প্রশ্নোত্তর
[আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম ‘প্রশ্নোত্তর’। এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।]
প্রশ্ন ১৫ : কেউ কেউ বলে, সমস্ত রাসূলই সমান মর্যাদার, তাদের মধ্যে মর্যাদাগত কোনো পার্থক্য নেই। অথচ আমরা তো বিশ্বাস করি, নবী-রাসূলদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে পার্থক্য আছে এবং আমাদের নবীজী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তারা তাদের কথার প্রমাণ হিসেবে কুরআন কারীম থেকে এই উদ্ধৃতি দেয়-
لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْ رُّسُلِهٖ.
অর্থাৎ আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না।
তাদের এ ধারণা কতটুকু ঠিক?
উত্তর : উল্লিখিত আয়াতাংশ দিয়ে নবীগণের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই- এমন দাবি করা সম্পূর্ণ ভুল। আয়াতাংশের বক্তব্য হল, আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সকল নবী-রাসূল হক হওয়ার ব্যাপারে, নিজ নিজ যুগে তাদের প্রতি অবতীর্ণ শরীয়ত অনুসরণযোগ্য হওয়া এবং তাদের সকলের প্রতি ঈমান আনা ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ সকল নবীর প্রতিই ঈমান আনতে হবে। কোনো এক নবীর প্রতি ঈমান না আনলে ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। যেমন ইহুদী-খ্রিস্টানরা কোনো নবীর প্রতি ঈমান রাখে আবার কোনো নবীর প্রতি ঈমান রাখে না- মুসলিমরা এমন নয়; বরং তারা সকল নবীর প্রতিই ঈমান রাখে। সকল নবীকেই নবী হিসেবে স্বীকার করে। উক্ত আয়াতাংশে একথা বলা হয়নি যে, সকল নবীর মর্যাদা সমান, তাঁদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ আল্লাহ তাআলা নবী রাসূলগণের কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের কথা নিজেই কুরআন কারীমে জানিয়েছেন। নবী-রাসূলগণের মাঝে কোনো পার্থক্য করা যাবে না- এই মর্মের আয়াতগুলো থেকে এ বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট যে, এই দুই বিশ্বাসের মাঝে কোনো বিরোধ নেই। উভয়টিই কুরআন কারীমের শিক্ষা। এবার আয়াতগুলো ভালোভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করি-
قُوْلُوْۤا اٰمَنَّا بِاللهِ وَ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْنَا وَ مَاۤ اُنْزِلَ اِلٰۤی اِبْرٰهٖمَ وَ اِسْمٰعِیْلَ وَ اِسْحٰقَ وَ یَعْقُوْبَ وَ الْاَسْبَاطِ وَ مَاۤ اُوْتِیَ مُوْسٰی وَ عِیْسٰی وَ مَاۤ اُوْتِیَ النَّبِیُّوْنَ مِنْ رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْهُمْ وَ نَحْنُ لَهٗ مُسْلِمُوْنَ.
(হে মুসলিমগণ!) বলে দাও, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং সেই বাণীর প্রতিও, যা আমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে এবং তার প্রতিও, যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং তার প্রতিও, যা মূসা ও ঈসাকে দেওয়া হয়েছিল এবং তার প্রতিও, যা অন্যান্য নবীগণকে তাঁদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে দেওয়া হয়েছিল। আমরা এই নবীগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই (এক আল্লাহরই) অনুগত। -সূরা বাকারা (২) : ১৩৬
অন্যত্র রয়েছে-
اٰمَنَ الرَّسُوْلُ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِ مِنْ رَّبِّهٖ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلٌّ اٰمَنَ بِاللهِ وَ مَلٰٓىِٕكَتِهٖ وَ كُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ لَا نُفَرِّقُ بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْ رُّسُلِهٖ وَ قَالُوْا سَمِعْنَا وَ اَطَعْنَا ؗغُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَ اِلَیْكَ الْمَصِیْرُ.
রাসূল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছে, যা তাঁর উপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তারা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। তাঁরা আরও বলে, আমরা শুনেছি এবং পালন করছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার মাগফিরাতের ভিখারী, আর আপনারই কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন। -সূরা বাকারা (২) : ২৮৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ الَّذِیْنَ یَكْفُرُوْنَ بِاللهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یُّفَرِّقُوْا بَیْنَ اللهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یَقُوْلُوْنَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَّ نَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَّ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَّخِذُوْا بَیْنَ ذٰلِكَ سَبِیْلًا ،اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْكٰفِرُوْنَ حَقًّا وَ اَعْتَدْنَا لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابًا مُّهِیْنًا، وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللهِ وَ رُسُلِهٖ وَ لَمْ یُفَرِّقُوْا بَیْنَ اَحَدٍ مِّنْهُمْ اُولٰٓىِٕكَ سَوْفَ یُؤْتِیْهِمْ اُجُوْرَهُمْ وَ كَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا.
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় ও বলে, আমরা কতক (রাসূল)-এর প্রতি ঈমান রাখি এবং কতককে অস্বীকার করি, আর (এভাবে) তারা (কুফর ও ঈমানের) মাঝামাঝি একটি পথ অবলম্বন করতে চায়; এরূপ লোকই সত্যিকারের কাফির। আর আমি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাদের কারও মধ্যে কোনো পার্থক্য করবে না, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মফল দান করবেন। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা নিসা (৪) : ১৫০-১৫২
এসকল আয়াতে মুমিনদের ব্যাপারে বারবার এ কথাই বলা হয়েছে, তারা আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সকল নবীর প্রতি ঈমান আনে। সকলের নবুওতে বিশ্বাস করে এবং সবাইকে নবী হিসেবে স্বীকার করে। আল্লাহর কোনো নবীকে অস্বীকার করে না। সেইসঙ্গে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খাতামুন নাবিয়্যীন হিসেবে বিশ্বাস করে। তাঁর আবিভার্বের পর সকলের জন্য এখন তাঁরই ওপর অবতীর্ণ কিতাব আলকুরআনুল কারীম এবং তাঁর আনীত শরীয়তের অনুসরণ করা আবশ্যক এবং এটাই মুক্তি ও সফলতার একমাত্র উপায়। এবার থাকল দ্বিতীয় বিষয়টি। তো সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করে কেবল দুটি আয়াত উল্লেখ করছি-
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلٰی بَعْضٍ ۘ مِنْهُمْ مَّنْ كَلَّمَ اللهُ وَ رَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجٰتٍ.
এই যে রাসূলগণ, (যাদেরকে আমি মানুষের ইসলাহের জন্য পাঠিয়েছি) তাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে কেউ এমন আছে, যার সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাদের মধ্যে কাউকে তিনি বহু উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৫৩
وَ رَبُّكَ اَعْلَمُ بِمَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ لَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِیّٖنَ عَلٰی بَعْضٍ وَّ اٰتَیْنَا دَاوٗدَ زَبُوْرًا.
যারা আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীতে আছে, তোমার প্রতিপালক তাদেরকে ভালোভাবে জানেন। আমি কতক নবীকে কতক নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। আর আমি দাউদকে যাবূর দিয়েছিলাম। -সূরা বনী ঈসরাইল (১৭) : ৫৫
অতএব, প্রশ্নে উল্লেখিত আয়াতাংশের বক্তব্য হল, এই শেষ নবী ও তাঁর উম্মত পূর্ববর্তী সকল নবীর প্রতিই ঈমান রাখে এবং তাদের কাউকে অস্বীকার করে না। ওখানে নবীগণের প্রতি ঈমান রাখার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তাদের মর্যাদাগত বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। (দ্রষ্টব্য, তাফসীরে কাবীর ২/৫২১, ৩/১১১)
প্রশ্ন ১৬ : হযরত থানভী রাহ.-এর বয়ানুল কুরাআনে যে তাফসীরে হক্কানীর নাম রয়েছে, সেটা কোন্ কিতাব এবং কার লেখা?
উত্তর : তাফসীরে হক্কানী কিতাবটির মূল নাম فتح المنان في تفسير القرآن (ফাতহুল মান্নান ফী তাফসীরিল কুরআন)। তবে কিতাবটি তাফসীরে হক্কানী নামেই বেশি প্রসিদ্ধ। এর মুসান্নিফ মাওলানা আবদুল হক হক্কানী দেহলভী রাহ. (ওফাত ১২ জুমাদাল উলা ১৩৩৫ হিজরী)। তিনি অখণ্ড ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে দিল্লীতে বসবাস করেন। তাফসীরে হক্কানী উর্দু ভাষায় রচিত এবং অত্যন্ত সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য একটি তাফসীরগ্রন্থ। বিশেষত এই কিতাবে তিনি বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও অপব্যাখ্যার খুব বলিষ্ঠ জবাব দিয়েছেন। কিতাবটির গুরুত্ব এখান থেকেও বুঝে আসে যে, থানভী রাহ. বয়ানুল কুরআন লেখার সময় এই কিতাব সামনে রেখেছেন। তাফসীরে হক্কানীর শুরুতে মুসান্নিফের প্রায় দুইশত পৃষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রয়েছে, তার শেষদিকে তিনি এই কিতাবের কিছু বৈশিষ্ট্যও উল্লেখ করেছেন। এটি সর্বপ্রথম ১৩১৮ হিজরীতে আট খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। পরবতীর্তে বিভিন্ন মাকতাবা কিতাবটি ছেপেছে। একটি সংস্করণ ইতিকাদ পাবলিকেশন্স দিল্লী পাঁচ খণ্ডে ছেপেছে। হযরত কাশ্মীরী রাহ.-এর ছেলে মাওলানা আনযার শাহ কাশ্মীরী রাহ. কিতাবটির হাশিয়া লিখেছেন।
উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায়ও একটি তাফসীরগ্রন্থ হক্কানী তাফসীর নামে প্রসিদ্ধ, সেটা বাংলার সূর্য হযরত মাওলানা সদর ছাহেব রাহ. লিখেছেন। এর কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন ১৭ : আসহাবুল হিজর কারা ছিল? তাদের বসবাস কোথায় ছিল এবং তাদের নবী কে ছিলেন?
উত্তর : কওমে ছামূদই আসহাবুল হিজর বা হিজরবাসী। তাদের বসবাস ছিল তখনকার শাম ও আরবের মধ্যবর্তী ‘হিজর’ নামক অঞ্চলে। হিজর অঞ্চলের বর্তমান নাম মাদায়েনে সালেহ। এটা মদীনা থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং বর্তমান সৌদি আরবের অন্তভুর্ক্ত ঐতিহাসিক স্থান। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনো সেখানে রয়েছে। জায়গাটি ওয়াদিল কুরা নামেও পরিচিত।
হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম ওই সম্প্রদায়ের নবী ছিলেন। আসহাবুল হিজর বা ছামূদ জাতি হযরত হূদ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় আদ জাতিরই বংশধর। তাই তাদেরকে দ্বিতীয় আদও বলা হয়। কুরআন কারীমে বেশ কয়েকটি সূরায় তাদের কথা বলা হয়েছে। (দ্র. তাফসীরে তবারী ১৭/১২৬; কাসাসুল কুরআন, মাওলানা হিফযুর রহমান সিওহারবী ১/৮৯; আতলাসুল কুরআন, ড. শাওকী আবূ খলীল, পৃষ্ঠা ৩২