স্মৃতির মুকুরে শায়খে কাতিয়া
অধম লেখকের ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে’ ৪র্থ ও ৫ম কিস্তিতে বৃহত্তর সিলেটের প্রথিতযশা আলেম-উলামা প্রসঙ্গে শায়খে কাতিয়া হযরত মাওলানা আমীনুদ্দীন রাহ.-এর আলোচনা তেমনভাবে আসেনি। কারণ সাধারণভাবে জীবিত লোকদের মূল্যায়ন তাঁদের বর্তমানে করার রীতি নেই।
বক্ষমান নিবন্ধে তাঁর চরিত্রের উজ্জ্বল দিকগুলোকে তুলে ধরার যে চেষ্টা করা হয়েছে তাতে একটুও অতিরঞ্জন নেই। তিনি যা ছিলেন, যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনটিই তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি, বৃহত্তর সিলেট তথা সিলেট বিভাগ এবং ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী তাঁর শিষ্য-শাগরিদ, মুরীদান, গুণগ্রাহী এবং বাংলাদেশের আলেমসমাজসহ (কারণ তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একজন শীর্ষনেতা ছিলেন।) সকল পাঠকই এতে একজন মর্দে মুজাহিদ ও আদর্শ পুরুষের সাক্ষাত পাবেন।
৩০ রমযান, শুক্রবার ১৪৩১ হি. বিকেলে সিলেট বিভাগের প্রবীণতম এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী আলেমের ইন্তেকালের সংবাদে রমযানের শেষ ইফতার ও ঈদের আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেল। সেই প্রখ্যাত আলেম হচ্ছেন শায়খে কাতিয়া নামে সর্বজনপরিচিত নবতিপর আলেম হযরত মাওলানা আমীনুদ্দীন রাহ.। বিকেল তিনটায় সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এমনিতেই প্রবাদ আছে, মওতুল আলিমে মওতুল আলমে। অর্থাৎ কোনো একজন আলেমের মৃত্যু গোটা বিশ্বের মৃত্যুতুল্য। প্রবাদটি কার জন্যে কতটুকু প্রযোজ্য, কোন মাত্রায় প্রযোজ্য তার পরিমাপ আমি করতে পারব না। তবে হযরত শায়খে কাতিয়ার মৃত্যু আমার কাছে শাব্দিক অর্থেই এরূপ মনে হয়েছে। তাঁর সাথে আমার দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের পরিচয়। তিনি আমার উস্তাদ জাতীয় মসজিদের সাবেক খতীব ও ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস ও হেড মাওলানা হযরত মাওলানা ওবায়দুল হক রাহ. এবং আমার অন্যতম পীর ও মুর্শিদ চট্টগ্রাম হাটহাজারী এলাকার ফতেহাবাদ পরগনার ফতেহপুর নিবাসী হযরত শাহ আবদুস সাত্তার রাহ.-এর দেওবন্দ দারুল উলূমের সতীর্থ। এঁরা একই সাথে হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.সহ সেখানকার প্রখ্যাত আলিমগণের নিকট পাঠ গ্রহণ করেছেন ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে ৬০/৬৫ বছর পূর্বে। এঁরা প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে এক একজন দিকপাল ছিলেন। জাতীয় মসজিদের খতীব ও ঢাকা আলিয়ার মুহাদ্দিস ও হেড মাওলানা উস্তাদ মাওলানা ওবায়দুল হকের পরিচিতি বলার অপেক্ষা রাখে না। শাহ আবদুস সাত্তার রাহ. সম্ভবত বাংলাদেশী ও পাকিস্তানী শাগরিদদের মধ্যে মাদানী রাহ.-এর খেদমতে সর্বাধিক সময় সাহচর্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে সাড়ে বার বছর মাদানী রাহ.-এর খেদমতে অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু হযরত মাদানীর পাগল বলতে কেবল দু’জনকেই বোঝানো হত। প্রথমজন ছিলেন হযরত শায়খে বাঘা (সিলেট) মাওলানা বশিরুদ্দীন আহমদ রাহ. আর অপরজন ছিলেন এই শায়খে কাতিয়া রাহ.। সূরতে-সীরাতে, পোশাকে-আশাকে, কথাবার্তা ও চাল-চলনে এঁরা ছিলেন হযরত মাদানীর হুবহু প্রতিচ্ছবি। হযরত মাদানী রাহ. কেমন ছিলেন্তএ প্রশ্নের জবাব সহজেই দেওয়া যেত-শায়খে কাতিয়াকে দেখে নাও! দেওবন্দের ছাত্রজীবনে স্বাধীনতা-সংগ্রামী হযরত মাদানীর অনুকরণে সেই যে খদ্দরের পোশাক ধরেছিলেন, জীবনে আর তার পরিবর্তন হয়নি। আমার মতো পাঞ্জাবি-আলীগড়ি পায়জামা ও জিন্নাহ ক্যাপ পরনে অভ্যস্ত একসময়ের তুখোড় সরকারী মাদরাসা পড়ুয়া সংগ্রামী ছাত্র নেতাকেও তিনি তাঁর মতো করে খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে অনেকটা অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর সংসর্গের প্রভাব এতই যাদুকরী ছিল যে, সেই আমি যে কখন হঠাৎ খদ্দরের মোটা কাপড়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম তা মোটেই টের পাইনি।
হাদীসে আছে, ‘সাহাবীগণ হচ্ছেন নক্ষত্রতুল্য। তোমরা তাঁদের মধ্যকার যাকেই অনুসরণ করবে হেদায়েত পেয়ে যাবে।’ হযরত শায়খে কাতিয়ার চরিত্রে একাধারে নবীযুগের প্রখ্যাত দু’জন মনীষীর প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা যেত। তাঁদের একজন হচ্ছেন আমীরুল মুমিনীন ও খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ফারূক রা., যাঁকে শয়তানও ভয় পেত। আর অপরজন হচ্ছেন হযরত ওয়ায়েস করনী রাহ.। হযরত ওমর রা.-এর মতো নিরাপস সংগ্রামী চরিত্র এবং ওয়ায়েস করনীর বিনয়ী সূফীচরিত্রের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর জীবনে। হযরত মাদানীর এরূপ বহুমুখী গুণের প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে।
বিগত শতকের চল্লিশের দশকে তিনি যখন দেওবন্দ দারুল উলূমের ছাত্র তখন তার আর্থিক অবস্থা অনেকটা সচ্ছল ছিল। তাঁর এক চাচাত ভাই লন্ডন থেকে প্রতি মাসে তাঁর জন্য যে অর্থ পাঠাতেন তার পরিমাণ মোটামুটি ভালোই ছিল। একবার তিনি তাঁর ঐ চাচাত ভাইকে একটি বিশেষ প্রয়োজনে আরো একটু বেশি পরিমাণ টাকা পাঠাতে লিখলেন। তিনি যথারীতি টাকা পাঠিয়ে দিলেন। তরুণ আলেম আমীনুদ্দীন টাকা পেয়ে যে কাজটি করলেন তা উস্তাদ-শাগরিদ সকলকে হকচকিয়ে দিল। তিনি সাহারানপুর বাজার থেকে দামি কার্পেট কিনে এনে তা কেটে কয়েক খণ্ড করলেন। তাঁর হাতে দামি কার্পেটের এরূপ দুর্দশা দেখতে পেয়ে সকলেই হায় হায় করে উঠলেন। হায়, এ পাগল করছেটা কী? তারপর তিনি কার্পেটের সে খণ্ডগুলো হযরত মাদানী, শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ মাওলানা এজায আলী, মাওলানা ইবরাহীম বলিয়াভী রাহ. প্রমুখ উস্তাদগণের বসার আসনে স্থাপন করে বললেন, আমার উস্তাদগণ কুরআন্তহাদীসের অমূল্য শিক্ষা বিতরণ করবেন চটের বিছানায় বসে এটা হতে পারে না। এ দামি কার্পেটই তাঁদের জন্য শোভনীয়।’ তখনই কেবল সকলে তাঁর পাগলামির রহস্য অনুধাবন করতে সমর্থ হলেন। মাওলানা আমীনুদ্দীন এভাবে উস্তাদগণের খেদমতে ব্যস- থেকে যথাসময়ে কুরআন্তহাদীস, ফিকহ প্রভৃতি শাস্ত্রের পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি নিজে আমাকে বলেছেন, ‘হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ. দেওবন্দে যে কামরায় অবস্থান করে বিদ্যাভ্যাস করতেন, সৌভাগ্যক্রমে তিনি সেই কামরাতেই অবস্থান করতেন।’
মাওলানা মাদানী রাহ. তাঁর উস্তাদ শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান রাহ.-এর নির্দেশে প্রথমে কলকাতা সরকারি আলিয়া মাদরাসার যেসব ছাত্র স্বদেশী আন্দোলনকালে অসহযোগিতা করে মাদরাসা ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁদেরকে হাদীস পড়ানোর জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। তারপর সেখান থেকে তিনি সিলেট এসে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর সিলেটেই অবস্থান করেছিলেন। মানিকপীরের টিলা সংলগ্ন খিলাফত বিল্ডিং-এ তিনি শিক্ষার্থীদেরকে হাদীসের দরস দিতেন। সেখান থেকেই মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.সহ দেওবন্দ মাদরাসার মজলিসে শুরার বিশেষ অনুরোধে দেওবন্দ দারুল উলূমের সদরুল মুদাররিসীন হয়ে দেওবন্দে গিয়েছিলেন। কিন্তু সিলেটবাসী তাঁকে নিঃশর্তে চিরতরে ছাড়তে রাজি হয়নি। তাই প্রতি বছর রমযান মাসে তিনি সিলেটে এসে নয়া সড়ক মসজিদে অবস্থান করে তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণ করতেন। দেশবিভাগকালে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিরোধজনিত তিক্ততার কারণে ৪৭ সালের পর তিনি আর সিলেট আসেননি। আসতেন আসামের শিলচর জেলাধীন বাঁশকান্দিতে। ১৯৫৮ সালে তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত এ নিয়ম চালু ছিল। মাওলানা আমীনুদ্দীন যেহেতু তাঁরই হাতে বাইআত ছিলেন তাই তিনিও বাঁশকান্দিতে ছুটে গিয়ে উস্তাদ ও শায়খের সংসর্গ লাভে ধন্য হতেন। বাঁশকান্দির সেই দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সালেকীনদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তিনি স্বেচ্ছাসেবকরূপে সকলের খানাপিনার ইন্তেযাম করতেন। মাওলানা নূরুদ্দীন গহরপুরী এবং মাওলানা আবদুল হক গাজীনগরী প্রমুখও যথারীতি উক্ত মজলিসে উপস্থিত থাকতেন এবং মাওলানা গাজীনগরী হযরত মাদানীর নিকট সেখানে খিলাফতও লাভ করেন। কিন্তু আমাদের শায়খে কাতিয়া খিলাফত লাভ করেন মুজাযে মাদানী ডাক্তার আলী আসগর নূরী রাহ.-এর নিকট থেকে।
পঞ্চাশের দশকে তিনি তাঁর জন্মস্থান তদানীন্তন সিলেট জেলাধীন জগন্নাথপুর থানার অন্তর্গত কাতিয়া গ্রামে একটি কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা প্রকৃতপক্ষে পার্শ্ববর্তী অটলতলী গ্রামে অবস্থিত হলেও এবং তার অফিসিয়াল নাম ‘কাতিয়া অটলতলী মাদরাসা’ হলেও শায়খে কাতিয়ার সুখ্যাতির দরুণ সাধারণ্যে ‘কাতিয়া মাদরাসা’ নামেই খ্যাতি লাভ করে। বর্তমানে তা সুনামগঞ্জ জেলা তথা সিলেট বিভাগের একটি বিখ্যাত ও প্রধান মাদরাসা। যোগ্যতর মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক একটি দারুল হাদীস এবং হিফজখানাসহ এটি একটি পূর্ণাঙ্গ দাওরা মাদরাসা। এর বর্তমান ছাত্র সংখ্যা ৮ হাজারেরও অধিক। গ্রাম বাংলায় (বিশেষত ভাটিএলাকায়) যা অকল্পনীয়। মাওলানা আবদুল হক শায়খে গাজীনগরী প্রতিষ্ঠিত গাজীনগর কওমী মাদরাসা ছাড়া বৃহত্তর ভাটি অঞ্চলে এত বড় মাদরাসা আর একটিও নেই। বর্তমানে মাদরাসাটি তাঁর সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র হাকিম মাওলানা এমদাদুল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে, যিনি নিজেও হযরত মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ.-এর নিকট থেকে খিলাফতপ্রাপ্ত।
মাওলানা মাদানী রাহ. ও খিলাফত আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত নয়া সড়কের মানিকপীরের টিলা সংলগ্ন ঐতিহাসিক খিলাফতঅফিস আলেম-উলামার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। মাদানী-পাগল শায়খে কাতিয়া অনেক সংগ্রামের পর তা পুনরুদ্ধার করে সেখানেও মাওলানা মাদানীর আদলে দরসে হাদীস মাদরাসা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে তাঁরই দৌহিত্র উক্ত মাদরাসার মুহতামিম এবং মাওলানা মনসুর রায়পুরী তাতে হাদীসের দরস দিয়ে থাকেন।
জগন্নাথপুর থানাধীন সৈয়দপুর সন্নিহিত একসময়ের হিন্দুপ্রধান গ্রাম বুধরাইলে ১৯৬৬ সালে তিনি একটি মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। ঐসময় আমি নিজে তাঁর সঙ্গে ছিলাম এবং ঐ মাদরাসার নামকরণ আমিই করেছিলাম ‘আমীনিয়্যাহ মাদরাসা’ নামে। মাত্র বছর দেড়েক আগে সিলেটের গাজী বুরহানুদ্দীন মার্কেটের মাদানী হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমার দেখা হলে আমার দিকে চোখ পড়তেই তিনি মজলিসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘মাওলানা আবদুল্লাহ সাহেব! আপনি এখন কী করে এলেন? যাবার সময় আমার নিকট থেকে এক হাজার টাকা হাদিয়া নিয়ে যাবেন। আপনি বুধরাইলে সেই যে মাদারাসার নামকরণ করেছিলেন আমীনিয়া মাদরাসা তা এখন একটা পুরোদস্তুর মাদরাসা।’ কথাগুলো তিনি এক নিঃশ্বাসেই বলে ফেললেন এবং আমার প্রতি তাঁর স্বভাবসুলভ চরম সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
মাদানী সিলসিলার একজন ইজাযতপ্রাপ্ত পীরে কামেল এবং একাধিক দ্বীনী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতারূপেই তাঁর গুরুত্ব ছিল না, তাঁর গুরুত্ব ও মাহাত্ম ছিল এই যে, শিরক-বিদআত ও বাতিলপন্তুীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন। বাতিলপন্তুীরা তাঁকে যমের মতো ভয় করত। এলাকার গণ্যমান্য দুইজন ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানসহ হাজার হাজার লোককে এই একটি মাত্র লোকের উপস্থিতি টের পেয়ে গভীর নিশিথে পালিয়ে যেতে আমি নিজে একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছি। এমনিতে তিনি হযরত শায়খে বর্ণভী প্রতিষ্ঠিত অরাজনৈতিক তাবলীগী সংস্থা আনজুমানে হিফাযতে ইসলাম এবং বাংলাদেশ জমিয়তে উলমায়ে ইসলামের একজন কেন্দ্রীয় নেতা হলেও তাঁর আসল কর্মস্থল ছিল সুনামগঞ্জ জেলায়। জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে ঐ জেলার প্রতিটি মানুষের নিকট তিনি সুপরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জেলার প্রতিটি শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে তাঁর প্রভাব অনুভূত হত।
তিনি যে একজন অনন্যসাধারণ আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গ এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। কী হেমন্তে, কী বর্ষায়-যখন গোটা ভাটি অঞ্চলের জনপদগুলো পরস্পরবিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অকূল সাগরের মধ্যে ভাসতে থাকে তখন তিনি আমীরে হেফাযতে ইসলাম হযরত শায়খে বর্ণভীকে নিয়ে বিভিন্ন জনপদে সপ্তাহব্যাপী, পক্ষকালব্যাপী ওয়ায মাহফিলের ইন্তেযাম করতেন। একজন সংগঠক হিসেবে তিনি যে কত কামিয়াব ও পারঙ্গম ছিলেন তা নিজ চোখে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ১৯৬৬ সালে আমার টাইটেল পাশ করার পর শায়খে কাতিয়ার দাওয়াতে এরূপ একটি কর্মসূচিতে আমি প্রায় পক্ষকাল উক্ত বুযুর্গদের সাথে সফর করে বেড়িয়েছি এবং প্রতিটি মাহফিলে তাঁদের সাথে বক্তব্যও রেখেছি। এর আগেই শায়খের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আমি আমীরে হেফাযতে ইসলাম শায়খ বর্ণভীর নিকট উপস্থিত হই এবং তাঁদের অনুরোধে তদানীন্তন নিখিল পাকিস্তান হেফাযতে ইসলামের প্রচারসম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। দরগায়ে শাহজালাল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হেফাযতে ইসলামের এক বার্ষিক সম্মেলনে প্রচারসম্পাদকরূপে আমার অভিষেক হয়েছিল আমার ভাষণপ্রদানসহ। তারপর থেকে আমীরে হেফাযতে ইসলামের ডাকে সাড়া দেওয়া এবং ভাটি অঞ্চল সফর করা অনেকটা আমার সাংগঠনিক দায়িত্বও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভাটিঅঞ্চলে শায়খে কাতিয়ার মাধ্যমে শায়খে বর্ণভীও ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। উক্ত শায়খদ্বয়ের ইখলাস ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধও আমাকে বিমোহিত করেছে। ঐ বারের সে সফরের সংবাদ তদানীন্তন বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদে খুব ফলাও করে প্রকাশিতও হয়েছিল।
শায়খে বর্ণভীও বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অন্যান্য জেলায় তাঁর প্রোগ্রামসমূহে শায়খে কাতিয়াকে তাঁর সফরসঙ্গী ও ব্যবস্থাপকরূপে রাখতেন। ফলে সিলেট বিভাগের কোণায় কোণায় হেফাযতে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল।
শায়খে কাতিয়ার জনসংশ্লিষ্টতা ছিল তাঁর চরিত্রের এক অনন্য দিক। চারণকবির মতো গ্রামেগঞ্জে নিজের নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং তাদেরকে ওয়ায-নসীহত করতেন। ভাটিএলাকায় বর্ষাকালে এছাড়া আর কোনো বাহন কার্যকরীও নয় আজকের এ একবিংশ শতকেও। অবশ্য এখন ভাটিএলাকায়ও কিছু কিছু রাস্তাঘাট হয়েছে। পুল-কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। যেমন একসময়ে জগন্নাথপুর থেকে সোজাসুজি মাত্র কুড়ি-বাইশ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত সুনামগঞ্জ সদরে যাওয়ার মতো কোনো রাস্তা না থাকায় প্রায় পঞ্চাশ মাইল অতিক্রম করে সিলেট সদর হয়ে সেখানে যেতে হত। এখন সোজাসুজি রাস্তা হওয়ায় দূরত্ব কমে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোনো গান্তবাজনা, জুয়া বা ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী কিছু হতে যাচ্ছে সংবাদ পেলে তিনি তৎক্ষণাৎ অকুস্থলে গিয়ে পৌঁছাতেন এবং ঐ উদ্যোগকে পণ্ড না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হতেন না। কৃষ্টি প্রদর্শনী ও মেলার নামে অশ্লীল নাচগান ও জুয়ার যে আয়োজন সরকারিভাবে পাকিস্তানী আমলে হত তা তিনি একাধিকবার পণ্ড করে দিয়েছেন তাঁর প্রভাব ও ব্যক্তিত্বের বলে।
১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে একবার আমি নিজে তাঁর সাথে ছিলাম। যতদূর মনে পড়ে ঐ দিন আমি সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর মহল্লায় তাঁর কোনো এক ভক্তের বাড়িতে ছিলাম। সকালে শহরে পায়চারি করতে বেরোতেই একটি বাসা থেকে রেডিওতে গানের আওয়াজ পাওয়া গেল। বাড়িটি ছিল একজন ম্যাজিস্ট্রেটের। প্রথমে তিনি দরজায় টোকা দিয়ে গৃহস্বামীকে ফজর-পরবর্তী কুরআন তিলাওয়াতের এ সময়টাতে গানবাজনা বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানান। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সম্ভবত শায়খে কাতিয়ার প্রভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি গান বন্ধ করলেন ঠিক, কিন্তু সুনামগঞ্জ (তখন মহকুমা) আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে এটি মামলা ঠুকে দিলেন। একটু পরেই মহকুমা কৃষি প্রদর্শনীর জন্য প্রস্থত মাঠে গিয়ে সরাসরি মহকুমা-হাকিমকে-যিনি প্রদর্শনী কমিটির সভাপতি ছিলেন্তসুনামগঞ্জে নাচগান ও জুয়ার আসর বসাতে নিষেধ করে দেন। সম্ভবত ঐ ম্যাজিস্ট্রেট ও মহকুমা হাকিমের যোগসাজসে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি হয়েছিল। ঐ দিন দুপুরেই শায়খকে গ্রেফতার করা হল। তাঁর সঙ্গী হিসেবে আমি একান্তই অসহায় বোধ করছিলাম এবং অনেকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সাথে সাথে গোটা শহরে খবরটা রটে গেল। কোর্টপ্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। জনাব হোসেন বখতের মতো শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এসে কোর্টে ভিড় করলেন। সম্ভবত ঐ নেতৃবর্গ প্রশাসনকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে, শায়খে কাতিয়াকে গ্রেফতারের ঘটনা সরকারের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। ব্যাপক গণঅসন্তোষ দেখা দিবে। তাঁর চাইতে তাঁকে মুক্তি দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে শায়খকে কর্তৃপক্ষ মুক্তি দিতে বাধ্য হল। এ আমার চোখে দেখা ঘটনা। লোকজন বিজয় মিছিল করে মালা দিয়ে তাঁদের প্রাণপ্রিয় শায়খকে নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করল।
পূর্বে কথিত ঐ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন নোয়াখালি নিবাসী জনাব ফজলুল করীম-যিনি গণভবন মসজিদে আমার একজন ঘনিষ্ঠ মুক্তাদি হয়েছিলেন আশির দশকে। তখন তিনি একজন উপসচিব। প্রতিদিন আমার হুজরায় বা তাঁর সরকারি বাসায় আমাদের দীর্ঘ আলাপচারিতা চলত। ইমাম হিসেবে তিনি আমাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন এবং আমার লেখালেখির অভ্যাস তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। আমার গণভবন মসজিদে ইমামতিকালেই (১৯৭৬-১৯৯২) তিনি ইনে-কাল করেন।
একদিন শায়খ তাঁর নৌকায় করে জগন্নাথপুর থানাধীন রানীর বাজারের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। সেদিন আমি তাঁর সঙ্গেই নৌকায় ছিলাম। ঐ দিন ছিল হাটের দিন। শত শত নৌকা হাট উপলক্ষে রানীর বাজারের দিকে আসছিল। হঠাৎ একটি নৌকা শায়খের নৌকার একেবারে কাছে এসে পড়ল এবং এক ব্যক্তি শায়খকে কানে কানে কী যেন বললেন। শায়খকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আজ রাতে আমাদের একটা অভিযানে যেতে হবে। বিষয়টি হচ্ছে, ভাটিঅঞ্চলের আট-দশটি গ্রামের যুবকরা রাতে হলদিপুর গ্রামে একটি নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দুই ইউনিয়নের দুইজন চেয়ারম্যান প্রধান অতিথিরূপে রয়েছেন। হাজার হাজার আমোদপ্রিয় দর্শকের সমাগম হবে সেখানে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রূপবান যাত্রাদল এসেছে। খুব জমজমাট আয়োজন। শায়খ শুধু পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য লোকটিকে নির্দিষ্ট একটি স্থানে থাকতে বলে দিয়েছিলেন।
রাত একটার দিকে রূপবানযাত্রা যখন খুব জমে উঠেছে এবং উপস্থিত জনতা বিভোর হয়ে তা উপভোগ করছে এমনি সময় শায়খের নৌকা নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হল। আমি যথারীতি তাঁর সাথেই রয়েছি। ঐ লোকটি তাঁর সাথে নৌকায় উঠল এবং যেখানে নাট্যানুষ্ঠান হচ্ছিল সেখানে আমাদেরকে নিয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে হঠাৎ শায়খের গুরু গম্ভীর ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে যেন গোটা নাট্যানুষ্ঠানে বজ্রপাত হল। ‘কাতিয়ার ছাব আইচ্ছইন্তু বলে লোকজন অন্ধকারে কে কোথায় পালিয়ে গেল কোনো দিশাই পাওয়া গেল না। মঞ্চের উপরে দুই খানা চেয়ার পাতা রয়েছে। কেবল ‘রূপবান্তু সেজেছিল যে ছেলেটি সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুহূর্তের মধ্যে এমন কী ঘটে গেল, সে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারল না। আমি নিজেও তাঁর এরূপ অশ্রুতপূর্ব প্রভাব দৃষ্টে কম বিস্মিত হই না।
শায়খ আমাকে একটি চেয়ারে বসতে বলে নিজে অপরটিতে বসে পড়লেন। আমাকে কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য বললেন। তাঁর নির্দেশমতো আমি তিলাওয়াত করলাম। ভাটিঅঞ্চল বলে কথা। লোকজন এ গভীর নিশিথে দ্বীপের মতো ভাসমান অকুস্থল থেকে পালাবে কোথায়? শায়খ জানতেন, ওরা আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে শায়খ কী করেন তা দেখছে অবশ্যই। তিনি অত্যন্ত বিনীত ও মধুর কণ্ঠে ওদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘ভাইসব!’ কাতিয়ার শায়খ এমন কোনো বিশাল কেউ না যে তাকে তোমাদের ভয় করতে হবে। আমি তোমাদের চাইতে অনেক বেশি গুনাহগার। আমার গুনাহর কারণেই তো তোমরা এ গুনাহর মজলিসের আয়োজন করেছ। আমি যদি তোমাদের হক আদায় করে ঠিকমতো বোঝানোর দায়িত্ব পালন করতাম তাহলে তো তোমরা এমনটি করতে না। তাই তোমাদের এ পাপানুষ্ঠানের দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। তোমাদের এ খাদেমের দায়িত্ব পালনে গাফলতির দরুণই তোমরা এ পথে পা বাড়িয়েছ। এসো, এসো, সকলে মিলে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে তওবা করি। আল্লাহ তোমাদেরকেও মাফ করবেন আমাকেও মাফ করবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
শায়খের আন্তরিকতাপূর্ণ এ আহ্বানের যাদুকরী ফল ফলল। একে একে লোকজন এসে আবার মজলিসে বসতে শুরু করল। মজলিস আবার কানায় কানায় ভরে উঠল। শায়খ নিজেও তওবা করলেন। মজলিসশুদ্ধ লোকজন অনুতাপের অশ্রু বিসর্জন করে তওবা করল।
কাহিনীর কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার এর পরে আসছে। একটি যুবক-প্রতিনিধিদল শায়খকে সালাম দিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা তাঁকে জানাল। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হল, হুজুর, আমরা এলাকার যুবসমাজ পরস্পরে সমপ্রীতি ও সৌহার্দের সাথে বসবাস করতে চাই। আমরা পরস্পরের বন্ধু এবং নিকটাত্মীয়ও বটে। কিন্তু আমাদের মুরব্বীরা তাদের পার্থিব স্বার্থে শতধাবিভক্ত। তাঁরা আমাদেরকে তাঁদের এসব বিরোধে জড়িয়ে পরস্পরে খুনাখুনি পর্যন্ত ঘটিয়ে ছাড়েন। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীকরূপে আমরা এ নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সুনামগঞ্জ সদর আদালতে উভয় পক্ষের মামলা-পাল্টা মামলার সংখ্যা হচ্ছে ২২। অথচ এগুলোর কোনোই সারবত্তা নেই। কেবল একদল অপর দলকে হয়রানি করে দুর্বল করার জন্যই এসব মামলা দায়ের করেছে। ঐ মামলা ও বিরোধসমূহের সমাধান আপনাকেই করে দিতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা অভিশাপমুক্ত হতে পারি।
যুবকদের এ আবেদন শায়খের হৃদয় স্পর্শ করল। তিনি উপস্থিত মুরব্বী বয়সীদেরকে এর সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরাও তা স্বীকার করলেন। অগত্যা শায়খকে যাত্রাবিরতি করতে হল। তিনি তাদের বিরোধসমূহের শুনানি গ্রহণে রাজি হলেন এবং পরদিন বাদ মাগরিব হলদিপুর মসজিদে উভয় পক্ষের বৈঠকের স্থান নির্ধারিত হল। আমাদের নৌকা হলদিপুর মসজিদের ঘাটেই বাঁধা রইল।
সকাল দশ-এগারটার দিকে শায়খ আমাকে গোসল সেরে নিতে বললেন। এ সময় ঘাটে পাড়ার আরেকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর সন্তানদের নিয়ে গোসল করতে এসেছেন। ভদ্রলোক আমাকে দেখে বুঝতে পারছিলেন যে, আমি এ ভাটিএলাকায় একজন নতুন আগন্তুক। পরিচয় জানতে চাইলে বললাম, জন্মগতভাবে সিলেটী হলেও আমি এখন এসেছি ঢাকা থেকে। শায়খে কাতিয়ার সাথে তাদের গ্রামে এসেছি। বললেন, ‘ওহ, শায়খ ছাহেব এসেছেন বুঝি। তাহলে তো তিনি যতক্ষণ আছেন আর জামাতে আসা যাবে না।’ আমি বললাম, ‘কারণ?’ জবাবে ভদ্রলোক বললেন, ‘এত বড় আলেম ও শায়খের উপস্থিতিতে আমাদের ইমাম তো আর ইমামতি করবেন না। শায়খ সাহেবের পেছনেই নামায আদায় করতে হবে।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাতে আপত্তি কি? এত বড় একজন বুযুর্গের সাথে নামায আদায় করা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার! আপনি পিছিয়ে থাকবেন কেন?’ ভদ্রলোক যে জবাব দিলেন তাতে আমি হকচকিয়ে গেলাম। ‘আমাদের পীর সাহেব বলেছেন, ‘দাল্লীন না বলে সূরা ফাতিহায় যাল্লীন বললে নামায হয় না।’ আমি বললাম, ‘ওসব জটিল ব্যাপার তো আলেম-উলামাগণ বুঝবেন। আমাদের তাতে কী?’ উনি বললেন, ‘না, তা হয় না। আমাদের পীর সাহেব শক্তভাবে মানা করেছেন।’ ঐ সৌম্যদর্শন পীর সাহেব সদাসর্বদাই দেওবন্দী আলেমগণের পেছনে নামায পড়েছেন। অথচ তিনিই এ ভাটিএলাকায় এরূপ বিষ ছড়িয়ে রেখেছেন কল্পনা করতেও কেমন যেন ঘৃণা হয়। আমি মন্তব্য করতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় নৌকার ভিতর থেকে শায়খ আমাকে ইশারায় বললেন, ‘এরা বেদাতী পীরের ভক্ত। আমরা অনেক বড় কাজে এসেছি। ওর সাথে আমি যেন বিরোধে জড়িয়ে না যাই। তাতে বৃহত্তর স্বার্থ নষ্ট হবে।’ তাই আমি আমতা আমতা করে চুপসে গেলাম। ঐ ব্যক্তি গোসল করে চলে গেলেন।
বাদ মাগরিব বসল সেই প্রতীক্ষিত বিরোধ-মীমাংসা মজলিস। উভয় পক্ষের কথা শুনে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, যুবকদের নালিশটি সঠিকই ছিল। উভয় পক্ষ মামলা-পাল্টামামলায় সাংঘাতিকভাকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেগেছে। হযরত শায়খে কাতিয়া একে একে সব কটি বিরোধের এমনি সমাধান দিলেন যে, উভয়পক্ষই স্বেচ্ছায় তাতে সম্মতি দিল। একে একে বাইশটি মামলার সহজ সমাধান হয়ে গেল। উভয় পক্ষ পরদিনই সুনামগঞ্জে গিয়ে মামলাগুলো প্রত্যাহারের লিখিত অঙ্গীকারনামা দিল।
আমার সম্মুখে হযরত শায়খে কাতিয়া এমন এক মহান সমাজসংস্কারকের মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন্তযা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। এমন সংস্কারক কি গোটা দেশে আর কেউ আছেন? অথচ তিনি যে এলাকায় এ মহান দায়িত্ব পালন করলেন তারা তাঁর শাগরিদ বা মুরীদ নয়। তারা যথারীতি ঘৃণ্য ও হীন মনমানসিকতার অধিকারী এক বেদাতী পীরের মুরিদ। কিন্তু হযরত শায়খের এখলাসপূর্ণ উদ্যোগকে তারা সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছে। সাথে সাথে যুবকরাও শায়খে কাতিয়া জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে গভীর রাতে এলাকাকে কাঁপিয়ে তুলল।
শায়খ মজলিস শেষে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে এলাকা থেকে বিদায় নিতে উদ্যত হলেন। তাঁর প্রতি মন্ত্রমুগ্ধ যুবকরা তখন তাঁকে শেষ অনুরোধটি জানাল এভাবে-‘হযরত! আমরা তো পর পর সাত দিন নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সাত দিনে সাতটি গরু জবাই করে দর্শকদের আপ্যায়িত করার ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি। আমাদের সে গরুগুলো রয়ে গেছে। এ অনুষ্ঠান তো আর হবার নয়। আমরা চাই, আপনি নিজ পবিত্র হাতে গরুগুলো জবাই করে দেবেন। আমরা তা গ্রামে গ্রামে বিলিবণ্টন করে দেব। অগত্যা শায়খকে সে রাতও ঐ গ্রামেই থাকতে রাজি হতে হল।
সকালে সত্যি সত্যি সাতটি হৃষ্টপুষ্ট গরু নিয়ে ওরা হাযির হল। ওরা শায়খকে তাদের গোশত প্রস্থত হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করে তাদের হাদিয়া নিয়ে যেতে অনুরোধ করল। কিন্তু তাদের সে অনুরোধ রক্ষার অবকাশ হযরতের ছিল না। অগত্যা তারা ঐ হৃষ্টপুষ্ট গরুগুলোর সাত সাতটি মাথা নৌকার অগ্রভাগে তুলে দিল। নৌকা তো এমনিতে বড় ছিল না। এক মাল্লার নৌকা। নৌকার গলুই এমনভাবে বোঝাই হল যেন আরেকটু হলেই তা ডুবে যাবে। তা নিয়েই আমরা প্রস্থান করলাম। আর পাড়ে অসংখ্য লোক তাঁদের এ মুক্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।
আরেকবারের কথা। আমি তখন আমার সিলেটের টুকের বাজারের পৈত্রিক বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ সেখানে এসে শায়খে কাতিয়া হাযির। আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান তখনও জীবিত। ইতিপূর্বে আরো ২/৩ বার হযরত শায়খ আমাদের বাড়িতে এসেছেন এবং আমার বাপচাচাগণকে বলে গেছেন, তাঁরা যেন আমার বিবাহ নিয়ে চিন্তা না করেন। তিনি নিজে তার ব্যবস্থা করবেন। সুতরাং আমার আব্বার কাছে তা ছিল অনেকটা তাঁর হবু বেয়াই-এর আগমন। তাই আমাদের বাড়িতে তাঁর এরূপ আগমন মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি চা-নাশতা খেয়েই শায়খ বললেন, ‘আপনাকে নিয়ে তো আমি কয়েকটি হারাম মজলিস পণ্ড করেছি। এবার কিন্তু আমার নিজ এলাকায় এ আপদ দেখা দিয়েছে। তাই সুনামগঞ্জ সদর থেকে এ সংবাদ পেয়ে বাড়ি যাচ্ছি।’
তাঁর বাড়ি যেতে সিলেট থেকে ঢাকার পথে শেরপুর হয়ে লঞ্চে চড়ে ফেচির বাজার দিয়ে যেতে হয়। ঐ ফেচির বাজারেই স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তি এক নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমার আব্বার অনুমতি নিয়ে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যথাসময়ে আমরা কাতিয়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা জানতেন শায়খ দীর্ঘ সফরে সুনামগঞ্জ গিয়েছেন। ঐ ফাঁকে তারা ঐ নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন সেরে নিতে চেয়েছিলেন। তাঁর লোকজন সুনামগঞ্জে সে সংবাদটি তাঁর কানে পৌঁছিয়ে দিলে অস্থির হয়ে তিনি তাঁর সেখানকার প্রোগ্রাম স্থগিত করে দিয়ে ছুটে এসেছেন। আমাকে সাথে পেয়ে তাঁর উদ্যম আরো বেড়ে গেছে। সম্ভবত আমাকে পথের নির্দেশনা দানই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। অথবা এটাও যে একটা সামাজিক বড় খেদমত- যার দ্বারা গরীব ধর্মপ্রাণ অভিভাবকদের সন্তানরা নাচগান, জুয়া ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে রক্ষা পেতে পারে তা দেখিয়ে দেওয়াও তাঁর উদ্দিষ্ট হতে পারে।
যাই হোক, বাড়িতে পৌঁছেই তিনি তাঁর মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের দিয়ে গোটা এলাকার মসজিদ ও মাদরাসাসমূহে সংবাদ পাঠিয়ে দিলেন যেন সকলে আসরের নামায দলে দলে এসে ফেচির বাজারে জামাতে আদায় করেন। তাঁর উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে আয়োজকরা রীতিমতো প্রমাদ গুনল। চতুর্দিক থেকে দাড়ি টুপিপরা লোকজন দলে দলে ফেচির বাজারের চরে সমবেত হতে লাগল। তিনি তাঁর মাদরাসার কয়েক শত ছাত্র শিক্ষক নিয়ে যথাসময়ে সেখানে পৌঁছলেন। অন্যান্য নাট্যানুষ্ঠান পণ্ডের ব্যাপারে যেমনটি করেছেন তেমনি এ মজলিসেও তিনি আমাকে দিয়েই তিলাওয়াত করালেন এবং উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে আদেশ করলেন। মজলিসে কুশিয়ারা নদীর ওপারের দীঘল বাক থেকেও লোকজন এসেছে। আয়োজনটি কয়েক একর জায়গাজুড়ে নতুন ঢেউটিনের ঘেরাও দিয়ে বড় ভাবেই করা হয়েছিল। এলাকার যে প্রভাবশালী লোকজন এর আয়োজন করেছিল তারা কিন্তু তাঁর প্রভাববলয়ের লোকজন নয়, ঐ বেদাতী পীরের অনুসারী-যার কথা আগেই ইঙ্গিতে বলে এসেছি। সুতরাং শায়খে কাতিয়ার বাধা তারা গ্রাহ্য করতে যাবে কেন? এটা অনেকটা তাঁর জেলাব্যাপী প্রভাবকে অগ্রাহ্য করে কিছু একটা করে দেখানোর প্রচেষ্টায় শামিল ছিল। কিন্তু শায়খের মজলিসে চারদিক থেকে হাজার হাজার লোকের আগমন লক্ষ করে তারা খুবই চিনি-ত হয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নাট্যদল তাদের বহুমূল্য বাদ্যযন্ত্রাদিসহ তখনও এসে পৌঁছেনি। আয়োজকরা অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ববর্তী লঞ্চস্টেশনে (যা ফেচির বাজার থেকে দুই তিন মাইল পশ্চিমে অবস্থিত) লোক পাঠিয়ে নাট্যকর্মীদেরকে ঐখানেই নেমে পড়তে বলে দিয়ে লোক পাঠাল। সে মতে ঐ দলটি ফেচির বাজার পর্যন্ত না পৌঁছে পূর্ববর্তী স্টেশনেই নেমে পড়ল। কারণ ফেচি স্টেশনে নামা তাদের জন্য মোটেও নিরাপদ ছিল না।
আসর ও মাগরিবের নামায ফেচির বাজারস্থ কুশিয়ারা নদীর চরে আদায় করে মজলিস পুনরায় শুরু হল। সম্ভবত গোপন পথে নিরাপদে নাট্যকর্মীদেরকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কেননা, বাদ মাগরিবই তাদের অনুষ্ঠান শুরুর অঙ্গীকারে তারা শত শত টিকেট ইতিমধ্যে বিক্রি করে ফেলেছিল। এমন সময় আকস্মিকভাবে শায়খ গোটা মজলিসকে নাট্যমঞ্চের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে উঠবার নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে মজলিসশুদ্ধ লোকজন বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো দেখতে দেখতে তাদের ঘেরাও দেওয়া পূর্ণ প্যাণ্ডল দখল করে বসল। তখন আয়োজকদের প্রধান গুণ্ডাষণ্ডা ধরনের প্রভাবশালী লোকটি চিৎকার করে বলছিল, বন্দুক আনো, বন্দুক আনো। এক্ষুণি আমি গুলি করব। সে বন্দুক তাকও করল। কিন্তু না শায়খ, না উপস্থিত জনতা তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করল। শায়খ তাঁর দলবল নিয়ে (সাথে আমি) ঐ মজলিসে উচ্চস্বরে যিকির শুরু করে দিলেন। এইভাবে আমার চোখের সামনেই নাট্যানুষ্ঠান একটি যিকির মজলিসের রূপ ধারণ করল। আয়োজক আর তাদের শ্রোতা-দর্শকরা একদম চুপসে গেল। এমনি ছিল জনতার উপর শায়খে কাতিয়ার যাদুকরী প্রভাব।
পরের দিন আমি কুশিয়ারা নদীর ওপারে আমার বাল্যবন্ধু ও সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার সহপাঠী মাওলানা রেদওয়ানুদ্দীনের সাথে তাঁর বাড়িতে সাক্ষাত করতে গিয়ে বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম, নদীর ওপার থেকেও লোকজন আগের দিন ফেচির বাজারের মজলিসে শরিক হয়েছিল। যোহরের নামাযের সময় বন্ধুটি আমাকেই ইমামতির জন্য এগিয়ে দিলে দীঘলবাক গ্রামের জনৈক মাতব্বর গোছের লোক হালকা আপত্তি জানাল। বন্ধুটি আমার পরিচয় দিয়ে ভর্ৎসনা করলে সে ব্যক্তি চুপ হয়ে যায়। নামাযের পর ঐ ব্যক্তি আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না যেন। আমাদের পীর সাহেব তো বলেছেন সূরা ফাতেহায় ‘দাল্লীন্তু উচ্চারণে না পড়ে ‘যাল্লীন্তু উচ্চারণ করলে নামাযই শুদ্ধ হয় না।’ আমি বললাম, ‘আমি কী পড়ি না পড়ি তা আপনি কোত্থেকে জানলেন?’ সে ব্যক্তি জবাব দিল, ‘গতকাল ফেচির বাজারে কাতিয়ার শায়খ সাহেবের মজলিসে আপনাকে আমি বক্তৃতা করতে দেখেই বুঝে নিয়েছি, আপনি আমাদের দাল্লীন গ্রুপের লোক নন।’ আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, ‘তাদের ঐ বেদাতী পীর তাহলে জেলার সর্বত্রই এই দাল্লীন্তযাল্লীনের ভিত্তিতে ধর্মপ্রাণ লোকগুলোকে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপক্ষে বিভক্ত করে রেখেছেন। অথচ শায়খে কাতিয়ার মতো শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে অনৈসলামী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে, তাঁর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অথচ তিনিও একজন ধর্মীয় নেতা। তাঁরই ভক্ত-মুরীদদের এলাকার সংস্কার-সংশোধনের কাজ করেন শায়খে কাতিয়া আর ভক্তদের খাসী-মুরগীটা খান ঐ বেদআতী পীর! হায়রে পীর-মুরীদি!’ তাঁর এরূপ কদর্য আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক ধর্মসেবার পরিচয় আমি অন্যত্রও পেয়েছি। অথচ শায়খে কাতিয়া এতই উদার মনের লোক ছিলেন যে, উক্ত দেওবন্দবিদ্বেষী আলেমের জানাযায়ও তিনি সুদূর কাতিয়া থেকে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। শায়খের সাথে ভাটিএলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফরের সুযোগ না পেলে আমি ঢাকায় বসে কোনো দিনই ধর্মপ্রাণ লোকদের মধ্যে এরূপ অনাকাঙ্খিত বিভেদ সৃষ্টির তথ্য সম্পর্কে জানতে পারতাম না।
আমি যখন হযরত শায়খের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক ও কুসংস্কার-অনাচার বিরোধী অভিযানসমূহ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছিলাম তখন একদিন তিনি তাঁর যৌবনকালের আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা আমাকে শোনালেন। তখন সবেমাত্র ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হযরত শায়খে কাতিয়া বা তাঁর উস্তাদ ও শায়খ হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. কোনোদিনই বিশ্বাস করতেন না যে, ইসলামী চরিত্র বিহীন মুসলিম লীগ নেতাদের দ্বারা পাকিস্তানে ইসলামী শাসন্তসংবিধান জারি হবে। জনসভাসমূহে শতমুখে তাঁরা এসব কথা বলতেনও। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁরা আর তাঁদের পূর্ববিরোধিতা চালিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করেননি। খোদ মাওলানা মাদানী ১৯৪৭ সালে দেওবন্দের পাকিস্তানী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বক্তৃতায় বলেও ছিলেন যে, ঐ নব্য প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামী’ রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে বৈরিতা পোষণ আর উচিত হবে না। তোমরা দেশে ফিরে ওটাকে সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সাধনায় লিপ্ত হও। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দীর্ঘতম কালের প্রেসিডেন্ট মাওলানা আবুল কালাম আজাদও আমাদের সাংবাদিক, কলামিস্ট, রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদকে দিল্লীতে বসে একান্তে এরূপ কথাই বলেছিলেন। তাই শায়খে কাতিয়া এবং জমিয়তেউলামাপন্তুী তাঁর সমগোত্রীয় সকল আলেম-উলামা তাঁদের প্রিয় উস্তাদের উপদেশমতো আন্তরিকতার সাথে নব্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানকে ইসলামী আদলে গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় ছিলেন।
একবার (সম্ভবত বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে) ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে দিরাই থানা সদরে এক বিরাট নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। নৌকাবাইচে সাধারণত বাদ্যযন্ত্রসহ উৎসাহসব্যঞ্জক গানবাজনা দিয়ে মাল্লাদেরকে উত্তেজিত-উদ্দীপ্ত করার একটা অনুষঙ্গ থাকে। তাছাড়া এ উপলক্ষে রেসকোর্সের ঘোড়দৌড়ের মতো জুয়া ও অন্যান্য কিছু খারাপ অনুষঙ্গও থাকে। তাই আলেম-উলামা সর্বদাই এর বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁর নিজ জেলায় এরূপ একটি অনৈসলামী আয়োজন ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বাধীনতাদিবসে হতে যাচ্ছে শুনে শায়খে কাতিয়া আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি গিয়ে দিরাই থানা সদরে উপস্থিত হলেন। নদীর দুই পারে তখন হাজার হাজার আমোদপ্রিয় দর্শকের ভিড়। নদীতে ১৫/২০টি প্রতিযোগী নৌকা, যার প্রত্যেকটিতে ৪০/৫০ জন করে স্বাস্থ্যবান যুবক মাঝি-মাল্লা। নৌকাবাইচের এ উৎসবে সুনামগঞ্জের মহকুমা-হাকিম প্রধান অতিথিরূপে উপস্থিত। তিনিই প্রধান প্রশাসক হিসেবে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিরতণ করবেন।
নৌকাবাইচ শুরুর পরম উত্তেজনার মুহূর্তে হযরত শায়খ তাঁর আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘ভাইসব! ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। অনৈসলামী আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে আমরা এর অবমাননা করতে পারি না। কুরআন্ততিলাওয়াত ও ইসলামী কার্যকলাপের মাধ্যমে এদিন আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করব। তা না করে আমরা যা করতে যাচ্ছি তা আমাদেরকে গজবের দিকে ঠেলে দিবে। আমার জীবন থাকতে আমি তা হতে দেব না। মহকুমা হাকিমের উপস্থিতিতে হাজার হাজার উৎসাহী আগ্রহী দর্শক শ্রোতার প্রতি তাঁর এরূপ বক্তব্য শুনে সকলেই হতবাক হয়ে যায়। সকলেই কম বেশি দমে যায়। কিন্তু একটি নৌকার সর্দার বলে উঠে, আমরা শায়খ সাহেবের কথায় ক্ষান্ত হব না। এ আয়োজন আমাদের অনেক পূর্ব থেকে চলে আসছে এবং এতে আমাদের প্রচুর খয়খরচাও হয়ে গেছে। বলেই লোকটি নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে সারি গানের সুর ধরে নৃত্য শুরু করে দেয়। অমনি লোকটি সকলের সম্মুখে ঢলে পড়ে এবং সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়। মুহূর্তের মধ্যে লোকজন যার যার নৌকা নিয়ে অকুস্থল ত্যাগ করে। স্বল্প সময়ের মধ্যে আয়োজকদের সকল আয়োজনই পণ্ড হয়ে যায়।
শায়খের সাথে আমার ঐরূপ যোগাযোগের একপর্যায়ে তাঁর সাথে আমার চট্টগ্রাম সফরের সুযোগ হয়েছিল। তিনি চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ধর্মপ্রাণ ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব জনাব আদালত খানের বাসভবনে গেলে খান সাহেব তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বরণ করলেন। আমার কাছে মনে হল, ইনি আমাদের সিলেটের ঐ সময়ের বিশিষ্ট মাদানীভক্ত জনাব সুলায়মান খান এবং উলামা নেওয়ায প্রিন্সিপাল মজদুদ্দীন সাহেবের মতো একজন ইলমদোস্ত ব্যক্তিত্ব। তারপর আমরা হাটহাজারীর বিখ্যাত মুঈনুল ইসলাম দারুল উলূমে গেলাম। তখন হযরত থানভীর বিশিষ্ট খলীফা হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব রাহ. সেখানকার মুহতামিম। শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল কাইয়ুম, মাওলানা আবদুল আযীয, মাওলানা আহমদুল হক, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী রাহ.সহ অনেক অনন্যসাধারণ বুযুর্গ আলিম উস্তাদরূপে ছিলেন। বর্তমান মুহতামিম হযরত মাওলানা আহমদ শফী দামাত বারাকাতুহুম তখনো যৌবনকাল অতিক্রম করছেন। তিনিও আমাদের শায়খে কাতিয়ার সমবয়সী ও সমপাঠী মনে হল। অন্তত তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক দেখে আমার কাছে সেরূপই মনে হয়েছে। আমি অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, মুহতামিম সাহেবসহ পূর্বোক্ত বুযুর্গগণের সকলেই শায়খে কাতিয়ার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। সম্ভবত এদের প্রায় সকলেই যেহেতু হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর শিষ্য শাগরিদ এবং শায়খে কাতিয়া তাঁরই একজন পাগলপারা প্রিয় শিষ্য খাদেম তাই তাঁর ঐ জযবা, অবস্থান ও বিশেষত্বের প্রতি সকলে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন।
যোহরের নামাযের সময় যখন মাদরাসার প্রায় আট হাজার ছাত্র-শিক্ষক উপস্থিত, এমন সময় হযরত শায়খে কাতিয়াকে মুহতামিম সাহেব রাহ. মিম্বরে আরোহণ করে কিছু নসীহত করার অনুরোধ জানালেন। হযরত শায়খে কাতিয়া আমার প্রতি তাঁর অগাধ ও অকৃত্রিম শফকত ও একাত্মতা প্রকাশের জন্যই বুঝি আমাকেই মিম্বরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি তখন ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে সবেমাত্র কামিল (হাদীস) পাশ করেছি। হযরত মুহতামিম সাহেবের সাথে যদিও আমার এটাই প্রথম মোলাকাত বা হাটহাজারী মাদরাসায় প্রথম যাওয়া ছিল না কারণ ইতিপূর্বে ১৯৬২ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সময়ই আমি একটি রিলিফ কমিটির সদস্যরূপে হাটহাজারীতে গিয়ে বিশেষত তখনকার গহীরা এলাকায় জনৈক বিদেশী পাদ্রীর মুসলমানদেরকে খৃষ্টান করার দুরভিসন্ধি ও তার কার্যকলাপ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়ে মুহতামিম সাহেবের নেকনজরে পড়েছিলাম। তা সত্ত্বেও মুহতামিম সাহেব আমাকেই বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মিম্বরে দাঁড় করিয়ে দেবেন এটা আমি কল্পনা করতে পারিনি। হানাফী মাযহাবের অন্যতম সেরা আলেম আমার শায়খ হযরত মাওলানা যফর আহমদ উছমানী রাহ. (তখনো তিনি জীবিত) যেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন সেখানে দাঁড়িয়ে আমি রীতিমতো কম্পিত বোধ করছিলাম। কিন্তু হযরত মুহতামিম সাহেব ও হযরত শায়খের তাওয়াজ্জুহের কল্যাণে স্বল্পক্ষণের মধ্যেই আমি নিজেকে সামলে নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় সমসাময়িক ফিতনা-ফাসাদ ও আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে বক্তৃতা করি। যতদূর মনে পড়ে, এমন একটি আলেম প্রধান এলাকায় বিদেশী পাদ্রী কর্তৃক মুসলমানদেরকে ধর্মান্তরিত করার দুঃসাহসের ব্যাপারে আমি উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলাম। জামাতে ইসলামী ও মাওলানা মওদুদীর ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস যেন ইসলামের এ দুর্গে আঘাত হানতে না পারে এ ব্যাপারেও আমি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। নোয়াখালির, যতদূর মনে পড়ে, রামগতি থানার একজন মুজাহিদ আলিম মাওলানা মুখলিসুর রহমান গ্রাম্য ষণ্ডাগুণ্ডাদের নাট্যানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ায় রাতের আঁধারে পাটক্ষেতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর ব্যাপারেও আমাদের প্রতিবাদমুখর হতে হবে এবং দুআ করতে হবে এ বক্তব্যও দিয়েছিলাম। সর্বোপরি বৃহত্তর আলেমসমাজকে একটি ঐক্যফ্রন্টে সম্মিলিত হতে আহ্বান জানিয়েছিলাম। হযরত শায়খে কাতিয়ার নেকনজরের বদৌলতেই আমার এতবড় একটা উলামা মজলিসে দীঘক্ষণ পর্যন্ত বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। এটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিত্বের অবদান ছিল, নতুবা আমার মতো একজন সরকারি মাদরাসায় পড়ুয়া নবীন আলেমকে অন্তত হাটহাজারী দারুল উলূমে এরূপ সুযোগ যে দেওয়া হত না তা নিশ্চিভাবেই বলা চলে। ঐ সভার বিবরণ যথারীতি তখনকার দিনের বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়েছিল।
ইন্তেকালের ঠিক এক বছর পূর্বে (জুলাই ২০০৯) সিলেটের কাজীটোলায় আমার মেঝো পুত্র মাহমুদ ইবন আবদুল্লাহর বিবাহও পড়িয়েছিলেন হযরত শায়খে কাতিয়া। কনেপক্ষ তাঁর মুরীদ ছিলেন। তাঁদের মেয়ের বিবাহ আমারই ছেলের সাথে হচ্ছে জানতে পেরে তিনি গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এবং আমাকেই বিবাহের খুতবা পাঠের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তাঁর সম্পর্কে আমার যতটুকু জানার সুযোগ বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে ঘটেছে হয়ত অনেকেরই এতটা হয়নি। এজন্য তাঁর অনন্যসাধারণ চরিত্র সম্পর্কে অবগত করার মানসেই এ আলোচনাটুকু করা হল। এতে আমার নিজের প্রসঙ্গ যতটুকু এসেছে তা একান্তই প্রাসঙ্গিক ব্যাপার। এগুলো বাদ দিয়ে বললে ঘটনাগুলো প্রামাণ্য বলে বিবেচিত নাও হতে পারে বলেই নিজের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাইনি।
১৯৭০ সালের ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের শেষ সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিখ্যাত জমিদার ও বাউল কবি হাসান রাজার পৌত্র উবেদ রাজার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে জমিয়তের খেজুর গাছ মার্কায় প্রচুর ভোট পেয়েছিলেন। অথচ তিনি ঐ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না। হাফেজ্জী হুজুর রাহ. যে একাশি সালের নির্বাচনে অর্জিত ভোটের প্রায় এক চতুর্থাংশ সিলেট বিভাগ থেকে পেয়েছিলেন তাতেও শায়খে কাতিয়ার বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল।
ইনে-কালের সময় হযরত শায়খের বয়স হয়েছিল তাঁর পাসপোর্ট অনুসারে ১০২ বছর। সিলেটের ঐতিহাসিক শাহী ঈদগায় দুপুর দু’টায় তাঁর জানাযায় রেকর্ডপরিমাণ আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ জনতার উপস্থিতি দর্শকমাত্রকেই বিমোহিত করেছিল। জানাযার ইমামতি করেছিলেন তাঁরই দৌহিত্র হাকিম মাওলানা মানযুর আহমদ। রাজধানীর পত্রপত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এত বড় একটি সংবাদ প্রকাশে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তবে বৃহত্তর সিলেট বিভাগে এটাই ছিল শীর্ষসংবাদ এবং দীর্ঘ সপ্তাহকালব্যাপী এটিই ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। ঐ জানাযায় প্রায় ছয় লাখ লোকের সমাবেশ হয়েছিল। গোটা সিলেট শহর ঐ দিন লোকে লোকারণ্য ছিল। দ্বিতীয় জানাযা হয় তারই প্রতিষ্ঠিত কাতিয়া মাদরাসা মাঠে। ঐ জামাতের ইমামতি করেন শায়খের জ্যেষ্ঠ পুত্র হাকিম মাওলানা এমদাদুল্লাহ। ঐ জামাতেও দুই আড়াই লাখ লোকের সমাবেশ ঘটেছিল বলে জানা যায়। মরহুম পাঁচ পুত্রসন্তান ও চার কন্যার জনক ছিলেন। কাতিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়। আর কোনো দিন বাতিলের বিরুদ্ধে তাঁর সিংহ-গর্জন উচ্চারিত হবে না , কিন্তু তাঁর স্মৃতি কোনো দিন ভোলাও যাবে না।
প্রিয় পাঠক! তাঁর ইনি-কাল সম্পর্কে আরেকবার স্মরণ করুন। বছরের সেরা মাস রমযান, সপ্তাহের সেরা পবিত্র দিন জুমাবার। প্রায় চারশ বছর সিলেটের যে ঐতিহাসিক শাহী ঈদগায় লক্ষ লক্ষ পুণ্যাত্মা লোক বছরের দুটি ঈদের নামায আদায় করেছেন সেখানেই পবিত্র ঈদের দিন তাঁর নামাযে জানাযা!! লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি!! দু দুটো জানাযায় যাঁরা ইমামতি করলেন, তাঁরা দুজনই একাধারে হাফিযে কুরআন ও দাওরায়ে হাদীস পাশ মাওলানা। দুজনই তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারী। একজন পুত্র, আরেকজন দৌহিত্র!!
এমনি পুণ্যাত্মাদের প্রতিই বুঝি ঘোষিত হয়েছে রাব্বুল আলামীনের উদাত্ত আহ্বান, (তরজমা) ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তোমার মহান প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাও এমনি অবস্থায় যে, তুমিও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনিও তোমার প্রতি প্রসন্ন! সুতরাং আমার (সম্মানিত) বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ কর। আমার জান্নাতে প্রবেশ কর! (সূরা ফজর : ২৭-৩০)
আমার কাছে তাঁর মতো পুণ্যাত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের মতো উপযুক্ত ভাষা নেই। শুধু এতটুকুই বলব :
জীবনেও তুমি মহীয়ান ছিলে
মরণেও মহীয়ান
জানি না কভুও পূরণ হবে কি
তোমার শূন্যস্থান
হে ক্লান্ত বীর, অনেক হয়েছে
এবার ঘুমিয়ে থাক
আমরা তোমার পথ ধরে চলি
ভক্ত প্রেমিক লাখো।