আল্লাহ তাআলা অবকাশ দেওয়ার পর
ভূস্বর্গ কাশ্মীর যুগ যুগ ধরে রক্ত, লাশ, শোক আর বেদনায় ডুবে আছে। এখানকার টকটকে লাল রক্ত বিচারহীনতায় ভুগতে ভুগতে কালচে হয়ে উঠেছে। কাশ্মীর এমন এক উপত্যকা, যেখানে খুনের বিচার হয় না। সেখানে লাশটুকু ফেরত পেতেই মিছিল করতে হয়। শোক এখানে এতটাই গাঢ় হয়ে আছে যে, মানুষগুলো পাথর হয়ে গেছে। বেদনা তাদেরকে এতটাই নীল করে ফেলেছে যে, তারা আর আত্মভোলা স্বজাতীর কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করে না। নিজেদের সংগ্রাম, নিজেদের ভাগ্য তারা এখন খোদার কাছ থেকেই চেয়ে নেয়। দ্রোহের আগুন গেরুয়া পরা জালিমদের এখনো জ্বালিয়ে ছারখার করতে না পারলেও আসমানী কিছু ফায়সালা কখনো কখনো তাদের জন্য সান্ত্বনা হয়ে আসে। সেই সান্ত্বনাকে পুঁজি করে তারা আবার দ্রোহের আগুন প্রজ্বালিত করে। প্রাণে কতটুকু শক্তি থাকলে ছাইচাপা আগুন আবার জ্বলে ওঠে।
স্বাধীনতা কাশ্মীরিদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচণ্ড ইচ্ছা তারা বেগবান করে রেখেছে সত্তর বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে। যেখানে কথা ছিল গণভোটের মধ্যমে কাশ্মীরের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর, সেখানে জুলুম নিপীড়নই কাশ্মীরিদের নিত্য নিয়তি। জালিমরা একধরনের জুলুম করেই ক্ষ্যান্ত হয় না; বের করে নিত্য নতুন ধরন। যেসব দেখে বিবেকবান মানুষ হচকচিয়ে ওঠে। কাশ্মীর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামরিকায়িত অঞ্চল। এখানে সবচেয়ে বেশি সেনা মোতায়েন করে রেখেছে ভারত। সংখ্যাটি সাত লাখেরও বেশি। এ উপত্যকায় জুলুম-নিপীড়ন-হত্যার জন্য কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। উল্টো প্রতিটি পৈশাচিক ঘটনার নায়কদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। কখনো কাশ্মীরিদের ফলের বাগানগুলো নিষ্ঠুর হাতে ধ্বংস করতে থাকে। আর মানুষগুলোকে তো সেই সত্তর বছরে ধরে ধ্বংস করেই চলেছে।
এই জুলুম-নিপীড়নের মধ্য দিয়েই ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। সামান্য যা অধিকার ছিল তাও ছিনিয়ে নেয়। তখন কাশ্মীরিরা বিক্ষোভে-বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। সেইসঙ্গে নেমে আসে নির্যাতনের নতুন নতুন খড়্গ। ইতিমধ্যে শত শত কাশ্মীরিকে ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে এক সেনাকর্মকর্তা এক কাশ্মীরিকে জিপের সামনে বেঁধে রাস্তায় টহল দেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন এ ছবি দেখে সারা দুনিয়ায় ছি ছি রব ওঠে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। কিন্তু জালিমরা হিংস্র হওয়ার পাশাপাশি নির্লজ্জও হয়ে থাকে। হিংস্রতার পরিচয় তো তারা যুগ যুগ ধরে দিয়ে যাচ্ছে। নির্লজ্জতার পরিচয় দেয় এসব নিপীড়ক সেনা সদস্যদের সাফাই গেয়ে। অভিনব পন্থায় নিপীড়ন করা সেই সেনা সদস্যের যারা সাফাই গেয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত।
একসময়ের এই সেনাপ্রধানকে অবসর গ্রহণের পর প্রতিরক্ষা প্রধান করা হয়। এই পদটি ভারতে এই প্রথম। আগে সেনা প্রধান তারপর প্রতিরক্ষা প্রধানের মত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সে বাগিয়ে নিতে পেরেছিল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আস্থাভাজন হয়ে। আর জানা কথাই, বিজেপির আস্থা অর্জন করতে হলে অবশ্যই তাকে মুসলিম বিরোধী হতে হবে। সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় নানা বিতর্কিত উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে আস্থা অর্জনের কাজটি করেছিলেন।
কাশ্মীরি যুবককে জিপের সামনে বেঁধে রাস্তায় টহল দেওয়ার মত অমানবিক কাজকে বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, ‘অভিনব উদ্ভাবন’!
জুলুম-নির্যাতন, দমন-পীড়ন ও হত্যার মত কাজগুলো তারা শুধু করেই না, নানাভাবে সেগুলোকে বৈধ করার অপপ্রয়াস চালায়। তাদের অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়ে যায় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ। এ যেন বিগত শতাব্দীর সেই কৌতুকের মতই শোনা যায়, রাশিয়ান এক মা ছেলেকে উসমানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিদায় দিচ্ছিল। ছেলেকে বলল, শত্রু যদি এদিক দিয়ে আসে তাহলে এভাবে মারবি। ওদিক দিয়ে এলে এভাবে মারবি। মোটকথা, শত্রুকে কোনোভাবেই রক্ষে পাওয়ার সুযোগ দিবি না।
ছেলে মাকে বলল, ওরা যদি আমাকে মারে তাহলে আমি কী করব?
মা নিষ্পাপ চেহারা করে উত্তর দেয়, ওমা, তুই কী অন্যায় করেছিস যে তোকে মারবে?!
আজকে দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতনকারীদের অবস্থা এরকমই।
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন মানুষের মত জীবন যাপনের জন্য। কিন্তু সেই মানুষই অমানুষ হয়ে উঠছে ক্ষমতার লোভে। ক্ষমতার এই লিপ্সার সামনে মজলুমরা যখন অসহায় তখন আল্লাহর আসমানী ফায়সালা নেমে আসে পৃথিবীতে। জালিমের অস্ত্র দিয়েই জালিমকে শেষ করে দেয়। আমরা জানি না, সাম্প্রতিক কালে ভারতে ঘটে যাওয়া হাই প্রোফাইল সেনা অফিসারদের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাটির সাথে মজলুমের আহাজারির কোনো যোগসূত্র আছে কি না- এসব বিষয়ে অন্তর্যামী মহান আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। খবরটি নিম্নরূপ- গত ৮ ডিসেম্বর ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন রাওয়াত দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুলুর বিমানঘাটি থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে বহন করা হেলিকপ্টারটি নীলগিরি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়। রাশিয়ার তৈরি এমআই-১৭ ভি-৫ কপ্টারটি ছিল এমআই-৮-এর উন্নত সংস্করণ। এই হেলিকপ্টারটি নিয়ে তাদের ভরসা ও আত্মবিশ্বাসের শেষ ছিল না। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যাতায়াতে ব্যবহার করা হত এই হেলিকপ্টার। পরিশেষে দুনিয়ার তাবৎ মজলুমানকে আমরা কুরআনের সেই আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللهَ غَافِلًا عَمَّا یَعْمَلُ الظّٰلِمُوْنَ، اِنَّمَا یُؤَخِّرُهُمْ لِیَوْمٍ تَشْخَصُ فِیْهِ الْاَبْصَارُ.
তুমি কিছুতেই মনে করো না জালিমরা যা-কিছু করছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর। তিনি তো তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিচ্ছেন, যে দিন চক্ষুসমূহ থাকবে বিস্ফারিত। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪২
তাই মজলুমানের উচিত নিজের যা আছে তা নিয়ে দ্বীনের পথে অবিচল থাকা। সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও সর্বদ্রষ্টা রাহমানুর রাহীমের দরজা তো খোলা আছে। সেই দুয়ারে নিজের সব দুঃখ-বেদনার কথা তুলে ধরা এবং আল্লাহর কাছে নিবেদন করা-
اللهم أهلك الظالمين بالظالمين، وأخرجنا من بينهم سالمين.
হে আল্লাহ! জালিমদেরকে জালিমদের দ্বারা ধ্বংস করুন। তাদের মাঝখান থেকে আমাদেরকে নিরাপদে বের করে আনুন- আমীন। হ