে দিয়ে দিলাম। তাকে আলেম  বানাও। আর আলেম, জবর দস্ত আলেম। এই মাওলানা শাব্বীর আলী হযরতের একেবারে ডান হাত ছিলেন। তো চাচার ইন্তেকালের পর এই ভাতিজা বলল, আমার চাচাজান জীবনভর উসূলের পাবন্দি করতেন। জানাযার সময় দেওয়া হয়েছে, এখন আর দেরি করা উচিত হবে না। আমাদের কাছে মনে হবে একদম নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিষ্কার বাণী; জানাযা তাড়াতাড়ি দাও। কয়েকজন লোকের জন্য  দেরি করার কী দরকার? যে জানাযা পেলনা সেকি বঞ্চিত হল? বঞ্চিত হয়নি। এক ব্যক্তি মসজিদে নামাযের জন্য গেল। গিয়ে দেখল নামায হয়ে গেছে। ভেবেছিল সাতটা ত্রিশ মিনিটে নামাযসাতটা পনের মিনিটে। মাওলানা যাকারিয়া রহ. ফাযায়েলে নামাযের মধ্যে উল্লেখ করেছেন, সেই ব্যক্তি জামাতের পূরা সওয়াব পাবে। আমাদের মাওলানা শায়খুল হাদীস, জনাব আজিজুল হক সাহেব নিজে আমাকে গল্প শুনিয়েছেন; আমি রওয়ানা হলাম থানাভবন যাব। হুজুরের অসুস্থতার খবর পাইছি। কলকাতায় পেঁৗছলাম। কলকাতার গোয়ালন্দ থেকে সরাসরি ট্রেন যাইত। ওখানে ট্রেন বদলাইতে হয়। একদিন, দুইদিন, সাতদিন গিয়ে লাইন ধরলাম। কিন্তু ওইখান থেকে যে ট্রেন আমাকে থানাভবন নিবে; তার টিকিট পাইলাম না। অবশেষে সপ্তম দিনে টিকিট পাইছি। এই টিকিটে পৌছলাম। কিন্তু জানাযা পাইলাম না। আমাদের শায়খুল হাদীস  সাহেব জানাযা পেলেন না। কিন্তু আজিমপুরী হুজুর পেয়েছেন। মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব রহ. এতে আফসোসের কিছু নেই। কুরআনে পরিষ্কার  বলা হয়েছে

وَ مَنْ اَرَادَ الْاٰخِرَةَ وَ سَعٰی لَهَا سَعْیَهَا وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَاُولٰٓىِٕكَ كَانَ سَعْیُهُمْ مَّشْكُوْرًا.

যে ব্যক্তি আখেরাতের ইরাদা করল এবং যথাযথ চেষ্টা করল। (হাকীমুল উম্মতের ব্যাখ্যা করেছেন) সুন্নত তরীকায় চেষ্টা করল, ঈমানের সঙ্গে।

فَاُولٰٓىِٕكَ كَانَ سَعْیُهُمْ مَّشْكُوْرًا.

তাদের চেষ্টা আল্লাহর নিকট কবুল হবে। পুরষ্কারযোগ্য হবে। তাই ঈমানের সঙ্গে চেষ্টা করাটা দরকার। কাজেই আমি ঈমানের সঙ্গে চেষ্টা  করলাম, গিয়ে দেখলাম জানাযা হয়ে গেছে, আমি জানাযা পেলাম না। কিন্তু আল্লাহ কি দেখেন না?

আল্লাহর তো সব কিছুরই কুদরত আছে। সমস্ত মাখলুক তার। কুরআনের আয়াত

لَا یُسْـَٔلُ عَمَّا یَفْعَلُ وَ هُمْ یُسْـَٔلُوْنَ.

তিনি যা করেন তাকে প্রশ্ন করা যাবে না। তিনি শুধু চেষ্টার উপর সওয়াব দিলে কার কী বলার? আর আল্লাহ তো তাই করেন, নিয়ত আর চেষ্টার জন্যই সওয়াব দিয়ে থাকেন। কাজেই জানাযার এই মাসআলাটি আমরা খেয়াল রাখি, যদি পারি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতকে যিন্দা করার লক্ষ্যে মাওলানা আবরারুল হক রহ. বলতেন, তুমি আমার বাবা, তুমি আমার পীর, তুমি আমার নানা সেটা আসে যায় না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করতে বলেছেন সেটাই দেখব।

আমাদের মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব আমাদের কাছে একটি কিসসা বর্ণনা করেছেন। হারদুঈ হযরত এসেছেন। এখানে একটা জানাযা এসেছে ইশার আজানের ২০ মিনিট আগে। আমরা মনে করলাম, নামাযের পর জানাযা পড়ব। কিন্তু আমার খেয়াল হল, হযরত তো সবসময় বলেন, তাড়াতাড়ি জানাযা পড়। এখন যদি আমি দেরি করি তাহলে কাজটি ঠিক হবে না। এখনও আযান হয়নি। আযানের আগে ২০ মিনিট, আযানের পর আধা ঘণ্টা। তার মানে প্রায় এক ঘন্টা দেরি হবে। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম কোন্দিকে যাই। তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলাই ভাল। এর মধ্যে দেখি, হুজুর ঘরের দিকে যাচ্ছেন, ভাবলাম মাযুর মানুষ। তখন আমি লোকদের বললাম তাড়াতাড়ি আসো, জানাযার নামায পড়ি। ইশা পড়ার আগেই জানাযা পড়ে ফেললাম। একটু পরে দেখি, হযরত অযু করে আসতেছেন। এসে বললেন, ‘জানাযা হো গায়া’? জানাযা হয়ে গেছে? বললাম, জী হুজুর হয়ে গেছে। হযরত কিছু বললেন না। একথা বলেননি যে, আমার জন্য দেরি  করলে না কেন? চিন্তা করুন। এটা একেবারে যাত্রাবাড়ি মাদরাসার ঘটনা। আসলে দাফন-কাফন ঝটপট করা একটা বড় জিনিস। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে একাজের সৌভাগ্য নসীব করুন। আমীন

আমাদের যিন্দেগীতে আমাদের সময় যদি আল্লাহর রাসূলের সুন্নতগুলো যিন্দা করার কাজে কাটে তাহলে এটা মুবারক। আপনাদের কাছে আমি কাকরাইলের একজন মুরব্বির কথা বলি। মাওলানা আলী আকবার সাহেব। তিনি বার বার এই হাদীসটা পড়তেন। بدأالاسلام غريبا

ইসলাম তার কাজটা শুরু করেছে আগন্তুকের মত। আগন্তুক কাকে বলে? অপরিচিত, অজানা, অচেনা মানুষকে।

وسيعود كما بدأ

 শিগগির আবার আগের মত হয়ে যাবে। فطوبى للغرباء

আগন্তুকের জন্য খোশখবরী। আলী আকবর সাহেব বলতেন, আগন্তুক হও। আগন্তুক হও। এটার মানে কী? তুমি কত বড় ডাক্তার, কত বড় ইঞ্জিনিয়ার, কত বড় চাকুরীজীবী সব ভুলে যাও। গাট্টি বোঁচকা নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে যাও। এটা হল কথা। নিজেকে আগন্তুক বানাও এই হল হুজুরের দাওয়াত। বাকিটা হুজুর বলতেন না । একই হাদীসের বাকি অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম নিজেই বলেছেন, আগন্তুকদের জন্য খোশখবরি!    

অর্থাৎ আগন্তুকদের বেহেশতের খোশখবরি। তারপর নিজেই বলেছেন আগন্তুক কারা

هم لَّذِينَ يُصْلِحُونَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ مِنْ سُنَّتِي مِنْ بَعْدِي.

এরা ঐ সমস্তলোক যারা আমার সুন্নতগুলোকে মানুষেরা বিগড়ে দেওয়ার পর আবার সহীহ করে; সুন্নত কোনটা? একটি দৃষ্টান্ত শুনুন। মানুষ মনে করে বিয়ের মধ্যে উকিল বাপ লাগে। অথচ কোথাও এর দলিল নেই। আবার উকিল বাপের সঙ্গে কত খাতির। মউত পর্যন্ত উকিল বাপের সাথে পর্দা নাই। নাউযুবিল্লাহ! একটি ঘটনা বলি, আমরা বসে আছি, বসুন্ধরায় বুয়েটের ডা. মুজিবুর রহমান সাহেবের ছেলের বিয়ে। মেয়ের বাপ আমাদের আরেকজন সহকর্মী আব্দুল হক আশরাফ ইঞ্জিনিয়ার। উনি দেরি করে আসলেন। এসে বললেন, হুজুর উকিল আসেনি। মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব বললেন, উকিল মানে কী? সে বলল হুজুর আমরা তো জীবনভর শিখে এসেছি, উকিল লাগে। মুফতী সাহেব বললেন, উকিল আবার কী? আপনিই তো মেয়ের আব্বা। আপনি উপস্থিত আছেন। উকিলবাপ লাগবে এটার কোন দলিল নেই। তাই এটা বর্জনীয়। এটা বর্জন করা মানে সুন্নতের উপর চলা।

আরেকটি দৃষ্টান্ত, ইযিনের জন্য সাক্ষী। কাজীরা বলে থাকেন, পাত্রপক্ষের একজন আসুন। পাত্রীপক্ষের একজন আসুন। অথচ ইযিনের জন্য সাক্ষী জরুরি নয়। ভাববার বিষয় হল, যেই দুইজনকে কাজী সাহেব মেয়ের কাছে পাঠান তারা কি মেয়ের মাহরাম? এটা কিন্তু লক্ষ করা হয় না। অথচ পাত্রপক্ষের লোকটি সাধারণত গায়রে মাহরাম হয়ে থাকে। আসলে সাক্ষী কোনটা? যখন মেয়ের পক্ষ বলবে, এত টাকা দেনমোহর অমুকের মেয়ে অমুককে তোমার সাথে বিবাহ দিলাম। আর পাত্র বলবে, আমি কবুল করলাম। এই কথা যারা শুনবে তারাই সাক্ষী।

আমার এক প্রিয় স্যার শামসুদ্দীন স্যার। তিনি আমাকে বলেছেন, হামিদ, তুমি আমার ছেলের বিয়েতে থাকবে। আমি বললাম, এক শর্তে থাকতে পারি, যদি বিয়ে মসজিদে হয়। তিনি বললেন, ঠিক আছে। জিজ্ঞেস করলেন, কোন মসজিদ? আমি বললাম, কলোনির ওই পুকুর পাড়ের মসজিদ। বললেন, ঠিক আছে। তিনি সময় দিয়েছেন নয়টায়। দশটা ত্রিশ মিনিটের সময় একজন এসে বলছে, আপনার স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি খুব লজ্জিত। তিনি আমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে, হামীদুর রহমানের কাছে গিয়ে বল, আমার পুরা ইচ্ছা ছিল মসজিদে বিয়ে পড়ানোর । কিন্তু কন্যাপক্ষের কারণে পারছি না। হামীদ যেন মেহেরবাণী করে আসে। আমি আটকে গেলাম। মসজিদের মধ্যে হলে তো শয়তান ধরতে পারত না। এখন বাড়ির মধ্যে কোন্ শয়তান ধরে। কোন মুসিবতে পড়ি। ঠিকই মুসিবতে পড়ে গেলাম। প্রথমে সাক্ষী নিয়ে কাজী সাহেব উকিল পাঠাতে চাইলেন। আমি ধমক দিলাম, না! উনাকে পাঠাবেন না। মেয়ের মাহরাম নয় উনাকে পাঠাবেন না। আমি চমৎকার ধমক দিলাম। যেহেতু আমার স্যার আছে। খুঁটির জোর একটু বেশি। পাঠাল না। কিন্তু মামুকে পাঠাল, চাচাকে পাঠাল, পরে মেয়ে পক্ষের লোকেরাই আমাকে বলে, আপনি এগুলো কোথায় পেয়েছেন? আমি বললাম, আলেমদের কাছে পেয়েছি।

আবার ছবি তোলা নিয়ে লাগল। আমি নিষেধ করলে আমাকে বলা হল আপনি হজ্বের জন্য ছবি তোলেন না? আমি বললাম, হ্যঁা তুলি। তখন ছবি তোলেন কেন? বললাম, উলামায়ে কেরাম তখন জায়েয বলেন। আর এখানকার কথা না জায়েয বলেন।

মসলিসে দাওয়াতুল হক সুন্নতকে যিন্দা করার মজলিস। আপনারা যারা দাওয়াতুল হকের মজলিসে ছিলেন তারা দেখেছেন, মসজিদে আযানের মশক হয় ইকামতের মশক হয়, কুরআনের মশক হয় ইত্যাদি। দাওয়াতুল হাকের বড় মুরব্বি মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব হুজুর বলেন, এগুলো ইবাদতের অংশ। প্রত্যেক দিন প্রয়োজন হয়। আসলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নতের প্রয়োজন। স্বামীর সাথে স্ত্রীর আচার-আচরণের জন্য দাওয়াতুল হকের কর্মকাণ্ড নেই? স্বামী স্ত্রীর সাথে কী আচরণ করবে? স্ত্রী স্বামীর সাথে কী আচরণ করবে? তিনি বলেন, জীবনের প্রতিটি কাজে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নতকে যিন্দা করতে হবে এটাই হল দাওয়াতুল হক। হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. বলেছেন, যে কোন জায়গায় যে কোন মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নতকে পুনজীবিত করার কাজ করে সেই দাওয়াতুল হকের কাজ করে। আমার নামের দরকার নেই। কিন্তু নামের সাথে আমার সম্পর্ক এই জন্য যে, জামাতের সঙ্গে কাজ করলে কাজে বরকত হয়। এই জন্য একটি জামাত বানিয়েছি। অপূর্ব নম্রতা! এখন কাজ হল আমাদের মজলিসে  শরিক হওয়া। বারবার মোযাকারা করা। কারণ একই কথা নিজে নিজে পড়া আর সেটা উলামায়ে কেরামের নিকট থেকে শুনার মধ্যে পার্থক্য থাকে। সত্যিকারের রূপরেখা তারা দিতে পারেন। হাকীমুল উম্মতের কিতাব হায়াতুল মুসলিমীনের বিশ তম পরিচ্ছেদ বিশতম রূহ। সেখানে বলা হয়েছে বিবাহ কর এবং বংশবৃদ্ধি কর। পুরুষত্বের অপব্যবহার করে ধ্বংস হয়ো না। আজকেই আমার কাছে এক আল্লাহর বান্দী এসেছে। স্বামীর সাথে মারাত্মক ঝগড়া। ছাড়াছাড়ি হয় হয় ভাব। আমি বললাম সবর কর। আমাকে বলে, আপনি আর  আমাকে ওখানে যেতে বলবেন না। আমি বললাম, তোমাকে তো তালাক দেয়নি। সে বলল, জানেন না, আমাকে কত গালিগালাজ করে। আমি বললাম, গালিগালাজ করুক, তালাক তো দেয়নি। তোমাকে আল্লাহ বদলা দিবেন। তুমি আমার কথা বিশ্বাস না  করলে আমার কাছে আস কেন? আমার কাছে আসল হল আখেরাত। তোমার কষ্ট হচ্ছে, ছবর করা। আল্লাহ তোমাকে বদলা দিবেন। এক পর্যায়ে বলল, আপনাকে আমি গভীর শ্রদ্ধা করি। একটা কথা না বললে হয় না। বললাম, বল। সে বলল, স্বামী আমাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চা নিতে দেয়নি। আচ্ছা এটা কি শুধু স্বামীরা করে, না মেয়েরাও করে। মেয়ে অনার্স পড়ে। বাপেই কয়, মেয়েকে আমি মানা করে দিয়েছি অনার্স পাশ না করা পর্যন্ত বাচ্চা নিবি না। এরা ধ্বংস করে কি করে না? প্রিয় মুসলমান, বংশ বৃদ্ধি কর। পুরুষত্বের অপব্যবহার করে ধ্বংস হয়ো না। বিবাহ করা মানে কি খালি বিবাহ করা? এখন বাচ্চা নিব না। মানে আমিই হলাম খোদা, আমি বাচ্চা নিব না। এদের যখন বাচ্চা হয় না তখন কী করে সেটা দেখ না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বিখ্যাত কথা। কিয়ামতের দিন আমি আমার উম্মতের সংখ্যাধিক্যের জন্য গর্ব করব। তো আপনি বাবা হয়ে মেয়েকে বলছেন, সন্তান নিবিনা স্বামী হয়ে স্ত্রীকে বলছেন, বাচ্চা নিও না। স্ত্রীরাও অনেক সময় বাচ্চা নিতে চায় না। সে বলল, ‘আমার স্বামী আমার তিনটা বাচ্চা নষ্ট করেছে। চতুর্থবার আমি বললামকিছুতেই না। লক্ষ করুন তিনবার গর্ভে সন্তান এসেছিল। তিনবারই গর্ভ নষ্ট করেছে। আর এ ধরনের ঘটনা কিন্তু একটা নয়। এটা এখন ব্যাপক। আমাদের নিকট জন শক্তি হচ্ছে বাচ্চা নিব না। এটা মারাত্মক ভুল কথা। আসল কথা হল ঈমানের সঙ্গে। আল্লাহ আল্লাহর রসূল কী বলেছেন। তার জন্য মুহাব্বত হলে কি তার কথার মুহাব্বত হবে না? আসলে অনেকের জানাই নেই এ বিষয়ে রাসূল কিছু বলেছেন কি না। রাসূল কি বলেছেন শুধু বিবাহ কর? যেমন খুশি চল? বর; তার বিখ্যাত কথা, বংশ বৃদ্ধি কর। এখন আমাদের এদেশের কথা হল, দুটি সন্তান যার সুখী সংসার তার। এখন আরো মর্ডান হয়েছে-সুসন্তান একটি হলেই যথেষ্ট। তো রাসূলের কথার খেলাপ হল না? থানভী রহ. একথা বলেননি যে, প্রিয় মুসলমান, বিবাহ কর; বরং বলেছেন, বিবাহ করে বংশ বৃদ্ধি কর।

পুরুষত্বের অপব্যবহার করে ধ্বংস হয়ো না। এই কথাটা ব্র্যাকেটে লেখা। এটা থানভী রহ. নাকি শামসুল হক ফরিপুরী রহ. এর নিজের তা জানা নেই। ব্র্যাকেটে দেখে মনে হচ্ছে ফরিদপুরী রহ. এর নিজের। যে পুরুষের স্ত্রীর প্রয়োজন নেই তাদের ও বিবাহ করা উচিত। বিবাহ করা কোন ক্ষেত্রে ওয়াজিব, কোন ক্ষেত্রে সুন্নাত, কোন ক্ষেত্রে মুস্তাহাব। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন যে পুরুষের স্ত্রী নেই সে দরিদ্র। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, বিবাহ করা ও স্ত্রী রাখা ছাড়াও তো মানুষ অনেক মালদার হতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদিও মালদার হয় তবুও যাহার স্ত্রী নেই সে দরিদ্র। (কেননা, মাল দৌলতের উদ্দেশ্য হল শান্তিতে জীবন যাপন করা। যে পুরুষের স্ত্রী নেই সে লক্ষ টাকার অধিকারী হলেও শান্তিতে বসবাস করতে পারে না।) আবার বললেন, যে নারীর নেই সে দরিদ্র, সে দরিদ্র। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ হয়ত স্বামী ছাড়াও কোন স্ত্রীলোক ধনশালিনী হতে পারে? রাসূল সা. বললেন, ধনশালিনী হইয়াও স্বামীবিহীন নারী দরিদ্র। (কারণ স্বামী ব্যতীত নারীর শান্তির সাথে জীবনযাপন হতেই পারে না। অথচ টাকা পয়সা আসল লক্ষ  শান্তির জীবন লাভ করাই টাকা পয়সার আসল লক্ষ্য। অতএব টাকার যে উদ্দেশ্য ছিল টাকা দ্বারা হাসিল হয় নি। শান্তি লাভ হয়না। এজন্য সে দরিদ্র রয়ে গেল।

এই হাদীস দ্বারা বুঝা গেল, বিবাহের দ্বারাই প্রকৃত ধনী হওয়া যায়। দুনিয়াতে শান্তির জীবন যাপন করা যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন, হে যুবকগণ, তোমাদের মধ্যে যাদের গৃহস্থলি খরচ বহন করার যোগ্যতা আছে অর্থাৎ স্ত্রীর হক আদায় করার শক্তি আছে তাদের বিবাহ করা উচিত। কেননা, বিবাহের দ্বারা দ্বীনী এবং দুনিয়াবী অনেক উপকার হয়। বিবাহ দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে, লজ্জাস্থানকে রক্ষা করে। অর্থাৎ কুদৃষ্টি ও কুকাজ থেকে সহজেই বাচিয়ে রাখে। এটা হায়াতুল মুসলিমীনের ২০ নং রূহ। কিতাবটা সবার ঘরে থাকা উচিত। হাফেজ্জী হুজুর এই কিতাবটার কথা বারবার বলতেন। তিনি বলেন, থানভী রহ. বলেছেন, আমি এই কিতাবটা আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করে লিখেছি। আমি আশা করি, এই কিতাব আমার জন্য নাজাতের ওসীলা হবে।

 

advertisement