কর্মক্ষেত্র নিয়ে উলামায়ে কেরামের সমালোচনা : কিছু মৌলিক কথা
بسم الله الرحمن الرحيم
نحمده ونصلي على رسوله الكريم، أما بعد :
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক পোস্টে দেখা যায়, সেখানে অনেক আলেমের উপর অনেকের অনেক রকমের প্রশ্ন, অভিযোগ ও ক্ষোভ। অমুক আলেম রাজনীতি করেন না কেন? অমুক আলেমকে মিটিং-মিছিলে দেখা যায় না কেন? অমুক আলেমকে আন্দোলনে দেখা যায় না কেন? অমুক আলেম অমুক প্রতিবাদ সভায় যোগ দিলেন না কেন? অমুক আলেম অমুক ব্যাপারে নীরব কেন? অমুক আলেম দাওয়াত ও তাবলীগে সময় লাগান না কেন? অমুক আলেম এটা করেন না কেন, তমুক আলেম সেটা করেন না কেন? ইত্যাদি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ধরনের বহু অভিযোগ বা ক্ষোভ ব্যক্ত করে পোস্ট দিতে দেখা যায় অনেককে। অফলাইনেও যে এমন প্রশ্ন বা ক্ষোভ দেখা যায় না তা নয়, তবে অনলাইনে ব্যাপারটা একটু বেশিই দেখা যায়। বিজ্ঞ আলেমদের ব্যাপারেই এমন অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এসব অভিযোগ ও ক্ষোভ নিয়ে অনেককে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম থেকে দূরে সরে যেতেও দেখা যায়।
বস্তুত কোন্ কাজে যোগ দেয়ার হুকুম কোন্ পর্যায়ের। কোন্ কাজে যোগ দেয়ার গুরুত্ব কতটুকু। কোন্ সময় কোন্ কাজে লিপ্ত হওয়া অধিকতর শ্রেয়। কার পক্ষে কোন্ কাজে যোগ দেয়া বেশি উপযোগী- এসব তত্ত্ব সামনে রেখেই বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম করণীয় নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু এসব তত্ত্ব ও তত্ত্বের ভিত্তিতে কী করণীয় নির্ধারণ করা চাই- এগুলো যারা ভালো করে বোঝে না, তারা বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের অবস্থান বুঝে উঠতে সক্ষম হয় না। এই বুঝে উঠতে না পারা থেকেই তাদের মধ্যে জন্ম নেয় বিভিন্ন আলেমের অবস্থান নিয়ে নানান রকমের প্রশ্ন, অভিযোগ ও ক্ষোভ।
আমি এখানে কয়েকটা উসূলী বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা পেশ করছি। আশা করি তাতে বিভিন্ন আলেমের বিভিন্ন অবস্থান নিয়ে যেসব প্রশ্ন দেখা দেয় তার অনেকটার নিরসন হয়ে যাবে, ক্ষোভ-অভিযোগ প্রশমিত হবে। এ পর্যায়ে আমি সাতটি উসূলী কথা পেশ করছি।
এক.
সব কাজ ফরযে আইন নয় যে, সবাইকে তাতে শরীক হতেই হবে। কোনো কাজ ফরযে আইন হলে সবাইকেই তা করতে হয়। পক্ষান্তরে কোনো কাজ ফরযে আইন পর্যায়ের না হয়ে যদি ফরযে কেফায়া পর্যায়ের হয়, তাহলে সকলের তাতে শরীক হওয়ার আবশ্যকতা নেই। বরং কাজটি আঞ্জাম পায় এমনসংখ্যক লোক শরীক হয়ে গেলে অন্যদের তাতে শরীক না হলেও চলে। সেক্ষেত্রে যারা তাতে শরীক হল না, তাদের সমালোচনা বা তিরস্কার করার অবকাশ নেই। কেননা, সমালোচনা-তিরস্কারের কারণে মনে হবে, সকলেরই তাতে শরীক হওয়া জরুরি ছিল। অথচ ফরযে কেফায়া কাজে সকলের শরীক হওয়া জরুরি নয়। রাজনীতির বিষয়টাও এমনই। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করা ফরযে কেফায়া। এই চেষ্টা-সাধনার অনেক সূরত হতে পারে, যার একটা সূরত হল ইসলামী রাজনীতি। এ হিসেবে ইসলামী রাজনীতি ফরযে কেফায়া ধরনের একটি কাজ। সুতরাং কোনো আলেম যদি মনে করেন, ময়দানে যারা রাজনীতি করছেন তারাই যথেষ্ট। এই ভেবে তিনি ময়দানের রাজনীতিতে যোগ না দেন, তাহলে এ নিয়ে তার সমালোচনা হতে পারে না। যেমন, জানাযার নামায ফরযে কেফায়া। তাই কিছু লোক দ্বারা জানাযার নামায আদায়ের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে যারা শরীক হল না তাদের সমালোচনা করা যায় না। তবে অন্যদের দ্বারা যথেষ্টতা সম্পন্ন হচ্ছে ভেবে যারা রাজনীতিতে শরীক হলেন না, তাদেরও এই শরীক না হওয়া নিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো ঠিক হবে না যে, আমি রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কারণ, ফরযে কেফায়া কাজে অন্যদের দ্বারা যথেষ্টতা সম্পন্ন হলেও তাতে শরীক হওয়া উত্তম তো বটেই। আর কোনো উত্তম কাজে শরীক না থাকাকে শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনা করা যায় না।
যদি কেউ বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে যতজন কাজ করছেন, তাদের দ্বারা কেফায়াত তথা যথেষ্টতা সম্পন্ন হচ্ছে না, অতএব এ অবস্থায় অন্যদের এ থেকে দূরে থাকার অবকাশ নেই, তাহলে তার উত্তর হল, মূলত ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ ফরযে কেফায়া। তা সেই কাজ প্রচলিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূরতেই হতে হবে তা জরুরি নয়। প্রচলিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূরতেও তা হতে পারে, অন্য কোনো সূরতেও তা হতে পারে। যেমন কোনো আলেম যদি এমন হন, ক্ষমতাসীনরা যার কথা মূল্যায়ন করে, তাহলে তিনি ক্ষমতাসীনদের ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে সে দায়িত্ব আদায় করতে পারেন। অতএব কেউ ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়ায় যদি কাজটি সম্পন্ন করেন, তাহলে সূরতবিশেষে শরীক না হওয়ায় তার সমালোচনা হতে পারে না। সামনে বর্ণিত ৩ নং উসূলে এ সম্বন্ধে আরও ব্যাখ্যা আসছে। আবার ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য চর্চিত রাজনীতি ফরযে কেফায়া ধরনের কাজ হলেও সেই রাজনীতির কর্মপদ্ধতি কী হওয়া চাই- তা নিয়েও যোগ্য আলেমদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনো যোগ্য আলেম বিশেষ কোনো এক কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে তা থেকে বিরত থাকলে তার অবকাশও রয়েছে বৈ কি। তবে কেউ কোনো কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে তা থেকে বিরত থাকলেও বৃহত্তর আলেম সমাজ যে কর্মপদ্ধতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তার অবকাশ থাকলে তার সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকাই সংগত। অবকাশ নেই মনে করলে আর সমালোচনা করতে হলেও ইখতেলাফের আদাব ও সমালোচনার আদাব রক্ষা করা চাই। বিশেষত এ কারণে যে, অন্যদিকে বৃহত্তর আলেম সমাজ রয়েছেন। আর বৃহত্তর আলেম সমাজের অবস্থানকে শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করার রীতি বর্জিত হলে দ্বীনী অঙ্গনে বিচ্ছিন্ন মতবাদ প্রশ্রয় পাবে।
অনেক আলেমের প্রচলিত রাজনীতিতে যোগ না দেয়ার পেছনে আরও যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে, যা সামনে উল্লেখ করছি।
দুই.
দ্বীনী কাজের অনেক সূরত ‘মানসূস আলাইহি’ (যে ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে স্পষ্ট ভাষ্য পাওয়া যায় এমন) নয়, বরং ইজতিহাদভিত্তিক। এমন ক্ষেত্রে কোনো যোগ্য আলেমের সেই ইজতিহাদী সূরতের ব্যাপারে ভিন্নমতও থাকতে পারে এবং ভিন্নমতের অনুকূলে দলীল-প্রমাণ তার কাছে শক্তিশালী মনে হতে পারে। এমন হলে তিনি অন্যদের ইজতিহাদী সূরত অনুযায়ী সে কাজ করবেন না, বরং যে দিকটার দলীল-প্রমাণ তার কাছে শক্তিশালী প্রতীয়মান হবে সে দিকটাই তিনি অবলম্বন করবেন। এটাই উসূলসম্মত কথা। জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফফীনে হযরত উছমান রা.-এর হত্যাকারীদের বিচার চাওয়ার যে সূরত দাঁড়িয়েছিল শেষমেষ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া- এটা ছিল কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ার একটা ইজতিহাদী সূরত। আল্লামা নববী রাহ. বলেছেন, এক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যার কাছে যে পক্ষের দলীল-প্রমাণ শক্তিশালী মনে হয়েছে, দলীলের ভিত্তিতে যে পক্ষ তার কাছে হক মনে হয়েছে তিনি সে পক্ষ অবলম্বন করেছেন। যাদের কাছে কোনো পক্ষেরই দলীল শক্তিশালী মনে হয়নি তারা কোনো পক্ষেই যোগ দেননি। যিনি যে পক্ষেই যোগ দিয়েছেন দলীলের ভিত্তিতেই তা করেছেন। যার কাছে কোনো পক্ষেরই দলীল স্পষ্ট হয়নি তিনি কোনো পক্ষেই যোগ দেননি। হযরত তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ্ও ‘ইনআমুল বারী’তে এমন ব্যাখ্যাই দিয়েছেন।
তবে এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, আমি এখানে মুশাজারাতে সাহাবা বা জঙ্গে জামাল ও সিফফীনের প্রসঙ্গ টেনেছি শুধু এটা দেখানোর জন্য যে, ইজতিহাদী মতভেদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষকে নিজ নিজ দলীল অনুসারে কাজ করতে হবে, যে পক্ষের কাছে যে দিকের দলীল শক্তিশালী মনে হবে, সে পক্ষ সে অনুসারেই কাজ করবে- এটাই নীতি। এই নীতিটি বোঝানোর জন্যই জঙ্গে জামাল ও সিফফীনের প্রসঙ্গ টানা। অন্যথায় আমাদের মধ্যকার সব বিরোধকে জঙ্গে জামাল ও সিফফীনের বিরোধের সাথে হুবহু তুলনা করা সংগত মনে হয় না। কেননা ইজতিহাদী ইখতেলাফের সময়ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যে এখলাস ও লিল্লাহিয়াত, যে তাকওয়া ও তহারাত ছিল বলে আমরা বিশ্বাস রাখি, আমাদের মধ্যে ইজতিহাদী বিরোধ লাগলে সে রকম এখলাস ও লিল্লাহিয়াত, সে রকম তাকওয়া ও তহারাত থাকে- তা বলা কঠিন।
যাহোক এবার আমাদের আলোচ্য বিষয়ে আসা যাক। মনে করুন কিছু আলেম যদি কোনো ধর্মীয় দাবি আদায়ের জন্য কিংবা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য হরতাল বা অবরোধের ডাক দেন, তাহলে কোনো বিজ্ঞ আলেম তাতে যোগ নাও দিতে পারেন। কারণ, কোনো দাবি আদায়ের জন্য হরতাল বা অবরোধ পালন বা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য হরতাল বা অবরোধ পালন একটা ইজতিহাদী পদ্ধতি। কোনো বিজ্ঞ আলেমের ইজতিহাদে এই পদ্ধতি অবৈধও প্রতীয়মান হতে পারে- এই যুক্তিতে যে, হরতাল বা অবরোধে সাধারণ মানুষের বিশেষত রোজ-আনে-রোজ-খায় গোছের লোকদের ভোগান্তি হয়, তাদের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকের জান মালের ক্ষতি হয় (যেটা হরতাল অবরোধের স্বাভাবিক অবস্থা)। তাদের তো কোনো দোষ নেই। অতএব তাদের ক্ষতি ডেকে-আনা হরতাল-অবরোধ বৈধ হতে পারে না। হাদীসে কারও ক্ষতি করতে নিষেধ করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لا ضرر ولا ضرار.
)رواه أحمد في مسنده برقم ২৮৬৭ وقال شعيب الأرنؤوط: حسن.(
অর্থাৎ, নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করাও নেই অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করাও নেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৮৬৭
অতএব এ যুক্তি ও দলীলের ভিত্তিতে কোনো আলেম অন্য আলেমদের ডাকা হরতাল-অবরোধের সাথে একাত্মতা পোষণ নাও করতে পারেন; এমনকি তার বিরোধিতাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তার সমালোচনা করার অবকাশ নেই- এই বলে যে, এমন এক ধর্মীয় ইস্যুতে কেন তিনি যোগ দিলেন না বা কেন বিরোধিতা করলেন।
তিন.
যদি এমন হয় যে, কোনো একটা শরয়ী কাজ বিভিন্ন পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা যেতে পারে। শরীয়ত কোনো পদ্ধতি খাস করে দেয়নি। এরূপ ক্ষেত্রে কেউ যদি একটা খাস পদ্ধতির অনুসরণ না করেন বরং সে কাজটিই তিনি অন্য পদ্ধতিতে সম্পন্ন করেন, তাহলে ঐ খাস পদ্ধতি কেন তিনি অবলম্বন করলেন না- এজন্য তার সমালোচনা করা যেতে পারে না। যেমন সাধ্য অনুযায়ী দাওয়াত ও তাবলীগ এবং আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার করা জরুরি। বয়ান-বিবৃতির মাধ্যমে, ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে, ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে বলে- বিভিন্ন পদ্ধতিতে এটা সম্পন্ন হতে পারে। সহীহ তরীকায় পরিচালিত হওয়ার শর্তে প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলীগ জামাতের সঙ্গে জুড়েও কাজটি করা যেতে পারে। এগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটা খাস পদ্ধতি অবলম্বন আবশ্যক নয়। অতএব কেউ যদি প্রচলিত তাবলীগ জামাতের সঙ্গে না জুড়ে অন্য কোনো পদ্ধতিতে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দেন তা-ও চলবে। সেক্ষেত্রে তার সমালোচনা চলবে না- এই বলে যে, তিনি তাবলীগ জামাতে সময় লাগান না কেন। এই সমালোচনা চলবে না- এ কারণে যে, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুধু প্রচলিত তাবলীগ জামাতের সূরতেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্য আরও অনেক পদ্ধতিতে তা হতে পারে। তদ্রূপ মনে করুন কেউ বইপত্র লেখার কাজ না করলে এই বলে তার সমালোচনা চলবে না যে, তিনি বইপত্র লেখার কাজ করেন না কেন। কেননা আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের কাজ বইপত্র লেখার সূরতেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্য আরও অনেক পদ্ধতিতে হতে পারে। তদ্রƒপ কোনো আলেমের এই বলে সমালোচনা চলবে না যে, তিনি ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করেন না কেন। কেননা আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের কাজ এই সূরতেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনিভাবে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য লংমার্চ বা মানববন্ধন ডাকা এমন কর্মসূচি বা পদ্ধতি যে, এই পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাবেও সংশ্লিষ্ট অন্যায়ের প্রতিবাদ হতে পারে। প্রতিবাদ একমাত্র এই পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অতএব কোনো আলেম যদি খাস এই পদ্ধতির প্রতিবাদে শরীক না হন, বরং অন্যভাবে প্রতিবাদের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে এই খাস পদ্ধতির প্রতিবাদে শরীক না হওয়ায় তার সমালোচনা হতে পারে না।
চার.
দ্বীনের যেসব কাজ প্রত্যেককেই করতে হবে এমন নয়, সেগুলোতে ‘তাকসীমে আমল’ তথা যোগ্যতা ও আগ্রহ হিসেবে কর্মবণ্টন থাকা উত্তম। সেমতে সকলকে সব কাজে না টেনে যার মধ্যে যে কাজের যোগ্যতা বেশি, যার যে কাজের প্রতি আগ্রহ থাকে, তাকে সেই কাজে নিয়োজিত রাখা উত্তম। তাতে কাজ ভালো হয়। যেমন, একজন রাজনীতি ভালো বোঝেন না, রাজনীতি তার স্বভাব-বিরুদ্ধ, তাকে রাজনীতিতে লাগালে তিনি রাজনীতিতে ভালো করতে পারবেন না। তার যদি পড়াশোনা-গবেষণা স্বভাবসম্মত হয় তাহলে তাকে পড়াশোনা ও গবেষণায় লাগিয়ে রাখুন। এখানে তিনি ভালো করবেন। পক্ষান্তরে একজন রাজনীতি ভালো বোঝেন, এটা তার স্বভাবের অনুকূল, কিন্তু লেখাপড়া-গবেষণায় তেমন নন, তাহলে তাকে রাজনীতিতে লাগিয়ে রাখুন। এ অঙ্গনে তিনি ভালো করবেন। পড়াশোনা-গবেষণায় তিনি তত ভালো করবেন না। এমনিভাবে সাংগঠনিক কাজ, সমাজসেবামূলক কাজ, সমষ্টিগত তৎপরতা, ওয়াজ বয়ান প্রভৃতি যার যেটাতে যোগ্যতা ও আগ্রহ ভালো তাকে সেটাতে লাগালে তিনি তাতে ভালো করবেন। এটা বাস্তব কথা যে, সবাই সব কাজের জন্য যুৎসই নন। তাই সকলকে সব অঙ্গনে না টেনে যিনি যে অঙ্গনে যুৎসই তাকে সেই অঙ্গনে নিয়োজিত রাখাই ভাল। তবে যিনি যে অঙ্গনেই কাজ করুন অন্য সব অঙ্গনের ভালো কাজে তার সমর্থন থাকবে। এটাই হল তাকসীমে আমলের ব্যাখ্যা, যার সারকথা হল, ভালো বিষয়ের চিন্তায় সকলের ঐক্য থাকবে তবে তৎপরতা থাকবে বিশেষ বিশেষ অঙ্গনে, যার যার যোগ্যতা ও আগ্রহ হিসেবে। সেমতে তাকসীমে আমলের নীতি মোতাবেক কেউ যদি এক অঙ্গনে তৎপর থাকেন অন্য অঙ্গনে তিনি সক্রীয়ভাবে অংশ না নেন, তাহলে তার সমালোচনা হতে পারবে না এই বলে যে, তিনি শুধু অমুকটা নিয়ে পড়ে আছেন, অমুকটা কেন করেন না।
পাঁচ.
কোনো কোনো ইজতিমায়ী বা সাংগঠনিক কাজের জন্য, যেমন দলবদ্ধভাবে কোনো আন্দোলনের জন্য, দলীয়ভাবে রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদি বেশ কিছু গুণাবলি থাকা আবশ্যক। অন্যথায় আন্দোলন বিক্রি হয়ে যায়, আন্দোলন মার খায়, আন্দোলনকারী সাধারণ কর্মীরা প্রতারিত হয় এবং ভবিষ্যতে সে ধরনের আন্দোলন সক্রীয় করার মত চেতনা জাগরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাহলে সেরকম ইজতিমায়ী কাজ ও আন্দোলন করার চেয়ে না করাই শ্রেয়। অতএব কেউ যদি ইজতিমায়ী কাজের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদি প্রয়োজনীয় গুণাবলির অনুপস্থিতির কারণে এরকম নেতিবাচকতা লক্ষ করেন এবং তার পক্ষে সেটার প্রতিকার করাও সম্ভব না হয়, বরং প্রতিকার করতে গেলে ফ্যাসাদ বা দ্বীনী ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার জন্য সেই ইজতিমায়ী কাজ ও সামষ্টিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় হয়ে দাঁড়ায়। তখন তিনি ইজতিমায়ী কাজ ও সামষ্টিক আন্দোলন ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যা যতটুকু করা সম্ভব করে যাবেন। এক হাদীস থেকে এমন শিক্ষাই পাওয়া যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিতনার (যামানার) কথা উল্লেখ করলে তিনি বললেন-
إِذَا رَأَيْتَ النَّاسَ قَدْ مَرِجَتْ عُهُودُهُمْ وَخَفّتْ أَمَانَاتُهُمْ وَكَانُوا هَكَذَا وَشَبّكَ بَيْنَ أَنَامِلِهِ، فَقُمْتُ إِلَيْهِ فَقُلْتُ: كَيْفَ أَفْعَلُ يَا رَسُولَ اللهِ، جَعَلَنِي اللهُ فِدَاكَ؟ قَالَ: الْزَمْ بَيْتَكَ، وأمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَخُذْ مَا تَعْرِفُ وَدَعْ مَا تُنْكِرُ، وَعَلَيْكَ بِخَاصّةِ أَمْرِ نَفْسِكَ، وَدَعْ عَنْكَ أَمْرَ الْعَامّةِ.
)رواه الحاكم في المستدرك برقم 7758 وقال : هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه وأقره عليه الذهبي في التلخيص صحيح. والحديث أيضا في سنن أبي داود بإسناد صحيح برقم 4344، وفي صحيح ابن حبان عن أبي هريرة برقم 6730، وإسناده صحيح على شرط مسلم(
অর্থাৎ, যখন দেখবে মানুষের ওয়াদা-অঙ্গীকার হ-য-ব-র-ল হয়ে গেছে, তাদের আমানতদারী-বিশ্বস্ততা হ্রাস পেয়েছে এবং তারা এমন হয়ে গেছে -তিনি এক হাতের আঙ্গুলসমূহ অন্য হাতের আঙ্গুলসমূহের মাঝে ঢুকিয়ে দেখালেন-
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, তখন আমি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য নিবেদিতপ্রাণ করুন (এ অবস্থা সৃষ্টি হলে) আমি কী করব?
তিনি বললেন, নিজের ঘরে অবস্থান করবে। নিজের জবান নিয়ন্ত্রণে রাখবে। যেটা হক জানো তা আঁকড়ে থাকবে। যেটা বাতিল জানো তা বর্জন করবে। এবং নিজের খাস বিষয়ে নিয়ে মগ্ন থাকবে আর গণমানুষের বিষয় এড়িয়ে যাবে। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৭৫৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৪৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৭৩০
হযরত যাকারিয়া রাহ.-ও ‘আলই‘তিদাল ফী মারাতিবির রিজাল’ গ্রন্থে ইসলাহ করার ক্ষমতা না থাকলে এবং ইসলাহ করতে গেলে ফিতনা ও দ্বীনী ক্ষতির আশংকা থাকলে দল থেকে আলাদা হয়ে এবং দলের ইসলাহের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের কাজে মাশগুল থাকার পক্ষে এই হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন।
অতএব কেউ যদি ইজতিমায়ী কাজের নেতৃবৃন্দের মধ্যে পূর্বোল্লিখিত নেতিবাচকতা দেখে এ হাদীসের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ইজতিমায়ী কাজ থেকে দূরে থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দ্বীনী কাজ করে যেতে থাকেন, তাহলে ইজতিমায়ী কাজে শরীক না থাকার কারণে তার সমালোচনা হতে পারে না। কারণ, তিনি হাদীসের দিকনির্দেশনা মোতাবেকই চলছেন। তবে হাঁ, যারা ইসলাহ করার ক্ষমতা রাখেন এবং যারা সব প্রতিকূলতা উৎরে কাজ এগিয়ে নেয়ার মত আশা ও হিম্মত রাখেন তারা সেভাবেই এগিয়ে যাবেন। এরূপ ক্ষেত্রে যারা সেই ইজতিমায়ী কাজ থেকে বিরত থাকবেন তাদের উচিত হবে, যারা আশা ও হিম্মত নিয়ে প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন, তাদেরকে নিরুৎসাহিত না করে বরং তাদেরকে উৎসাহিত করা। তাদের সমালোচনা থেকে বিরত থাকা। দোষ-ত্রুটি ব্যাপক হয়ে যাওয়ার এই যামানায় কোন্ অঙ্গনই বা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পাওয়া যায়। তবুও কাজ এগিয়ে নিতে হয়।
ছয়.
শরীয়ত যদি কোনো কাজের জন্য একটা খাস সময় নির্ধারণ করে থাকে, যে সময়ে সেটা না করলে পরে আর করার সময় থাকবে না, তাহলে সেই খাস সময়ে সেই নির্ধারিত কাজটিই করা কাম্য, যদিও সেটা করতে গেলে সেই মুহূর্তে এমন কোনো কাজ ছুটে যায়, যা তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেই মুহূর্তেই করতে হবে এমন নয়।
এ উসূলটির কিছু তাফসীল করেছেন হযরত তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ ‘ইনআমুল বারী’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ‘দাওয়াত ও তাবলীগ মে এক গলত ফাহমী’ শিরোনামের অধীনে। একটা উদাহরণ দেই। যেমন ফজরের নামাযের পর নিজ জায়গায় বসে থেকে ইশরাকের ওয়াক্ত হলে ইশরাকের নামায পড়া একটি আমল। জামে তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদের হাসান স্তরের হাদীস দ্বারা আমলটি প্রমাণিত। এটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের আমল। একটা নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর এই আমলের সময় থাকবে না। কিন্তু এই আমল করতে গেলে ঐ সময় এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো আমল ছুটে যায়, (যেমন দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ, যা মৌলিকভাবে ফরযে কেফায়া পর্যায়ের আমল হওয়ায় তার বিশেষ কোনো সূরত, যেমন মাশওয়ারায় বসা বা তালীমে শরীক হওয়া সম্পর্কে কেউ হয়ত বাড়াবাড়ি করে বলতে পারে, তা নফলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ) যা এই সময়ের মধ্যেই করতে হবে এমন নয়, পরেও করা যাবে। এক্ষেত্রে এই সময় ইশরাকের নামাযের আমলই শরীয়তে কাম্য। কেননা, শরীয়ত এই সময়ের জন্য এই আমলই বিধিবদ্ধ করেছে। সুতরাং এই সময় এই আমল করাই শরীয়তের তাগাদা ও কাম্য। অতএব কেউ যদি এ সময় দাওয়াত-এর আমলে মগ্ন না হয়ে ইশরাকের নামায আদায়ে মগ্ন থাকে, তাহলে এই বলে তার সমালোচনা করা যাবে না যে, তিনি দাওয়াতের কাজের উপর নফল কাজকে কেন প্রাধান্য দেন। আবার যারা মাশওয়ারাপূর্বক এই সময় দাওয়াত-এর কাজের নেযাম বানিয়ে নিয়েছেন এবং সে মোতাবেক এই সময় গাশত-দাওয়াতে যাচ্ছেন তাদেরও সমালোচনা না করা চাই। কেননা কোনো খাস ওয়াক্তের নফলের সময়ে মাশওয়ারাপূর্বক অন্য আমলের নেযাম বানানোরও অবকাশ রয়েছে। আকাবির-আসলাফের তাআমুল এমনই। যেমন আমরা শরীয়ত নির্দেশিত কোনো নফল আমলের সময়ে মাশওয়ারা মোতাবেক মাদরাসার বিভিন্ন আমলের নেযাম রেখে থাকি।
এই ৬ নং উসূলের আরেকটা উদাহরণ দেই। কেউ হজ্ব বা উমরার সফরে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি সময় সুযোগ পেলেই বেশি বেশি নফল তাওয়াফ নফল উমরায় মশগুল হতে পারেন। আবার সময় সুযোগ পেলেই বেশি বেশি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ বা পীর-মুরীদির কাজ কিংবা যিকির-আযকার তথা তাযকিয়ার কাজে মশগুল হতে পারেন। এখন কোন্টা শরীয়তে কাম্য? উসূল মোতাবেক আগের আমলগুলোই কাম্য। কারণ পরের আমলগুলো তিনি দেশে এসেও করতে পারবেন। পক্ষান্তরে আগেরগুলো দেশে আসার পর আর করতে পারবেন না। অতএব কেউ যদি হজ্ব-উমরার সফরে আগের আমলগুলোই প্রাধান্য দিয়ে করেন তাহলে পরের আমলগুলোকে প্রাধান্য না দেয়ার কারণে তার সমালোচনা সংগত হবে না।
সাত.
সর্বশেষ একটা কথা হল অনেকসময় একজন মানুষের ব্যক্তিগত এমন মাজুরী থাকতে পারে, যার ফলে তিনি অনেক কাজ করতে পারেন না। যেমন কারও হার্ট দুর্বল থাকার কারণে তিনি বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি পারেন না, কিংবা বাকপটু ও হাজির জওয়াব না হওয়ার কারণে বা নার্ভাসনেসের কারণে বাহাছ-বিতর্ক ও ডিবেট পারেন না, অথবা শারীরিক মাজুরীর কারণে দৌড়ঝাপমূলক কাজ করতে পারেন না। এগুলো মাজুরী। কারও কারও তবীয়তে খালওয়াত বা নিভৃতচারিতা এত বেশি প্রবল থাকে যে, রাজনীতি ইত্যাদি ইজতিমায়ী কাজের জালওয়াত বা কোলাহল তারা মোটেই সইতে পারেন না। যে কাজ সকলকে করতেই হবে এমন নয়, সেরকম ক্ষেত্রে এটাও একধরনের মাজুরী গণ্য হবে বৈ কি। এমনিভাবে অনেক কাজে অনেকের শরীক না হতে পারার পেছনে এজাতীয় আরও বহু রকমের মাজুরী থাকতে পারে, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানেন, অন্যরা তা নাও জানতে পারেন। তাই কাউকে কোনো কাজে শরীক হতে না দেখলেই সেজন্য তার সমালোচনা করা সংগত নয়, কারণ তার কোনো ন্যায়সংগত মাজুরীও থাকতে পারে।
এ পর্যন্ত ৭টি উসূলী বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ হল। আশা করি এই ৭টি উসূলী বিষয় সামনে রাখলে বিভিন্ন আলেমের বিভিন্ন অবস্থান নিয়ে যেসব প্রশ্ন দেখা দেয় তার অনেকটার নিরসন হয়ে যাবে এবং অমুক আলেম এটা করেন না কেন, তমুক আলেম সেটা করেন না কেন ইত্যাদি অভিযোগ ও ক্ষোভ হ্রাস পাবে।
এর পরও বিশেষ কোনো ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞ আলেমের অবস্থান পরিষ্কার না হলে এবং তা জানার নিতান্ত প্রয়োজন দেখা দিলে সে ব্যাপারে উক্ত আলেমের কাছ থেকে মুহাযযাব ও মার্জিত উপায়ে জেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু মুক্তাদায়ে কওম বিজ্ঞ কোনো আলেমের ব্যাপারে ফেসবুক প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন মেরে দিয়ে পোস্ট ছাড়া যে, উনি এই করেন না কেন, সেই করেন না কেন- এটা আদৌ সেই মার্জিত পন্থার অন্তর্ভুক্ত নয়।
وما علينا إلا البلاغ.