মাহে রমযানের পর
সওম ও রমযানের শিক্ষা অক্ষয় হোক আমাদের জীবনে
মাহে রমযান আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত ছিল। এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। সওম ও তারাবীর বিশেষ বিধানের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য অর্জনের উপায় নির্দেশ করেছেন। তাকওয়ার শিক্ষার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়ার পথনির্দেশ দান করেছেন। আন্তরিকতার সাথে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, এইসকল বিষয়ের সমন্বয়ে মাহে রমযান সত্যি সত্যি আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল। এই মাস আমাদের মধ্য থেকে বিদায় নিয়ে গেছে। মানুষের জানা নেই, আগামী রমযান পর্যন্ত কারা কারা বেঁচে থাকবেন। কাজেই এই নিআমতের শোকরগোযারির পাশাপাশি এর প্রভাব কীভাবে আমাদের কর্ম ও জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে- এই চিন্তা করাটা আমাদের কর্তব্য।
মাহে রমযানের শিক্ষা যদি আমরা বছরব্যাপী অনুসরণ করতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন সবদিক থেকে সুন্দর হতে পারে। ইবাদত-বন্দেগীর দিক থেকেই ধরা যাক। মাহে রমযানে পূর্ণ মাস সিয়াম পালনের বিধান ছিল। ফরয হওয়ার কারণে সর্বস্তরের মুসলিমেরা তা পালন করেছেন। এ থেকে বোঝা গেছে, সওম পালনের সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। ইচ্ছে করলে আমরা তা পালন করতে পারি। কাজেই রমযানের পরও কিছু কিছু নফল সওম পালনের চেষ্টা যদি আমরা করি, তাহলে আশা করা যায়, সেটাও আমাদের জন্য সম্ভব হবে। এভাবে সওমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সুফল আমরা বছরব্যাপী লাভ করতে পারব।
মাহে রমযানের রাতে আমরা দীর্ঘ সময় তারাবীর নামায পড়েছি। সাহরীর জন্য শেষ রাতে উঠেছি। এই ধারাটা রমযানের পরও সে সময়ের মতো করে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা যায়। রমযানের পরে তারাবী নেই, কিন্তু তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল আছে। কাজেই সন্ধ্যায়, রাতে, শেষরাতে কিছু সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা কিয়ামুল লাইলের সুফল ও সৌভাগ্য বছরব্যাপী অর্জন করতে পারি।
মাহে রমযানে বিশেষভাবে ছিল দুআ, ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াতের আমল। এই বরকতময় আমলগুলো তো সারা বছরই উন্মুক্ত। যে যত বেশি অর্জন করতে চায় অর্জন করতে পারে। নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও মাসনূন দুআ-যিকিরের আমলের মাধ্যমে আমরা সারা বছর আল্লাহ তাআলার রহমত লাভ করতে পারি। মাহে রমযানে আমাদের মধ্যে আমলের যে ধারা তৈরি হয়েছিল সে ধারাটি যেন বন্ধ না হয়। কিছু কিছু হলেও চলমান থাকে- এ চেষ্টা আমাদের করতে হবে।
এ তো গেল ইবাদতের কিছু দিক। আরো কিছু ইবাদতও এ মাসে ছিল যেমন, ই‘তিকাফ, দান-সদকা ইত্যাদি। এককথায় ইবাদতের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু অগ্রসরতার যে অনুশীলন এ মাসে হয়েছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে বছরের অবশিষ্ট সময়টুকুতেও আমরা এক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
মাহে রমযানে সওমের বিধানের মধ্যে বিশেষভাবে আছে স্বভাব-চরিত্র ও আদব-আখলাক সংশোধনের শিক্ষা। অত্যন্ত তাকীদের সাথে রোযাদারের জন্য মিথ্যাচার, হৈচৈ ও গর্হিত কর্মকাণ্ড বর্জনের নির্দেশনা হাদীস শরীফে এসেছে। গীবত-শেকায়েত, কটূক্তি-কটাক্ষ, ঝগড়া-বিবাদ ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। পানাহারে হালাল-হারামের কথা তো বলাই বাহুল্য। এভাবে কর্ম ও আচরণের শুদ্ধির যে বার্তা সওমের বিধানে ছিল এবং যার অনুসরণের কিছু না কিছু চেষ্টা মাহে রমযানে করা হয়েছে, আমাদের কর্তব্য, বছরের অবশিষ্ট সময়েও সে শিক্ষার অনুসরণ করা। আমরা যদি আমাদের সামষ্টিক ও সামাজিক জীবনে সংযম অবলম্বনে অভ্যস্ত হই, অন্তত সংযমের অনুশীলন অব্যাহত রাখতে পারি, তাহলে তা আমাদের জন্য একটি ইতিবাচক ব্যাপার হতে পারে।
ইসলামী শরীয়তে ইবাদতের যে বিধান দেওয়া হয়েছে তাতে আল্লাহ তাআলার হক আদায়ের পাশাপাশি উন্নত ব্যক্তিত্ব গঠনের শিক্ষা খুব গভীরভাবে দেয়া আছে। কুরআন-সুন্নাহ মনোযোগের সাথে পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারব যে, ইবাদত-বন্দেগীর বিধানের মধ্যে সভ্য-শালীন ও মার্জিত ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রসঙ্গ কত গভীর। কুরআন মাজীদের পাঠক জানেন, কুরআন মাজীদে যেমন সালাতের বিধান আছে, তেমনি আছে মুসল্লীর ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলির বর্ণনা। ঈমানের বিধান যেমন আছে, তেমনি আছে মুমিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিবরণ। হাদীস শরীফে সওমের বিধি-বিধানের পাশাপাশি আছে সায়েমের আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্যের আলোচনা। এভাবে চিন্তা করলে কুরআন-সুন্নাহর নুসূস থেকেই ইবাদতকারীর ব্যক্তিত্বের রূপরেখা পেয়ে যাওয়া সম্ভব। ইবাদত-বন্দেগী আমাদের জীবনকে অনেক গভীর থেকে শুদ্ধ করে ও গঠন করে।
এজন্য ইসলামের মৌলিক ইবাদত- সালাত, যাকাত, সওম ও হজ্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা প্রয়োজন। ইবাদতের শিক্ষা গভীরভাবে উপলব্ধি করে তার আলোকে কর্ম ও জীবনকে গড়ে তোলার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন।
আমরা আমাদের কর্ম ও প্রচেষ্টার দ্বারা আমাদের চারপাশের জগৎকে গড়ে তুলি; মনোরম দালান-কোঠা, সুপ্রসস্ত সড়ক-মহাসড়ক, উন্নত শহর-নগর মানুষের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে, কিন্তু নিজ স্বভাব-চরিত্র, কর্ম-আচরণ গঠনে সেই নিষ্ঠাপূর্ণ শ্রম ব্যয় না করার ফলে আমাদের চিন্তা-ভাবনায়, কর্মে-আচরণে অনেক অন্ধকার বিরাজ করে। সেই অন্ধকার দূর করে জীবনকে আলোকিত করার জন্যই দ্বীন-শরীয়ত, ইবাদত-বন্দেগী।
মাহে রমযান আমাদের মাঝে নিজেকে গড়ার বার্তা ও বিধান নিয়েই আগমন করেছিল। জীবনব্যাপী চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যা আমাদের জীবনে সত্যে পরিণত করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।