কিছু আদব
আদবের অর্থ হল, তরীকা। কোনো কাজের ভালো তরীকাকে আদব বলা হয়। সব কাজ নিপুণভাবে করা আদব। এক হল কাজের আদব, আরেক হল সারা জীবনের আদব। এক হল কাজ নিপুণভাবে করা, আরেক হল সারা জীবন গুছিয়ে চলা। অন্তরে আদব সৃষ্টি করা। এবাদত, মুআমালা, মুআশারাসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী আদব রক্ষা করা।
এখনকার বিষয় হল, কথা, কাজ ও জীবন-যাপনের কিছু আদব নিয়ে আলোচনা করা। কিছু আদব গুরুত্বপূর্ণ, কিছু আদব বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু আদব কেবলই শোভা ও সৌন্দর্য। এমনিভাবে কিছু আদব তো সরাসরি শরীয়তের নুসূসের মধ্যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে; যাকে আমরা সাধারণত সুন্নত অথবা সুনান বলে থাকি। আর যেসব আদব বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা সহজেই উপলব্ধি করা যায় সেগুলোর প্রতি লক্ষ রাখার কথাও শরীয়তের মূলনীতির অধিনে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মোটকথা, সব আদবের শরয়ী হুকুম এক নয়, আবার সবগুলোর গুরুত্ব এক স্তরের নয়। তবে যেসব আদব কেবলই শোভা ও সৌন্দর্য, কোনো ওযর না থাকলে নিজস্ব পরিমণ্ডলে সেগুলোর প্রতিও লক্ষ রাখা ভালো।
কিছু আদবের আলোচনা আলকাউসারের এ বিভাগে দুয়েকবার করা হয়েছিল। সে সব লেখা এখন আমার সামনে নেই। কিছু আদবের আলোচনা করার তাগাদা যেহেতু মনে বার বার আসছিল তাই নিজে মনে রাখার জন্য এবং সাথীদের ফায়েদার জন্য কিছু আদব আলোচনা করছি। এর মধ্যে কিছু তো এমন থাকবে, যার আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। কিছু এমন থাকবে, যেগুলোর আলোচনা খুব সম্ভব এখনো এ বিভাগে করা হয়নি।
আদবের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব হল, নিজে তা গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা। অন্যের মধ্যে কোনো আদবের কমতি দেখলে তার প্রতি খারাপ ধরাণা করা যাবে না। তার ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে না; বরং তার ভালো গুণাবলীর প্রতি লক্ষ রাখবে। নিজের কমতি ও দুর্বলতার কথা স্মরণ করবে। কারণ, এমন অনেক হয়, আমরা কিছু শাখাগত আদবের তো খুব খেয়াল রাখি, কিন্তু গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার মত ফরয আদবের মধ্যে কমতি করে বসি। এমনও হয়ে থাকে, কিছু শাখাগত আদবের প্রতি খেয়াল রাখলেও সুনানুল হুদা ও সুনানে মুআক্কাদার ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দিই।
হাঁ, নিজের চেয়ে ছোট কারো মাঝে কিংবা নিজ সাথীদের মধ্যে কোনো আদবের কমতি দেখা গেলে, যদি জানা যায়, অমনোযোগিতা অথবা ওযরের কারণে নয়, বরং এ আদব সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে এমন হচ্ছে, তাহলে নিরালায় সম্মানের সঙ্গে ওই আদবের দিকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমস্যা নেই। তাকেও অনুরোধ করা উচিত- আমার থেকে এমন অপছন্দনীয় অথবা অশোভনীয় কোনো আচরণ অথবা কথা প্রকাশ পেলে আপনিও আমাকে অবশ্যই অবহিত করবেন।
এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর সংক্ষেপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদবের আলোচনা করা হচ্ছে, লক্ষণীয় যে, এ তালিকা একেবারেই তারতীব ছাড়া। না বিষয়বস্তু হিসেবে এতে কোনো তারতীব আছে, না গুরুত্বের দিকে লক্ষ করে কোনো তারতীব দেওয়া হয়েছে।
কিছু আদবের তালিকা
এক. তালিবুল ইলম কোনো বুযুর্গ অথবা কোনো মাদরাসার যিয়ারতে যেতে চাইলে বিরতির সময়ে যাবে। নিজের মাদরাসা খোলা অবস্থায় যাবে না। প্রচণ্ড ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে উস্তাযের হুকুমে দরসের বাইরের সময়ে গেলে ভিন্ন কথা। বিরতির সময় গেলেও নিজ অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে যাবে। যেখানে যাচ্ছে সেখানে যোগাযোগ করে জেনে নেবে, যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছে সে উদ্দেশ্য তখন পূর্ণ হবে কি না।
দুই. বের হওয়ার সময় খেয়াল করবে, সামনের ওয়াক্তের নামাযগুলো মসজিদে জামাতে আদায়ের কী ব্যবস্থা হবে? কমপক্ষে জামাতে আদায় করার কী সূরত হবে? বুযুর্গদের দেখেছি, এসব বিষয়ে লক্ষ রাখতে- বের হওয়ার পূর্বে জামাতে নামায আদায় করে বের হতেন কিংবা গন্তব্যে জামাতে নামায আদায়ের ব্যবস্থা ভেবে নিতেন। আর রাস্তায় সহজে তা সম্ভব হলে তাই করতেন।
তিন. বের হওয়ার পূর্বে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, বাজারের খোলা দোকান এবং হোটেল থেকে কিংবা হোটেলে বসে খাবারের প্রয়োজন যেন না পড়ে। কারণ, খুব প্রয়োজন ছাড়া তালিবুল ইলমদের জন্য এসব জিনিস থেকে বিরত থাকাই ভালো। এটা আদব ও মাসলাহাতের ব্যাপার। কোনো ফিকহী হুকুম নয় যে, এটা নাজায়েয অথবা মাকরূহ বলা হবে।
যেখানে যাচ্ছে সেখানে মেহমানদারির ইনতিযাম হলে তা কবুল করাই উচিত। তবে আমাকেও খেয়াল রাখতে হবে, যেন খবর দেওয়া ছাড়া ঠিক দস্তরখানের মুহূর্তে অথবা অসময়ে উপস্থিত না হই। একবার নোমানী রাহ.-এর কাছে ঠিক দুপুরে গিয়ে পৌঁছলাম। আগে কোনো খবরও দেওয়া হয়নি। হযরত জিজ্ঞেস করলেন, খেয়ে এসেছ?
বললাম, না।
বললেন, কেন খেয়ে আসনি?
এরপর যা ছিল তা দিয়েই মেহমানদারি করেন।
বিশেষ করে কয়েকজন একসঙ্গে ঠিক দস্তরখানের সময় অথবা অসময়ে কোথাও গিয়ে ওঠা উচিত নয়। আগে থেকে খবর দিয়ে গেলে ঠিক আছে।
চার. বের হওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, ফেরার সময় যানবাহন পেতে কষ্ট হবে না তো।
পাঁচ. রাতে ওখানে থাকতে হলে আগেই ভাবতে হবে, সেখানে রাতে থাকার ব্যবস্থাপনা কী? সেখানে মেহমানখানা থাকলেও অপরিচিত মানুষকে অনুমতি কীভাবে দেবে? তাই আগেই এমন কোনো পন্থা ভেবে নিতে হবে, যেন ব্যবস্থাপকদের কোনো পেরেশানী না হয়।
ছয়. কোনো বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে, বিশেষত কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করতে হলে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে যাওয়া ভালো। কমপক্ষে যোগাযোগ করে অবস্থা অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিত। যে হযরতরা বেশি ব্যস্ত এবং রুটিন খুব মেনে চলেন তাদের ক্ষেত্রে এই আদবের রক্ষা করা বেশি জরুরি।
সাত. কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হাদিয়া নিয়ে যাওয়া সুন্নত মনে করা ঠিক না। কিছু মানুষ আলেমদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় হাদিয়া দেওয়া জরুরি মনে করে। এ ধারণা একেবারে ভুল। হাদিয়ার কিছু বিধান, মূলনীতি ও আদব আছে। সেগুলো জানা জরুরি। এখানে ওসবের আলোচনা করছি না। আমি শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। তা হল, কাউকে দেখা যায়, হাদিয়া নিয়ে আসে; কিন্তু সাক্ষাতের মাঝে অথবা সাক্ষাৎ শেষে যাওয়ার সময় হাদিয়ার কথা বলে না। অনুমতি ছাড়া বরং জানানো ছাড়াই হাদিয়ার জিনিস রেখে চলে যায়। এ কাজ মারাত্মক ভুল। এটা হাদিয়ার প্রাণই নষ্ট করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, মেযবান জানবেই বা কী করে- এটা হাদিয়া না মেহমানের ব্যক্তিগত জিনিস! হাদিয়া হয়ে থাকলে কার জন্য হাদিয়া? যদি কোনোভাবে জানাও যায়, এটা তার জন্য হাদিয়া তখন তো তার এটা ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ হবে। আত্মসম্মানের অধিকারী মানুষ এটা কবুল করতে পারবে না। কারণ, হাদিয়া তো পেশ করা হয়। কোনো রকম না জানিয়ে ফেলে চলে যায় না। এটা খেয়াল রাখাও জরুরি, সদকাকেও হাদিয়া বলে না, সহযোগিতাকেও বলে না। এটা ভিন্ন এক নেক কাজ। এর ভিন্ন আদব ও আহকাম আছে। হাদিয়া তো হয় নিষ্কলুষ মহব্বতের ভিত্তিতে ইকরামের জন্য। এর ভিন্ন মূলনীতি ও আদব আছে।
আট. দস্তরখানে কাউকে বিশেষ কোনো কিছু খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। এক-দুবার অনুরোধ করে নিরস্ত হওয়া উচিত। মেহমানের মর্জিবিরোধী পীড়াপীড়ি করতে থাকা উচিত নয়।
নয়. এমনিভাবে কাউকে মেযবান অথবা খাদেমের পক্ষ থেকে বেশি পরিমাণে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। উদ্দেশ্য তো হল, মেহমানকে খুশি করা এবং আরাম দেওয়া। কিন্তু কেউ কেউ মেহমানের কাছে দাবি করে, বেশি খেয়ে, সব পদ খেয়ে যেন মেজবানকে খুশি করে। মনে রাখবেন, এমন দাবি মেহমানদারির নীতি-পরিপন্থী।
হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-কে এ ধরনেরই কোনো প্রেক্ষাপটে কেউ বলেছেন, এতে মেজবানের দিল-শিকনী (মনোকষ্ট) হবে। হযরত বললেন, আমরা যদি তার মন রক্ষা করতে যাই তাহলে আমাদের শিকম-শিকনী (পেট-খারাপ) হবে।
এটা ভিন্ন কথা যে, অসহনীয় না হলে মেহমান মেজবানের মন রক্ষার প্রতি খেয়াল রাখবে। তবে এখানে প্রসঙ্গক্রমে এ কথা নিবেদন করছি, দস্তরখানে অনেক পদের সমাহার ঘটানো খাইরুল কুরুনের তরীকা নয়। ভালো হয়, যদি আমরা এ তরীকার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করি।
দশ. কারও সাক্ষাতে গেলে উপযুক্ত সময়ে যাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে শুধু নিজের সহজতার দিকেই লক্ষ রাখবে না; বরং যার সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়া হচ্ছে তার সহজতা প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
অসময়ে সাক্ষাৎ জরুরি প্রয়োজনেই কেবল হতে পারে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে একটি ঘটনা খোদ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর জবানীতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, একবার আমি কায়লুলার জন্য শুয়ে গেছি। এমন সময় সংবাদ এল, দরজায় কে একজন এসেছে।
আমি বললাম-
ما جاء هذه الساعة إلا لحاجة، أدخلوه.
এ সময়ে সে কোনো প্রয়োজনেই এসেছে। নিয়ে আসো তাকে -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৫/৭৫
এগার. মুখোমুখি হয়ে বসতে হলে নিজের অবস্থা অনুযায়ী হয়ত দু’হাঁটু গেড়ে বসবে কিংবা আসন পেতে বসবে। এক হাঁটু উঠিয়ে বসতে চাইলে যথাসম্ভব দেহের নিম্নাংশ কাপড় দিয়ে ঢেকে নেবে। যেন কোনো অশোভনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি না হয়। দু হাঁটু উঠিয়ে বসা তো একেবারেই উচিত নয়। ‘খাবারের সময় এভাবে বসা সুন্নত’ ধারণাটি একেবারেই প্রমাণহীন কথা। এটা কেবল মুখে মুখে প্রচারিত একটি কথা, যার কোনো ভিত্তি নেই।
বারো. সালোয়ার বা লুঙ্গির সাথের অন্তর্বাস একটি প্রাচীন পোশাক। খাইরুল কুরূনে এর প্রচলন ছিল। কমপক্ষে বাইরে যাওয়ার সময় বিশেষ করে বাস ইত্যাদিতে সফরের সময় লুঙ্গি অথবা সালোয়ারের নিচে তা ব্যবহার করা উচিত।
তের. কথার আওয়াজ সীমিত হওয়া কাম্য। এত নীচু হবে না যে, পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় কী বললেন! আবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জোরেও হবে না।
চৌদ্দ. শুধু কথার আওয়াজই নয়, সব ধরনের আওয়াজই সীমিত হওয়া কাম্য। প্লেটের আওয়াজ, চামচের আওয়াজ, খাবারের আওয়াজ, ডাল পান করার আওয়াজ, চা পান করার আওয়াজ- সব কিছুতে কোমলতা কাম্য। আওয়াজ না হওয়ার জন্য অনেক বেশি তাকাল্লুফ করবে না আবার উদাসীনতার পরিচয়ও দেবে না।
এমনিভাবে হাঁটার সময়ও যথাসম্ভব জুতার আওয়াজ সীমিত রাখবে। কিছু জুতা আছে, যেগুলোতে পানি লাগলে অথবা ভেজা পায়ে পরে হাঁটলে একরকম অসুন্দর আওয়াজ হয়, তাই শুকানোর সুযোগ থাকলে পা ও জুতা শুকিয়ে নিলে ভালো।
জুতা পরিধানের সময় মাটিতে আস্তে রাখবে। সোজা দাঁড়িয়ে উপর থেকে জামিনে ফেলবে না। মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় অনেক মুসল্লি বিষয়টি খেয়াল করেন না; ফলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত এ অপছন্দনীয় আওয়াজ সবাইকে শুনতে হয়। এমন না করা উচিত। যে কোনো অপছন্দনীয় আওয়াজ থেকে আশপাশের লোকজনকে বাঁচানো শরীয়তে কাম্য।
গাড়ির আওয়াজ, স্পিকারের আওয়াজ, শাসনের জন্য ধমকানোর আওয়াজ, এমনকি ওয়াজ-নসীহত ও পাঠদানের আওয়াজ ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া কাম্য। খেয়াল রাখতে হবে, প্রয়োজনের সীমা যেন অতিক্রম না হয় এবং অন্যের কষ্টের কারণ না হয়। হযরাতুল উস্তায শাইখুল ইসলাম তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘লাউড স্পিকারের নিষ্ঠুর ব্যবহার’ প্রবন্ধটি মনোযোগ দেওয়ার মতো বিষয়। ‘যিকর ও ফিকরে’ এটি ছাপা হয়েছে।
পনের. দস্তরখানে হাত ধোয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, আশপাশের কারও কাপড় অথবা শরীরে যেন কোনো ছিটা না পড়ে। খাবারের পরে হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে এদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। আলাদা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলে জোয়ানরা ওখানে হাত ধৌত করবে। দস্তরখানে বসে হাত ধোয়ার কী প্রয়োজন?
ষোল. হাত ধোয়ানোর ক্ষেত্রেও নৈপুণ্যের বিষয় আছে। কখন পানি ঢালতে হবে, কখন বেশি, কখন কম, কখন থামতে হবে, প্রয়োজন মতো কখন পানি অথবা গ্লাস ঘোরাতে হবে, না এক জায়গাতেই ঢালতে হবে? সঠিক আকল থাকলে আকল কাজে লাগালেই ব্যাপারটি সহজ হয়ে যায়। নতুবা এসব বিষয়ও শিখতে হয়। কেউ কেউ হাত ধোয়ানোর সময় অনেক পানি নষ্ট করে, কিন্তু এরপরও পরিষ্কার হয় না।
সতের. হাত ধোয়া ও ধোয়ানোর সময় আশপাশে খেয়াল রাখা জরুরি। ডানে-বামে আহার চলমান অবস্থায় নিজে আগে আগে উঠতে চাইলে আলাদা হয়ে হাত ধোয়া উচিত। এমনিভাবে দস্তরখানে তরকারি অথবা ভাতের পাত্র থাকলে সেগুলো প্রথমে উঠিয়ে নিতে হবে। পানির ছিটা কারও উপর অথবা খাবারে না পড়ার প্রতি লক্ষ রাখা কাম্য।
আঠার. সাধ্য থাকলে দস্তরখানের জন্য আলাদা হ্যান্ডওয়াশ রাখা ভালো। বাথরুম থেকে হ্যান্ডওয়াশ এনে দস্তরখানে হাত ধোয়ালে কারও অস্বস্তি হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এসব কথা লেখা হয়েছে। অন্যথায় সাবান বলুন অথবা হ্যান্ডওয়াশ কিংবা টিস্যু কোনোটাই না আবশ্যক না সুন্নত। এসব আমাদের আরামের যিন্দেগির অংশ।
حرص قانع نيست صائب ورنہ اسباب معاش
ہرچہ ما دركار داريم اكثرے در كار نيست
কিন্তু আরামের যিন্দেগি যখন গ্রহণই করেছি তখন আকল ব্যবহার করে এমন পন্থা অবলম্বন করবে যেন পরিশীলিত স্বভাবের মানুষের জন্য অসহনীয় না হয়।
ঊনিশ. গ্লাসে পানি না থাকলেও তার মুখ আলগা রাখা উচিত নয়। উপরে কোনো ঢাকনা রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পর এ গ্লাসে আমিই পান করব অথবা অন্যকে পান করাব।
বিশ. গ্লাস ব্যবহারের সময় ঢাকনাটা উল্টো করে রাখা। অর্থাৎ গ্লাসের ভেতরের দিকে যে অংশটা থাকে তা উপরের দিকে রাখা, যে দিকটা গ্লাসের ভেতরের দিকে থাকে সে দিকে যেন ধুলাবালি না লাগে।
একুশ. যৌথ গোসলখানায় কোনো ব্যক্তিগত জিনিস রেখে আসবে না। খাস হাম্মাম হলেও নিজের এমন কোনো জিনিস উন্মুক্ত রাখবে না, যা অন্য কারও নজরে পড়া উচিত নয়।
বাইশ. হাম্মাম থেকে ফিরে যৌথ ব্যবহারের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বদলে ব্যক্তিগত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ভালো। সাধ্য থাকলে এর খেয়াল রাখা উচিত। গুলশানের এক মসজিদে দেখেছি, অযু খানায়ও মাশাআল্লাহ সাবান ও সাবানদানি রাখা আছে। এটা তাদের সুন্দর রুচি ও মুসল্লীদের একরাম করার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এ মসজিদ কর্তৃপক্ষের হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা করা সহজেই সম্ভব ছিল। এটা পরিশীলিত স্বভাবের তাগাদাও। আবার স্বাস্থ্যের জন্যও অধিক উপযোগী। যেমনটা শুনেছি কোনো কোনো ডাক্তারের কাছ থেকে।
অনেককে দেখা যায় হাম্মামে বা বেসিনে জরুরত সারার পর হাত ধোয়ার জন্য সাবান রেখে দেয়। সামর্থ থাকলে এখানে তরল সাবান (হ্যান্ডওয়াশ) রাখা উচিত।
তেইশ. এক রিকশায় দুই সাথীর বেশি ওঠা ঠিক না। এটা অশোভন ও ভদ্রতার পরিপন্থী। বিশেষ করে মাদরাসার তালিবুল ইলমের জন্য।
চব্বিশ. পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা উভয়টাই ঈমানের শাখা। এর প্রতি খুব গুরুত্বারোপ করা উচিত।
পঁচিশ. পরিচ্ছন্নতার তা‘মীম-ব্যাপকতা, তাদকীক-নৈপুণ্য এবং মুদাওয়ামাত-ধারাবাহিকতা কাম্য।
তা‘মীম-ব্যাপকতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, প্রত্যেক জিনিসের পরিচ্ছন্নতা কাম্য। প্রত্যেক জিনিসের প্রত্যেকটি অংশে পরিচ্ছন্নতা কাম্য। যেমন, শুধু নিজের কাপড়ের পরিচ্ছন্নতা নয়, দেহের পরিচ্ছন্নতাও কাম্য। দেহের শুধু দর্শনীয় অংশগুলো নয়, সারা শরীরের পরিচ্ছন্নতার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। শুধু নিজের মধ্যেই পরিচ্ছন্নতা সীমাবদ্ধ রাখবে না, নিজের আসবাব, ঘর, হাম্মাম, আঙিনা- প্রতিটি জিনিস মানসম্মত পর্যায়ে পরিচ্ছন্ন রাখব।
মাদরাসা অথবা নিজ বাড়ির ভবন এবং ভবনের পেছনের অংশ পরিচ্ছন রাখব। তা আপনার জন্য পেছনের অংশ, কিন্তু আপনার ওদিকের প্রতিবেশীর জন্য এবং ওদিক দিয়ে যাতায়াতকারীর জন্য সামনের অংশ। তাই আপনি যতটা গুরুত্ব দিয়ে সামনের অংশ পরিষ্কার করে থাকেন পেছনের অংশও -যা সাধারণত আপনার দৃষ্টির আড়ালে থাকে- গুরুত্ব দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত।
পরিচ্ছন্নতার সামানগুলোর পরিচ্ছন্নতা কাম্য। বদনার তলাও পরিচ্ছন্নতার সময় লক্ষণীয়। এভাবে ভাবতে থাকুন আর পরিচ্ছন্নতার সীমারেখা বোঝার চেষ্টা করুন।
তাদকীক-নিপুণতা দিয়ে উদ্দেশ্য হল, পরিচ্ছন্নতা ভালোভাবে হতে হবে, নিখুঁতভাবে হতে হবে।
আজকাল অনেকসময় পরিচ্ছন্নতার নৈপুণ্যের প্রতি এজন্য খেয়াল করা হয় না যে, পরিচ্ছন্নতার মর্মই মাথা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। যেমন হাম্মামের পরিচ্ছন্নতার বেলায় কিছু মানুষের মাথায় এটা কাজ করে, পা-দানি ও আশপাশে কোনো বড় নাপাকি না থাকলেই হল। পানির মধ্যে ময়লা দেখা গেলে কী সমস্যা? কমোডে ময়লার আস্তর পড়লে কী? টাইলসের রং বদলে গেলেও কোনো সমস্যা নেই। টাইলসের ফাঁকে ময়লা জমলে কী সমস্যা?
বদনার ভেতর-বাহির কালো হয়ে যাওয়া, জুতো পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া, জুতোর নিচে নয় উপরের দিকে ময়লার আস্তর পড়ে গেলেই বা কী! দরজা ও দেয়ালের অবস্থা দেখার তো প্রয়োজনই নেই!
মোটকথা, স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই তো ‘পরিচ্ছন্নতা’ ও ‘ময়লা’র মর্ম স্থীর হয়। তাই এখন সম্ভবত এসব বিষয়ে আলোচনাও একটু কঠিন হয়ে গেছে।
এমনিভাবে ওযুখানার অবস্থাও ভেবে দেখুন। আমাদের অনেকের মাথায় ওযুখানার পরিচ্ছন্নতার অর্থ কী? টিউবওয়েলের আশপাশের অবস্থা ভাবুন, এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কী মর্ম আমাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়?
وإذا كان ذلك موضع غسل الأواني بعد الطعام فأمره خطير جدا، يرى هناك حبوب الرز، قطعات الأدم، والعدس، ونحو ذلك، فإن لم يكن هذا غيرَ مخل عندنا بالنظافة والمروءة، وغير مخل أيضا بأدب النعمة وأدب الرزق، فعلى فهمنا وذوقنا السلام، أما والحال هذا فلا قول ولا كلام!
উল্লেখিত উদাহরণগুলো দিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি, নিখুঁত পরিচ্ছন্নতার জন্য আমাদের কতটা ভেবেচিন্তে কাজ করা উচিত এবং এর কত গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
নিয়মতি পরিষ্কার করলে এর জন্য প্রতিদিন বেশি সময় ও বেশি মেহনতের প্রয়োজন পড়ে না। পরিচ্ছন্নতা এমন নয় যে, একদিন করবে এরপর দু-তিন দিন অথবা তিন-চার দিন বিরতি দেবে। প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হয়। কিছু জায়গা, কিছু জিনিসের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রতিদিন একাধিকবার করতে হয়। আর হালকা-পাতলা পরিচ্ছন্নতা তো চলমান থাকাই উচিত।
ছাব্বিশ. হাড়ি, পাতিল, পেয়ালা, চামচ, দস্তরখান, চায়ের কাপ ব্যবহারের পর এমনিই রেখে দেওয়া ঠিক নয়। অনতিবিলম্বে পরিষ্কার করে জায়গা মতো রেখে দেওয়া উচিত। কোনো জিনিস ব্যবহারের পর পরিষ্কার না করে রেখে দেওয়া, সামনে প্রয়োজন হলে ধোয়ার ফিকির করা উসূলের খেলাফ কাজ, স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এ থেকে বেঁচে থাকা অনেক জরুরি।
এমনিভাবে দস্তরখানের সময় ব্যবহৃত পানির বালতিটি ভরার পর পরিষ্কার করার প্রবণতা ঠিক নয়, তা দিনে অন্তত তিনবার খালি করা এবং পরিষ্কার করা জরুরি।
ব্যবহৃত পানির বালতি এবং ময়লার ঝুড়ি পরিষ্কার না করে ফেলে রাখা ভদ্রতা পরিপন্থী কাজ। এই অলসতা ও উদাসীনতা থেকে আমাদেরকে বাঁচতেই হবে।
সাতাশ. ইসলামে যেমনিভাবে পরিচ্ছন্নতার তাকিদ করা হয়েছে তেমনিভাবে পরিপাটি থাকার তাকিদও করা হয়েছে। পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি থাকা- এ তিন গুণ একত্রিত হলে পূর্ণতা সৃষ্টি হয়।
হাদীস শরীফে এসেছে, এক সফর থেকে ফেরার সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার কাছে পৌঁছে ইরশাদ করেন-
إِنّكُمْ قَادِمُونَ عَلَى إِخْوَانِكُمْ، فَأَصْلِحُوا رِحَالَكُمْ، وَأَصْلِحُوا لِبَاسَكُمْ، حَتّى تَكُونُوا كَأَنّكُمْ شَامَةٌ فِي النّاسِ.
অর্থাৎ তোমরা তোমাদের ভাই বেরাদারের নিকট পৌঁছতে যাচ্ছ। সুতরাং নিজেদের বাহন ঠিকঠাক কর এবং পোশাক-পরিচ্ছদ পরিপাটি কর। যেন তোমরা লোকজনের মাঝে সুন্দর অবয়বের তিলকসদৃশ হও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৮৯
আটাশ. কোনো জিনিস ফেলতে হলে নির্ধারিত জায়গায় ফেলবে, নতুবা উপযুক্ত জায়গায় তো অবশ্যই ফেলবে। জানালা দিয়ে বাইরে কিছু ফেলা একদমই অনুচিত কাজ।
ঊনত্রিশ. ব্যবহৃত টিস্যু ও অন্যান্য ময়লা রাখার জন্য পৃথক ঝুড়ি এবং কাগজ রাখার জন্য (বিশেষত যে কাগজে লেখা থাকে, আরও বিশেষ করে যদি দ্বীনী লেখা হয়) পৃথক ঝুড়ি হওয়া উচিত। একই ঝুড়িতে ময়লার সঙ্গে পবিত্র কাগজ রাখা উচিত নয়। এরপর ময়লা নির্ধারিত জায়গায় ফেলবে। কাগজ-পত্র উপযুক্ত স্থানে রেখে পুড়িয়ে দেবে।
ত্রিশ. কোথাও দেখেছি, টিস্যু দিয়ে হাত মুছে চিলমচি অথবা পেয়ালার পানিতে ফেলে দিয়েছে। এমন করা উচিত নয়। পানিতে কাঁটা, হাড্ডি, টিস্যু ইত্যাদি না ফেলা উচিত। কারণ, পানি ফেলার জায়গা আর এসব জিনিস ফেলার জায়গা এক নয়। আরও কিছু কারণ আছে, যে জন্য এমন করা উচিত নয়।
একত্রিশ. থু থু ফেলার জন্য, নাক সাফ করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ব্যবহার করা উচিত অথবা কোনো উপযুক্ত জায়গা খোঁজা উচিত। কোনো ধরনের ভাবনা চিন্তা ছাড়াই ডানে বামে থুথু ফেলা অথবা নাক সাফ করা উচিত নয়। এটা মুরূআত পরিপন্থী এবং অন্যের জন্য কষ্টদায়কও।
আজ এখানেই ইতি টানতে চাচ্ছি। কিছু কথা ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’-এর মধ্যেও উল্লেখ আছে। কিছু কথা আলকাউসার মুহাররম ১৪৩০ হিজরী (ভলিউম ২০১১ ঈ.) রবিউল আখির ১৪৩৫ হিজরী, যিলকদ ১৪৩৫ হিজরী (ভলিউম ২০১৪ ঈ.) সংখ্যায় উল্লেখ আছে।
আল্লাহ তাআলা আমাকে, আমার সন্তানদেরকে, আমার তালিবুল ইলম ভাইদেরকে, আমার শুভানুধ্যায়ী এবং প্রত্যেক মুমিন-মুমিনাতকে ইসলামী আদব শেখার এবং আপন করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন।
هذا، وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين لا نبي بعده، وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
-আরযগুযার
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
০৯-০৫-১৪৪৩ হিজরী