Jumadal Akhirah 1443   ||   January 2022

মদ খাইয়ে মাদক বন্ধ হবে না

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

আলকাউসারের চলতি সংখ্যা প্রেসে যাওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত। এমন সময় একটি খবর দেখে আঁৎকে উঠি। একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘মদে ছাড় নিয়ে নানা আলোচনা।’  খবরে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্তরের বড় বড় কিছু কর্মকর্তা ও কোনো কোনো সংসদ সদস্য একটি বৈঠকে একত্রিত হয়েছেন। বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল, মদকে বৈধতা দেওয়া। সেখানে তাঁদের বিভিন্নজন বিশেষজ্ঞের মতো বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, মদকে কিছুটা বৈধতা দেওয়া হলে যুব সমাজকে মাদক থেকে ফেরানো যাবে। কেউ কেউ বলেছেন, মদকে বৈধতা দিলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব পাবে। বর্তমানে মদের উপর মোটা অংকের কর ধার্য করা আছে। তাই বিভিন্ন ক্লাবে যেসব মদ পরিবেশন করা হয় সেগুলো বৈধ পথে না এসে চোরাই পথে আসে। অতএব কর কমিয়ে দিলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে।

আমরা জানি না, উপরোক্ত বৈঠকটি সরকারের উচ্চ মহলের অবগতিতে হয়েছে, নাকি তারা নিজেরাই বসেছেন। কিন্তু সে বৈঠকে যেসব কথা আলোচনা হয়েছে তা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত আতংক ও উদ্বেগের বিষয়। কার অজানা আছে যে, মদ ইসলামের কঠোরতম হারাম। ইসলামে নিকৃষ্টতম হারাম খাদ্য ও পানীয় এবং হারাম কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মদ গ্রহণ করা। এদেশের প্রায় নব্বই ভাগ লোক ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। সুতরাং এমন একটি বস্তুকে বাংলাদেশে বৈধতা দেয়ার চিন্তা কীভাবে করা হয় তা-ই বোধগম্য হচ্ছে না! পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা মায়েদায় সুস্পষ্টভাবে মদের নিষেধাজ্ঞার কথা এসেছে। এটাকে বলা হয়েছে-

رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ.

তথা শয়তানের নিকৃষ্ট অপবিত্র কাজ। ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَیْسِرُ وَ الْاَنْصَابُ وَ الْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.

হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদী ও জুয়ার তীর অপবিত্র, শয়তানী কাজ। সুতরাং এসব পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর। -সূরা মায়েদা (০৫) : ৯০

বহু সহীহ হাদীসে মদের সেবন, বেচাকেনা, পরিবেশন ইত্যাদির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। শুধু তাই নয় সহীহ বুখারীর বর্ণনায় মদের সেবনের আধিক্যকে কিয়ামতের আলামত বলা হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক আয়াত নাযিল হওয়ার পর মসজিদে নববীতে খুতবা দিয়ে তা গণমানুষকে জানিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাদের ঘরে থাকা সকল মদ রাস্তায়-ড্রেনে ঢেলে দিয়েছেন। মদীনা মুনাওয়ারার ড্রেন-নালাগুলো মদের আধিক্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেউ সে নির্দেশ মানতে দ্বিধা করেননি।

গণমাধ্যমে খবরে জানা গেছে, যারা মদের বৈধতা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন তারা কিছু যুক্তি পেশ করছেন। তার মধ্যে একটি হল, মদ ও মাদক এক নয়। মাদক থেকে মদকে বের করে দিতে হবে। তবেই যুব সমাজ মদের সুবিধা পেলে মাদক থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। তাদের আরেকটি যুক্তি হল, কোনো বিয়ারে বা পানীয়তে অল্প পরিমাণে এ্যালকোহল থাকলে তাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়! আমরা জানি না, এ ব্যক্তিত্বগণ কোনো মানসিক বিশেষজ্ঞ কি না? মাদক বিষয়ক তাদের গবেষণা বা পড়াশোনা আছে কি না? অল্প মদ খেলে বেশি মাদক থেকে দূরে সরে যাবে- একথার পেছনে বৈজ্ঞানিক কী যুক্তি আছে সেটিও অজানা, তবে তারা যে সূত্র বা যে কারণেই কথা বলুক না কেন, সেগুলোর জবাব প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেড় হাজার বছর আগেই বলে গিয়েছেন। সুনানে আবু দাউদে (হাদীস নং ৩৮৭৩) বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে এসেছে,

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, তা সেবন করা যাবে না।

পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি একই উত্তর দেন।

এরপর বলা হল-

إنها دَوَاءٌ

হে আল্লাহর রাসূল, এটি তো ওষুধ?

জবাবে রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন-

ولكِنَّها دَاءٌ

না বরং এটি রোগ।

আজকে যারা অল্প মদ খাইয়ে আরও জঘন্য মাদক থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে চান তাদের এ হাদীস বারবার পড়া উচিত।

এখানে উল্লেখ করা ভালো যে, সে যুগে এ্যালকোহলযুক্ত মদই ছিল। এখনকার হিরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল না।

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ.

যে নেশাজাতীয় বস্তু অধিক পরিমাণে খেলে নেশা হয় তা সামান্য পরিমাণে সেবন করাও হারাম।  -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮৬৫

আরেকটি হাদীসের ভাষ্য-

حُرِّمَتِ الْخَمْرُ بِعَيْنِهَا قَلِيلُهَا وَكَثِيرُهَا.

মদ কম ও বেশি যে কোনো পরিমাণে সেবন করা হারাম।  -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫৬৮৪

মদ বা এ্যালকোহল সেবনের নিষেধাজ্ঞা কুরআন ও হাদীসের এক-দু জায়গায় আসেনি, বরং বেশ কিছু আয়াত এবং বহু হাদীসে বিভিন্নভাবে মদের নিষেধাজ্ঞা এবং এর ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর যেসকল জাতি ও দেশ মদের বৈধতা তাদের দেশে দিয়ে রেখেছে, তারা এর কারণে জাগতিকভাবে কী কী ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে তা তো এখন খুবই প্রকাশ্য বিষয়। সেখানে এ দেশের সাধারণ জনগণের জন্য মদ বৈধ করার পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্ন কেন এল তা এখনো অস্পষ্ট। এদেশে কি জনগণ কোনো আন্দোলন, মিছিল বা হরতাল করেছিল মদের বৈধতার জন্য। অথবা কয়েক হাজার লোক কি সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছিল? আমাদের জানা মতে এসব কিছুই ঘটেনি।

যে এলিট শ্রেণির ভদ্রলোকদের এ্যালকোহল বা মদ সেবন না করলে ঘুম আসে না, তাদের জন্য তো তাদের ওপেন সিক্রেট ক্লাবগুলোই রয়েছে। অন্য ভাষায় বললে, তাদের জন্য কি বৈধ-অবৈধের প্রশ্ন আছে? তাদের কি আইনের ভেতরে থাকতে হয়? তাহলে কি কেউ নতুন করে মদের ব্যবসা জমিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারকে দিয়ে এমন পদক্ষেপ নেওয়ানোর চেষ্টা করছে? কিছু বছর আগে দেশের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একটি শিল্প গ্রুপ হঠাৎ করেই এ্যালকোহল মিশ্রিত পানীয় বানিয়ে ফেলেছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিক্ষোভের মুখে সে প্রকল্প পরে বাতিল করতে বাধ্য হয়।

কেউ একজন বললেন, আদালত থেকে এমন একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, মদকে মাদক থেকে আলাদা করা যায় কি না- সে বিষয়ে মতামত দিতে। আদালতের বিষয়টি আমরা বিস্তারিত জানি না। আমরা কল্যাণকামিতার স্বার্থে সরকারকে জোরালোভাবে নিবেদন করতে চাই, মদের কম বা বেশি যে কোনো পরিমাণের বৈধতা দেওয়া হবে দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মাক। সহীহ বুখারীতে (হাদীস নং ৩৩৯৪) এসেছে, মেরাজের রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দুটি পেয়ালা রাখা হল। একটিতে ছিল দুধ আরেকটিতে ছিল মদ। এরপর বলা হল, যে কোনো একটি গ্রহণ করুন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মদের পেয়ালা না নিয়ে দুধের পেয়ালা হাতে নিলেন। সাথে সাথে বলা হল-

أَمَا إِنَّكَ لَوْ أَخَذْتَ الخَمْرَ غَوَتْ أُمَّتُكَ.

আপনি মদ নিলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।

সুতরাং ইহ এবং স্থায়ী জগৎ দুটির জন্যই মদ জঘন্য রকমের ক্ষতিকারক। এদেশের বড় বড় দলগুলো নির্বাচনের আগে যখন দলীয় ইশতিহার প্রকাশ করে, তাতে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গিকার থাকে, আমাদের সরকার ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করবে না। আওয়ামীলীগও এমন অঙ্গিকার করেছিল। সে অঙ্গিকারের কথা সরকারের কর্ণধারগণ নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। আর আদালতের কথা নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করে সরকার তো দলে দলে উকীল নিয়োগ করে রেখেছেন; তাদেরই বরং দায়িত্বে পড়ে, আদালতের কাছে এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করা এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস ও আবেগের কথাগুলো জানানো। সরকারের অঙ্গিকারের কথা আদালতকে শোনানো। আমরা বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালতের বড় বড় বিচারপতিদের মুখে একটি কথা শুনেছি, ‘এমন কিছু করা যাবে না, যার দ্বারা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে মদের বৈধতা দিলে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এমন যে কোনো পদক্ষেপ সরকারের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হতে বাধ্য। মদ থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য মদীনায় মদ তৈরি ও এর পরিবেশনের পাত্রগুলোর বেচা-কেনা এবং প্রদর্শনও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেখানে স্বল্প পরিমাণের এ্যালকোহল বড় মাদক থেকে ফেরাবে- এমন যুক্তি দেয়ার অবকাশ নেই। সুতরাং আবারও বিনীত নিবেদন করছি, এ বিষয়ে যা কথা হয়েছে এতটুকুর মধ্যেই যেন শেষ হয়ে যায়। মাদক বন্ধ হবে মদ খাইয়ে- এমন খোঁড়া যুক্তি থেকে সংশ্লিষ্টদের সরিয়ে আনাই হবে সকলের জন্য নিরাপদ কাজ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের সহায় হোন। জনগণ, সমাজ ও এদেশের জন্য ক্ষতিকারক সকল ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে আমাদেরকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন। হ

 

advertisement