বাবাকে যেমন দেখেছি
সম্ভবত ১৪২১ হিজরীর কথা। তখন মারকাযুদ দাওয়াহ ছিল মুহাম্মাদপুরের ১/৫ সাতমসজিদ রোডের ভাড়া বাড়িতে। সে সময় শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক রাহ. মারকাযে তাফসীরে কুরআনের উপর কিছু বিশেষ দরস প্রদান করেছেন। ইফতেতাহী দরসে শাইখের পরিচয় তুলে ধরে মেজ ভাইজান (হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা.) একপর্যায়ে বললেন, আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী রাহ. ‘তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা’ গ্রন্থে ইমাম গাযালীর ব্যাপারে বলেছেন, ‘কারো সঠিক পরিচয় ও ব্যক্তিত্বের স্বরূপ যথাযথ ব্যক্ত করা তখনই সম্ভব হয়, যখন জীবনী লেখক আলোচিত ব্যক্তির সম মর্যাদার হয়। আর আমি তো তা নই...।’ বাবার ব্যাপারে আজ লিখতে গিয়ে সে কথাটিই মনে পড়ছে। এরপরও বাবাকে নিয়ে এ লেখার পেছনে কারণ দুটি :
এক. প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা এবং সালাফে সালেহীনের অনেক থেকেই এ কথা বর্ণিত হয়েছে, ‘নেককারদের আলোচনাকালে রহমত নাযিল হয়।’ তাই ভাবলাম, এ লেখার কারণে আর কিছু না হোক, আল্লাহর কিছু রহমত তো আমি হতভাগার ভাগ্যে জুটবে ইনশাআল্লাহ।
দুই. আমার জানা ও দেখা মতে বাবা ছিলেন আহলে দিল ও কালবে সালীমের অধিকারী মানুষ। ভাবলাম, আমার মতো ‘মারীযুল কল্ব-রুগ্ণ হৃদয়ে’র মানুষ তাঁকে নিয়ে কিছু আলোচনার বরকতে কলবের ইসলাহ ও সংশোধনের কিছু ব্যবস্থা হবে ইনশাআল্লাহ।
কিছু সিফাত কিছু গুণ
বাবা কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। চেহারায় সর্বদা একধরনের গাম্ভীর্য বিরাজ করত। সেইসঙ্গে চেহারায় একধরনের নূরানিয়াত ঝলমল করত। খেড়িহর মাদরাসার মুতাওয়াল্লী মরহুম আলহাজ্ব আবদুল ওয়াদুদ খান সাহেব খতীবে আযম সিদ্দীক আহমাদ রাহ., শায়খুল হাদীস আজিজুল হক রাহ., মুফতী আমিনী রাহ. এবং এ মাপের বড় বড় আলেমদের সাথেও বেতাকাল্লুফ ছিলেন; তা সত্ত্বেও বাবার সঙ্গে তিনি বিশেষ ধরনের সমীহের আচরণ করতেন।
তিনি ছিলেন খুব নাযুক তবীয়তের। বড় অপরাধ তো বটেই, ছোট খাটো ত্রুটি বিচ্যুতির জন্যও খুব রেগে যেতেন। অনিয়ম তার বরদাশতই হতো না। তার মধ্যে শানে জালালা গালেব ছিল। সুলূক ও তরীকত, বাইআত ও খেলাফত জাতীয় শিরোনাম তাঁর কাছে ছিল না। সবাই তাঁকে একজন আদর্শ উস্তায ও আদর্শ মুহতামিম হিসেবেই জানতেন। বাস্তবতা হল, এসবের পাশাপাশি তিনি একজন আহলে দিল এবং নিসবতওয়ালা মানুষ ছিলেন। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.-এর উর্দূ ভাষায় লেখা ‘শরীয়ত ও তরীকত’ কিতাবটি পড়লে আমরা বুঝতে পারব, সুলূক, ইহসান, তাযকিয়া, তরীকত, বাইআত, রূহানিয়্যাত ইত্যাদির জগৎ অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। আমরা যে এসব বিষয়কে সীমিত কিছু ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করি তা সম্পূর্ণ ভুল। তাখলিয়া ও তাহলিয়ার সমন্বিত রূপের পারিভাষিক নাম তাযকিয়া বা এর সঙ্গে আরো যেগুলো পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটির রয়েছে অনেক শাখা-প্রশাখা। এ মুহূর্তে তাঁর অন্তর্জগতের যে কয়েকটি গুণ আমার মনে পড়ছে সেগুলো উল্লেখ করছি।
অন্তরের পরিশুদ্ধি
এটি তাঁর জীবনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে তিনি নবীজীর শেখানো দুআ-
اللهُمّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا، وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكّاهَا.
(হে আল্লাহ, আমার নফসকে তাকওয়ার নিআমতে ধন্য করুন, একে পরিশুদ্ধ করুন। আপনিই উত্তম পরিশুদ্ধকারী।)
এর জীবন্ত প্রমাণ ছিলেন। দীর্ঘ নয় বছর বাবার কামরায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাঁর দিবারাত্রির চাল-চলন, উঠা-বসা ও সার্বিক অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো নিম্নোক্ত দুআটির কথা খুব বেশি বেশি স্মরণ হয়-
اللّهُمّ اجْعَلْ سَرِيرَتِي خَيْرًا مِنْ عَلَانِيَتِي، وَاجْعَلْ عَلَانِيَتِي صَالِحَةً.
(হে আল্লাহ, আমার ভিতরকে আমার বাইরের চেয়েও সুন্দর করে দিন আর আমার বাহিরকে ভালো করে দিন।)
মনের গভীরে বারবারই উচ্চারিত হচ্ছে, তাঁর বাতেন জাহের অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর ও স্বচ্ছ ছিল। আমার ধারণায় তিনি হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত দিলের অধিকারী ছিলেন। অন্যের ব্যাপারে খারাপ ও অমূলক ধারণা পোষণ কিংবা অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ তাঁর ব্যাপারে কল্পনাই করা যেত না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দুশমন ও বিরোধীদের কৌশলে ঘায়েল করা বা অপমানকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কারো ক্ষতি করার চিন্তা থেকেও সর্বদা নিজের দিল পাকসাফ রাখতেন। তাঁর এ গুণগুলোর কথা ভাবলে অনায়াসেই মনে পড়ে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি অমূল্য নসীহত, যা তিনি তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আনাস রা.-কে লক্ষ করে বলেছিলেন-
يَا بُنَيّ، إِنْ قَدَرْتَ أَنْ تُصْبِحَ وَتُمْسِيَ لَيْسَ فِي قَلْبِكَ غِشّ لِأَحَدٍ فَافْعَلْ.
হে বৎস! তুমি যদি অন্তরে কারো প্রতি হিংসা ও অকল্যাণ চিন্তা ছাড়া সকাল-সন্ধ্যা যাপন করতে পার, তাহলে তাই করো।
তারপর নবীজী বললেন-
يَا بُنَيّ وَذَلِكَ مِنْ سُنّتِي، وَمَنْ أَحْيَا سُنّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِي فِي الجَنّةِ.
হে বৎস! তা (অর্থাৎ এমন হিংসা-বিদ্বেষ ও অন্যের অকল্যাণের চিন্তামুক্ত কলবের অধিকারী হওয়া) আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নত জিন্দা করল সে আমাকে ভালবাসল। যে আমাকে ভালবাসল সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৮
তাঁর দিলের স্বচ্ছতার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন উজানীর মরহুম পীর হযরত মাওলানা মুবারক করীম রাহ.। হিফজ পড়ার সময় খেড়িহর বাজারের মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শামসুল হক কালা আর তাঁর দিল সাদা।’
এছাড়া মধুপুরের পীর হযরত মাওলানা আবদুল হামীদ দা. বা. একবার খেড়িহর মাদরাসার মাহফিলে এসেছিলেন। বাবার সঙ্গে মুলাকাত করে আমাকে বলেছিলেন, ‘যা দেখলাম তাতে দিল ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’ বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহু আকবার! কী যে দেখলাম! কেমন ঈমানদার আহলে দিল মানুষ দেখলাম।’ অথচ আমি বাবার ব্যাপারে ইতিপূর্বে তাকে কিছুই বলিনি। তিনি যা বলেছেন তা কেবল প্রথম দর্শনের অনুভূতি থেকেই বলেছেন।
তাকওয়ার যিন্দেগী
বাবার জীবনের উল্লেখযোগ্য আরেকটি গুণ ছিল তাকওয়ার যিন্দেগী। তাঁর যবানী আস্তাগফিরুল্লাহ অপেক্ষা আমলী এস্তেগফার ছিল অধিকতর শক্তিশালী। এক্ষেত্রে তিনি اتّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النّاسِ (হারাম থেকে বেঁচে থাকো, তুমি হবে সবচে বড় ইবাদতগুযার)-এর বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন। বিশেষ করে নজর ও যৌবনের হেফাজতে তিনি ছিলেন উপমাতুল্য মানুষ।
অর্থহীন কথা ও কাজ পরিহার
অর্থহীন কথা ও কাজ পরিহার করা ইসলামের মহান সৌন্দর্য। আত্মশুদ্ধির লাইনে সালেকের জন্য অতীব জরুরি বিষয়। এক্ষেত্রে বাবাজান مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ (ব্যক্তির সুন্দর মুসলিম হওয়ার এক নিদর্শন, অর্থহীন কাজ ত্যাগ করা।)-এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিনা প্রয়োজনে ঘর বা মাদরাসা থেকে কখনোই বের হতেন না। এক্ষেত্রে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী- وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ (তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়।)-এর যথার্থ পাবন্দ ছিলেন। চাঁদপুর কচুয়া মাদরাসার নাযেম দামুলিয়ার হুজুর রাহ. (যিনি ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ বড় বড় আলেমের শ্রদ্ধেয় উস্তায) একাধিকবার আমাকে বলেছেন, ‘আমরা আপনার বাবার হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্র জীবনের সাথী। তিনি ছাত্র জীবনে সবসময় পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতেন। কখনো দোকান-পাট বা বাজার-ঘাটে গল্প-গুজবের অভ্যাস তাঁর ছিল না। তিনি খুবই নেক মানুষ ছিলেন।’
দুনিয়াবিমুখতা
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক দুনিয়াবিমুখ মানুষ। নির্মোহতা ছিল তাঁর সৌন্দর্য। অর্থ ও প্রাচুর্যের ফিকির তাঁর কখনোই ছিল না। একাধিক আয়-ইনকামের বহু সুযোগ বাবা হাতছাড়া করেছেন। এ ব্যাপারে একটি বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে, যা ঘটেছে আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল পূর্বে। কাশিপুর মাদরাসার শিক্ষকতার সময় বাবার মাসিক সম্মানী ছিল একুশ অথবা সাতাশ টাকা। তখন ঢাকার বড় কাটরা মাদরাসা থেকে ২৫০ টাকা সম্মানীতে দাওরায়ে হাদীসের উস্তায হওয়ার প্রস্তাবও এসেছিল। লাকসামের শাহপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে ১,০০০ টাকা সম্মানীতে শিক্ষকতার সম্মানজনক সুযোগও তাঁর এসেছিল। কিন্তু এমন সুবিধাজনক প্রস্তাব তিনি নির্দ্বিধায় এড়িয়ে গেছেন। অথচ বাবা কাশিপুর ছেড়ে ওসব মাদরাসায় গেলেও তো তালীমে দ্বীন ও মাদরাসার খেদমতই হতো। সাথে কিছু হালাল উপার্জনেরও ব্যবস্থা হত। এতে নাজায়েযের কিছুই ছিল না। কিন্তু সূক্ষ্ম বিবেচনায় এখানে যুহদ ও ইখলাসের কমতির একটা ব্যাপার ছিল। হয়তো এ কারণেই ‘মুখলিস’ শব্দটি প্রায় তাঁর নামের অংশই হয়ে গিয়েছিল। সে অঞ্চলের কারো মুখে বাবার আলোচনা এলেই তাদেরকে বলতে শোনা যায়, হুজুর খুব সাদামাটা মুখলিস মানুষ। হাদীসের ভাষায়- ثُمّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي الْأَرْضِ (পৃথিবীতে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দান করা হয়।)-এর এটিও এক প্রকার। সেজন্যই বলছিলাম, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক দুনিয়াবিমুখ মানুষ। নির্মোহতা ছিল তাঁর সৌন্দর্য।
আমিত্ব বর্জন ও মাকামে ফানাইয়্যাত
সুলূকের লাইনে ‘আমিত্ব বর্জন’ বা ‘ফানা’-এর মাকাম হল সবচেয়ে কঠিন স্তর। বহু সাধনার পরও এটি সহজে অর্জিত হয় না। কিন্তু আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমতে এ মাকামের অনেকগুলো গুণ তাঁর স্বভাবের মধ্যেই ছিল। নিচের কয়েকটি ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ :
১. বাবা মীযান কিতাব পড়েছেন নোয়াখালীর আমানতপুর মাদরাসায়। এ জামাতে তাঁরা ছিলেন তিন জন। সে সময় মীযান পড়াতেন থানভী সিলসিলার প্রসিদ্ধ বুযুর্গ মাওলানা কোব্বাদ রাহ.। একদিন কোব্বাদ ছাহেব বললেন, শামসুল হক সবক শোনাও।
হুকুম করা মাত্রই বাবা পুরো সবক নিভুর্ল শুনিয়ে দিলেন। বাকি দুজনকে সবক শোনাতে বললে তারা সবক শোনাতে পারেনি।
হুজুর বললেন, তোমরা কানে ধরো। আদেশ হওয়া মাত্রই দুইজনের সঙ্গে বাবাও কানে ধরলেন।
হুজুর বললেন, শামসুল হক কেন কানে ধরেছ? তুমি তো সবক পেরেছ।
তিনি বললেন, আপনি তো বলেননি, যারা সবক পারনি তারা কানে ধরো। আপনি তো বলেছেন, তোমরা কানে ধরো। এর মধ্যে আমিও তো আছি।
একথা শুনে কোব্বাদ ছাহেব রাহ. বাবাকে কাছে নিয়ে অনেক দুআ দিয়েছেন। বাবাকে আমি বলতে শুনেছি, আশা করি, আল্লাহ তাঁর দুআ কবুল করেছেন।
এ ঘটনাটি আমার সরাসরি তাঁর থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছে।
২. বাবা যখন একজন স্বনামধন্য মুদাররিস তখনও তিনি কুরআন শুদ্ধ করার বিভিন্ন কেরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিঃসংকোচে চলে যেতেন। ছাত্র হয়ে কুরআন শিখতেন। আল্লাহু আকবার!
৩. বাবার আরেকটি গুণ ছিল মাদরাসার যেকোনো সাধারণ কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতেন। নিজের হাম্মাম নিজেই পরিষ্কার করতেন। সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও নিজের মাথায় নিজেই পানি দিতেন। খেড়িহর মাদরাসার কিছু ফসলি জমি ছিল। সেগুলোর চাষাবাদে অন্যদের সাথে নিজেও শরীক হতেন। কৃষকদের মতো তিনি নিজেও কাজ করতেন।
ইস্তেগনা বা মাখলুক থেকে নির্মুখাপেক্ষিতা
এটি ছিল তাঁর বিশেষ গুণ। অথচ তাঁর মাদরাসার মুতাওয়াল্লী ছিলেন দেশের বড় ধনাঢ্য ব্যক্তি আলহাজ্ব আবদুল ওয়াদুদ খান। সেই সুবাদে অনেক বড় বড় সম্পদশালী ব্যক্তির সাথে স্বাভাবিকভাবেই বাবার সাক্ষাৎ হত। মুতাওয়াল্লী সাহেবও বাবাকে তাদের সাথে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তিনি কখনও তাদের সাথে দীর্ঘ সম্পর্ক করেননি। মাদরাসার স্বার্থে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই যোগাযোগ রাখতেন। নিজের হাজত নিয়ে তাদের কারো কাছে তো নয়ই এমনকি খান সাহেবের কাছেও কখনো কোনো কথা বলেননি। অথচ খান সাহেবের সাথে তাঁর বেতাকাল্লুফ সম্পর্ক ছিল এবং সংসারে আর্থিক সংকটও ছিল। আবদুল ওয়াদুদ সাহেবও অনেকের কাছে একথা বলেছেন, হুজুর আজব মানুষ; কখনো কিছু বলেন না। অথচ খান সাহেবের মেযাজ ছিল ভিন্ন রকম। কোনো আলেম তাঁর কাছে কোনো হাজতের কথা প্রকাশ করলে খুশি হতেন এবং সহযোগিতাও করতেন।
বিনয়
বিনয়ের গুণেও তিনি একজন নীরব সাধক ছিলেন। তাঁর মধ্যে স্বভাবগত জালাল প্রবল থাকার কারণে এই গুণটির কথা তাঁর ছাত্রদের কাছে প্রসিদ্ধ হয়নি। চালচলন ও কথাবার্তায় সেটা প্রকাশ পেত না। একান্ত অবস্থায় সেটা কখনো কখনো অনুভূত হত। খেড়িহরের শিক্ষক মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব আমাকে বলেছেন, হুজুরকে অনেকবার বোঝালাম, দয়া করে কোনো হাদীসের কিতাবের দরস দিন। অন্তত আমাকে একটি হাদীস পড়িয়ে হলেও ইযাজত দিতে হবে। বাবা বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু সে ছিল নাছোড়বান্দা। একপর্যায়ে বাবা বললেন, দেখো, হাদীসের দরস দিতে হলে এই এই মাপের আমলী ও মুত্তাকী হতে হয়। আমার মধ্যে এগুলো নেই।
সম্ভবত, মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব পরবতীর্তে বাবার কাছে দু-একটি হাদীস পড়তে সক্ষম হয়েছেন এবং হাদীসের ইজাযতও লাভ করেছেন।
কানাআত বা অল্পেতুষ্টি
এটিও তাঁর বিশেষ গুণ ছিল। নির্মোহতার কারণেই মানুষের মধ্যে অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জিত হয়। বাবার জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূল মুহূর্তে এ গুণটি খুব লক্ষ করেছি। পান্তা ভাত, সাথে একটু কাঁচা মরিচ বা পোড়া মরিচ পেলেই খুব খুশি হয়ে যেতেন। আমার খুব মনে পড়ে, খেড়িহরে ছোটবেলার কথা। মাদরাসার দস্তরখানে একেবারে সাধারণ মানের লাবড়া দেওয়া হত, তাও হলুদ-মরিচ কম দিয়ে। কখনো ভাতের সাথে শুধু এ্যাংকর ডাল কোনোরকম রান্না করা হত। সে সময়ও তাঁর মধ্যে কানাআতের গুণ সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখেছি। তাঁর মুহতামিম হওয়ার শান এগুলোতে প্রকাশ পেত না। আইন প্রয়োগের বেলায় কেবল বোঝা যেত তিনি একজন যোগ্য মুহতামিম। আমি অনেকসময় রাগ করে বলতাম, এগুলো খাব না।
তিনি বলতেন, ‘কষ্ট করি খা। ধনীদের পাঁচ শ বছর আগে জান্নাত পাইবি।’
দীর্ঘ নীরবতা
জীবনের বহু ক্ষেত্রে দীর্ঘ নীরবতা ছিল তাঁর পরম সৌন্দর্য। বিপদ-আপদে চুপচাপ থেকে কষ্ট সহ্য করে নেওয়ার অভ্যাস তাঁর ছিল। কখনো কখনো প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর দীর্ঘ নীরবতা আমাদেরকে খুব অভিভূত করত। নিন্দুকদের সকল সমালোচনার জবাব তাৎক্ষণিক দেওয়ার জরুরত তিনি মনে করতেন না। বরং তাঁর স্বভাবজাত নীরবতা দিয়েই অনেকসময় নিন্দুকদের সমালোচনার ঝড় থেমে যেত। তাঁর নীরবতার কোনো কোনো হালাতে কবির এই কবিতা অবশ্যই প্রযোজ্য হবে ইনশাআল্লাহ!
إذا سكتوا رأيت لهم جمالا + وإن نطقوا سمعت لهم عقولا
তাঁরা নীরব থাকলে সৌন্দর্য দেখতে পাই।/তাঁরা কথা বললে জ্ঞানের পরিচয় পাই।
মাদরাসার প্রতি সীমাহীন আন্তরিকতা
তিনি মাদরাসাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসতেন। সর্বদা মাদরাসার স্বার্থকে নিজের স্বার্থের উপর প্রাধান্য দিতেন। মাদরাসাকে নিজের পরিবারের চেয়েও বেশি মহব্বত করতেন। মাদরাসার প্রতি সীমাহীন আন্তরিকতা ও ভালবাসা তার রক্ত-মাংসে মিশে ছিল। শুধু দায়িত্ব বা মুহতামিম হওয়ার কারণে নয়, বরং স্বভাবগতভাবেই এই ভালবাসা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘ ১৫ বছর কাশিপুর মাদরাসায় শিক্ষকতার পর খেড়িহরে যখন যোগ দিলেন তখন খেড়িহর মাদরাসা নতুন প্রতিষ্ঠান। কাশিপুরের বহু ছাত্রের মনের ইচ্ছা ছিল, বাবার সাথে খেড়িহরে এসে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু তিনি স্পষ্ট ভাষায় তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বললেন, এর দ্বারা কাশিপুর মাদরাসা ভেঙে যাবে। মাদরাসার ক্ষতি করা ঠিক নয়। এটা তো স্পষ্ট কথা, তিনি দলে দলে ছাত্র নিয়ে শান-শওকতের সাথে খেড়িহরে এলে তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত। বাহ্যত খেড়িহরেরও ফায়দা হত। কিন্তু যেহেতু স্বভাবগতভাবে আল্লাহ তাকে আত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন তাই তিনি এমনটি করতে রাজি হননি।
খেড়িহর মাদরাসা পরিচালনাকালে বিরতিগুলোতে বেশিরভাগ সময় মাদরাসা পাহারা দিতেন। এমনকি ঈদের দিনগুলোতেও মাদরাসায় অবস্থান করতেন। ঈদের আনন্দ বাবার সাথে বাড়িতে উপভোগ করেছি- এমন কোনো স্মৃতিই আমার মনে পড়ে না। ঈদ উপলক্ষে আলাদা বাজার বা কেনাকাটার ইতিহাস তার অভিধানে পাওয়া যাবে না। ছোটবেলায় যখন অভিমান করে তাঁকে বলতাম, ঈদে আপনি এলেন না কেন?
তিনি তার স্বভাবজাত তিরস্কার মিশ্রিত সুরে বলতেন, ‘সেমাই খাওনেল লাই নি? ইতান অঁার (আমার) দরকার নাই। ঈদের দিন অঁাই (আমি) মাদরাসায় থাইকলে মাদরাসার অনেক ফায়দা অয়।’
মাদরাসার কাজে কোথাও গেলে রিক্সা ভাড়া বেশি চাইলে বলতেন, ‘অঁাই (আমি) আঁডি (হেঁটে) যাইয়ুম, মাদরাসার পয়সা বাইছবো।’
এই বলে হাঁটা শুরু করতেন। মাদরাসার প্রয়োজনে সফর হলে থাকা-খাওয়ার ক্ষেত্রে মাদরাসার আর্থিক বিষয়ে খুব খেয়াল রাখতেন। কীভাবে কম খরচে মাদরাসার কাজ সেরে সফর খুব দ্রুত শেষ করা যায়- সে ব্যাপারে অস্থির থাকতেন।
ওফাতের মাত্র দুই-তিন দিন আগের ঘটনা। তখন বাবা কুমিল্লার একটি হাসপাতালে ছিলেন। নাকে-মুখে পাইপ লাগানো। খাবার চলছিল পাইপের সাহায্যে। এমন পরিস্থিতিতেও মাহফিলের দিন নিজ থেকেই এই বলে চিৎকার করে উঠলেন, মাইকের আওয়াজ নাই কেন? আজকে তো মাহফিল।
সবাই বলল, আপনি তো হাসপাতালে আছেন।
ব্যস! তাঁকে আর মানানোই গেল না। জোর করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মাদরাসায় চলে গেলেন। নাকে নল নিয়েই স্টেজে উঠে ওয়াজ শুনতে লাগলেন। তখন ওয়াজ করছিলেন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ মাওলানা মুশতাকুন্নবী। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, গুরুতর অসুস্থতা এবং এমন অসহনীয় অবস্থায়ও হাসপাতালের বেড থেকে মাহফিলে হাজির হওয়া, এমনকি স্টেজে হাজির হয়ে যাওয়া- নজীরবিহীন ঘটনা। আল্লাহু আকবার, মাদরাসার প্রতি কেমন জানকোরবান দরদ! এক্ষেত্রে তাঁর উপমা আসলে তিনি নিজেই।
আম্মা ও বড় ভাইয়ের যে অবদানটির কথা ভোলা যায় না
এ কথা ঠিক যে, বাবা সম্পদের অপচয় কখনোই পছন্দ করতেন না। ভালো খাবার-দাবার আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় অর্থ খরচ করা তাঁর মধ্যে ছিলই না। আর্থিকভাবে তিনি অস্বচ্ছল ছিলেন। কিন্তু কাউকে কখনোই অভাব বুঝতে দিতেন না। তাঁর সকল খরচের উৎস ছিল একটি মাত্র আয়। এজন্য তাঁর কোনো দুঃখও ছিল না। কাশিপুরের যামানায় বিরতিগুলোতে বাড়িতে এসে ধানের মৌসুমে দাদার ফসলি জমিগুলোতে নিজেই চাষাবাদ করতেন। হালচাষ, ধান রোপণ, ধান কাটা, ধান মাড়ানো এমনকি ধান সেদ্ধ করে রোদে দিয়ে এগুলো গোলাঘরে নেওয়া পর্যন্ত যে কোনো ধরনের কাজই তিনি স্বচ্ছন্দ্যে করতেন। সে সময়ে শুক্রবারগুলোতে বাড়িতে এসে খাল-বিলে মাছ ধরতেন। এক কথায় সংসার গোছানো এবং নিজ সন্তানদের কল্যাণকামিতায় তিনি কখনোই উদাসীন ছিলেন না।
যখন বাবা খেড়িহর এলেন তখন মাদরাসার ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সাংসারিক কাজে এত সময় দেওয়ার সুযোগ হতো না। যে কারণে সংসারে অনেকসময় টানাপোড়েন থাকত। এরপরও বাবা মাদরাসাকে প্রাধান্য দিতেন। সংসার ও নিজের পরিবারকে সাধ্যের চেয়ে বেশি ভাবনায় আনতেন না। সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও মাদরাসার জন্য এমন আন্তরিক হয়ে খেদমত করার পেছনে আম্মার সীমাহীন অবদান রয়েছে। আম্মা সাংসারিক কোনো বিষয়ে বাবাকে কখনোই চাপ দিতেন না। কখনো এমনও হত, দিনকে দিন চলে যেত কিন্তু ঘরে খাবারের কোনো কিছু থাকত না। আম্মা বরাবরই সালাতুল হাজত পড়তে থাকতেন। হঠাৎ দেখা যেত, ঘরের দরজায় কেউ আওয়াজ করছেন। দরজা খুলে দেখতেন অপরিচিত কেউ কিছু দিয়ে চলে গেছে। অনেকসময় এমনও হত, আম্মা নিজে না খেয়ে রোযা রাখতেন। নিজের খাবারটুকু সন্তানদের জন্য রেখে দিতেন। তবুও বাবাকে সাংসারিক বিষয়ে পেরেশান করতেন না। বড় ভাইজান (মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম) করাচি থেকে আসার কয়েক বছর পর থেকে সাংসারিক পুরো দায়-দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। আম্মা-আব্বা কাউকে আর এ ব্যাপারে কষ্ট করতে দেননি। তিনি আন্তরিকতার সাথে যেভাবে আব্বা-আম্মার আজমত ও খেদমতে নিবেতিপ্রাণ ছিলেন, তেমনি ভাই-বোনদেরকে নিজ সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। তাদের প্রতি সীমাহীন খেয়াল রাখতেন। তিনিই পারিবারিকভাবে আমাদের জন্য ঢাকার অধিবাসী হওয়ার রূপরেখা তৈরি করেন। মনে আছে, জীবনের প্রথম লিচু বড় ভাইজান আমাদেরকে খাইয়েছেন। করাচি থেকে আসার সময় ঢাকা থেকে অনেক কিছুর সাথে এ ফলটিও এনেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যেককে আপন শান মুতাবেক জাযায়ে খায়ের দান করুন।
মুহতামিম জীবনের কিছু বৈশিষ্ট্য
১. সত্যবাদিতায় অবিচলতা
পরিচালনার মসনদে বসে সব পরিস্থিতিতে সত্যবাদিতার উপর অবিচল থাকা কত যে জটিল ও কঠিন বিষয় তা কেবল দায়িত্বশীল ও পরিচালকগণ অনুমান করতে পারবেন। প্রতিকূলতার সময় এটি পাহাড় ডিঙ্গানোর চেয়েও বড় বিপদ মনে হয়। কিন্তু বাবার মাদরাসা পরিচালনার দীর্ঘ ৪৫ বছরের জীবনে স্বাভাবিক অবস্থায় তো বটেই, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সত্য বলা এবং সততায় অবিচল থাকা ছিল তাঁর জীবনের অনন্য এক মহৎ গুণ। হালাত খুব নাযুক হলে প্রয়োজনে দীর্ঘ নীরবতা অবলম্বন করতেন এবং ধৈর্য ধরতেন, তবুও মিথ্যা বলতেন না। এমনকি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া বা বিরোধীকে ঘায়েল করার জন্য অপবাদের পথ বেছে নেওয়া তো তার জন্য ছিল অসম্ভব ও কল্পনাতীত ব্যাপার। মুহতামিম হওয়ার পূর্বেও তিনি প্রায় ১৫ বছর কাশিপুর মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। সেখানেও বহু বিষয়ে তাঁকে মজলুম হয়ে ঠকতে হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এ মহৎ গুণটির তিনি মহান ধারক ছিলেন।
২. বিরোধীদের সমালোচনায় তার কাজে প্রভাব পড়ত না
মাদরাসা পরিচালনার দীর্ঘ জীবনে তাঁকে অনেক সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হয়েছে; কিন্তু এতে তার পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি। কাজের গতি ও আবেগ নষ্ট হয়নি। দক্ষ নেতৃত্বের জন্য এটি যে একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ। এ ব্যাপারে বাবার বক্তব্য ছিল ভিন্ন রকম। তিনি বলতেন, ‘সমালোচনায় মন খারাপ করতে নেই। কাজ করলেই সমালোচনা হয়, যারা কাজ করে না তাদের কোনো সমালোচনা হয় না।’ খেড়িহর মাদরাসা পরিচালনার প্রায় অর্ধ শতাব্দীকালের এই সময়ে অনেক ডাহা মিথ্যা অপবাদের ঝড়ও তাঁর উপর দিয়ে বয়ে গেছে; অপরদিকে তিনি ছিলেন খুব জালালী তবিয়তের এবং তার রাগও ছিল প্রচণ্ড। এর পরও তিনি কীভাবে এগুলো সয়ে গেছেন তা ভাবতে অবাক লাগে। এতে এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি মাদরাসা পরিচালনা করতেন শুধু আল্লাহর জন্য।
৩. ইবাদত ও খেদমত হিসাবে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করতেন
আমি একাধিকবার বাবাকে এই মর্মে অনুরোধ করেছিলাম, জীবনের এই কঠিন সময়ে আপনি মুহতামিমের দায়িত্ব ছেড়ে বিশ্রাম নিন?
উত্তরে তিনি বিভিন্ন সময় যা বলেছিলেন তা হল,
* দেখো, বিশ্রামে গিয়ে কী লাভ? নিজে দ্বীনের কাজ করব, অন্যদের বুঝিয়ে দেব, কাজ বুঝে নেব- এটাই তো জীবন। বাবার এ উত্তরে বোঝা যায়, পরিশ্রমই ছিল তার জীবনের বিশ্রাম। সত্যিই তিনি ছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমী। বড়রা এমনই হয়ে থাকেন।
* যে দায়িত্ব না চাওয়া সত্ত্বেও সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে সেটাতে আল্লাহর সাহায্য থাকে। এ দায়িত্ব তো আমি চেয়ে নিইনি। এমন ইচ্ছাও আমার ছিল না। আমি এর যোগ্যও নই। আমি খেড়িহর মাদরাসার একটি কামরায় থাকতাম। একদিন কামরা ঝাড়– দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে খবর এল, ‘খতীবে আযম সিদ্দীক আহমাদ ছাহেব আমাকে দফতরে ডাকছেন। গিয়ে দেখি, তাঁরা আমার মুহতামিম হওয়ার ফায়সালা চূড়ান্ত করে রেখেছেন। আমাকে জানানোর জন্যই কেবল ডেকেছেন। নিজের অযোগ্যতা ও অপারগতার কথা যতই পেশ করলাম তাঁরা কোনোভাবেই আমার ওযর কবুল করলেন না।’
বাবার বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, এ দায়িত্ব যেহেতু আমার ইচ্ছা ছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত হয়েছে তাই এটাকে নিজ ইচ্ছায় ছাড়া যাবে না। সাধ্যমত এ কাজ ধরে রাখতে হবে।
আসলে তিনি যশ-খ্যাতি কিংবা আয়েশী জীবন বা হুব্বে জাহ হিসাবে এ ‘মানসাব’ গ্রহণ করেননি; খালেছ ইবাদত ও দ্বীনের খেদমত মনে করেই এ দায়িত্ব নিয়েছেন।
৪. আমানতদারির অনুপম দৃষ্টান্ত
বাবার মাদরাসা পরিচালনার উল্লেখযোগ্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, হিসাব-নিকাশ। মাদরাসার আসবাব হেফাজতসহ সকল বিষয়ে যথাযথ আমানতদারি। আমানতের দুর্বলতা ঈমানের দুর্বলতা। আমানতের হেফাজত ঈমানের হেফাজত। এ ব্যাপারেও তিনি ছিলেন উপমাতুল্য মানুষ। লেনদেনের স্বচ্ছতা ও আমানতদারি রক্ষায় তিনি সুবিদিত ছিলেন। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুতাওয়াল্লী সাবেক এমপি আবদুল ওয়াদুদ খান রাহ. এবং মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক খতীবে আযম সিদ্দীক আহমাদ রাহ. তাঁর প্রতি সিমাহীন খুশি ছিলেন। তাঁর এ আমানতদারি নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছেও মকবুল হয়েছে। যার আলামত নিম্নরূপ :
* আল্লাহ তাঁকে আকস্মিকভাবে মৃত্যু দেননি। এমন হালতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে যে, মাদরাসা বা কারো হিসাব তার সাথে জড়িত ছিল না।
* ওফাতের কিছুদিন পূর্বে তিনি মাদরাসায় এক লক্ষ টাকা দান করেন। মাদরাসার নায়েব সাহেব হুজুর এ মর্মে একটি রশিদ করতে চাইলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন, জীবনের একটা বড় অংশ আমি এ মাদরাসার খেদমতে ছিলাম। এ দীর্ঘ জীবনে আমার অনিচ্ছায় কোনো ভুল হয়েছে কি না- জানি না। তাই আমার ইচ্ছা হল, রশিদ করা ছাড়াই এ টাকাগুলো মাদরাসার কাজে ব্যয় করা হোক। আল্লাহু আকবার! এটাকে বলে তাকওয়া। একেই বলে আল্লাহর সামনে হাযিরীর ভয়।
৫. বিলাসিতামুক্ত অনাড়ম্বর জীবন
দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাদরাসার মুহতামিম হয়েও তিনি ছিলেন সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। হযরত ইবনে মাসউদ রা.-এর হাদীসে সাহাবীদের একটি সিফাত বর্ণিত হয়েছে। তা হল, সাহাবীরা ছিলেন সর্বাধিক লৌকিকতামুক্ত। এ গুণ তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভালো কাপড়, আয়েশী চালচলন, উন্নত খাবার-দাবারের ফিকির তাঁর মধ্যে ছিলই না। যেকোনো খাবারে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। সাধারণ লাবড়াও মুরগির গোস্তের মতোই খেতে পারতেন। ঘটনাক্রমে ভালো খাবারের ব্যবস্থা হলে সেটাও খুব মজা করে খেতেন এবং খুব বেশি বেশি আল্লাহর শোকর আদায় করতেন। অনুন্নত কষ্টকর খাবারের প্রভাব তার কাজকর্মে কখানোই পড়ত না। উন্নত খাবার-দাবার খেয়ে একজন মানুষ যেমন উদ্যমী থাকে, এর বিপরীত হালতেও তিনি একইরকম থাকতেন। কষ্ট ও অনাড়ম্বরতায় ছিল তার প্রশান্তি।
৬. হুকুকের ব্যাপারে দায়িত্বসচেতনতা
উস্তায-ছাত্র ও মাদরাসার হক আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন পূর্ণ সচেতন। ফরজ-ওয়াজিবের মতোই এগুলোর প্রতি তাঁর পূর্ণ মনোনিবেশ ছিল। আমাকে আমার প্রিয় উস্তায হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব (ভাটরার হুজুর) বলেছেন, ‘মুহতামিম সাহেব হুজুর দূরবতীর্ অঞ্চলের যেসব উস্তায রমযানে বাড়িতে অবস্থান করতেন তাঁদের বেতন নিজেই বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসতেন।’
এ কথাটি আমাকে আমার আরেক উস্তায মাওলানা আবদুল বারী রাহ. (ভবানীর হুজুর)ও বলেছেন। যেসকল ছাত্র পড়াশোনায় ভালো ছিল কিংবা মাদরাসার কাজে-কর্মে তৎপর ছিল তাদের প্রতি তিনি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। নিজের হাতে অর্থ না থাকলে হাস্য-রসিকতা ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে দুআ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের মন খুশি করে দিতেন। এমনিতে তিনি জালালী মেযাজের ছিলেন। কিন্তু হক আদায় না করার বাহানা হিসাবে কখানেই তিনি এ জালাল প্রকাশ করেননি। সেক্ষেত্রে তিনি হতেন অত্যন্ত জামালী ও বিনয়ী। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুর সময় তাঁর কোনো পাওনাদার ছিল না। তিনি অন্যদের কাছে পাওনা ছিলেন।
৭. প্রতিষ্ঠানের আইন-কানুনের পাবন্দী
মাদরাসার আইন-কানুনের প্রতি তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অসাধারণ, অদ্বিতীয় ব্যক্তি। মাদরাসার নূরানী ও হিফজ বিভাগের ছাত্ররা যেভাবে উস্তাযের ভয়ে আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, ঠিক বাবা মুহতামিম হয়েও মাদরাসার আইনগুলো এমন গুরুত্বের সাথেই পালন করতেন; যেন তিনি কারো অধীনে চাকরি করছেন। খোলার তারিখের প্রতি ছিল তার বিশেষ গুরুত্ব। আশি-পঁচাশি বছর বয়সেও খোলার আগের দিন মাদরাসায় হাযিরী ছিল তার জীবনের এমনি এক অনন্য গুণ, হয়তো এক্ষেত্রে তিনিই তাঁর উপমা। বেশিরভাগ ছুটির দিন বাড়ি যেতে দেরি করতেন, কিন্তু খোলার দিনের হাযিরীতে অনুপস্থিতি স্বপ্নেও ভাবা যেত না। ভাবতে অবাক লাগে, বয়োবৃদ্ধ অবস্থায়ও সাধারণ বিপদ আপদ ও দুর্যোগ তার জন্য কখনোই প্রতিবন্ধক হতো না। দেখা যেত প্রবল বর্ষণ হচ্ছে, সাথে বজ্রপাতও, তার পরও দীর্ঘ ৮/৯ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যথাসময়ের পূর্বেই হাযির। আইনের প্রশ্নে কখনোই তিনি নিজ আত্মীয় ও সন্তানদের কোনো ধরনের ছাড় দিতেন না; বরং এদের প্রতি তিনি অধিকতর কঠোর থাকতেন।
একবারের ঘটনা। তখন আমার বয়স দশও হয়নি। আমি ছিলাম হিফজ বিভাগের ছাত্র। জুমার দিন আসরের পর মাদরাসার সকল ছাত্রদেরকে নিয়ে বাবা মাতবাখের জন্য গাছের লাকড়ি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করছিলেন। আমি ও আরেকজন (তিনি এখন এক মাদরাসার মুহাদ্দিস) মসজিদের ছাদে গম্বুজের পাশে লুকিয়ে খেলা করছিলাম। কোনোভাবে বাবা এ খবর পেয়ে সকল ছাত্রের সামনে আমাকে খুব মার লাগালেন। এমনকি শরীরে দাগ পড়ে গেল। বললেন, মাদরাসার কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তোরা আইন না মানলে অন্যরা আরো বেশি উল্টা-পাল্টা করবে।
৮. পরিচালনার পাশাপাশি দরসের পূর্ণ পাবন্দী
দীর্ঘ মুহতামিম-জীবনে তার কোনোদিন দরস ছুটেছে বলে আমার জানা নাই। মাদরাসার কোনো তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কখনো দু-এক দিন দূরের সফরে থাকলে ভিন্ন কথা। একথা ঠিক যে, মাঝেমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দরস প্রদান করা মুহতামিমদের জন্য কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু যথাযথ পরিচালনার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিয়মিত দরস প্রদান যে কত কঠিন কাজ তা কেবল মুহতামিম সাহেবগণ ভালো বুঝবেন। মূলত বাবার ইখলাস ও অসাধারণ হিম্মত এবং তালেবে ইলমদের হকের ব্যাপারে দায়িত্ব সচেতনতা সর্বোপরি দরস ও তাদরীসের প্রতি তার অস্বাভাবিক টান- এ কাজ তাঁর জন্য সহজ করে দিয়েছে। এ মুহূর্তে এ ধরনের আরেকজন মুহতামিমের নাম আমার মনে পড়ছে। তিনি হলেন, জামিয়া সাহবানিয়া, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকার মুহতামিম মুফতী নিয়ামাতুল্লাহ সাহেব। নিয়মিত দরসের পাশাপাশি মাদরাসা পরিচালনা এবং হাকিমির কাজও তিনি অনায়াসে করতে পারেন। এতে দরসী নিয়মতান্ত্রিকতা ও মানসম্পন্ন দরস প্রদানের মধ্যে কোনোই প্রভাব পড়ে না। এ গুণের অধিকারী সকল পরিচালকদেরকে আল্লাহ জাযায়ে খায়ের দান করুন- আমীন।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]