Zilhajj 1427   ||   January 2007

নির্বাচনী ঝড়ো হাওয়া : ঈমান আমল রক্ষায় সতর্কতা ও সচেতনতা জরুরি

আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অনিশ্চয়তার পরিবেশ বিরাজ করছে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে বা কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে দেশের সর্বস্তরের জনগণ বেশ উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার জন্য যে প্রচলিত নোংরা রাজনীতিই দায়ী তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যে ক্ষমতাই দখল করতে চাইবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিষয়টিই আরো প্রকটরূপে দেখা যাচ্ছে। মুখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বললেও সকল পক্ষই চাইছেন নির্বাচনের আগেই নিজেদের জয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে নিতে।

আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার বাইরে আর কোন কিছু চিন্তাই করতে পারেন না। এজন্য দলীয় নীতি, আদর্শ, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন  করে ফেলতেও তাদের দ্বিধা হচ্ছে না। এ দল থেকে সে দল, এ জোট থেকে ওই জোট, এমনই চলছে বর্তমানে। কারণ সবার আগে চাই ক্ষমতা, চাই এমপিত্ব। বলা বাহুল্য, জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং সংসদে বসতে আগ্রহীদের এ মানসিকতা জাতির জন্য শান্তি ও স্বস্তির বারতা বয়ে আনতে পারে না।

যেহেতু নির্বাচনই ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি, তাই শত অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্যেও নির্বাচনমুখী বায়ু প্রবাহের অস্তিত্ব বেশ টের পাওয়া  যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। আর অন্যেরা ব্যস্ত রয়েছে বড় দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছুটা হলেও ক্ষমতার ভাগ নিশ্চিত করতে। মিডিয়াগুলোও তাদের চিরাচরিত পন্থায় নির্বাচনপূর্ব দায়িত্বপালন করছে।

দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে নির্বাচনের এই বায়ু-প্রবাহ ধীরে ধীরে গতি লাভ করবে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতাও ততই বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় দেশের একজন দাির্য়ত্বশীল মুমিন নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব-সচেতনতার পাশাপশি নিজের দ্বীন ও ঈমান রক্ষায় সজাগ সতর্ক থাকা কর্তব্য। গীবত, শেকায়েত, মিথ্যাচার, মিথ্যা অপবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলো ইসলামে সব সময়ের জন্যই নিষিদ্ধ। দায়িত্ব-বহির্ভর্ূত অযথা বাক্যালাপ, তর্ক-বিতর্ক, কোন সময়ই সুফল বয়ে আনে না। এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি।

বর্তমান সময়ের একটি বড় ট্রাজেডি হল, ইসলামী খেলাফতের অনুপস্থিতি। এর বিষফল সবাইকেই  ভুগতে হচ্ছে। ইসলামে খলীফা নিজে ভোট চান না, জনগণই তাদের খলীফা নির্বাচন করে। খলীফা হয়ে থাকেন জনগণের প্রকৃত সেবক। তিনি কোনো ধরণের গণতন্ত্রী বা অগণতন্ত্রী স্বৈরাচারী শাসক হতে পারেন না। তার জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত থাকে।

খলীফা নির্বাচন এবং খিলাফত পরিচালনার নীতিমালাও ইসলামে রয়েছে। খিলাফত পরিচালনার দায়িত্বে বরিত হওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা প্রয়োজন এবং কীভাবে এই গুরুদায়িত্ব একজন যথার্থ সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত হতে পারে তার যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নির্দেশনা ইসলামে রয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক পড়াশোনা  ও চিন্তা-ভাবনা হওয়া প্রয়োজন। জাতির মেধাবী ও কল্যাণকামী ব্যক্তিবর্গ এদিকে নজর দিলে তা দেশ ও জাতির জন্য অশেষ কল্যাণকর হতে পারে। বিশেষত যারা রাজনীতিকে নিজেদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদের জন্য এ সম্পর্কীয় নীতিমালা জেনে নেওয়া ফরয দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বলা বাহুল্য একটি সৎ ও কল্যাণমুখী রাজনীতির ধারা সৃষ্টি করতে এর বিকল্প নেই।

বর্তমানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তা যে ত্রুটিমুক্ত নয় সেটা প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সা¤প্রতিক আন্দোলন-পাল্টাআন্দোলন থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু এখন এ ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনপদ্ধতি এবং এর চেয়েও ত্রুটিপূর্ণ সরকার ব্যবস্থাই যেহেতু নিষ্ঠুর বাস্তবতা, তাই এ ভোটাভুটির ব্যাপারেও শরঈ নীতিমালা জেনে নেওয়া আবশ্যক।

নির্বাচনে কোন প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ার অর্থ হল, তার সততা ও যোগ্যতার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা। কেননা যিনি কোন দায়িত্ব বা পদপ্রার্থী হন তিনি সেই পদ বা দায়িত্বের জন্য নিজেকে যোগ্য বলে দাবি করেন। আর  দায়িত্ব অর্পিত হলে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পালনের প্রতিশ্রম্নতি তো প্রার্থীগণ খুব জোরেশোরেই প্রচার করে থাকেন। এ অবস্থায় কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ তার পক্ষে শাহাদাত বা সাক্ষ্য দেওয়া। তদ্রূপ উক্ত পদে বরিত হওয়ার জন্য তার পক্ষে সুপারিশ করা এবং একটি সামাজিক দায়িত্ব, যেখানে অসংখ্য মানুষের হক্ব ও অধিকার সংশ্লিষ্ট, সেখানে তাকে নিয়োগ দানের পক্ষে মত প্রদান করা। এই সবগুলো বিষয় এখানে রয়েছে।

শরীয়তে সাক্ষ্য, সুপারিশ ও মত প্রদানের গুরুত্ব ও দায় অপরিসীম। কুরআনে কারীমে যেমন সাহসিকতার সঙ্গে সত্য সাক্ষ্য দিতে আদেশ করা হয়েছে এবং সাক্ষ্য গোপনকারীর অন্তরকে পাপী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তদ্রূপ মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াকেও মারাত্মক কবীরা গুনাহরূপে চিহ্নিত  করা হয়েছে।

কারো পক্ষে বা বিপক্ষে সুপারিশ করার ব্যাপারে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, (তরজমা) যে ব্যক্তি ভালো সুপারিশ করে সে এর কারণে (সওয়াবের) হিস্যা পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ সুপারিশ করবে তাকেও এর কারণে পাপের দায় কাঁধে নিতে হবে।

তদ্রূপ জনসাধারণের হক্ব ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারাদিতে মত প্রদান করা যে খুবই চিন্তা-ভাবনা ও দায়িত্বশীলতার দাবিদার তা তো বলাই বাহুল্য।

এভাবে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ভোট প্রদানের ব্যাপারটিকে ততটা হালকা মনে করার সুযোগ থাকে না, কার্যত একে যতটা হালকা ভাবা হয়। এক কাপ চা কিংবা নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের বিগলিত অনুরোধে প্রভাবান্বিত হয়ে এই আমানতে খেয়ানত করারও অবকাশ থাকে না। দেশের সর্বস্তরের জনগণকে যদি এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলা যায় তবে সেটাই হবে প্রকৃত দেশপ্রেম এবং দেশ ও জনগণের সাথে প্রকৃত ওয়াফাদারি। তুলনামূলক সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরাও যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় আসতে সক্ষম হন তাহলেও দেশ ও জাতি তুলনামূলক কম ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং এদেশের বঞ্চিত জনতার ভাগ্যে পরিবর্তন সূচিত হবে এ আশা খুব সহজেই করা যায়।

 

advertisement