তালিবানে ইলমের উদ্দেশে: তোমরা কে? তোমরা কী? তোমাদের গন্তব্য কোথায়? (২)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে যখন সাইয়েদুনা হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিতাব ও রিসালাত দিয়ে দুনিয়াতে পাঠানো হয়, পৃথিবী ও মানববসতি তখন পরিবর্তনের এমন কিছু পর্যায় অতিক্রম করেছিলো এবং মানবজাতি ও মানবসভ্যতা উন্নতি ও অগ্রগতির এমন একটি উচ্চ্স্তরে উপনীত হয়েছিলো যে, একটি সার্বজনীন ও সর্বকালীন নবুয়ত ও শরী‘আত ঘোষণা করাই ছিলো হাকীম ও মহাপ্রজ্ঞাবান আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও প্রজ্ঞার দাবী। সুতরাং হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিতাব ও নবুয়তকে আখেরি কিতাব ও আখেরি নবুয়তরূপে ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ তাতে সার্বজনীনতা ও সর্বকালীনতার পূর্ণ যোগ্যতা বিদ্যমান ছিলো। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে এমন আসমানি নেযাম ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যাতে এই নবুয়ত ও শরী‘আত সর্বকালের জন্য অবিকৃত অবস্থায় সুসংরক্ষিত থাকে, যাতে নতুন কোন নবুয়ত ও হিদায়াতের প্রয়োজনই দেখা না দেয়। তাই আমার, আপনার এবং প্রতিটি মুসলিমের ঈমান ও আকীদা এটাই যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন হিদায়াত এসে গেছে এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত সুসংরক্ষিত থাকবে। সুতরাং নতুন অহী ও নবী এবং নতুন কিতাব ও শরী‘আতের না কোন প্রয়োজন আছে, না কোনো অবকাশ আছে। তো অহীর মাধ্যমে হিদায়াত গ্রহণ ও ধারণ করার প্রথম কাজটি হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে সুসম্পন্ন ও সুসমাপ্ত হয়ে গেছে। তবে দ্বিতীয় কাজটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর তা হলো অহীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে প্রাপ্ত হিদায়াত সকল মানুষের নিকট পৌঁছানো এবং তাদেরকে সেই হিদায়াতের উপর পরিচালিত করার চেষ্টা-মেহনত চালানো। এই কাজের গুরুদায়িত্ব উম্মতে মুহম্মদীর উপর অর্পণ করা হয়েছে।
তো উম্মতে মুহম্মদী কারা? আমি, আপনি, আমরা সকলেই উম্মতে মুহম্মদীর অংশ। হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যারা আখেরী নবী বলে বিশ্বাস করে তারাই উম্মতে মুহম্মদী। পৃথিবীতে উম্মতে মুহম্মদীর দু’টি অবস্থান। প্রথম অবস্থানে উম্মতে মুহম্মদী ও অন্যান্য নবীর উম্মত সমান। অর্থাৎ নবীর আনীত হিদায়াত ও শরী‘আতের অনুসরণ করা এবং তার উপর আমল করা। প্রত্যেক নবীর উম্মতের উপর এটা অপরিহার্য ফরয ছিলো, উম্মতে মুহম্মদীর উপরো তা ফরজ- শরী‘আতের অনুগত থাকা এবং শরী‘আতের উপর আমল করা। দ্বিতীয় অবস্থানটি হচ্ছে এই উম্মতের একক বৈশিষ্ট্য। তা এই যে, উম্মতের প্রত্যের সদস্যের অপরিহার্য কর্তব্য হলো সম্ভাব্য সকল উপায়ে শরী‘আতে মুহম্মদীর হিফাযত ও সংরক্ষণ এবং তার প্রচার প্রসারের চেষ্টা-সাধনা ও মেহনত-মোজাহাদায় আত্মনিয়োগ করা। তাদের দায়িত্ব হলো, সারা পৃথিবীতে সমগ্র মানবজাতির নিকট হিদায়াত ও শরী‘আত পৌঁছে দেয়া এবং তার উপর তাদেরকে পরিচালিত করার জন্য নবীওয়ালা মেহনতে আত্মনিয়োগ করা। আর এ সূত্রেই উম্মতে মুহম্মদী হচ্ছে নবুয়তের দাওয়াতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নবীগণের নায়েব বা ওয়ারিছ।
বিরাছাত ও নিয়াবাতের এ মহাদায়িত্ব পুরো উম্মতের উপর ন্যস্ত হয়েছে, তবে এক্ষেত্রে স্তর- তারতম্য অবশ্যই রয়েছে। একটি হলো সাধারণ স্তর, যার জন্য বিশেষ কোন বুদ্ধি-প্রজ্ঞা এবং বিশেষ কোন জ্ঞান্তযোগ্যতার প্রয়োজন নেই। ঈমানের দাবীতে উম্মতের প্রত্যেক সদস্যই এর অন্তর্ভুক্ত। বিরাছাত ও নিয়াবাতের এই সাধারণ স্তরের দায়িত্বও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তবে এই দায়িত্ব ও যিম্মাদারির ক্ষেত্রে রয়েছে একটি বিশেষ স্তর, আর তা এই যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ইলমে ওয়াহী এবং যে হিদায়াত ও শরী‘আত উম্মতের জন্য রেখে গেছেন স্ব স্ব যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী তা আহরণ করা, সংরক্ষণ করা এবং তার প্রচার-প্রসারের মেহনত-মোজাহাদায় আত্মনিয়োগ করা। নবীর নিয়াবাত ও বিরাছাতের এটি অতি উচ্চ স্তর, যা উম্মতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত। মূলত এরাই হলেন নবীগণের প্রকৃত ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী এবং নাইব বা প্রতিনিধি।
আমাদের দ্বীনী মাদরাসাগুলো প্রকৃতপক্ষে ঐসকল যোগ্য মানুষ গড়ার কারখানা, যারা কোরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান অর্জন করার জন্য জীবনব্যাপী সাধনায় নিয়োজিত হবেন এবং নিয়াবাত ও বিরাছাতের সুমহান দায়িত্ব ও যিম্মাদারি পালনের জন্য যিন্দেগি ওয়াকফ করে দেবেন।
আমার পেয়ারে ভাই! এটাই হচ্ছে দ্বীনী দায়িত্বের দিক থেকে আপনাদের প্রকৃত অবস্থান ও মর্যাদা এবং এটাই আমাদের দ্বীনী মাদারিসের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
কোরআন মজীদে উম্মে ঈসা হযরত মারয়াম বিনতে ইমরান্তএর জন্মপ্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। ইমরানের স্ত্রী যখন সন্তানসম্ভবা হলেন (এবং সম্ভবত লক্ষণযোগে পুত্রসন্তানের আশা লাভ করলেন) তখন তিনি মান্নত করলেন যে, আমি আমার গর্ভস্থ সন্তানকে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দিলাম। পবিত্র কোরআনে এই মহান মান্নতের বর্ণনা এভাবে এসেছে-
رب انى نذرت لك ما فى بطنى محررا فتقبل منى انك انت السميع العليم
হে (আমার) প্রতিপালক, নিশ্চয় আমি ‘উৎসর্গ’ করে দিলাম আপনার জন্য আমার গর্ভে যা আছে তাকে, (ইহজাগতিক যাবতীয় দায় ও দায়িত্ব থেকে) মুক্ত করে। সুতরাং কবুল করুন আপনি আমার পক্ষ হতে। নিঃসন্দেহে আপনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।)
বনী ইসরাঈলের শরী‘আতে এই রীতি ছিলো যে, আল্লাহর নেক বান্দা ও বান্দীরা তাদের নবজাতককে আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে দিতেন। ঐ সন্তানকে বলা হতো ‘মুহাররার’, অর্থাৎ (দুনিয়ার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থেকে) আল্লাহর জন্য মুক্তকৃত সন্তান। তাদের নিয়ত ও উদ্দেশ্য হতো এই যে, আমাদের সন্তানকে আমরা আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি। জীবনের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থেকে, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে, উপার্জন ও জীবিকা থেকে সে মুক্ত থাকবে। বিবাহ ও সংসার নির্বাহ-এর ঝামেলায় কখনো নিজেকে সে জড়াবে না। বৈরাগ্যব্রত গ্রহণের মাধ্যমে সারা জীবন সে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন এবং উপাসনালয়ের সেবায় নিযুক্ত থাকবে। তো উম্মে ইমরান তার গর্ভস্থ সন্তানকে পুত্রসন্তান ধারণা করে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ তা কবুল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলো তখন তিনি পেরেশান হয়ে বললেন
رب انى وضعتها انثى
(হে আমার প্রতিপালক, আমি তো কন্যসন্তান প্রসব করেছি!)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন্ত
والله اعلم بما وضعت وليس الذكر كالانثى
(আল্লাহ অধিক অবগত ঐ বিষয়ে যা সে প্রসব করেছে। আর নয় পুরুষ- মাত্রই নারীর সমতুল্য)
যাই হোক উম্মে মারয়াম বা ইমরাআতে ইমরান তার মান্নত পালন করে শিশু মারয়ামকেই আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিলেন, আর তিনি হযরত যাকারিয়্যা (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হলেন। এই ওয়াকফকৃত সন্তান কত বরকতপূর্ণ ছিলেন তা তো আপনারা কোরআনের আয়াত থেকেই জেনেছেন।
সন্তান ওয়াক্ফে শরী‘আতে মুহম্মদীর বিধান
ইমাম আবু বকর জাছ্-ছাছ রাযী (রাহ,) তাঁর ‘আহকামুল কোরআন’ কিতাবে এ আয়াতের তাফসীরপ্রসঙ্গে লিখেছেন্ত
‘সন্তানকে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করার এ ধারা শরী‘আতে মুহম্মদীতেও বহাল রয়েছে, তবে শরী‘আতে মুহম্মদীর স্বভাব ও প্রকৃতি অনুযায়ী তার রূপ সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা সন্তানকে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করতে চায় তারা এভাবে নিয়ত করবে যে, এই সন্তানকে আমি আল্লাহর জন্য এবং তার দ্বীনের খিদমতের জন্য ওয়াকফ করলাম। এতে সে ইলমে দ্বীন হাছিল করা এবং দ্বীনের খিদমত করার জন্য ওয়াকফ হয়ে যাবে। তখন সে শুধু আল্লাহর জন্য হয়ে যাবে এবং তার সারা জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে শুধু আল্লাহর সন'ষ্টি অর্জনের জন্য ইলমের তলব করে যাওয়া, দ্বীনের খিদমত করে যাওয়া এবং উম্মতকে ছিরাতুল মুস্তাকীমের উপর পরিচালিত করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকা। তবে আমাদের শরী‘আতে মুহম্মদীতে এজন্য তার সংসার ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই এবং অনুমতিও নেই। জীবনকে সে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করবে জীবনের অঙ্গনে অবস্থান করে এবং যিন্দেগিকে দ্বীনের জন্য কোরবান করবে যিন্দেগির ময়দানে ‘সার্গারম’ থেকে। প্রয়োজনে সে উপার্জন ও জীবিকার পথ গ্রহণ করবে, বিবাহ-সংসার নির্বাহ করবে এবং সন্তান্তসন্ততির তারবিয়াত করবে, এমনকি মা-বাবার সেবা-দায়িত্বও পালন করবে, কিন্তু তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে ইলমের তলব, দ্বীনের খিদমত এবং আল্লাহ তা‘আলার রিযা ও সন্তুষ্টি অর্জন। জীবনের অঙ্গনে অবস্থান করেও এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথেই হবে তার জীবন ও মরণ। যিন্দেগির ময়দানে ‘সার্গারম’ থেকেও এটাই হবে তার মাকছাদে হায়াত ও মাতলাবে মওত।
ভাই ও বন্ধুগণ! আমরা, আপনারা, যারা দ্বীনী মাদরাসায় ইলমের তলবে এসেছি, আমাদের মা-বাবার তো আসলে কর্তব্য ছিলো আমাদেরকে এভাবে আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দেয়া এবং কোরআনের ভাষায় ‘মুহাররার’ করে দেয়া। আমাদের তো হওয়া উচিত ছিলো এমন যে, সকল ঘাট ত্যাগ করে একমাত্র ইলমে দ্বীনের ঘাটে যিন্দেগির কিশতীকে বেঁধে রাখা।
কিন্তু আমার ধারণা, এখানে এমন ভাই খুব কমই আছেন যাদেরকে তাদের মা-বাবা ও মুরুব্বী এভাবে চিন্তা-ভাবনা করে, বুঝে শুনে, উম্মে মারয়ামের মত কোরবানির জাযবা নিয়ে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ এবং দ্বীনের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন, যাদের নিয়ত হলো, আমার সন্তানকে সবকিছু থেকে আমি মুক্ত করে দিলাম এবং দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের জন্য আযাদ করে দিলাম। তবে আমার পেয়ারে ভাই! তখন না হোক, এখন কিন্তু এ মহাসৌভাগ্য অর্জনের পথ আপনাদের জন্য খোলা রয়েছে। আপনি এখনই নিয়ত করতে পারেন এবং আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দ্বীনের জন্য, নবীর বিরাছাত ও নিয়াবাত -এর জন্য নিজেকে ওয়াকফ করে দিতে পারেন। আপনি এখনই এই নিয়ত করুন্ত
رب انى نذرت لك ما فى نفسى محررا فتقبل منى انك انت السميع العليم
যেভাবে আপনি নামাযের নিয়ত করেন, আর আপনার নামায শুধু আল্লাহর জন্য হয়ে যায়, আপনি রোযার নিয়ত করেন, আর আপনার রোযা শুধু আল্লাহর জন্য হয়ে যায়, আর আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন যে, বান্দা আমার জন্য রোযা রেখেছে, সুতরাং আমি নিজ হাতে তাকে এর প্রতিদান দেবো। তো যেভাবে নিয়তের মাধ্যমে আপনার নামায-রোযা আল্লাহর জন্য হয়ে যায়, ঠিক সেভাবে আপনি আপনার পুরা যিন্দেগির বিষয়ে নিয়ত করুন যে, আমি আমার পুরা যিন্দেগি আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দ্বীনের জন্য এবং আল্লাহর রাসূলের বিরাছাত ও নিয়াবাতের জন্য ওয়াকফ করে দিলাম। তো ব্যস, আপনার নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের মত আপনার পুরা যিন্দেগি আল্লাহর জন্য হয়ে গেলো। এখন থেকে আপনার সারা জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হবে আল্লাহর দ্বীনের খিদমত করা এবং খাদেম হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা। আপনি দ্বীনের ইলম হাছিল করবেন শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, এর মাধ্যমে আপনি নবীর বিরাছাত ও নিয়াবাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেবেন। আমাদের মিল্লাতের ‘আব্বা’ হযরত ইবরাহীম (আ.) এর মত পূর্ণ ঈমান ও ইয়াকীনের সঙ্গে আপনি বলুন্ত
انى وجهت وجهى للذى فطر السموت والارض حنيفا وما انا من المشركين
নিঃসন্দেহে আমি আমার মুখম ল (ও সমগ্র সত্তাকে) অভিমুখী করেছি ঐমহান সত্তার প্রতি, যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশম লী ও পৃথিবী, এমন অবস্থায় যে, আমি (তাঁর প্রতি) একনিষ্ঠ। আর নই আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত।
আরো বলুন্ত
ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العلمين
(নিঃসন্দেহে আমার ছালাত ও যাবতীয় ইবাদাত এবং আমার জীবন ও মৃত্যু রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্য।)
আপনি যখন এভাবে পূর্ণ অনুভব-অনুভূতি এবং চেতনা ও উপলব্ধির সঙ্গে নিয়ত করবেন এবং নিজেকে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দেবেন তখন আপনার পুরা যিন্দেগি আল্লাহর জন্য হয়ে যাবে। আপনার জীবনের প্রতিটি কাজ, এমনকি আপনার আহার-বিহার, আরাম-বিশ্রাম এবং জীবিকা ও সংসার সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় হবে এবং ইবাদত বলে গণ্য হবে। তখন আপনি নতুন একটি পরিচয় লাভ করবেন। আপনার অবস্থান ও পরিচয় হবে এই যে, আপনি ‘হিযবুল্লাহ’ বা আল্লাহর বিশেষ দলভুক্ত। এই নিয়ত ও ফায়ছালার মাধ্যমে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সেই ‘সৈন্যবাহিনী’তে ভর্তি হয়ে গেলেন যারা দ্বীনে মুহম্মদী ও উম্মতে মুহম্মদীর হেফাযতের যুদ্ধে নিয়োজিত।
এ মর্যাদার তুলনা নেই
আমার পেয়ারে ভাই! সত্যি সত্যি যদি আপনি আল্লাহর বিশেষ দলভুক্ত হওয়ার নিয়ত করে থাকেন, আপনি যদি দ্বীনে মুহম্মদী এবং উম্মতে মুহম্মদীর হেফাযতে নিযুক্ত সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হয়ে থাকেন এবং আপনি যদি নবীর বিরাছাত ও নিয়াবাতের সুমহান দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন তাহলে আল্লাহর ওয়াসে- একটু ভেবে দেখুন, দুনিয়ায় এর চেয়ে উচ্চ কোন অবস'ান ও মর্যাদা আর কী হতে পারে?! আল্লাহর দলে যারা তাদের চেয়ে বড় আর কে হতে পারে? ইসলামের সৈন্যদলের সিপাহী ও সিপাহসালার যারা তাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে হতে পারে? নবীর ওয়ারিছ ও নাইব যারা তাদের চেয়ে ইয্যতওয়ালা আর কে হতে পারে?! তারা অন্যদের দেখে ঈর্ষা করবে, না অন্যরা তাদের দেখে ঈর্ষা করবে?!
তো আমি আবার বলছি, দিলের পূর্ণ দরদ ও হামদর্দির সঙ্গে বলছি, আপনাদের মধ্য হতে কোন ভাই এখনো যদি বিষয়টির গুরুত্ব ও আযমত অনুধাবন না করে থাকেন, আপনি জাগ্রত হোন এবং পূর্ণ বুঝ ও সমঝের সঙ্গে নিয়ত করুন, ফায়ছালা করুন এবং নিজেকে আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দ্বীনের জন্য ওয়াক্ফ করে দিন। আপনার নিয়তে যদি ইখলাছ ও নিষ্ঠা থাকে, লিল্লাহিয়াত এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ থাকে তাহলে নির্দ্বিধভাবে আপনি বিশ্বাস করুন্ত আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে কবুল করে নিয়েছেন, আপনি আল্লাহর খাছ বান্দারূপে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
আল্লাহর জন্য ওয়াকফ হয়ে যাওয়ার এই নিয়ত ও ফায়ছালার পর ইনশাআল্লাহ আপনার মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন আসবে। আপনার চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান্তধারণায় আমূল বিপ্লব সাধিত হবে। আপনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত হবে। নিজেকে আপনার মনে হবে পরম সৌভাগ্যবান এবং এটাই সত্য। আসলেই আপনি পরম সৌভাগ্যবান। আপনার মর্যাদা এখন আকাশের উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। সেই হীনম্মন্যতা আপনাকে কিছুতেই স্পর্শ করতে পারে না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা এখন আমাদের দ্বীনী মাদরাসা-গুলোতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্রদের বিরাট অংশ এবং শিক্ষকদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ আজ হীনম্মন্যতার শিকার। এমনকি কিছু কিছু আলিমে দ্বীনও এখন ভাবতে শুরু করেছেন যে, ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে তারা এখন বিরাট ক্ষতি ও খাসারায় পড়ে গেছেন। না আছে তাদের শিক্ষার স্বীকৃতি, না আছে চাকুরীর সুযোগ। দুনিয়ার আরাম-আয়েশ থেকে তারা বঞ্চিত, অভাব ও দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী, এককথায় আমাদের কোন ভবিষ্যত নেই।
এধরনের হীনম্মন্যতা একজন তালিবে ইলমের অন্তরে কেন আসে? কীভাবে আসে? আসে শুধু এজন্যই যে, নিজেদের পরিচয় তাদের জানা নেই। নিজেদের মাকাম ও মর্যাদা সম্পর্কে তারা অবগত নয়।
কিন' যদি বুঝতে পারি যে, আমরা এখন আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত, আমরা দ্বীনে মুহম্মদী ও উম্মতে মুহম্মদীর সেবায় নিবেদিত, আমরা নিজেদেরকে আল্লাহর জন্য ওয়াক্ফ করেছি এবং আল্লাহ আমাদের কবুল করেছেন, ইনশাআল্লাহ তাহলে ‘যিল্লতি ও কমতরির ইহসাস’ কখনো আমাদের ‘শাখছিয়াতকে মাজরূহ’ করতে পারে না, হীনতা ও হীনম্মন্যতার অনুভূতি কখনো আমাদের ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের ধারে কাছে আসতে পারে না। বরং নিজেদেরকে তখন মনে হবে দুনিয়ার শাহানশাহ! তখন অন্তরের অনুভূতি হবে এই যে, আল্লাহর পক্ষ হতে এমন মাকাম ও মর্যাদা আপনি লাভ করেছেন, যা দুনিয়ার কোন বাদশা-শাহানশাহ লাভ করতে পারেনি! এমন মানযিল ও গন্তব্যে আপনি পৌঁছে গেছেন, যা দুনিয়ার বড় থেকে বড় কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। হৃদয় ও আত্মার জগতে আপনি তখন এমন শান্তি ও প্রশান্তি এবং স্বস্তি ও স্থিতি অনুভব করবেন, যা আল্লাহর নেক বান্দাদের কিসমতেই শুধু নছীব হয়। তখন এ পথে অভাব ও দারিদ্র্য যদি এসেই পড়ে সেটা আপনার মনে হবে সৌভাগ্য, কারণ আপনি তো বিরাছাতের চূড়ান্ত হক আদায় করেছেন। আপনার নবী ক্ষুধার জন্য পেটে পাথর বেঁধেছেন, কী জন্য? শুধু দ্বীনের জন্য! সেই ক্ষুধার ‘স্বাদ’ আপনি সামান্য হলেও ভোগ করেছেন।
যদি সমাজের পক্ষ হতে যিল্লতি ও উপহাস আসে, সেটা আপনার মনে হবে খোশকিসমতি, কারণ আপনি তো নিয়াবাতের পূর্ণ হক আদায় করেছেন। আপনার নবীকে তো পাগল বলা হয়েছে, পাথর ছোঁড়া হয়েছে। কী জন্য? শুধু দ্বীনের জন্য! সেই যিল্লতি ও উপহাসের কিছু হিছ্ছা আপনারও ভাগে এসেছে।
কষ্ট-দুর্ভোগের এই জীবনকে, অভাব ও দারিদ্র্যের এই যাতনাকে আপনি তখন আল্লাহর জন্য কোরবানি এবং জিহাদ ও মোজাহাদারূপেই গ্রহণ করবেন। এটাকেই আপনার তখন মনে হবে কামিয়াবি ও সফলতার রাজতোরণ। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
فاستبشروا ببعيكم الذى بايعتم به وذلك هو الفوز العظيم
(সুতরাং তোমরা যে সওদা করেছো সে সওদার জন্য আনন্দিত হও। আর সেটাই তো বিরাট কামিয়াবি।)
এখানে এ বিষয়ে আপনাদের সতর্ক করা জরুরি মনে করছি যে, আমার এ বক্তব্য দ্বারা একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আপনাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা জাগ্রত করা এবং হীনম্মন্যতার কবল থেকে উদ্ধার করা। আল্লাহ না করুন, আত্মগর্ব ও অহঙ্কার এবং বড়ত্ব ও কিবির পয়দা করা কখনই আমার উদ্দেশ্য নয়। গর্ব ও অহঙ্কার তো হলো বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হওয়ার কারণ।
আসলে আমাদের মনে যেন গর্ব ও অহঙ্কার না আসে এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা এ পথে কিছুটা অভাব ও দারিদ্র্য এবং হীনতা ও যিল্লতি রেখে দিয়েছেন। তারপরো তো অনেকের মধ্যে অহঙ্কার ও বড়ত্বের অনুভূতি এসে পড়ে এবং যিন্দেগিতে হালাকাত ও বরবাদি নেমে আসে।
তো গর্ব ও অহঙ্কার যেন না আসে। আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য এই যে, দ্বীনের ইলম, দ্বীনের খিদমত এবং উম্মতের রাহনুমায়ির দায়িত্বকে দুনিয়ার সবচে’ মর্যাদার বিষয় মনে করুন এবং এজন্য জীবন্তযৌবন উৎসর্গ করে দিন এবং জান্তমাল ওয়াক্ফ করে দিন, আর আল্লাহ যে দয়া করে তা কবুল করেছেন সে জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করুন এবং পদে পদে যে ভুলত্রুটি ও কোতাহি হয় সে জন্য তাওবা-ইস্তিগফার করুন। গর্ব ও অহঙ্কারের অবসর কোথায় বলুন! আমাদের অন্তরে তো আশা ও প্রত্যাশা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে ভয় ও উৎকণ্ঠা।
আমরা অমূল্য, আমাদের মাকাম অত্যুচ্চ
তো আমার পেয়ারে ভাই! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার একই কথা বলছি, কারণ একই দরদ, একই ব্যথা বারবার দিলের ভিতরে চাড়া দিয়ে উঠছে। এখনো যদি আপনারা নিজেদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য না জেনে থাকেন, এখনো যদি নিজেদের অবস্থান ও মর্যাদা না বুঝে থাকেন তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে এখন জেনে নিন, এখন বুঝে নিন। এ মুহূর্তে, এই মসজিদে বসেই নিয়ত করে নিন এবং ফায়ছালা করে ফেলুন যে, আমাদের জান্তমাল আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিলাম, কিসের বিনিময়ে? জান্নাতের বিনিময়ে। খরিদ করার ঈজাব করেছেন স্বয়ং আল্লাহ, আপনি তা কবুল করছেন। ঈজাব ও কবুল দ্বারাই বেচাকেনা হয়ে যায়। মুহূর্তের কাজ। আপনি এক বিরাট বাগান খরিদ করবেন। আপনি শুধু বললেন, বাগানটি আমি খরিদ করতে চাই একলাখ টাকার বিনিময়ে। বাগানের মালিক বললো, আমি রাজি। ব্যস হয়ে গেলো বেচাকেনা। মুহূর্তের মধ্যে আপনি বাগানের মালিক হয়ে গেলেন, এমনকি এখনো মূল্য পরিশোধ না করেও। তো এখানে আল্লাহর ঘরে বসে এই মুহূর্তে আপনি আল্লাহর সঙ্গে বেচাকেনা করে ফেলুন। আল্লাহ ঈজাব ও প্রস্তাব করেছেন, হে আমার বান্দা, আমি তোমার জান্তমাল খরিদ করতে চাই জান্নাতের বিনিময়ে! বড় লোভনীয় প্রস্তাব, আপনি বলে ফেলুন, আমি রাজি! ব্যস, হয়ে গেলো। আপনার জান্তমাল চলে গেলো আল্লাহ তা‘আলার মালিকানায়, আর আপনি হয়ে গেলেন জান্নাতের মালিক! জান্নাতের সওদা! মুহূর্তের কাজ, এখনই, এই মুহূর্তে করে ফেলুন। তারপর দেখুন, আপনার চিন্তা- চেতনায় কী বিরাট পরিবর্তন আসে! আপনার হিম্মত ও মনোবল কত দূরে কোন্ উচ্চতায় পৌঁছে যায়! মনে হবে, এই মুহূর্তে আপনি নবজন্ম লাভ করেছেন, ফরশ থেকে আপনি আরশে পৌঁছে গেছেন।
হীনতা বলুন, হীনম্মন্যতা বলুন, যা কিছু হচ্ছে শুধু এ কারণে যে, নিজেদের আপনারা চিনতে পারছেন না; নিজেদের অবস্থান ও মর্যাদা বুঝতে পারছেন না। ফলে শুধু নিজেদেরকে নয়, বরং সমগ্র ‘ইলমী খান্দান’কেই বে-কীমত ও মূল্যহীন মনে হচ্ছে এবং মনে হচ্ছে দুনিয়ার বাজারে আপনারা অচল মুদ্রা। আর কোন সমপ্রদায় নিজের চোখে নিজে যখন ছোট, তুচ্ছ ও মূল্যহীন হয়ে যায় তখন অন্যদের চোখেও সে তুচ্ছ ও মূল্যহীন হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে যদি আমরা হযরত মারয়াম সিদ্দীকার আম্মা যা করেছিলেন তা করতে পারি, অর্থাৎ নিজেদেরকে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করতে পারি এবং মাখলূক থেকে আশা ও প্রত্যাশার সকল বন্ধন ছিন্ন করে শুধু আল্লাহর হয়ে যেতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের অনুভূতি এটাই হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাদের মূল্য আদায় করতে পারবে না; আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাদের খরিদ্দার হতে পারবে না। দুনিয়ার বাজারে যে কোন বস্তুর, যে কোন ব্যক্তির মূল্য নির্ধারণ করা এবং পরিশোধ করা সম্ভব, সম্ভব নয় শুধু কোন তালিবে ইলমের মূল্য নির্ধারণ করা। কেননা তার মূল্য তো দুনিয়ার তুচ্ছ সোনা-চাঁদি ও মণি-কাঞ্চন দ্বারা হয় না; তার মূল্য নির্ধারণ করা যায় শুধু এবং শুধু জান্নাত দ্বারা। আমরা যদি নিজেদের মূল্য বুঝতে পারি তাহলে ঈমানের দৃঢ়তা এবং বিশ্বাসের দৃপ্ততা নিয়ে মানব-সভায় এ ঘোষণা দিতে পারি, হে মানুষ! দুনিয়ার বাজারে সবকিছুর সওদা হতে পারে, আমাদের সওদা হতে পারে না। কবির ভাষায়-
نرخ بالا كن كه ارزانى هنوز
‘নার্খ বালা কুন কেহ আরযানী হুনূয’
(‘আরো দাম বাড়াও, বাড়াতে থাকো; এখনো তুমি অনেক সস্তা ভেবেছো আমাকে।’)
পেয়ারে ভাই! আমি অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে চাই, নিজের অস্তিত্বের প্রতি আমার যেমন বিশ্বাস, তার চেয়ে বড় বিশ্বাসের সঙ্গে আমি বলতে চাই, যখনই আপনারা বিশুদ্ধ অন্তরে এই নিয়ত করে নেবেন, যখনই আপনারা ঘোষণা করবেন যে, আমরা আল্লাহর জন্য (ওয়াকফ) হয়ে গেলাম এবং এই ঘোষণার উপর অবিচল থেকে এর শর্তগুলো পূর্ণ করতে থাকবেন তখন ইনশাআল্লাহ দুনিয়াতেই আপনাদের উপর আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ নেমে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা আপনাদেরকে গায়ব থেকে এমনভাবে সাহায্য করবেন যে, তা অনুমান করা, কিংবা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। এককথায় আপনি যখন আল্লাহর জন্য হয়ে যাবেন তখন আল্লাহ আপনার জন্য হয়ে যাবেন।
من كان لله كان الله له
(যে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়, আল্লাহ তার জন্য হয়ে যান)
অন্য হাদীছ শরীফে আছে যে, আল্লাহ বান্দার কান হয়ে যান, যা দ্বারা সে শোনে, বান্দার চোখ হয়ে যান, যা দ্বারা সে দেখে, বান্দার হাত হয়ে যান, যা দ্বারা সে ধরে।