‘এ দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনের তলব পয়দা করা’
[হযরত মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. এখন এই নশ্বর পৃথিবীতে নেই। ‘নবীর ওয়ারিস যাঁরা উম্মতের দরদে দরদী হন তাঁরা।’ মুসলিম উম্মাহর দরদী এই মানুষটি উম্মাহর খেদমতে নিজেকে ওয়াকফ করেছেন। চার বছর হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর নিবিড় সাহচর্য লাভ করেছেন। সুন্নতকে ভালবেসেছেন, সুন্নতের পথে চলেছেন এবং কাছের ও দূরের সবাইকে সুন্নতের পথে ডেকেছেন।
কীর্তিময় বিশাল জীবন পার করে ১৪২০ হি. ২৩ রমযান তিনি প্রভুর ডাকে সাড়া দেন। জুমার দিন সুন্নত গোসল সম্পন্ন করে সাদা লেবাসে আতর-খোশবু মেখে জুমার জামাতের ইনতিযারে ছিলেন। সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত শুরু করেন। যখন মাগফিরাত ও আজরে কারীমের খোশ খবরওয়ালা আয়াত- فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَّ اَجْرٍ كَرِیْمٍ
পর্যন্ত পৌঁছেন তখন মউত এসে তাঁকে আলিঙ্গন করে।
হযরতের প্রায় ৯০ বছরের বরকতময় দীর্ঘ জীবন থেকে প্রায় ৯০ মিনিটের বরকতময় সাহচর্য অধমের নসীব হয়েছিল ২২ মার্চ ১৯৮৪ ঈ., বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব, জুমারাতে বয়ানের মজলিসে, কাকরাইল মারকায মসজিদে। আলহামদু লিল্লাহ।
আমি তখন ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্স পরীক্ষার্থী। কবি জসীম উদ্দীন হলের যিম্মাদার হিসেবে সাথীদের নিয়ে শবগুজারীতে এসে বয়ানের মজমায় ছিলাম। মিম্বারে বয়ান চলছিল। বয়ান করছিলেন তাবলীগের কিংবদন্তি কাকরাইলের বিশিষ্ট মুরব্বী হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান ছাহেব রাহ.।
অত্যন্ত আকর্ষণীয় বয়ান ছিল। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের সাথেই বয়ান শুনছিলাম। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। মাওলানা লুৎফুর রহমান ছাহেব মিম্বার থেকে নেমে এসে অল্প উত্তরে এগিয়ে গিয়ে মেহমানকে ইস্তেকবাল করে অত্যন্ত সম্মানের সাথে মিম্বারে বসিয়ে দিলেন। তারপর মেহমান হযরত মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বয়ান শুরু করার জন্য বিনীত অনুরোধ করলেন।
হযরত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়ে বয়ান পেশ করেন। আমি তা দিলের কানে শুনি এবং সেইসাথে নিজস্ব শর্টহ্যান্ড কায়দায় আমার ডায়েরিতে কলমবন্দ করে ফেলি।
জাতি-বর্ণ-গোত্র-দল নির্বিশেষে সারা বিশ্বের সকলের কাছে সমাদৃত তাবলীগ জামাত গৌরবময় অতীত হারিয়ে আজ যে মহা সংকটে নিপতিত তা থেকে উত্তরণে প্রায় ৩৭ বছর আগের এ বয়ানটি একটি দিকনির্দেশনামূলক বয়ান হিসেবে কাজ করবে- এই আশায় বুক বেঁধে বুকভরা দরদ-ব্যথা ও দহন-যন্ত্রণা নিয়ে আলমী ফিকিরের সাথে বয়ানটি উপস্থাপন করছি। মহান আল্লাহ তাআলা দয়া মায়া করে তাওফীক দান করুন ও কবুল করুন- আমীন। -আবুল কাশেম]
হামদ ও সানার পর আয়াতে কারীমা ও হাদীস শরীফ পাঠ করে সমবেত সবাইকে সম্বোধন করে হযরত বলেন- নতুন কী বলব? সব পুরোনো কথা। নতুন করে মনোযোগ দিলে কথা নতুন হয়। আমি দুটি কথা বলব। আপনারা কদর করবেন। কদর ও আজমত ছাড়া কুরআনুল কারীম থেকেও ফায়দা পাওয়া যায় না।
প্রথম কথা
এ দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনের তলব পয়দা করা। দ্বীনের সত্যিকার তলব ও পিপাসা পয়দা করা। ক্ষুধা না থাকলে ভালো খাবারও খেতে মনে চায় না। অনেক সুস্বাদু খাবারও মাটি মনে হয়। ঔষধের মতো করে খায়। কারণ, ক্ষুধা নেই। তাবলীগ হচ্ছে মুখের লালার মতো, যা ছাড়া মান্না সালওয়াও ভালো লাগবে না। আমি একথা হযরত মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব রাহ.-এর কাছে শুনেছি। তাঁর নিবিড় সাহচর্যে আমি চার বছর থেকেছি। আমার মাধ্যমে তিনি কথা বলতেন। অনেক সময় তিনি আমাকে তাঁর যবান বলে আখ্যা দিতেন। তাবলীগ পুরা দ্বীন না, কিন্তু পুরা দ্বীনের তলব, সত্যিকার তলব ও ‘ভোখ’ (ক্ষুধা) পয়দা করে। নিজের কমি নযরে আনাই হচ্ছে তাবলীগের মেহনতের উদ্দেশ্য-‘আপনী কমী কা ইহসাস পয়দা করনা মাকসাদ হ্যায়।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহবুবে রাব্বুল আলামীন হয়েও দুআ করতেন-
رَبِّ زِدْنِيْ عِلْمًا.
আর আমি চারদিন তাবলীগ করে মনে করি, হয়ে গেছে।
এ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ তালিবে ইলম বানানোর কাজ, আলিম বানানোর কাজ নয়-‘দাওয়াত ও তাবলীগ কা কাম তালিবে ইলম বানানে কা কাম হ্যায়, আলিম বানানে কা নেহী।’
যদি কেউ দ্বীনের মেহনত করে নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে করে তাহলে সে কামিয়াব। যে মনে করে ক্ষুধা মিটে গেছে সে নাকাম। ক্ষুধার দ্বারা মুখে লালা পয়দা হয়, যেটা খাবারের সাথে মিশে মজাদার করে দেয়। মুখে লালা না আসলে মান্না সালওয়াও মজাদার লাগবে না। আমি যা জানি তা-ই যথেষ্ট; যার এ ধরনের খেয়াল আসবে সে ভুল বুঝল এবং কখনও কামিয়াব হতে পারবে না। তাবলীগে সবাই তালিবে ইলম। তাবলীগে সবসময় তালিবে ইলম হয়ে থাকব। দেখতে হবে, তালিবে ইলম হয়ে মরতে পারি কি না। তলব কতটুকু বাকি আছে তা দেখা। যতদিন তলব বাকি থাকবে এ কাজে জুড়ে থাকতে পারব।১
দ্বিতীয় ও শেষ কথা
গলদ জিনিসের দ্বারা কখনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রভাবিত হতেন না। বাঁকা জিনিসের দ্বারা প্রভাবিত হতেন না। যেমন, শিশি বা বোতলের ভেতর বাঁকা জিনিস ঢোকানো যায় না; হয় সোজা হতে হবে, নয়তো ঢুকবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আপন ভাইয়ের সাহায্য করো, সে যালিম হোক আর মাজলুম হোক। যালিমকে সাহায্য কীভাবে করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হলে তিনি নারাজ হননি। নারাজ না হয়ে বুঝিয়ে দিলেন। যালিমকে সাহায্য করার অর্থ হচ্ছে, তার হাত ধরে ফেলা এবং তাকে যুলুম থেকে বিরত রাখা। শয়তান সবার পিছেই লেগে আছে। গড্ডালিকা প্রবাহে না যাওয়া। নিজের দ্বীনদারীর দ্বারা ইতমিনান না হওয়া। দুআ-কান্নাকাটিতে ইতমিনান না আসা। দ্বীনের হাকীকত বোঝা। সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর জীবনী পড়া ও চিন্তাভাবনা করা। আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা.-কে আমীর বানিয়ে এক জামাত পাঠানো হয়। সবাইকে আমীর মেনে চলার হেদায়েত দেয়া হয়েছিল। আমীর আগুন জ্বালানোর হুকুম করেন। তারপর সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ আগুনে ঝাঁপ দেননি। পরে জামাত ফিরলে কারগুজারী শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি আগুনে ঝাঁপ দিতে আগুনেই থাকতে। নাফরমানীর ক্ষেত্রে আমীরের হুকুম মানতে হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর মধ্যে একটা অনুভূতি পয়দা করেন। আর তাই কোনো গলদ জিনিস ঢুকতে পারত না সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর দেমাগে। কোনো গলদ জিনিস এসে গেলেও তা সহীহ হয়ে ঢুকত। যেমন কোনো জিনিস বোতলে ঢোকাতে হলে সোজা হতে হবে নয়তো ভেঙে যাবে। তাই আমাদের মধ্যে কোনো গলদ জিনিস প্রবেশ না করে- তেমন অনুভবশক্তি পয়দা করতে হবে।
সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর দিল ও দেমাগ পরিষ্কার ছিল। প্রশ্ন করে বসলেন- যালেমকে কীভাবে সাহায্য করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারায হননি।
কোনো গলদ জিনিস সাহাবা রা.-এর মধ্যে ঢুকতেই পারত না। আমার আশা, আপনাদের দেশে এত তাবলীগ; আপনাদের মধ্যে যেন সত্যিকার প্রভাব পয়দা হয়। গলদ জিনিস যেন আপনাদের উপর প্রভাব না ফেলে। কোনো গলদ জিনিস আপনাদের মধ্যে না ঢোকে এবং আপনাদেরকে এ কাজ থেকে বিচ্যুত না করে। সত্যিকার অনুভবশক্তি যেন আপনাদের মধ্যে সর্বদাই জাগ্রত থাকে। আমার দিল বলছে, আপনাদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে দ্বীন বিস্তার লাভ করবে।
[শ্রুতলিখন ও প্রস্তুতকরণ : প্রফেসর শেখ আবুল কাশেম, মুকীম, কাকরাইল]
১. আর এই তলবই সাথীকে নিয়ে যাবে আলেমদের কাছে। হযরত মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর এই কথাও উদ্ধৃত করেছিলেন যে, আমি এই কাজ মূলত শুরু করেছি মানুষকে উলামামুখী করার জন্য। দেখুন, তাবলীগ জামাত : বর্তমান পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায়, পৃ. ১৭৫-১৭৬, প্রকাশক : মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা।