পবিত্র কুরআনে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-এর দুআ
কুরআন মাজীদে ছাব্বিশজন নবী-রাসূলের নাম সুস্পষ্ট ভাষায় এসেছে। নাম ছাড়া প্রসঙ্গ এসেছে আরো কয়েকজনের। আল্লাহ তাআলা এই নবী ও রাসূলদের মধ্যে কারো কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলেছেন, আবার কারো বিবরণ বিস্তারিতভাবে দিয়েছেন। তন্মধ্যে অনেক নবী-রাসূলের কাহিনীতে রয়েছে, তারা জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে, বিভিন্ন স্বস্তি ও সংকটকালে, আনন্দ বা বেদনার সময় বিশেষ ভাষায় আল্লাহ পাকের নিকট মুনাজাত বা প্রার্থনা করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সেসব মুনাজাত কবুল করেছেন। যেহেতু নবী-রাসূলগণ আল্লাহ পাকের মনোনীত ও নির্বাচিত মহান দূত ও প্রেরিত পুরুষ ছিলেন, তাই তারা যে পরিস্থিতিতে যে শব্দে বা ভাষায় দুআ করেছেন, সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আমরাও যদি হুবহু ওই শব্দে মহান আল্লাহ পাকের নিকট মুনাজাত করি, তবে আশা করা যায়, আমাদের দুআও কবুল হবে। কুরআন মাজীদে যেসব নবী-রাসূলের দুআ উল্লেখিত হয়েছে,যুগ ও সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাঁদের দুআ উল্লেখিত হল।
হযরত আদম আ.-এর দুআ
আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়াকে সৃষ্টি করার পর উভয়কে বললেন, তারা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারবে এবং জান্নাতের সবকিছূ থেকে উপকৃত হতে পারবে। একটি নির্দিষ্ট বৃক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে বলে দেওয়া হল এই বৃক্ষের ফল আহার করবে না। এমনকি সেই বৃক্ষের কাছেও ঘেঁষবে না। কিন্তু শয়তানের কুমন্ত্রণায় তারা সেই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে ফেললেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। পৃথিবীতে এসে তারা তাঁদের কৃত ভুলের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে রোনাযারি করতে থাকেন। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তাদেরকে প্রার্থনা-বাণী শিখিয়ে দেওয়া হল। তারা বললেন,
رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.
হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। -সূরা আরাফ : ২৩
হযরত নূহ আ.-এর দুআ
হযরত নূহ আলাইহিস সালাম সাড়ে নয় শ বছর যাবৎ তার কওমকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু তার কওম তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করত, তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করত এবং তাঁকে লক্ষ করে বলত, এতো এক পাগল। তখন তিনি আল্লাহ পাককে আহ্বান করে বললেন, اَنِّیْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِر ‘হে আল্লাহ, আমি অসহায়, অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন।’ -সূরা কামার : ১০
অল্প কিছু লোক ব্যতীত অধিকাংশরা যখন তাঁকে প্রত্যাখ্যানই করতে থাকে তখন তিনি দুআ করেন,
رَبِّ اِنَّ قَوْمِیْ كَذَّبُوْنِۚ فَافْتَحْ بَیْنِیْ وَ بَیْنَهُمْ فَتْحًا وَّ نَجِّنِیْ وَ مَنْ مَّعِیَ مِنَ الْمُؤْمِنِیْنَ.
হে আমার প্রতিপালক, আমার স¤প্রদায় আমাকে মিথ্যাবাদী বলছে। অতএব আমার ও তাদের মধ্যে কোন ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে ও আমার সঙ্গী মুমিনদেরকে রক্ষা করুন। -সূরা শুআরা : ১১৭-১১৮
তিনি পরিশেষে যখন তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হলেন এবং বুঝতে পারলেন, তাদের সীমালংঘনের শাস্তি অবধারিত তখনই তিনি তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করলেন,
رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَی الْاَرْضِ مِنَ الْكٰفِرِیْنَ دَیَّارًا اِنَّكَ اِنْ تَذَرْهُمْ یُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَ لَا یَلِدُوْۤا اِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا.
হে আমার রব, আপনি পৃথিবীতে কোন কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিবেন না। যদি আপনি তাদেরকে রেহাই দেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল পাপাচারী, কাফের। -সূরা নূহ : ২৬-২৭
তারপর হযরত নূহ আ. মুমিনদের জন্য প্রার্থনা করে বললেন,
رَبِّ اغْفِرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِمَنْ دَخَلَ بَیْتِیَ مُؤْمِنًا وَّ لِلْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ.
হে আমার পালনকর্তা, আপনি ক্ষমা করুন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং সকল মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে। -সূরা নূহ : ২৮
সবশেষে তিনি কাফেরদের বেলায় কঠোরতর ভাষায় বদ দুআ করে বললেন,
وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا تَبَارًا.
‘আর আপনি জালেমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন। -সূরা নূহ : ২৮
হযরত নূহ আ. মুমিনদের জন্য নেক দুআ এবং কাফেরদের জন্য বদদুআ করেছিলেন। তার উভয় প্রার্থনাই কবুল হয়েছিল।
আল্লাহ পাক তাঁকে একটি নৌযান তৈরি করার নির্দেশ দেন। তারপর সেই নৌযানে মুমিনদেরকে নিয়ে আরোহণের হুকুম হল। তিনি তা-ই করলেন। তিনি নৌযানে আরোহণের সময় বললেন,
بِسْمِ اللّٰهِ مَؔجْرٖىهَا وَ مُرْسٰىهَا اِنَّ رَبِّیْ لَغَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ .
আল্লাহ পাকের নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা হুদ : ৪১
হযরত নূহ আ. সকল মুমিন-মুসলমানকে নিয়ে নৌযানে আরোহণের পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে নিম্নোক্ত দুটি দুআ পাঠ করতে বললেন,
الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ نَجّٰىنَا مِنَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِیْنَ .
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদেরকে জালেম স¤প্রদায় থেকে উদ্ধার করেছেন। -সূরা মুমিনূন : ২৮
رَّبِّ اَنْزِلْنِیْ مُنْزَلًا مُّبٰرَكًا وَّ اَنْتَ خَیْرُ الْمُنْزِلِیْنَ.
হে আমার রব! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করিয়ে দিন যা হবে কল্যাণকর; আর আপনিই শ্রেষ্ঠ অবতারণকারী। -সূরা মুমিনূন : ২৯
হযরত হুদ আ.-এর দুআ
হযরত হূদ আলাইহিস সালাম অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর কওমকে হেদায়াতের দিকে আহ্বান করেছিলেন। তাঁর কথায় ওরা কর্ণপাত না করায় তিনি তাদেরকে আল্লাহ পাকের শাস্তির ভয় দেখান। কিন্তু তাঁর সম্প্রদায় আরও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলল। তখন হযরত হূদ আ. আল্লাহ পাকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে বলেন,
رَبِّ انْصُرْنِیْ بِمَا كَذَّبُوْنِ.
হে আমার রব, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করছে। সুতরাং আপনি আমার সাহায্য করুন। -সূরা মুমিনূন : ৩৯
সূরা মুমিনূনের ছাব্বিশতম আয়াত থেকে বুঝা যায়, এই দুআখানি হযরত নূহ আ.-ও করেছিলেন।
হযরত ইবরাহীম আ.-এর প্রার্থনা
হযরত ইবরাহীম আ.-এর অনেগুলো দুআ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। তিনি নবুওতের দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পিতা ও কওমকে মূর্তিপূজা বর্জন করে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। তিনি একপর্যায়ে বললেন, তোমরা যেগুলোর পূজা কর এগুলো আমার শত্রু। জগৎসমূহের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তাআলাই আমার প্রভূ। যিনি আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দেন। আমাকে আহার্য এবং পানীয় দেন এবং আমি অসুস্থ হলে রোগমুক্ত করেন। যিনি আমাকে মৃত্যু দেবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন। তারপর ইবরাহীম আ. আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করেন-
رَبِّ هَبْ لِیْ حُكْمًا وَّ اَلْحِقْنِیْ بِالصّٰلِحِیْنَ وَ اجْعَلْ لِّیْ لِسَانَ صِدْقٍ فِی الْاٰخِرِیْنَ واجْعَلْنِیْ مِنْ وَّرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِیْمِ.
হে আমার পালনকর্তা, আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী করুন, আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিবাসীদের অন্তভুর্ক্ত করুন। -সূরা শুআরা : ৮৩-৮৫
হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহ পাকের নির্দেশে দু্গ্ধপোষ্য পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে মক্কার অনাবাদী ঊষর মরুপ্রান্তরে রেখে নিজ আবাসস্থল ফিলিস্তীনে ফিরে আসছিলেন। তিনি চলতে চলতে এক পর্বতশীর্ষে আরোহণ করলেন, যেখান থেকে স্ত্রী ও প্রিয় পুত্রধনকে দেখা যাচ্ছিল না। তখন কাবা শরীফের দিকে মুখ করে আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করলেন,
رَبَّنَاۤ اِنِّیْۤ اَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ بِوَادٍ غَیْرِ ذِیْ زَرْعٍ عِنْدَ بَیْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِیُقِیْمُوا الصَّلٰوةَ فَاجْعَلْ اَفْىِٕدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِیْۤ اِلَیْهِمْ وَ ارْزُقْهُمْ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّهُمْ یَشْكُرُوْنَ رَبَّنَاۤ اِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِیْ وَ مَا نُعْلِنُ وَ مَا یَخْفٰی عَلَی اللّٰهِ مِنْ شَیْءٍ فِی الْاَرْضِ وَ لَا فِی السَّمَآءِ.
হে আমাদের প্রতিপালক, আমি আমার বংশধরদের কতককে আপনার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে অনাবাদ উপত্যকায় বসবাস করালাম। হে আমাদের প্রতিপালক, তা এই জন্য যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব, আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হে আমাদের পালনকর্তা, নিশ্চয় আপনি জানেন আমরা যা গোপন করি এবং যা প্রকাশ করি। আল্লাহর নিকট আকাশ-ভূমির কোন কিছুই গোপন নেই। -সূরা ইবরাহীম : ৩৭-৩৮
হযরত ইবরাহীম আ. কিছুকাল মক্কা নগরীতে অবস্থান করেন। তিনি আল্লাহ পাকের একজন রাসূল হিসেবে নিজেকে ও নিজের সন্তানকে মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত রাখার এবং তাদের আবাসস্থল পবিত্র মক্কা নগরীকে নিরাপদ শহরে পরিণত করার প্রার্থনা করে বলেন,
رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا الْبَلَدَ اٰمِنًا وَّ اجْنُبْنِیْ وَ بَنِیَّ اَنْ نَّعْبُدَ الْاَصْنَام رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِیْ فَاِنَّهٗ مِنِّیْ وَ مَنْ عَصَانِیْ فَاِنَّكَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.
হে আমার প্রতিপালক, এই নগরীকে শান্তিময় শহর করে দিন এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন। হে আমার প্রতিপালক, এই সকল মূর্তি তো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সেই আমার দলভুক্ত, আর কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা ইবরাহীম : ৩৫-৩৬
হযরত ইবরাহীম আ. আাল্লাহ পাকের নিকট নেক সন্তানের জন্য প্রার্থনা করে বলেন,
رَبِّ هَبْ لِیْ مِنَ الصّٰلِحِیْنَ
হে আমার বর, আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। -সূরা সাফফাত : ১০০
আল্লাহ পাক তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করে তাঁকে একজন স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দান করেন। এর অল্পদিন পর হযরত ইসমাঈল আ. জন্মলাভ করেন।
হযরত ইসমাঈলের পর হযরত ইবরাহীম আ. -এর প্রথম স্ত্রী হযরত সারা-এর গর্ভে ইসহাক নামক দ্বিতীয় পুত্র জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত ইবরাহীম আ. একশ বছর বয়সে দুই পুত্রের পিতা হয়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করেন-
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ وَهَبَ لِیْ عَلَی الْكِبَرِ اِسْمٰعِیْلَ وَ اِسْحٰقَ اِنَّ رَبِّیْ لَسَمِیْعُ الدُّعَآءِ رَبِّ اجْعَلْنِیْ مُقِیْمَ الصَّلٰوةِ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ رَبَّنَا وَ تَقَبَّلْ دُعَآءِ رَبَّنَا اغْفِرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِلْمُؤْمِنِیْنَ یَوْمَ یَقُوْمُ الْحِسَابُ.
সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। আমার প্রতিালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনে থাকেন। হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ও আমার বংশধরদের থেকে সালাত কায়েমকারী করুন। হে আমাদের রব, আমার প্রার্থনা কবুল করুন। হে আমার প্রতিপালক, যেদিন হিসাব হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং মুমিনদেরকে ক্ষমা করুন। -সূরা ইবরাহীম : ৩৯-৪১
হযরত ইবরাহীম আ. মক্কা নগরীর নিরাপত্তা এবং মক্কার মুমিন অধিবাসীদের জন্য জীবিকা প্রার্থনা করে আরও দুআ করেন,
رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا بَلَدًا اٰمِنًا وَّ ارْزُقْ اَهْلَهٗ مِنَ الثَّمَرٰتِ مَنْ اٰمَنَ مِنْهُمْ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاَخِرِ .
হে আমার প্রতিপালক, মক্কাকে নিরাপদ শরহ করুন, আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদেরকে ফলমূল থেকে জীবিকা প্রদান করুন। -সূরা বাকারা : ১২৬
আল্লাহ পাক হযরত ইবরাহীম আ.-কে আল্লাহর গৃহ কাবা শরীফ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। হযরত ইবরাহীম আ. পুত্র ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর ঘর নির্মাণ করেন। নির্মাণকার্য সমাপ্ত করার পর পিতাপুত্র দুআ করেন,
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ رَبَّنَا وَ اجْعَلْنَا مُسْلِمَیْنِ لَكَ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَ اَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَ تُبْ عَلَیْنَا اِنَّكَ اَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِیْمُ.
হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এই কাজ গ্রহণ করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর থেকে আপনার এক অনুগত উম্মত করুন। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়মপদ্ধতি দেখিয়ে দিন এবং আমাদের তওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা বাকারা : ১২৭-১২৮
পবিত্র কুরআনে সূরায়ে মুমতাহিনায় রয়েছে, হযরত ইবরাহীম আ. তার কাফের ও মুশরিক স¤প্রদায়কে লক্ষ করে বলেছেন, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনলে তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে রইল। তখন ইবরাহীম আ. ও তাঁর অনুসারীগণ আল্লাহ পাকের নিকট সকাতর প্রার্থনায় বলেছেন,
رَبَّنَا عَلَیْكَ تَوَكَّلْنَا وَ اِلَیْكَ اَنَبْنَا وَ اِلَیْكَ الْمَصِیْرُ رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلَّذِیْنَ كَفَرُوْا وَ اغْفِرْ لَنَا رَبَّنَا اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ.
হে আমাদের রব, আমরা তো আপনারই উপর নির্ভর করেছি, আপনারই অভিমুখী হয়েছি এবং প্রত্যাবর্তন তো আপনারই নিকট। হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদেরকে কাফেরদের জন্য পরীক্ষার পাত্র করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। -সূরা মুমতাহিনা : ৪-৫
হযরত লূত আ. -এর দুআ
হযরত লূত আ. হযরত ইবরাহীম আ.-এর পরামর্শে দাওয়াত ও হেদায়েতের উদ্দেশ্যে মৃত সাগরের দক্ষিণ পাশের অঞ্চলে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে সাদূম ও আমূরা গোত্রদ্বয়ের বসতি ছিল। তিনি এখানে এসে দেখলেন, এখানকার লোকেরা একপ্রকার অতি কুৎসিৎ কুকর্মে লিপ্ত । তিনি সকলকে এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে সতর্ক করলেন। কিন্তু তারা তাঁর কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করল না; বরং তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল। হযরত লূত আ. এই সংকটকালে দুটি দুআ করেন। তিনি মুমিনদের জন্য প্রার্থনা করলেন,
رَبِّ نَجِّنِیْ وَ اَهْلِیْ مِمَّا یَعْمَلُوْنَ.
হে আমার রব, আমাকে ও আমার পরিবার-পরিজনকে এহেন দুষ্কর্ম থেকে রক্ষা করুন। -সূরা শুআরা : ১৬৯
তার অপর দুআটি হল,
رَبِّ انْصُرْنِیْ عَلَی الْقَوْمِ الْمُفْسِدِیْنَ.
হে আমার প্রতিপালক, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন। -সূরা আনকাবুত : ৩০
আল্লাহ পাক তাঁর দুআ কবুল করলেন। তাঁকে ও তার অনুসারীদেরকে রক্ষা করলেন এবং অপরাধীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন।
হযরত ইউসুফ আ.-এর মুনাজাত
মিসর অধিপতির স্ত্রী হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। অল্পদিনের মধ্যেই এ কথা রাষ্ট্র হয়ে যায় যে, আযীযের স্ত্রী তার ক্রীতদাসের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েছে। আযীযের স্ত্রী এ দুর্নাম অপনোদনের জন্য মিসরের নারীদেরকে দাওয়াত করলেন। মিসরের নারীগণ হযরত ইউসুফের রূপ-গরিমা দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। সকলেই হযরত ইউসুফের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়ল এবং তাঁকে বলল, তুমি আযীযের স্ত্রীর আনুগত্য কর। ঈমানের এরূপ কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে হযরত ইউসুফ আ. আল্লাহ পাকের মহান দরবারে দুআ করলেন,
رَبِّ السِّجْنُ اَحَبُّ اِلَیَّ مِمَّا یَدْعُوْنَنِیْۤ اِلَیْهِ.
হে আমার প্রতিপলক, এই নারীরা আমাকে যার প্রতি আহ্বান করছে তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। -সূরা ইউসুফ : ৩৩
আল্লাহ পাক হযরত ইউসুফের এই বিনীত প্রার্থনা কবুল করেছেন।
হযরত ইউসুফকে তার ভাইয়েরা কেনআনের কূপে ফেলে দিয়েছিল। আল্লাহ পাক তাঁকে কুপ থেকে উদ্ধার করে মিসর নিয়ে গেলেন। মিসরে এক মিথ্যা অপবাদে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে মিসরের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে দিলেন। পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর তার সাক্ষাৎ হল। তিনি ইহকালীন জীবনে সর্বদিক থেকে আল্লাহ পাকের রহমত ও নেয়ামত লাভ করার পর জীবন সায়ােহ্ন এসে আল্লাহ পাকের নিকট নিবেদন করলেন,
رَبِّ قَدْ اٰتَیْتَنِیْ مِنَ الْمُلْكِ وَ عَلَّمْتَنِیْ مِنْ تَاْوِیْلِ الْاَحَادِیْثِ فَاطِرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ اَنْتَ وَلِیّٖ فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ تَوَفَّنِیْ مُسْلِمًا وَّ اَلْحِقْنِیْ بِالصّٰلِحِیْنَ.
হে আমার রব, আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! আপনিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তভুর্ক্ত করুন। -সূরা ইউসুফ : ১০১
হযরত শুয়াইব আ.-এর প্রার্থনা
মাদাইয়ানবাসীর নিকট হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালাম নাবীরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর কওমকে বললেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তোমরা পরিমাপ ও ওজন ঠিকভাবে দিও। আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান আনে, তাদেরকে আল্লাহর পথে বাধা দিও না। তখন তাঁর স¤প্রদায়ের দাম্ভিক ও অতি দুরাচার নেতৃবর্গ বলল, হে শুয়াইব! তোমরা আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে না আসলে আমরা তোমাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে অবশ্যই বহিষ্কার করে দেব। তখন হযরত শুয়াইব আল্লাহ পাকের সাহায্য প্রর্থনা করে বললেন,
رَبَّنَا افْتَحْ بَیْنَنَا وَ بَیْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَ اَنْتَ خَیْرُ الْفٰتِحِیْنَ.
হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের ও আমাদের স¤প্রদায়ের অপরাধীদের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিন এবং আপনিই মীমাংসাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। -সূরা আরাফ : ৮৯
আল্লাহ পাক তার দুআ কবুল করে অপরাধীদেরকে ধ্বংস করে দিলেন।
হযরত মূসা আ.-এর দুআ
হযরত মূসা আ. একবার মিসরের এক পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখতে পেলেন, জনৈক স্থানীয় ব্যক্তি একজন ইসরাঈলীর উপর জুলুম করছে। তিনি সেই স্থানীয় ব্যক্তিকে প্রথমত জুলুম থেকে বিরত থাকতে বললেন, কিন্তু সে তার কথা অমান্য করল। তিনি তৎক্ষনাৎ এই অপরাধীকে হাত দিয়ে আঘাত করলেন। তাতে সে মারা গেল। হযরত মূসা আ.-এর তাকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন। এবং বললেন নিশ্চয়, এটি শয়তানের কাজ। তারপর তিনি আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন,
رَبِّ اِنِّیْ ظَلَمْتُ نَفْسِیْ فَاغْفِرْ لِیْ .
হে প্রভূ, আমি নিজের উপর জুলুম করেছি। অতএব আমাকে ক্ষাম করে দিন। -সূরা কাসাস : ১৬
আল্লাহ পাক তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি তখন তাওবা করে বললেন-
رَبِّ بِمَاۤ اَنْعَمْتَ عَلَیَّ فَلَنْ اَكُوْنَ ظَهِیْرًا لِّلْمُجْرِمِیْنَ.
হে আমার প্রতিপালক, যেহেতু আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আমি কখনো অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না। -সূরা কাসাস : ১৭
হযরত মূসা আ. কর্তৃক জনৈক মিসরী কিবতীকে হত্যার সংবাদ দ্রুতবেগে জানাজানি হয়ে গেল। ফেরাউনের পরিষদবর্গ হযরত মূসা আ.-কে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাঁকে খুঁজতে শুরু করল। তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে দুআ করলেন,
رَبِّ نَجِّنِیْ مِنَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِیْنَ.
হে আমার রব, আপনি জালেম স¤প্রদায় থেকে আমাকে রক্ষা করুন। -সূরা কাসাস : ২১
হযরত মূসা আ. মিসর থেকে পলায়ন করে লোহিত সাগরের পূর্ববর্তী অঞ্চল মাদাইয়ানে চলে আসলেন। তার জন্য মাদাইয়ান সম্পূর্ণ নতুন জায়গা। পথ-ঘাট ও মানুষজন একেবারে অপরিচিত। তিন মুসাফির, কপর্দকহীন। এমন অসহায় অবস্থায় তিনি আল্লাহ পাকের মহান দরবারে বিনয়াবনত হয়ে প্রার্থনা করেন-
رَبِّ اِنِّیْ لِمَاۤ اَنْزَلْتَ اِلَیَّ مِنْ خَیْرٍ فَقِیْرٌ.
হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন, আমি তারই কাঙ্গাল। -সূরা কাসাস : ২৪
আল্লাহ পাক তাঁর দুআ কবুল করলেন। আল্লাহ পাকের নবী হযরত শুয়াইব আ.-এর গৃহে স্থায়ীভাবে তার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
১. ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, আলজামিউস সহীহ ১/৪৭৫ (কিতাবুল আম্বিয়); মাওলানা হিফযুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন ১/২২৭
২ . কাসাসুল কুরআন ১/২৩১
৩ . কাসাসুল কুরআন ১/২৪২
৪. ডক্টর শাওকী আবু খলীল, আতলাসুল কুরআন ৬১
৫. কাসাসুল কুরআন ১/২৯৫
(চলবে)