নববর্ষ ২০২২
নতুন বছরের সংকল্প
মানুষের জীবনে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলা যেতে পারে, সময়ই জীবন। বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেছেন- ‘হে আদমের বেটা! তুমি তো কিছু দিবসের সমষ্টি। একটি দিন গত হওয়া মানে তোমার কিছু অংশ চলে যাওয়া।’ এভাবে এক দিন এক দিন করে আমাদের জীবনের দিনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কর্তব্য, এই আমোঘ বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
দিন-রাতের বিবর্তন আমাদেরকে এই বাস্তবতা সম্পর্কে সতর্ক করে এবং আমাদেরকে কর্মমুখর হওয়ার পয়গাম শোনায়। যারা দিন-রাতের গমনাগমনের এই নীরব বাণী শ্রবণ করে সময়কে কাজে লাগাতে পারেন পরিণামে তারাই সাফল্য অর্জন করেন। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে এ বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদ কি শুধু সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কেই সচেতন করে? না। কুরআন শুধু সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কেই সচেতন করে না, তা ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কেও স্পষ্ট পথনির্দেশ দান করে। যে নির্দেশনা অনুসরণ করে মানুষ নাজাত ও মুক্তির পরম গন্তব্যে উপনীত হতে পারে।
হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَايِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا.
অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রত্যুষে উপনীত হয়ে নিজ সত্তাকে বিক্রি করে। হয়তো আল্লাহর কাছে বিক্রি করে আল্লাহর বান্দা হয়ে দিনযাপন করে। এই ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত করে। অথবা নফস ও শয়তানের কাছে বিক্রি করে তাদের বান্দা হয়ে দিনযাপন করে। এই ব্যক্তি নিজেকে ধ্বংস করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৩
মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- সে কি আল্লাহর বান্দা হবে, না নফস ও শয়তানের বান্দা হবে।
আল্লাহর বান্দা হওয়ার অর্থ, আল্লাহ তাআলার বিধিবিধান অনুসারে জীবন-যাপন করা। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল- চব্বিশ ঘণ্টা যে নিজেকে আল্লাহ তাআলার অনুগত রাখে, তাঁর বিধান মত চলে সে-ই সত্যিকারের আল্লাহর বান্দা। আল্লাহর কাছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ ও শান্তি। পক্ষান্তরে জীবনের দিবস-রজনীগুলোতে যে আল্লাহর আনুগত্য বর্জন করে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সে নফস ও শয়তানের বান্দা। নফস-শয়তান তাকে অশান্তি-অকল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।
কারো মনে হতে পারে, যারা দ্বীন মোতাবেক চলে তাদের জীবনটা আবদ্ধ জীবন। নানা ধরনের বিধি-নিষেধের বেড়াজালে তারা আবদ্ধ। পক্ষান্তরে বেদ্বীনী জীবন হচ্ছে মুক্ত-স্বাধীন জীবন। সেখানে এতসব বিধি-নিষেধের বালাই নেই। কিন্তু এই চিন্তাটা গোড়া থেকেই ভুল। প্রথমত এই কারণে যে, যারা বেদ্বীনী জীবন যাপন করে তারা বাস্তবে মুক্ত-স্বাধীন নয়, বাস্তবে তারা নফস ও শয়তানের দাস। নফস-শয়তান তাদেরকে অনাচার-উচ্ছৃঙ্খলার আদেশ করে। আর তারা সে আদেশ পালন করে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করে। তাদের কর্তব্য ছিল এ আদেশ অমান্য করা। কিন্তু তারা তা না করে নফস ও শয়তানের ক্ষতিকর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এই বশ্যতা স্বীকার করার পর কীভাবে তারা নিজেদের মুক্ত-স্বাধীন মনে করতে পারে?
দ্বিতীয়ত যারা দ্বীনের বিধি-নিষেধ মেনে চলে, নিঃসন্দেহে তারাও মান্যতা ও আনুগত্য অবলম্বন করে, কিন্তু সে আনুগত্য আল্লাহর, যিনি তাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। এ আনুগত্য বান্দার নিজের জন্যই কল্যাণকর। এ হচ্ছে শৃঙ্খলা। আল্লাহ তাআলার বিধান পালনের মাধ্যমে মানুষের জীবন সংযত ও সুশৃঙ্খল হয়। ফলে তার দুনিয়ার জীবনও সুন্দর হয়, আখেরাতের জীবনও সুন্দর হয়। এই এক জায়গায় যে নিজেকে নত করে অন্য সকল জায়গার নতজানুতা থেকে সে মুক্তি পেয়ে যায়। কবি সত্য বলেছেন-
یہ ایک سجدہ جسے تو گراں سمجھتا ہے
ہزار سجدے سے دیتا ہے آدمی کو نجات
যে একটি সিজদা তোমার কাছে অতি কঠিন, সেটিই তোমাকে মুক্তি দেয় হাজার সিজদা থেকে ।
মানুষ যখন আল্লাহ তাআলার আনুগত্যকে জীবন ও কর্মের মানদ- হিসেবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তখন পরিষ্কার ক্ষতিকর বিষয়গুলোও সে চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করতে থাকে। মুসলিম জাতির এ অবক্ষয় খুবই দুঃখজনক। কেননা তাদের কাছে তো স্বচ্ছ পবিত্র নীতি-আদর্শ বিদ্যমান আছে। প্রবৃত্তির দাসত্বের ন্যক্কারজনক সব উদাহরণ মুসলিম-জাহানের দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে সম্প্রতি নানা যুক্তিতে মাদকের বৈধতা দেয়ার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। অথচ মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে কার না জানা আছে? মদ বিয়ার ইত্যাদিতে ৫ ভাগের নিচে এলকোহল থাকলে এগুলো বৈধ ঘোষণা করা উচিত বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ ইউরোপের কোনো কোনো দেশের উদাহরণ টানছেন যে, ওখানে গাঁজা বৈধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই গোড়া থেকে চিন্তা করছে না। আমাদের দেশেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শুধু ধর্মীয় চেতনা ও ধর্মপালনের কারণে মাদকের ভয়াবহ ক্ষতি থেকে বেঁচে আছেন তা কেউ আমলেই নিচ্ছেন না। এই অবস্থানকে প্রবৃত্তির অনুগামিতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
আমরা মনে করি, মাদকসহ সব ধরনের ক্ষতিকর বিষয় থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের গোড়া থেকে ভাবতে হবে। বিশ্বাস ও কর্ম সব ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসনের মান্যতাকে জীবনের মানদ- হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নতুন বছরে এই হোক আমাদের সংকল্প।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.