সুবহে সাদিক কখন শুরু?
প্রসঙ্গ : আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা-৫
বিগত কয়েক সংখ্যায় আহসানুল ফাতাওয়ার حوالجات : تحقیقات قدیمہ শিরোনামের সকল উদ্ধৃতির পর্যালোচনা মুহতারাম পাঠকের খেদমতে পেশ করা হয়েছে। এতে আমরা দেখেছি, ১৫°-এ সুবহে সাদিক হওয়ার দাবিটির সূত্র ও মূল ভিত্তি অজানা-অজ্ঞাত একটি কথা ছাড়া আর কিছু নয়। কথাটি কে বলেছেন- তার কোনো সন্ধান নেই। আর ১৮°-এ সুবহে কাযিব হওয়ার দাবিটির হাকীকত হল, পূর্ববর্তী কোনো কোনো ফালাকীর সুবহে সাদিকের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা। ব্যস্, আহসানুল ফাতাওয়ার ১৫°-এ সুবহে সাদিক এবং ১৮°-এ সুবহে কাযিবের উদ্ধৃতিগুলোর হাকীকত এই! যার বিশদ বিবরণ আমরা গত কিস্তিগুলোতে পড়েছি।
এখন বাকি থকল আহসানুল ফাতাওয়ার تحقیقات جدیدہ (নতুন তাহকীক) শিরোনামের উদ্ধৃতিগুলোর পর্যালোচনা। সামনে আমরা এর উপর বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা তুলে ধরছি ইনশাআল্লাহ। وبالله التوفيق
تحقیقات جدیدہ -এর পর্যালোচনা
تحقیقات جدیدہ (নতুন তাহকীক) এই শিরোনামের অধীনে আহসানুল ফাতাওয়ায় নিজ দাবির পক্ষে কিছু বইয়ের নাম এবং পাকিস্তান নেভি ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের কয়েকটি চিঠি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোতেও আহসানুল ফাতাওয়ার মূল দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। সামনে ধারাবাহিকভাবে এই উদ্ধৃতিগুলোর হাকীকত ও বাস্তব চিত্র বিস্তারিত পর্যালোচনাসহ তুলে ধরা হল।
‘মিয়ারুল আওকাত’-এর উদ্ধৃতি
আহসানুল ফাতাওয়ায় এই শিরোনামের অধীনে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মিয়ারুল আওকাত’ নামক একটি কিতাবের উদ্ধৃতি; যা মূলত একটি সময়সূচি। এই সময়সূচির অসঙ্গতি অনেক। সেহরির শেষ সময়, ফজরের নামাযের ওয়াক্ত, মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত কখন শেষ হয় এবং এশার নামাযের ওয়াক্ত কখন শুরু হয়- সব ক্ষেত্রেই এই সময়সূচিতে ভুল সময় প্রদান করা হয়েছে। এই সময়সূচিতে শাস্ত্রীয় দিক থেকে বড় বড় স্থূল ভুল তো আছেই। এমনকি এতে এমন কাঁচা ভুলও আছে, যা ভুল হওয়ার বিষয়টি আহসানুল ফাতাওয়ার নিকটও স্বীকৃত। কিছু বিষয় তাতে এমনও রয়েছে, যা আহসানুল ফাতাওয়ার দাবির সাথে মিল নেই। আহসানুল ফাতাওয়াতে দাবি করা হয়েছে একরকম, কিন্তু তাতে বিষয়টি সেভাবে নেই। সামনে একে একে বিষয়গুলো তুলে ধরা হল।
এক.
আহসানুল ফাতাওয়ায় এই সময়সূচি সম্পর্কে বলা হয়েছে-
اس کے صفحہ ১৪، ১৫، ২৫، ২৮ میں یہ وضاحت موجود ہے کہ صبح کاذب کے وقت آفتاب ১৮ درجہ اور صبح صادق کے وقت ১৫ درجہ نیچے ہوتا ہے۔
অর্থাৎ মিয়ারুল আওকাতের ১৪, ১৫, ২৫, ২৮ নং পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে আছে যে, সুবহে কাযিব হয় ১৮°-এ এবং সুবহে সাদিক হয় ১৫°-এ। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬৭; আরো দেখুন : আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৮৪)
আহসানুল ফাতাওয়ার এ কথা থেকে বোঝা যায়, ‘সুবহে কাযিব হয় ১৮°-এ এবং সুবহে সাদিক হয় ১৫°-এ’ কথাটি এভাবেই মিয়ারুল আওকাতের এ পৃষ্ঠাগুলোতে পরিষ্কার ভাষায় আছে। আহসানুল ফাতাওয়ার (২/১৮৪) কথা থেকে এটি আরো স্পষ্ট। সেখানে বলা হয়েছে-
اسی طرح نقشۂ مندرجہ معیار الاوقات میں 18 درجہ زیر افق کے اوقات دیئے ہیں، حالانکہ اس کتاب میں چار مختلف مقامات پر اس کی وضاحت موجود ہے کہ18 درجہ زیر افق صبح کاذب کا وقت ہے اور صبح صادق 15 درجہ زیر افق پر ہوتی ہے، نیز اس کتاب میں صبح کاذب کو کئی جگہ مطلق صبح سے تعبیر کیا ہے۔
আহসানুল ফাতাওয়ার এই কথা থেকেও এটিই বোঝা যায় যে, ‘সুবহে কাযিব হয় ১৮°-এ’ কথাটি এভাবেই স্পষ্ট ভাষায় মিয়ারুল আওকাতে আছে। আর কোথাও এর জন্য শুধু ‘সুবহ’ শব্দও ব্যবহার হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হল, মিয়ারুল আওকাতের এই পৃষ্ঠাগুলোতে সুবহে কাযিব শব্দই নেই। আছে কেবল ‘সুবহ’ ও ‘ফজর’ এই দুই শব্দ।
দুই.
এ কথা ঠিক যে, ১৮°-এ সুবহে কাযিব হয়- কথাটি এভাবে স্পষ্ট ভাষায় মিয়ারুল আওকাতে যদিও নেই, তবে এর পুরো আলোচনা পড়লে বোঝা যায়, তাতে ابتداء صبح বা طلوع صبح (‘সুবহ’-এর শুরু) বলে সুবহে কাযিবের শুরু বোঝানো হয়েছে এবং ابتداء فجر (ফজরের শুরু) বলে সুবহে সাদিকের শুরু উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। মিয়ারুল আওকাতের পুরো আলোচনার উপস্থাপনাভঙ্গি থেকে প্রতীয়মান হয়, সুবহে কাযিবকে صبح (সুবহ) শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা এবং সুবহে সাদিককে فجر (ফজর) শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা- এটি যেন শাস্ত্রীয় রীতি বা পরিভাষা। অথচ হাদীস-ফিকহ ও ইলমুল ফালাক (জ্যোতির্বিজ্ঞান) সব শাস্ত্রেই صبح (সুবহ) ও فجر (ফজর) উভয় শব্দ সমার্থক। একটির জায়গায় অপরটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর উভয় শব্দ দ্বারাই উদ্দেশ্য, সুবহে সাদিক। সুবহে কাযিবকে ‘কাযিব’ শব্দ ছাড়া শুধু ‘সুবহ’ বা ‘ফজর’ শব্দ দ্বারা উপস্থাপন করা হয় না। শুধু তাই নয়, আরবীতে ভাষাগত দিক থেকে ‘সুবহ’ শব্দের সাথে ‘কাযিব’ শব্দ ব্যবহার করাটাই মৌলিকভাবে অগ্রহণযোগ্য; বরং এক্ষেত্রে ‘কাযিব’ শব্দটি ‘ফজর’ শব্দের সাথে ব্যবহার হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুবহে সাদিকের আগের (দিগন্তের উপরে লম্বালম্বিভাবে প্রকাশিত) আলোটিকে ভাষাগতভাবে ‘আসসুবহুল কাযিব’ বলাটাই সমীচীন নয়; বরং ভাষার যথাযথ ব্যবহার অনুযায়ী এই আলোটির নাম ‘আলফাজরুল কাযিব’। পেছনে আমরা এর দালীলিক আলোচনা তুলে ধরেছি।
মোটকথা, আমরা যেটিকে সুবহে কাযিব বলে থাকি, আরবী ভাষা অনুযায়ী একে শুধু ‘সুবহ’ শব্দ দ্বারা তো উপস্থাপন করা হয়ই না; এর সাথে ‘কাযিব’ শব্দ যোগ করে ‘আসসুবহুল কাযিব’ বলাও ভাষার যথাযথ ব্যবহার নয়।
অতএব শুধু ‘সুবহ’ বলে তাতে সুবহে কাযিব উদ্দেশ্য নেওয়া এবং ব্যাপক রীতির মত করে এটিকে উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ রীতি বহির্ভূত।
আর মিয়ারুল আওকাতের এই রীতি অনুযায়ী ‘ابتداء فجر’ (ফজরের শুরু) দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক হওয়ার বিষয়টি যদি আহসানুল ফাতাওয়ার গ্রন্থাকার মেনে নেন তবে তো ভালোই। কেননা আলবেরুনী ও নাসীরুদ্দীন তূসীর বক্তব্যে ১৮°-এর সময়টিকে طلوع الفجر ও أول الفجر দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে। অতএব তাদের এই নীতি হিসেবেও আলবেরুনী ও নাসীরুদ্দীন তূসীর ১৮°-এর এই فجر (ফজর) দ্বারা উদ্দেশ্য সুবহে সাদিক হবে; সুবহে কাযিব নয়।
এ কথাটি আমরা বললাম আহসানুল ফাতাওয়ার নীতি অনুযায়ী। নতুবা আলবেরুনী ও তূসীর বক্তব্য দ্বারা যে সুবহে সাদিকই উদ্দেশ্য; সুবহে কাযিব নয়- তা তো স্বীকৃত বিষয়। এর অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে। যার বিবরণ আলহামদু লিল্লাহ আমরা পূর্বে তুলে ধরেছি।
তিন.
ফজরের নামাযের জন্য ভুল সময় প্রদান
এখন আসা যাক মিয়ারুল আওকাতে প্রদত্ত সময়সূচি প্রসঙ্গে। যা এখানে আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।
মিয়ারুল আওকাতে সূর্যোদয়ের পূর্বের মোট তিনটি সময় উল্লেখ করা হয়েছে। ابتداء وقت صبح বলে ১৮°-এর সময়। انتہائے وقت سحر (সেহরির শেষ সময়) বলে ১৮°-এরও দশ মিনিট আগের সময়। মিয়ারুল আওকাতে এই সময়ের বিবরণে বলা হয়েছে-
انتہائے وقت سحر: اس خانے میں سحری کا انتہائی وقت تاریخوار لکھا گیا ہے، اور سحری کا انتہائی وقت احتیاطا ابتداء صبح سے دس منٹ پہلے قرار دیا گیا ہے۔
অর্থাৎ انتہائے وقت سحر (সেহরির শেষ সময়) এই ঘরে সেহরির শেষ সময় সতর্কতামূলক নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সুবহ’-এর ১০ মিনিট আগে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৫)
তৃতীয় আরেকটি সময় ابتداء وقت فجر বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সময়ের বিবরণে মিয়ারুল আওকাতে বলা হয়েছে-
اس میں ابتداء وقت نماز فجر تاریخوار درج ہے۔ ابتداء نماز فجر کا وقت طلوع صبح سے بارہ منٹ بعد قرار دیا گیا ہے، کیونکہ طلوع صبح اور طلوع صبح صادق میں تین درجوں کا فرق ہوتا ہے۔
অর্থাৎ এই ঘরে ফজরের নামাযের ওয়াক্ত কখন শুরু হয় তা লেখা হয়েছে। ফজরের নামাযের ওয়াক্ত ‘সুবহ’-এর উদয়ের বারো মিনিট পর নির্ধারণ করা হয়েছে। কেননা ‘সুবহ’-এর উদয় আর সুবহে সাদিকের উদয়ের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান হয়ে থাকে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৫)
মিয়ারুল আওকাতের এই তিন সময়ের বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে, এতে ১৮°-এর সময়কে সুবহে কাযিব এবং ১৫°-এর সময়কে সুবহে সাদিক ধরা হয়েছে। আর এই হিসাব যে সম্পূর্ণ ইজমাপরিপন্থী ভুল দাবি, তা তো আমাদের পূর্বের আলোচনাগুলো থেকে সুস্পষ্ট। সুতরাং এখানে এর উপর পুনরায় আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই। এখানে আমরা এর অতিরিক্ত আরো যা যা অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি তাতে বিদ্যমান রয়েছে কেবল সেগুলোর আলোচনা তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
চার.
সেহরির সমাপ্তির জন্য ভুল সময় নির্ধারণ
আগেই বলা হয়েছে, মিয়ারুল আওকাতে ابتداء وقت صبح বলে ১৮°-এর যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে তাতে সেটি দ্বারা উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে সুবহে কাযিব। তাহলে প্রশ্ন হল, এতে সুবহে কাযিবের সময় (তাদের মত অনুযায়ী) উল্লেখ করার পরও সেহরির শেষ সময় বোঝানোর জন্য انتہائے وقت سحر (সেহরির শেষ সময়) বলে সুবহে কাযিবেরও দশ মিনিট আগের সময় (তাদের মত অনুযায়ী সুবহে সাদিকের ২২ মিনিট পূর্বের সময়) উল্লেখ করার বৈধতা কী? সেহরির ওয়াক্ত তো বাকি থাকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত। সুবহে কাযিব হয়ে গেলেও সেহরির সময় শেষ হয় না। সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত সেহরি খাওয়া জায়েয। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার করার কথা বলেছেন। [সূরা বাকারা (২) : ১৮৭] হাদীস শরীফেও এসেছে, ফাজরে কাযিব যেন তোমাদের সেহরি থেকে বাধা প্রদান না করে; বরং সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার কর। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭০৬)
সেহরির ক্ষেত্রে এই হচ্ছে কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ। সুবহে কাযিবের সময় পানাহার বন্ধ না করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু মিয়ারুল আওকাতে (নিজের কথা অনুযায়ী) সুবহে সাদিকের তিন ডিগ্রি (১২ মিনিট) আগে সুবহে কাযিবের সময় দেওয়া হল। আর সেহরির শেষ সময় বোঝানোর জন্য এরও ১০ মিনিট পূর্বের সময় দেওয়া হল!! কেমন উদ্ভট কাণ্ড!!! মানুষকে সুবহে সাদিকের এত দীর্ঘ সময় পূর্বেই সেহরি খাওয়া থেকে বিরত রাখা শরীয়তের হুকুমের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয়।
তারপর দেখুন, আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি হল, সময়সূচিতে সেহরির জন্য সতর্কতামূলক সুবহে কাযিবের সময় লেখা থাকে। বাস্তবতা ও শরীয়তের বিধান উভয় দিক থেকে যার অসারতা সম্পর্কে বিগত কিস্তিতে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু মিয়ারুল আওকাতের কথা হল, সেহরির শেষ সময় বোঝানোর জন্য সুবহে কাযিবের সময় দেওয়াও যথেষ্ট নয়! এর চেয়েও ১০ মিনিট আগের সময় উল্লেখ করতে হবে!! আসতাগফিরুল্লাহ। আহসানুল ফাতাওয়ার অনুসারীদের নিকটেই তো মিয়ারুল আওকাতের এই কা- গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
পাঁচ.
১৫°-এর সময়ের হিসাবে ভুল
এখন মিয়ারুল আওকাতের ফজরের সময় নির্ধারণের পদ্ধতিটি দেখার বিষয়। এ সম্পর্কে মিয়ারুল আওকাতের বক্তব্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে ১৫°-এ ফজরের ওয়াক্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৫°-এর সময় তাতে যে পদ্ধতিতে বের করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুল। ফলে সেখানে ১৫°-এ ফজরের ওয়াক্ত লেখার কথা বলা হলেও তাতে বিদ্যমান সময়সূচিতে অনেক ক্ষেত্রেই ১৫°-এর সময় না হয়ে এরও আগের সময় হয়ে গেছে। ১৫°-এ ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার দাবি আহসানুল ফাতাওয়া ও মিয়ারুল আওকাত উভয় কিতাবের যৌথ ভুল। কিন্তু এই ১৫°-এর সময় বের করার পদ্ধতিটি মিয়ারুল আওকাতের একক ভুল; যা আগের ভুলকে মারাত্মকভাবে ছাপিয়ে যায়। যা এর গ্রন্থাকারের ফালাকিয়াত বিষয়ক ইলমে প্রচ- রকমের ঘাটতির স্বাক্ষর রেখে যায় এবং যে ভুল বিদ্যমান থাকার পর আহসানুল ফাতাওয়ার জন্য এর উদ্ধৃতি টানার অবকাশ কোনোভাবেই থাকে না।
১৫°-এর সময় বের করার পদ্ধতি সম্পর্কে মিয়ারুল আওকাতে বলা হয়েছে-
ابتداء نماز فجر کا وقت طلوع صبح سے بارہ منٹ بعد قرار دیا گیا ہے، کیونکہ طلوع صبح اور طلوع صبح صادق میں تین درجوں کا فرق ہوتا ہے۔
অর্থাৎ এতে ফজরের নামাযের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সুবহ’-এর (অর্থাৎ ১৮°-এর) ১২ মিনিট পর। কারণ ‘সুবহ’-এর উদয় আর সুবহে সাদিকের উদয়ের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৫)
অর্থাৎ এতে ১৮°-এর সময় থেকে ডিগ্রি প্রতি ৪ মিনিট হিসাব করে ১৫°-এর সময় এভাবে বের করা হয়েছে যে, ১৫°-এর সময় হয় ১৮°-এর (৩দ্ধ৪=) ১২ মিনিট পর।
এক্ষেত্রে ডিগ্রির সময় বের করার এই পদ্ধতি যে বিরাট ভুল, তা আমরা গত সংখ্যাতেই তুলে ধরেছি। অ্যাস্ট্রোনমির বিভিন্ন বইপত্র থেকে, এমনকি আহসানুল ফাতাওয়ার বক্তব্য দ্বারাও হিসাবটি ভুল হওয়ার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
মূলত এক্ষেত্রে ডিগ্রির সময়, চাই তা ১৮° হোক বা ১৫°, প্রতি ডিগ্রির সময় নির্ণয়ের জন্য শাস্ত্রীয় একটি নির্ধারিত ফর্মুলা রয়েছে। সেই ফর্মুলা অনুযায়ীই এই ডিগ্রির সময় বের করতে হবে। কিন্তু মিয়ারুল আওকাতে শাস্ত্রীয় কোনো ফর্মুলা অনুযায়ী ১৫°-এর সময় নির্ণয় করা হয়নি। হয়ত কোনো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল আলম্যানাকের সহযোগিতায় ১৮°-এর সময় বের করে নেওয়া হয়েছে। আর এর সাথে ১২ মিনিট যোগ করেই ১৫°-এর সময় বের করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে এতে ১৫°-এর কথা বলা হলেও বাস্তবে সবক্ষেত্রে সেটি ১৫°-এর সময় থাকেনি।
এর ব্যাখ্যা হল, মিয়ারুল আওকাতে বিষুবীয় অঞ্চলের বাইরের এলাকারও সময়সূচি দেওয়া আছে। এতে হায়দ্রাবাদ, ভুপাল, লখনৌ ও দিল্লি- হিন্দুস্তানের এই চারটি শহরের বছরের প্রতি দিনের সময়সূচি প্রদান করা হয়েছে এবং প্রতি শহরের অবস্থান কত অক্ষাংশ ধরে সময়ের হিসাব করা হয়েছে তাও লেখা হয়েছে। হায়দ্রাবাদের অক্ষাংশ তাতে লেখা হয়েছে, ১৭ ডিগ্রি ২১ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। ভুপালের অক্ষাংশ ২৩ ডিগ্রি ১৫ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। লখনৌর অক্ষাংশ ২৬ ডিগ্রি ৫০ মিনিট। দিল্লির অক্ষাংশ ২৮ ডিগ্রি ৩৯ মিনিট। কিন্তু এই চার শহরের জন্যই এবং বছরের সব তারিখেই ১৮°-এর সময়ের সাথে ১২ মিনিট যোগ করে ১৫°-এর সময় প্রদান করা হয়েছে। যা নিতান্তই ভুল। এমনটি করার কারণে দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গার সময়সূচিতে ১৫°-এর যে সময় তাতে দেওয়া হয়েছে সেটি মূলত ১৫°-এর সময় নয়; বরং ঠিক ১৫°-এর সময় থেকে নিয়ে এর পাঁচ মিনিট, বরং এর চেয়ে কিছু আগের সময়ও হয়ে গেছে। ডিগ্রি হিসেবে যা প্রায় ১৬° পর্যন্ত হয়ে যায়।
যেমন এখানে আমরা দিল্লির দুইটি তারিখের সময়সূচির বিবরণ তুলে ধরছি। মিয়ারুল আওকাতে দিল্লির দ্রাঘিমাংশ লেখা হয়েছে ৭৭:১৭ (৭৭.২৮৩°) এবং অক্ষাংশ ২৮:৩৯ (২৮.৬৫°)। আর তাতে ১ জানুয়ারি উক্ত স্থানে ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে ৫:৪৯ মিনিট। এবং ফজরের সময় (বারো মিনিট পর হিসেবে) লেখা হয়েছে ৬:১ মিনিট। (মিয়ারুল আওকাত ১/১০৮) অথচ শাস্ত্রীয় হিসাব অনুযায়ী সেখানে ১ম জানুয়ারি ১৫°-এর সময় হয় ৬:০৩ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে। ৬:১ মিনিটে সূর্য দিগন্তের ১৫.৬° নিচে থাকে।
আর সেখানে ২১ জুন ১৮°-এর সময় লেখা হয়েছে ৩:৪৯ মিনিট। এর বারো মিনিট পর হিসেবে তাতে ফজরের সময় লেখা হয়েছে ৪:০১ মিনিট। (মিয়ারুল আওকাত ১/১১৮) অথচ শাস্ত্রীয় হিসাব অনুযায়ী সেখানে ২১ জুন ১৫°-এর সময় হয় ৪:০৬ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডে। ৪:০১ মিনিটে সেখানে মূলত ১৬°-এর সময় হয়।
তাহলে দেখা গেল, মিয়ারুল আওকাতে ফজরের যে সময় দেওয়া হয়েছে তা আহসানুল ফাতাওয়ার দৃষ্টিতেই ভুল। কেননা আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি অনুযায়ী ১৫°-এর আগে সুবহে সাদিক শুরুই হয় না। অথচ মিয়ারুল আওকাতে ১৬ ডিগ্রিতেও ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার হিসাব দেওয়া আছে। অতএব এই সময়সূচি আহসানুল ফাতাওয়ার প্রমাণ হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না।
মোটকথা, মিয়ারুল আওকাতের এই হিসাব অ্যাস্ট্রোনমির কোনো নিয়ম-কানুনেই পড়ে না। শাস্ত্রীয় কোনো ফর্মুলাই তাতে অনুসরণ করা হয়নি। যার ফলে তাতে ১৫°-এর যে সময় দেওয়া হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে সেটিকে বাস্তবে সুনির্ধারিত কোনো ডিগ্রির সময় বলা সম্ভবই নয়। অতএব মিয়ারুল আওকাতে ফজরের ক্ষেত্রে ১৫°-এর সময় উল্লেখ করা হয়েছে এ কথাই বাস্তবতার বিচারে সঠিক থাকছে না।
ছয়.
এশার ওয়াক্তের ক্ষেত্রে মাযহাব বর্ণনা ও ‘মুফতা বিহী’ মত নির্ণয়ে ভুল
এ তো গেল সেহরি ও ফজরের ওয়াক্ত সম্পর্কিত মিয়ারুল আওকাতের বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তির বিবরণ। এখন মাগরিবের ওয়াক্ত কখন শেষ হয় এবং এশার ওয়াক্ত কখন শুরু হয় এ ব্যাপারে মিয়ারুল আওকাতের বক্তব্য আমরা তুলে ধরছি। সেখানেও মিয়ারুল আওকাতের অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এশার ওয়াক্ত সম্পর্কে তাতে বলা হয়েছে-
ابتداء وقت عشاء: اس میں تاریخوار غروب شفق احمر کے اوقات لکھے ہیں، اس وقت مغرب کا وقت ختم اور عشاء کا وقت شروع ہوتا ہے۔
এখানে প্রথমে বলা হয়েছে, ابتداء وقت عشاء (এশার ওয়াক্ত শুরু)-এর ঘরে তারিখ অনুযায়ী শাফাকে আহমারের সময় লেখা হয়েছে। তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয় এবং এশার ওয়াক্ত শুরু হয়। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৬)
মিয়ারুল আওকাতেই এর টীকায় আরো বলা হয়েছে-
اگرچہ امام صاحب سے ایک روایت ہے کہ غروب شفق ابیض سے عشاء کا وقت شروع ہوتا ہے، اس بنا پر زمانہ صبح اور زمانہ شفق مساوی ہوگا، لیکن یہ قول مفتی بہ نہیں ہے، اس لئے اس کتاب میں اس کا اندراج نہیں کیا گیا، اگر کوئی اسکو دریافت کرنا چاہیں تو مندرجہ ابتداء وقت عشاء پر ২৫ منٹ بڑھا کر معلوم کر سکتے ہیں۔
অর্থাৎ যদিও ইমাম সাহেব (আবু হানীফা রাহ.) থেকে একটি বর্ণনা আছে যে, শাফাকে আবইয়ায শেষ হলে এশার ওয়াক্ত শুরু হয় এবং এই মত অনুযায়ী ‘সুবহ’ ও ‘শাফাক’ উভয়টির মোট সময় সমপরিমাণের হয়ে যায়। কিন্তু এই বর্ণনাটি ‘মুফতা বিহী’ নয়। এজন্য এই কিতাবে এর সময় দেওয়া হয়নি। অবশ্য কেউ যদি এর সময় জানতে চায় তাহলে ابتداء وقت عشاء -এর ঘরে প্রদত্ত সময়ের সাথে আরো ২৫ মিনিট যোগ করলেই শাফাকে আবইয়াযের সময় বেরিয়ে আসবে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৬)
মিয়ারুল আওকাতের এই বক্তব্যটির উপর আমাদের কথা হল, শাফাকে আবইয়াযের পর এশার ওয়াক্ত হওয়ার বিষয়টি ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে একটি বর্ণনায় আছে- বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করাটা সঠিক নয়। কারণ, শাফাকে আবইয়াযের পর এশার ওয়াক্ত হওয়ার কথাটিই ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মত ও মূল বক্তব্য। ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে এটিই ‘যাহিরুর রিওয়ায়াহ’। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. কিতাবুল আছলে ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর এই মতই উল্লেখ করেছেন। কিতাবুল আছলে আছে-
قلت: أرأيت المغرب متى هو؟ قال: من حين تغرب الشمس إلى أن يغيب الشفق. قلت: وتَكره أن يؤخرها إذا غابت الشمس؟ قال: نعم. والشفق البياض المعترض في الأفق في قول أبي حنيفة. وفي قول أبي يوسف ومحمد: الحمرة.
এখানে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বলেছেন, ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মতে এশার ওয়াক্ত হয় শাফাকে আবইয়াযের পর থেকে। শাফাকে আহমারের পর এশার ওয়াক্ত হওয়ার মতটি ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাাদ রাহ.-এর। (কিতাবুল আছল ১/১২৩)
সুতরাং ‘ইমাম সাহেব থেকে একটি বর্ণনায় আছে’ বলে শাফাকে আবইয়াযের মতকে উল্লেখ করা বাস্তবতার খেলাফ কথা।
দ্বিতীয়ত, তাতে এরপর বলা হয়েছে, শাফাকে আবইয়াযের মতটি ‘মুফতা বিহী’ নয়। এ কথাও ঠিক নয়; বরং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক ফকীহই এই মতকে গ্রহণ করেছেন এবং একে সহীহ ও ‘মুফতা বিহী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী ফকীহগণের মধ্যে ইমাম আবু বকর জাস্সাস রাহ. (৩৭০ হি.) ও ইমাম কুদুরী রাহ. (৪২৮ হি.) শাফাকে আবইয়াযের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (দেখুন : শরহু মুখতাসারিত তাহাবী, জাস্সাস ১/৫০২; আততাজরীদ, কুদুরী ১/৩৪৯)
আল্লামা ইবনুল হুমাম রাহ. (৮৬১ হি.), আল্লামা কাসিম ইবনে কুতলুবুগা রাহ. (৮৭৯ হি.), ইবনে নুজাইম রাহ. (৯৭০ হি.)সহ পরবর্তী অনেক ফকীহও এই মতটিকে গ্রহণ করেছেন ও প্রাধান্য দিয়েছেন। (দেখুন : ফাতহুল কাদীর ১/২২২; আততাসহীহ ওয়াততারজীহ আলা মুখতাসারিল কুদুরী, পৃ. ৬৪; আলবাহরুর রায়েক ১/২৫৮; মাজমাউল আনহুর ১/৭০; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাল মারাকী, পৃ. ১৭৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫১)
আকাবির উলামায়ে হিন্দের অধিকাংশ ফতোয়ার কিতাবেও শাফাকে আবইয়াযের মতকেই গ্রহণ করে ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে। দেখুন : ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৯৫, ৯৯; বাওয়াদিরুন নাওয়াদির ১/৪৩০; ইমদাদুল আহকাম ১/৪০৭, ৪১০; কেফায়াতুল মুফতী ৩/৪৭৬; ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ ২/৪১, ৪৩; ফাতাওয়া রহীমিয়া ৪/৭৯; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৫/৩৪৪; ফাতাওয়া উসমানী ১/৩৬০
এ ফতোয়াগুলোর উপর ভিত্তি করে এই উপমহাদেশে হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণের ব্যাপক আমল শাফাকে আবইয়ায অনুযায়ীই চলে আসছে। অতএব শাফাকে আবইয়াযের মতকে ‘মুফতা বিহী’ নয় বলা এবং যে অঞ্চলে এই মতটি আমলীভাবে প্রচলিত সেখানে ভিন্নমত চালিয়ে দেওয়া খুবই অন্যায় কাজ।
সাত.
শাফাকে আহমার ও আবইয়াযের সময় নির্ধারণে ভুল
এই সময়সূচির আরেক বড় ভুল হল, তাতে শাফাকে আহমারের শেষ সময় হিসাব করা হয়েছে ১২°-এ। এতে বলা হয়েছে-
شفق احمر کا زمانہ صبح کے زمانہ سے ہوتا ہے۔
অর্থাৎ শাফাকে আহমারের মোট সময়ের পরিমাণ ‘সুবহ’-এর মোট সময়ের দুই তৃতীয়াংশের সমান হয়ে থাকে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৬)
আর মিয়ারুল আওকাতে ‘সুবহ’-এর শুরু ধরা হয়েছে ১৮° থেকে। আর ১৮ এর দুই তৃতীয়াংশ হচ্ছে, (১৮÷৩×২=) ১২। তার মানে, এই সময়সূচিতে শাফাকে আহমারের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২°-এ। অথচ ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা পেছনে দলীল-প্রমাণসহ আলোচনা করে এসেছি, মুসলিম ফালাকীগণের দৃষ্টিতে ১৪°-এ শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথাই ভুল। এমনকি ১৬°-এ শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথাও তাদের নিকট দুর্বল। তাদের নিকট নির্ভরযোগ্য মত অনুযায়ী শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৭°-এ। যার কিছু উদ্ধৃতি পেছনে (ফেব্রুয়ারি ’২০২২ সংখ্যায়) তুলে ধরা হয়েছে। এপ্রিল-মে ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত এই লেখাটির প্রথম কিস্তিতে ফালাকীগণ থেকে এর বেশ কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হয়েছিল। তাছাড়া বর্তমান কালেও ১৬°-এর পরও শাফাকে আহমার মুশাহাদার প্রমাণ রয়েছে। যার বিবরণও পেছনে তুলে ধরা হয়েছে।
অতএব যেখানে শাস্ত্রজ্ঞ ফালাকীগণের মতে শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৭°-এ এবং তাঁরা যেখানে ১৬°-এর বক্তব্যকেই দুর্বল বলছেন, এবং ১৪°-এর কথাকে সম্পূর্ণ ভুল আখ্যায়িত করেছেন সেখানে ১২°-তেই শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলা কত বড় ভুল ও বাস্তবতা-বিরোধী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
মূলত যারা ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলেন তাদের সূত্র বিরজান্দী ও খলীল কামেলী রাহ.-এর দুই বক্তব্য। একদিকে বিরজান্দী রাহ. থেকে ১৫°-এ শাফাকে আবইয়ায শেষ হয়ে যাওয়ার কথাটি নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে খলীল কামেলী রাহ. থেকে শাফাকে আবইয়ায ও শাফাকে আহমারের মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধানের বক্তব্যটি নেওয়া হয়েছে। এ দুটিকে জোড়া লাগিয়ে ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কথা বের করা হয়েছে। ব্যস, ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কথাটির সূত্র এ ছাড়া আর কিছু নয়। আর শাস্ত্রজ্ঞ ফালাকীগণের মুশাহাদা ও তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এ কথাটি সুস্পষ্ট ভুল ও বাস্তবতা-বিরোধী হওয়ার বিষয়টি তো আছেই। এমনকি এ কথাটি এমনই ভুল ও বাস্তবতা-বিরোধী যে, স্বয়ং বিরজান্দী ও খলীল কামেলী রাহ., যাদের বক্তব্যকে জোড়া লাগিয়ে ১২°-এর হিসাব দাঁড় করানো হয়েছে, তাদের কারো বক্তব্যেও ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কথা নেই। বরং খলীল কামেলী রাহ.-এর বক্তব্যে আছে উল্টো কথা। তার বক্তব্যে আছে, শাফাকে আহমার শেষ হয় ১৫°-এ। যা সরাসরি তার কিতাব থেকে পেছনে তুলে ধরা হয়েছে। অতএব খলীল কামেলী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ীই ১২°-এ শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কথাটি ভুল সাব্যস্ত হয়। যদিও খলীল কামেলী রাহ.-এর ১৫°-এ শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার কথাটিও ফালাকীগণের দৃষ্টিতে সহীহ নয়।
আট.
মিয়ারুল আওকাতের আগের বক্তব্যটিতে আরেকটি বড় অসংলগ্ন দিক বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এতে বলা হয়েছে, শাফাকে আবইয়াযের মতটি যেহেতু ‘মুফতা বিহী’ নয় তাই এর সময় এই ‘সময়সূচি’তে উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য যদি কেউ এর সময় জানতে চায় তবে শাফাকে আহমারের সময়ের সাথে আরো ২৫ মিনিট যোগ করলেই শাফাকে আবইয়াযের সময় জানা যাবে। (মিয়ারুল আওকাত ১/২৬)
এখানে শাফাকে আবইয়াযের সময় জানার জন্য শাফাকে আহমারের সময়ের সাথে ২৫ মিনিট যোগ করতে বলা হয়েছে। আর মিয়ারুল আওকাতেই আছে যে, শাফাকে আহমার শেষ হয় ১২°-এ। তাহলে ভেবে দেখার বিষয়, ১২°-এর সময়ের সাথে ২৫ মিনিট যোগ করলে কত ডিগ্রির সময় বের হবে? ১৫°-এর না ১৮°-এর? ১২° থেকে ১৫° -এর মাঝে তিন ডিগ্রি ব্যবধান। এই তিন ডিগ্রির সময় তো আর ২৫ মিনিট হয়ে যাবে না। বরং মিয়ারুল আওকাতেই সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিবের ক্ষেত্রে ডিগ্রি প্রতি ৪ মিনিট সময় হিসাব করা হয়েছে। সে হিসেবে ২৫ মিনিটে হয় (২৫÷৪=) ৬.২৫°। ২৫ থেকে এক মিনিট কম ধরে ২৪ মিনিটে হয়ে থাকে (২৪÷৪=) ৬°। আমরা এখানে ৬ ডিগ্রিই ধরে নিলাম। আর ১২+৬=১৮°। অর্থাৎ ১২°-এর সময়ের সাথে ২৪ মিনিট (২৫ থেকে ১ মিনিট কম) যোগ করলেও (মিয়ারুল আওকাতের নিয়ম অনুযায়ী) ১৮°-এর সময় হয়।
তাহলে বিষয়টি কী দঁড়াল? মিয়ারুল আওকাতের বক্তব্য অনুযায়ী শাফাকে আহমার শেষ হয় ১২°-এ এবং শাফাকে আবইয়ায শেষ হয় ১৮°-এ! অর্থাৎ শাফাকে আহমার ও শাফাকে আবইয়ায দুটির মাঝে ব্যবধান ৬°-এর!! অথচ বিশেষজ্ঞ ফালাকীগণের মতে শাফাকে আহমার ও শাফাকে আবইয়াযের মাঝে ব্যবধান মাত্র ২°-এর। শাফাকে আহমার শেষ হওয়ার ২° পরই শাফাকে আবইয়ায শেষ হয়ে যায়। অতএব মিয়ারুল আওকাতের এটি কেমন উদ্ভট কথা নিজেরাই বিবেচনা করুন!! তাছাড়া যার নিকট শাফাকে আহমার শেষ হয় ১২°-এ তার পক্ষেই আবার শাফাকে আবইয়ায ১৮°-এ শেষ হওয়ার কথা বলা কীভাবে সম্ভব?! পক্ষান্তরে একদিকে সুবহে সাদিক ১৫°-এ হওয়ার কথা বলে অপরদিকে শাফাকে আবইয়ায ১৮°-এ শেষ হওয়ার কথা বলা, তেমনি ১৮°-এ (ভোরের সময়) সুবহে কাযিব হওয়ার দাবি করে ১৮ ডিগ্রিতেই (সন্ধ্যার পর) শাফাকে আবইয়ায শেষ হওয়ার কথা বলা কী পরিমাণ অসংলগ্ন ও স্থূল ভুল তা আর বলার অপেক্ষো রাখে না। একজন সময়সূচির ক্যালেন্ডার প্রস্তুতকারীর যদি এইরকম স্থূল ভুল হয় তবে তার জন্য নামায-রোযার সময়সূচি প্রস্তুত করার কোনো বৈধতাই থাকে না।
মিয়ারুল আওকাত উলামায়ে কেরাম দ্বারা সত্যায়িত হওয়ার দাবি সঠিক নয়
মোটকথা, মিয়ারুল আওকাতে শাস্ত্রীয় দিক থেকে বিরাট বিরাট অসঙ্গতি ও উদ্ভট ধরনের ভুল তো রয়েছেই। এমনকি তাতে একাধিক এমন অসঙ্গতিও রয়েছে, যা আহসানুল ফাতাওয়া অনুযায়ীও ভুল। অতএব এমন বহু কাঁচা কাঁচা ভুল নিয়ে এই সময়সূচি গ্রহণযোগ্যতার কাতারেই উঠতে পারে না। প্রমাণযোগ্য হওয়া তো অনেক দূরের কথা!
সামনে আমরা এই সময়সূচি সম্পর্কে জামেয়া ইসলামিয়া কাশিফুল উলূম আওরঙ্গবাদ থেকে প্রকাশিত : دائمی تقویم حقائق اور فتاویٰ کی روشنی میں নামক পুস্তিকা থেকে একটি বক্তব্য তুলে ধরছি। পুস্তিকাটি লেখাই হয়েছে মিয়ারুল আওকাতের ভুলের খণ্ডনে। এই পুস্তিকার ভূমিকায় আওরঙ্গবাদের শীর্ষস্থানীয় আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা রিয়াযুদ্দীন ফারুকী নদবী রাহ. লিখেছেন-
آج سے تقریبا ساٹھ ستر برس پہلے جناب بسم اللہ خان صاحب مرحوم وظیفہ یاب ساکن نزدپوسٹ آفس نے معیار الا وقات شہر حیدرآباد کے اوقات صلوة کی دائمی تقویم سے اورنگ آباد کے اوقات صلوة کی دائمی تقویم تیار کر کے اس کی نقلیں شہر کی تمام مساجد میں آویزاں فرمائی تھی۔ اسی کو بنیاد بنا کر دار العلوم اورنگ آباد نے ایک تختہ اوقات صلوة شائع کیا۔
معيار الاوقات کے مرتب جناب عبدالواسع صاحب سے اس دائمی تقویم میں ابتدائے فجر اور ابتدائے وقت عشاء کی تخریج میں بڑی بھاری غلطی ہوئی۔ انہوں نے ابتدائے فجر کے موقع پر آفتاب کو ১৫ درجے مشرق میں زیر افق اور ابتدائے وقت عشاء میں ১২ درجے مغرب میں زیر افق ماناہے۔ جب کہ تمام ماہرین ہیئت اور مفتیان کرام ان دونوں موقعوں پر آفتاب کو ৮ا درجے زیر افق مانتے ہیں۔
... معيار الاوقات کی یہی غلطی اورنگ آباد تختہ اوقات صلوۃ میں منتقل ہوگئی۔ کیونکہ اس تختہ کے اولین مرتب جناب بسم اللہ خان صاحب عالم نہیں تھے۔ اس لئے انہیں اس غلطی کا ادراک نہیں ہوسکا۔
... مخفی مباد کہ معیار الاوقات میں صرف شہر حیدرآباد کے اوقات صلاۃتخریج نہیں ہے، بلکہ اس کے علاوہ تین اور شہر دہلی، لکھنو اور بھوپال کے اوقات صلاۃ کی تخریج بھی ہے، اور ان تینوں شہروں کی تقویم میں صاحب معیار الاوقات نے ابتداء فجراور ابتداء وقت عشاء میں وہی غلطی دہرائی، جس کو ہر جگہ کے علماء نے مسترد فرمایا۔
یکم جنوری کو معیار الاوقات کے مطابق
متعلقہ شہروں کی مروجہ تقویم کے مطابق
مندرجہ بالا گوشوارے سے یہ بات واضح ہوگئی کہ معیار الاوقات کے غلط اوقات فجر وعشاء کو مقامی علماء کرام نے مسترد فرماکر صحیح اوقات فجر اور عشاء پر مشتمل تقویم شائع فرمائی...۔
এখানে তিনি বলেছেন, মিয়ারুল আওকাতে ফজর ও এশার ওয়াক্ত নির্ণয়ে জনাব আবদুল ওয়াসি‘ সাহেব থেকে বিরাট ভুল হয়ে গেছে। তিনি এতে ফজরের ওয়াক্ত নির্ধারণ করেছেন ১৫°-এ এবং এশার ওয়াক্ত ১২°-এ। অথচ বিশেষজ্ঞ সকল জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং মুফতিয়ানে কেরাম ফজর ও এশা উভয়টির ওয়াক্ত ১৮° থেকে হিসাব করে থাকেন। মিয়ারুল আওকাতের এই ভুল সময় আওরঙ্গবাদের সময়সূচির ক্যালেন্ডারে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। কারণ, এর প্রথম সংকলক জনাব বিসমিল্লাহ খান আলেম ছিলেন না। তাই তিনি এই ভুল ধরতে পারেননি।
আর মিয়ারুল আওকাতে শুধু হায়দ্রাবাদেরই নয়; বরং দিল্লি, লাখনৌ ও ভুপালেরও সময়সূচি দেওয়া হয়েছে। এই তিন শহরের সময়সূচিতেও ফজর ও এশার ওয়াক্তের ক্ষেত্রে মিয়ারুল আওকাতের এই ভুল হয়েছে। যাকে প্রত্যেক শহরের আলেমগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেমন মিয়ারুল আওকাতে ১ম জানুয়ারি দিল্লিতে ফজরের ওয়াক্ত লেখা হয়েছে ৬:০১ মিনিট এবং এশার ওয়াক্ত ৬:৩৫ মিনিট। অথচ হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়াতুল্লাহ রাহ.-কৃত দিল্লির সময়সূচিতে এই তারিখে ফজরের ওয়াক্ত লেখা হয়েছে ৫:৪৯ মিনিট এবং এশার ওয়াক্ত ৬:৫৯ মিনিট। লাখনৌ-এর জন্য মিয়ারুল আওকাতে ১ম জানুয়ারি ফজরের ওয়াক্ত লেখা হয়েছে ৫:৪৫ মিনিট এবং এশার ওয়াক্ত ৬:২৩ মিনিট। কিন্তু মাওলানা (আলী) যাইবিনী রাহ. প্রণিত সময়সূচিতে লাখনৌর জন্য ফজর ও এশার ওয়াক্ত লেখা হয়েছে যাথাক্রমে ৫:২৫ মিনিট ও ৬:৫৩ মিনিট। মিয়ারুল আওকাতে ভুপালের জন্য ৫:৫৩ মিনিটে ফজরের ওয়াক্ত এবং ৬:৪১ মিনিটে এশার ওয়াক্ত লেখা হয়েছে। অথচ দারুল কাযা ভুপাল-কৃত সময়সূচিতে উভয় ওয়াক্তের সময় প্রদান করা হয়েছে যথাক্রমে ৫:৪১ ও ৭:০৬ মিনিট।
এর থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মিয়ারুল আওকাত কর্তৃক প্রদত্ত ফজর ও এশার ওয়াক্তকে প্রত্যাখ্যান করে প্রত্যেক শহরের স্থানীয় উলামায়ে কেরাম উভয়টির সঠিক সময়সম্বলিত সময়সূচির ক্যালেন্ডার প্রচার করেছিলেন।
দেখুন-
دائمی تقویم : حقائق اور فتاویٰ کی روشنی میں ، شائع کردہ: شعبہ نشر واشاعت جامعہ اسلامیہ کاشف العلوم اورنگ آباد،ص৩-১۔
এই বক্তব্য থেকে বিষয়টি পরিষ্কার যে, মিয়ারুল আওকাত সবার নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। বরং এর সংকলনের সময় এবং এর আগে ও পরে ১৮° অনুযায়ী প্রণীত বিভিন্ন সময়সূচিরই অনুসরণ করা হত।
আমরা পেছনে তুলে ধরেছি যে, হযরত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রাহ. (১১৭৬ হি.) মুনাজ্জিম খাইরুল্লাহ প্রণীত সময়সূচি পছন্দ করতেন; যাতে সুবহে সাদিক ১৮° অনুযায়ী নির্ণয় করা হয়েছে। যে অনুযায়ী আকাবির উলামায়ে দেওবন্দের নিকট পরবর্তীতেও ব্যাপকভাবে এই সময়সূচিই পছন্দনীয়। তাছাড়া হাফিজ মুহাম্মাদ আ‘লা মিরাঠী কৃত সময়সূচিও ১৮° অনুযায়ী প্রণীত। যার সত্যায়ন করেছিলেন শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ.-সহ অনেক আকাবির উলামায়ে দেওবন্দ। হযরত হাকীমুল উম্মাত থানবী রাহ.-এর তৈরিকৃত একটি সময়সূচিও আছে الساعات للطاعات নামে। সেটিও ১৮° অনুযায়ী প্রণীত। হযরত মাওলানা আবদুল কাদির রায়পুরী রাহ.-এর পছন্দকৃত رحيمى دوامی جنترى নামক নামাযের একটি চিরস্থায়ী সময়সূচিও প্রচলিত ছিল। তাও ১৮° অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত।
বর্তমানেও হিন্দুস্তানে ব্যাপকভাবে ১৮° অনুযায়ী প্রণীত বিভিন্ন সময়সূচিই প্রচলিত। তন্মধ্যে একটি হল, দারুল উলূম দেওবন্দের পক্ষ থেকে হযরত মাওলানা আসলাম কাসেমী রাহ. কর্তৃক প্রস্তুতকৃত قاسمی جنتری। পুরো হিন্দুস্তানের জন্য মাওলানা মুহাম্মাদ আনাস কর্তৃক প্রস্তুতকৃত دائمی اوقات الصلوٰۃ -ও বর্তমান উলামায়ে হিন্দের কাছে ব্যাপকভাবে প্রহণযোগ্য।
এই সময়সূচিটি সংকলকের একক কর্ম
মোটকথা, এই উপমহাদেশে মিয়ারুল আওকাত সংকলনের অনেক আগে থেকেই ১৮° অনুযায়ী প্রণীত সময়সূচি অনুযায়ী আমল চলে আসছিল। এবং যে যুগে মিয়ারুল আওকাতের সংকলন হয়েছে সে যুগেই পাক-ভারত উপমহাদেশজুড়ে ১৮° অনুযায়ী প্রণীত সময়সূচি অনুযায়ীই ব্যাপক আমল ছিল। তারপর থেকে এখন পর্যন্তও পুরো উপমহাদেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে ১৮° অনুযায়ী প্রণীত সময়সূচি অনুযায়ীই আমল চলমান। এ থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট যে, মিয়ারুল আওকাত শুরুলগ্ন থেকেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি।
কিন্তু এতসব ভুলে ভরপুর অগ্রহণযোগ্য এই সময়সূচি সম্পর্কে আহসানুল ফাতাওয়ায় দাবি করা হয়েছে-
معیار الاوقات، اس کتاب کے سر ورق پر یہ عبارت تحریر ہے "مصنفہ مولوی عبد الواسع صاحب پروفیسر دینیات کلیہ جامعہ عثمانیہ متفقہ مجلس علماء منعقدہ محکمہ صدارت عالیہ سرکار عالی منظورہ بارگاہ خسروی جہاں پناہی حیدرآباد دکن"، اس سے ثابت ہوا کہ اس کتاب کی صحت پر علماء کی ایک ایسی مجلس کا اتفاق ہے جسے نواب حیدرآباد دکن نے متعین کیا تھا، پھر نواب صاحب نے اس کتاب کی تحقیقات کو منظور فرمایا۔
অর্থাৎ এই কিতাবের প্রচ্ছদে লেখা আছে-
متفقہ مجلس علماء منعقدہ محکمہ صدارت عالیہ سرکار عالی منظورہ بارگاہ خسروی جہاں پناہی حیدرآباد دکن۔
এই কথা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এই কিতাবের গ্রহণযোগ্যতার উপর উলামায়ে কেরামের এমন একটি মজলিসের ঐকমত্য ছিল, যাদেরকে হায়দ্রাবাদের নবাব নির্বাচন করেছিলেন এবং নবাব সাহেবও এই কিতাবের তাহকীকসমূহের অনুমোদন করেছিলেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ২/১৬৭)
এটিও আহসানুল ফাতাওয়ার এমন আরেক দাবি, যার বাস্তব কোনো প্রমাণ নেই। এক্ষেত্রে বরং বাস্তবতা হল, এই সময়সূচি কেবল প্রফেসর আবদুল ওয়াসি‘ সাহেবের একার কাজ। সম্পূর্ণ এককভাবেই তিনি এটি প্রস্তুত করেছেন। যার প্রমাণ মিয়ারুল আওকাতেই বিদ্যমান রয়েছে। মিয়ারুল আওকাতের ভূমিকায় তিনি নিজেই বলেছেন-
میرے دل میں یہ خیال پیدا ہوا کہ بلدۂ حیدرآباد دکن کے لئے حسابات شمسی کی ایک ایسی تقویم مرتب کروں کہ جس میں ہمیشہ آفتاب کا طلوع وغروب شرعی اور رمضان میں سحری افطار اور نماز پنج گانہ کے اوقات کی ابتدا وانتھا معلوم ہو سکے، تاکہ اس شہر کے مسلمانوں کو اپنے فرائض مذہبی کے ادا کرنے میں آسانی ہو۔ لیکن اب تک میں اپنے اس خیال کو پورا کرنے سے اس وجہ سے قاصر رہا کہ ... اور شہر میں آج کل طاعون شائع ہونے کی وجہ سے کالج میں بھی تعطیل ہو گئی، اور بیماری کی زیادتی سے کچھ ایسے پریشانی پھیلی کہ جو لوگ مکان پر پڑھنے آتے تھے وہ بھی نقل مقام کر کے چلے گئے، ان وجوہ سے مجھے اپنا خیال پورا کرنے کا موقع ملا، اور چونکہ وقت بہت تھا لہذا خیال میں بھی وسعت ہو گئی۔
এখানে তিনি বলেছেন, অনেকদিন ধরেই তাঁর এই সময়সূচি তৈরির ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এর জন্য সময় বের করতে পারছিলেন না। এর মধ্যে শহরে মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটে। ফলে দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ থাকে। মহামারিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যারা বাড়িতে পড়তে আসত তারাও স্থানান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যায়। তখন তার এই সময়সূচি তৈরির ইচ্ছা পূরণের সুযোগ হয়। এই একাকীত্বের সময় তিনি এই ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। (মিয়ারুল আওকাত ১/২-৩)
এই হচ্ছে সংকলকের কলমে এর সংকলনের ইতিহাস। মহামারিতে সম্পূর্ণ একাকীত্বে যার সংকলনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর থেকে ভিন্ন কোনো কথা তাতে নেই। মিয়ারুল আওকাতের এই পুরো ভূমিকায়, এমনকি কিতাবের অন্য কোথাও এ কথা নেই যে, তিনি এই সময়সূচি উলামায়ে কেরামের মজলিসে পেশ করেছেন এবং আলেমগণ এর সত্যায়ন করেছেন। অথচ বাস্তবেই এর সত্যায়নে উলামায়ে কেরামের এমন গুরুত্বপূর্ণ মজলিস হয়ে থাকলে এই কিতাবের ভেতর অবশ্যই এর বিবরণ থাকত। কখন এই মজলিস হয়েছে? কোন্ কোন্ আলেম এর সত্যায়ন করেছেন? এর সত্যায়নে তাঁরা কী বলেছেন ইত্যাদি মজলিসের যাবতীয় বিবরণ অবশ্যই লিপিবদ্ধ থাকত। এই কিতাবের সত্যায়নের উপর উলামায়ে কেরামের এমন গুরুত্বপূর্ণ মজলিস হয়ে যাবে, কিন্তু এর সম্পর্কে কোনো কথাই এই কিতাবের ভেতর থাকবে না- এটা হতেই পারে না। সুতরাং মিয়ারুল আওকাতের ভূমিকাই এর প্রমাণ যে, উলামায়ে কেরামের মজলিস দ্বারা এই সময়সূচি সত্যায়নের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়া কথা হল, বিভিন্ন পর্যায়ের এতসংখ্যক স্থূল ভুলসম্বলিত একটি সময়সূচির সপক্ষে উলামায়ে কেরামারে সত্যায়ন থাকবে- তা কী করে হয়!
দ্বিতীয়ত, আহসানুল ফাতাওয়ায় বলা হয়েছে, হায়দ্রাবাদের নবাব সাহেবও এই কিতাবের তাহকীকসমূহের অনুমোদন করেছিলেন। অথচ মিয়ারুল আওকাত থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, এমন কিছু হয়নি। মিয়ারুল আওকাতে আবদুল ওয়াসি‘ সাহেব নিজেই বলেন-
نیز سلطنۃ آصفیہ اور اس کے ہر دلعزیز فرماں روا اعلیٰحضرت بندگانعالی متعالی مدظلہ العالی سپہدار مظفر الملک والممالک نظام الملک نظام الدولۃ آصف جاہ میر عثمان علی خان بہادر فتح جنگ جی سی ایس آئی خلدہ اللہ تعالیٰ ملکہ وسلطنتہ کی درازی عمر واقبال وجاہ وجلال کے لئے دست بدعا رہیں گے، جن کی علمی سرپرستی اور قدر دانی کی بدولت مجھ کو اس قدر فارغ البالی نصیب ہو سکی کہ یہ عظیم الشان کام میں نے کچھ دنوں میں انجام دے لیا۔
অর্থাৎ নবাব সাহেবের ইলমী পৃষ্ঠপোষকতা, সহযোগিতা এবং মূল্যায়নের বদৌলতে আমার এমন নিশ্চিন্তমনে কাজ করার সময়-সুযোগ তৈরি হয়েছে যে, এই বিশাল কাজটি আমি অল্প দিনেই আঞ্জাম দিতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য নবাব সাহেবের জন্য সর্বদা দুআর হাত প্রসারিত থাকবে। (মিয়ারুল আওকাত ১/৩)
মিয়ারুল আওকাতে আবদুল ওয়াসি‘সাহেবের এ কথা থেকে স্পষ্ট যে, নবাব সাহেবের কাছে তিনি এটি পেশ করেছেন এবং নাবাব সাহেব এর অনুমোদন করেছেন- এমন কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি। এমনটি ঘটলে তো তিনি এটিই বড় করে বলতেন। কিন্তু তা না বলে তিনি বলছেন, নবাব সাহেব যেহেতু ইলম ও আলেমগণের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করেন, ফলে যারা ইলমী কাজ করেন তাদের ইলম ব্যতীত পার্থিব বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না। তাই তিনি পূর্ণ একাগ্রতার সাথে এই বিশাল কাজটি অল্প দিনেই সম্পাদন করতে পেরেছেন। এজন্য তিনি নবাব সাহেবের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছেন। কিন্তু কথা হল, নবাব সাহেব যদি সরকারিভাবে এর অনুমোদন করতেন তবে তো এর শুকরিয়া আদায়ই বেশি জরুরি ছিল। উপরন্তু কিতাবটির গ্রহণযোগ্যতার জন্য এ দিকটিই ছিল সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়। এমন কিছু ঘটে থাকলে ভূমিকায় উল্লেখ করার জন্য এটিই সর্বাধিক গুরুত্বের দাবি রাখে। এমন কিছু হয়ে থাকলে সেটি সম্পর্কে কিছুই না লিখে তিনি অন্য কথা বলবেন- তা হতে পারে না।
মিয়ারুল আওকাতের প্রচ্ছদের কথাটির উদ্দেশ্য
মিয়ারুল আওকাতের প্রচ্ছদে পূর্বোক্ত লেখাটিই কেবল আহসানুল ফাতাওয়ার এ দাবির উৎস। এর দ্বারাই আহসানুল ফাতাওয়ার এই বিভ্রান্তি হয়েছে। এটুকু ছাড়া এ বিষয়ে আহসানুল ফাতাওয়ার আর কোনো প্রমাণ নেই। অথচ বাস্তবে প্রচ্ছদের উক্ত কথাটির উদ্দেশ্য এই নয়, যা আহসানুল ফাতাওয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। মিয়ারুল আওকাতের প্রচ্ছদে সংকলকের নামের পর লেখা হয়েছে-
متفقہ مجلس علماء منعقدہ محکمہ صدارت عالیہ سرکار عالی منظورہ بارگاہ خسروی جہاں پناہی حیدرآباد دکن
প্রচ্ছদের এই কথাটি মিয়ারুল আওকাত কিতাব সম্পর্কে বলা হয়নি। বরং এর সংকলকের পরিচয় হিসেবে কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে কথাটি এভাবে বলা হয়েছে-
مؤلفہ مولوی عبد الواسع مرحوم، پروفیسر دینیات کلیہ جامعہ عثمانیہ
متفقہ مجلس علماء منعقدہ محکمہ صدارت عالیہ ...
অর্থাৎ এর সংকলক হলেন, মওলবী আবদুল ওয়াসি‘ সাহেব। তার প্রথম পরিচয় হল-
پروفیسر دینیات کلیہ جامعہ عثمانیہ.
অর্থাৎ জামেয়া উসমানিয়া কলেজের দ্বীনিয়াতের প্রফেসর।
এর পরবর্তী লাইনে সংকলকের দ্বিতীয় পরিচয় হিসেবে এই কথা লেখা হয়েছে-
متفقہ مجلس علماء منعقدہ محکمہ صدارت عالیہ ...
এর থেকে বোঝা যায় যে, এই নামে আলেমগণের সরকারি একটি বোর্ড ছিল। তিনি হয়ত এর সদস্য বা কোনো দায়িত্বে ছিলেন।
মিয়ারুল আওকাতের প্রচ্ছদের উক্ত কথাটির সঠিক মর্ম এটিই হবে। এই কথাটি কিতাবের পরিচয় হওয়াটা এখান থেকে বুঝা যায় না। তা ছাড়া প্রচ্ছদের এই কথাটি আবদুল ওয়াসি‘ সাহেবেরই না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, বইয়ের প্রচ্ছদ তো সাধারণত প্রকাশনীর পক্ষ থেকে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রে এরও সম্ভাবনা রয়েছে যে, প্রচ্ছদ তৈরির সময় বাক্যগুলো লিখতে প্রকাশকের পক্ষ থেকে কোনো ভুল হয়ে গেছে। কোনো শব্দ ছুটে গেছে, কিংবা শব্দ একটির জায়গায় অন্যটি হয়ে গেছে। বা এতে অন্য কোনো ধরনের ভুল হয়ে গেছে। যার কারণে এখন আমাদের জন্য বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝার সুযোগ থাকেনি।
মোটকথা, প্রচ্ছদের এই কথাটিকে ভিত্তি করে এই সময়সূচিটি সরকার কর্তৃক নিযুক্ত আলেমগণের মজলিস দ্বারা সত্যায়িত হওয়ার দাবি করার সুযোগ নেই। কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়াতে মিয়ারুল আওকাতের সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য বা ভিন্ন কোনো প্রমাণ ছাড়া কেবল প্রচ্ছদের এই অস্পষ্ট কথাটির উপর ভিত্তি করেই এই বাস্তবতা-বিরোধী দাবি করা হয়েছে। ঘটনা যদি বাস্তবে এমনই হত যে, হায়দ্রাবাদের নবাবকর্তৃক নির্বাচিত উলামায়ে কেরামের জামাত এই কিতাব সম্পর্কে মজলিস করে তা সত্যায়ন করেছেন এবং হায়দ্রাবাদের নবাবও সরাসরি এর অনুমোদন দিয়েছেন তবে তো এর ব্যাপক প্রসিদ্ধি থাকত। পুরো হিন্দুস্তানে ব্যাপকভাবে এর অনুসরণ করা হত। এবং অন্তত এই কিতাবেই আলেমগণের এই মজলিসের বিবরণ বিদ্যমান থাকত। কিন্তু এমন কিছুই তো নেই। এর ভূমিকার বক্তব্য দ্বারা বরং এর খেলাফ প্রমাণিত হয়। সাথে সাথে এ দিকটিও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই সময়সূচিটি নিয়ে আলেমগণের মজলিস হয়ে থাকলে তাতে এত পরিমাণে এবং এত স্থূল ভুল থেকে যাবে- তাও হতে পারে না। এগুলোই বাস্তব প্রমাণ যে, এই বাক্যটি কিতাবের পরিচিতি নয় এবং উলামায়ে কেরাম ও নবাব কর্তৃক এটি সত্যায়নের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
***
যাই হোক, আসল কথা হল, মিয়ারুল আওকাতে বিদ্যমান সময়সূচিতে নামায-রোযার ওয়াক্ত বর্ণনায় অনেক বড় বড় ভুল রয়েছে। এর কোনো ভুল তো এমন, যা আহসানুল ফাতাওয়ার মৌলিক দাবির সাথেই সাংঘর্ষিক। আহসানুল ফাতাওয়ার মূল দাবিই হচ্ছে, সুবহে সাদিক ১৫°-এর আগে শুরুই হয় না। কিন্তু মিয়ারুল আওকাতে ফজরের নামাযের ওয়াক্ত দেওয়া হয়েছে ১৬° পর্যন্ত। আর আহসানুল ফাতাওয়ার দাবি অনুযায়ী শাফাকে আবইয়ায শেষ হয় (এশার ওয়াক্ত শুরু হয়) ১৫°-এ। কিন্তু মিয়ারুল আওকাতে শাফাকে আবইয়ায ১৮°-এ শেষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এই সময়সূচি আহসানুল ফাতাওয়ার নিকটই গ্রহণযোগ্য হওয়ার সুযোগ নেই। অতএব এর উদ্ধৃতি দেওয়া সহীহ নয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)