ডক্টর আব্দুল কাদীর খান
উম্মাহর এক নিবেদিতপ্রাণ সেবক
[জন্ম : ২৭ এপ্রিল ১৯৩৬ ঈ., মৃত্যু : ১০ অক্টোবর ২০২১ ঈ.]
১০ অক্টোবর ২০২১ রোববার সকালে স্থানীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন পরমাণু বিজ্ঞানী মুহসিনে পাকিস্তান ডক্টর আব্দুল কাদীর খান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হে আল্লাহ, মুসলিম উম্মাহর এ ক্ষতি এর চেয়ে উত্তম কিছু দিয়ে পূর্ণ করে দিন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি এক স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান রেখে যান।
অদম্য মেধাবী এই মানুষটি ১৯৩৭ সালে ভূপালে জন্মগ্রহণ করেন। ভূপাল জ্ঞান চর্চার সেই উর্বর অঞ্চল, যেখানকার নবাবগণ জ্ঞান ও জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন অকাতরে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বপ্রথম উপমহাদেশে ফাতহুল বারীর মতো মূল্যবান গ্রন্থ ছাপার অক্ষরে আসে। বিশিষ্ট গবেষক হামীদুল্লাহ খান রাহ. এ অঞ্চলেরই মানুষ ছিলেন। আল্লামা ইকবালের কাব্য ভূপালের প্রশংসায় ভরে আছে।
তিনি উচ্চ শিক্ষা নিয়েছিলেন পশ্চিমে। বিয়ে করেছিলেন পশ্চিমা নারী। এর পরও তিনি ভুলে যাননি ইসলামকে, নিজ দেশ পকিস্তানকে। যেটা অনেক বিরল ঘটনা। কারণ, পশ্চিমে চাকরি-বাকরি বিয়ে-শাদি করে অনেকেই ভুলে যায় স্বদেশ ও স্বধর্মের প্রতি দায়িত্ববোধ। ইসলাম ও ইসলামী ভূখণ্ড ছিল তার হৃদয়ের গভীরে। ১৯৭১ সালে যখন এ অঞ্চলে পাক সেনাদের জুলুম-নিপীড়ন চলছিল হল্যান্ডে বসে সবই তিনি দেখেছিলেন আর গুমরে কেঁদেছিলেন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটি যখন ভেঙে গেল তখন তিনি এতটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন যে, কদিন নাওয়া-খাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দেশের ভেতর নানান সমস্যা, বহিঃশত্রুর নানান ষড়যন্ত্র দেখে তিনি ইসলাম, মুসলমান ও দেশের জন্য কিছু একটা করার ভাবনায় বিভোর ছিলেন। এর মধ্যে ভারত পরমাণু বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে বসল। বিশ্বকে জানান দিল নিজেদের পরমাণু সক্ষমতা। এসব দেখে আবদুল কাদীর খানের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। যে দেশটি পাকিস্তানের চরম শত্রুতাকে নিজের মিশন বানিয়ে নিয়েছে তার হাতে এটম বোমা, তাহলে তার দেশের কী হবে? তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন যুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি হল্যান্ড থেকে পত্র মারফত যুলফিকার আলী ভুট্টোকে পরমাণু বোমা তৈরির প্রস্তাব দেন। ভুট্টো সাহেব তখন তাঁকে দেখা করতে বলেন। ক্রিসমাসের ছুটিতে খান সাহেব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি নিজের যোগ্যতার ব্যাপারে আস্বস্ত করতে সক্ষম হন। কাজ শুরু করার পর তৃতীয় বিশে^র সেই চিরচেনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখোমুখি হন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরলে তাকে প্রধান করে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউল হক এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন একিউ খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ।
পরমাণু কর্মসূচি জোরদারভাবে শুরু করার পর থেকে নিয়ে সফল পরীক্ষা পর্যন্ত অনেক সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। তবে পাকিস্তানের সৌভাগ্য যে, সবাই এই কর্মসূচি আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়েছে। ২৮ মে ১৯৯৮-এ পাকিস্তান যখন পারমাণু বোমার সফল পরীক্ষা চালায়, তখন সারা পৃথিবীতে রব পড়ে যায়। ইসলামবিরোধী সব শক্তি হইহই রইরই করে ওঠে। এর বিরুদ্ধে হেন কোনো অপপ্রচার নেই, যা তারা চালায়নি। তারা এ বোমার নাম দেয় ‘ইসলামী বোমা’। এর আগে ভারত পরমাণু বোমা বানিয়েছে সেটা নিয়ে কোনো হইচই হয়নি। এটার নাম কেউ ‘হিন্দু বোমা’ দেয়নি। চীনও তো বহু আগেই পরমাণু বোমা বানিয়েছে। এর নাম তো ‘বৌদ্ধ বোমা’ রাখেনি। এরও আগে আমেরিকা জাপানের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে। বহু বনী আদম সেখানে নিহত হয়েছে। সেই বোমা হামলার চিহ্ন হয়তো কোনোদিন মুছবে না। এই জঘন্য কাজের জন্য আমেরিকা কখনো ক্ষমা তো চায়-ই নাই, উল্টো দম্ভভরে ক্ষমা না চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আমেরিকার এ বোমাকে তো কেউ ‘খ্রিস্টান বোমা’ বলছে না। এদের বোমাকে পৃথিবীর জন্য হুমকি মনে করছে না। আমরা মনে করি, একটি মুসলিম দেশের পরমাণু বোমার মালিক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখানেই। কারণ, তারা চায় না, কোনো একটি মুসলিম রাষ্ট্র ক্ষমতাধর হোক, চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো সক্ষমতা অর্জন করুক। বাংলাদেশের হলে তো বটেই এ বোমা যদি সৌদি আরবেরও হতো, কিংবা ইন্দোনেশিয়া বা অন্য কোনো মুসলিম দেশের হতো তাহলেও আমরা একথাই বলতাম। পবিত্র কুরআনে মুসলমানদেরকে শক্তি অর্জন করতে বলা হয়েছে-
وَ اَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّۃٍ وَّمِنْ رِّبَاطِ الْخَیْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهٖ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَ اٰخَرِیْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ لَا تَعْلَمُوْنَهُمْ اَللهُ یَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ شَیْءٍ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ یُوَفَّ اِلَیْكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تُظْلَمُوْنَ .
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা তাদের (মুকাবিলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্বছাউনি প্রস্তুত কর, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের (বর্তমান) শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে এবং তাদের ছাড়া সেই সব লোককেও, যাদেরকে তোমরা এখনও জান না; (কিন্তু) আল্লাহ তাদেরকে জানেন। তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে, তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। -সূরা আনফাল (৮) : ৬০
আল্লাহ মুসলমানদেরকে শক্তি সঞ্চয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত এই শক্তির সর্বশেষ স্তর এটাই- পরমাণু শক্তিধর হওয়া। এ শক্তি অর্জন করার অর্থ এই নয় যে, যাচ্ছে তাইভাবে যখন তখন বোমার ব্যবহার করতে হবে। বরং আমার কাছে শক্তি থাকলে কেউ আমার সঙ্গে গায়ে পড়ে লাগতে আসবে না। আক্রমণ করার আগে হাজার বার ভাববে। এরপরও যদি আক্রমণ করে বসে তখন চেয়ে থাকতে হবে না আমাকে। প্রতিবিধান করা যাবে।
ডক্টর আব্দুল কাদীর খান ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সৎ ও খোদাভীরু ছিলেন শিশুকাল থেকেই নিয়মিত নামাযী ছিলেন। অনেকদিন ধরেই তার কলাম পড়া হয়। দৈনিক জংগে তিনি নিয়মিত লিখতেন। তার লেখার শিরোনাম ছিল, سحر ہونے تک। আলকাউসারেও তার কিছু লেখা অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আগে তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণ লিখতেন। শেষ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক বিষয়ে লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, এসব নিয়ে আর কী লিখব? এসব কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে কথা বলে লাভ কী? শেষ দিকে তিনি বেশি লিখতেন বুক রিভিউ। কুরআন-হাদীস নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের ওপর মন্তব্য করতেন। কখনো শেখ সা‘দীর কবিতা অথবা মসনবী রুমীর কবিতা বিশ্লেষণ করতেন। গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁর গল্প ও কবিতা উল্লেখ করে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমাট বাঁধা অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরতেন। একজন বিজ্ঞানী হয়েও তিনি সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেছেন গভীরভাবে। সমাজের মূল সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন। গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ ও মসনবী তাঁর অনেকটা মুখস্থ মতো ছিল। ফার্সি ভাষায় তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন যেমন দক্ষ ছিলেন পৃথিবীর আরো অনেক ভাষায়।
ড. আবদুল কাদীর খানের জীবনের প্রধান লক্ষণীয় দিক হল, তিনি নিজেকে নিজে প্রস্তুত করেছিলেন। কেউ তাঁকে প্রস্তুত করে দেয়নি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। অধ্যবসায় ও আত্মনিবেদনের অপূর্ব সমন্বয়ে নিজেকে উম্মাহর জন্য পেশ করেন। এভাবে যখন কেউ পথ চলতে শুরু করে তখন আল্লাহর তাওফীকও সঙ্গ দেয়। সেজন্যই তো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রাচীন পদ্ধতি রিএক্টর প্রসেসিং থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রিফিউজ পদ্ধতিতে অত্যন্ত অল্প খরচে পাকিস্তানের জন্য পরমাণু বোমা তৈরি করতে সক্ষম হন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পাকিস্তানের পরমাণু বোমা তৈরি করতে গিয়ে একটি এফ-১৬ বিমানের চেয়েও কম খরচ হয়েছে।
মুসলিম উম্মাহর নায়কদের কপালে অপদার্থ শাসকদের তরফ থেকে যা জোটে র্ঠিক তা-ই জুটেছিল ড. আবদুল কাদীর খানের কপালে। তখন সেনা শাসক পারভেজ মোশাররফের শাসনাামল। পশ্চিমা তল্পিবাহক হিসেবে তার জুড়ি মেলা ভার। তাকে সঙ্গে নিয়েই আমেরিকা আফগানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তার ইসলাম বিদ্বেষী চরম ভুল সিদ্ধান্তগুলোর কারণেই পাকিস্তানে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য কুফরি শক্তি জন্মলগ্ন থেকেই লেগে ছিল। পরমাণু বোমার মালিক হওয়ার পর তো কুফরি শক্তির ঘুম হারাম হয়ে যায়। কীভাবে এ বোমার জনককে কলূষিত করা যায় সে চেষ্টায় লেগে গেল। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরমাণু প্রযুক্তির তথ্য পাচারের অভিযোগ তুলে নানা রকম প্রোপাগান্ডায় পরিবেশ অস্থির করে তোলে। এপর্যন্ত তো ব্যাপারটি স্বাভাবিকই ছিল। কারণ, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুফরি শক্তির সম্মিলিত প্রোপাগান্ডা তো শুরুর যুগ থেকেই। এজন্যই বলা হয়-
الْكُفْرُ مِلّةٌ وَاحِدَةٌ.
কুফরি শক্তি সবাই এক জাতিভুক্ত।
অস্বাভাবিক ব্যাপার যেটা ঘটল তা হল, ডা. আবদুল কাদীর খানকে টিভির পর্দায় হাজির করা হল, তাঁর মুখ দিয়ে পরমাণু তথ্য পাচারের অভিযোগ স্বীকার করানো হল। তাঁর নামে বলা হল, তথ্য পাচারের জন্য তিনি নাকি দুবাইয়ে অফিস খুলেছিলেন। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে ধ্বংসাত্মক পরমাণু বোমা সংক্রান্ত তথ্যাদি পাঠানো হতো। অথচ পরমাণু বোমা তৈরির পর তার চলাচল হয়ে গিয়েছিল একদমই সীমিত। এরপর তাকে অনেকটা গৃহবন্দি করে রাখা হয়। একসময় হাইকোর্ট থেকে গৃহবন্দিত্ব অবসানের নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের নির্দেশও পুরোপুরি পালিত হয়নি। সরকার তাঁর পরিস্থিতি এমন করে রেখেছিল যে, তাঁকে না মুক্ত বলা যেত, না গৃহবন্দি। পাকিস্তানের পরম উপকারী এ মানুষটাকে এমনই প্রতিদান দিয়েছে অপদার্থ শাসকরা। অন্যদিকে ভারতের দিকে দেখুন। এপিজে আব্দুল কালাম ভারতের জন্য পরমাণু বোমার অন্যতম জনক। তারা তাঁকে আজীবন ‘হিরো’র মর্যাদা দিয়েছে। তাঁকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। মৃত্যুর পর তাঁর নামে একটি সরণির নামকরণ করেছে। যদিও যে সরণিটির নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে সেটা ইতিপূর্বে বাদশা আওরঙ্গজেবের নামে ছিল। মুসলিম বিদ্বেষ থেকেই আওরঙ্গজেবের নাম মুছে ফেলা হয়। নাম দেওয়া হয় এপিজে আব্দুল কালামের নামে। এ ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়টি হয়তো অনেকেরই জানা।
এই বন্দিদশার দরুন তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। একবার এক্সপ্রেস নিউজের বিশিষ্ট সাংবাদিক জাভেদ চৌধুরির সঙ্গে তাঁর বিমানে দেখা। ঘটনাচক্রে পাশাপাশি আসন পড়েছিল তাদের। জাভেদ চৌধুরি তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা আপনি টেলিভিশনে যা বলেছেন তা যে মিথ্যা- পুরো দেশবাসী তো তা জানে। কিন্তু আপনি এমন স্বীকারোক্তি কেন দিলেন?
ডা. আবদুল কাদীর খান বললেন, আমাকে আসলে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। ব্যাপারটি ছিল, পারভেজ মোশারফের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী চৌধুরী শুজাআত হুসাইন এসে আমাকে ধরল, আমার সাথে তার ব্যক্তিগত খাতির ছিল। তিনি বললেন, আমি যদি এমন স্বীকারোক্তি না দিই তাহলে পাকিস্তান ঘোরতর বিপদে পড়ে যাবে। তারা আমাদের ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা দেবে অথবা আক্রমণ করে বসবে। আপনার একটু স্বীকারোক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান বেঁচে যেতে পারে।
তখন আমি বাধ্য হয়ে এ স্বীকারোক্তি দিই। এজন্য ড. আবদুল কাদীর খান বলতেন, ‘আমি পাকিস্তানকে দু’বার রক্ষা করেছি, একবার পরমাণু বোমা তৈরি করে। আরেকবার পরমাণু বোমার তথ্য পাচারের মিথ্যা দায় নিজের মাথায় চাপিয়ে নিয়ে।’
সাংবাদিক জাভেদ চৌধুরি তাঁকে আরেকটি প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা আপনি কি আপনার অর্থ-সম্পদ নিরাপদে রাখতে পেরেছেন?
তিনি বললেন, আমার অর্থ-সম্পদ বলতে থাকার জন্য একটি বাড়ি আছে। এছাড়া আর কিছুই নেই। সেই বাড়িটিও একবার নগর কর্তৃপক্ষ ভাঙতে এসেছিল। তখন চৌধুরী শুজাআতের প্রচেষ্টায় বাড়িটি রক্ষা পায়। অন্যথায় পথেই হয়তো আমাকে থাকতে হত। ইউরোপে তার সর্বশেষ চাকরিটির মাসিক বেতন ছিল তৎকালীন পাকিস্তানী ছয় লক্ষ রূপীর সমান। আর সেটি ছেড়ে দেশের প্রকল্পে যোগ দিয়ে তিনি পান মাত্র ৩০ হাজার রূপী। তাও শুরু হয় ছয় মাস পর থেকে। এভাবেই তিনি বৈষয়িক কুরবানী দেন ইসলাম ও দেশের জন্য।
তিনি একবার বলেছিলেন, যারা আমাকে অপমান করতে চেয়েছিল তারা আজ পথে-ঘাটে ঘোরে। আর আল্লাহ তো আমাকে সম্মানিতই রেখেছেন; মানুষ আমাকে পরমভাবে ভালবাসে। তিনি একথা বলে পারভেজ মোশাররফকে বুঝিয়েছেন। পাকিস্তানে তার এত এত সম্পদ, দামি ফার্ম হাউজ অথচ বিচারের ভয়ে দেশে আসতে পারে না। দুবাইয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকতে হচ্ছে।
মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের অধিকাংশেরই এই অবস্থা। তারা মান-সম্মান ভুলে পশ্চিমা প্রভুদেরই পা চেটে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে। সে সম্পদ বিদেশে পাচার করে। যখন লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তখন তো দেশে থাকার সুযোগ থাকে না, বিদেশ পালিয়ে যায়। মাটির নিচের জীবনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকে।
মানুষ অস্থায়ী পৃথিবীতে আসেই চলে যাওয়ার জন্য। আবদুল কাদীর খানও পাড়ি জমিয়েছেন স্থায়ী জীবনের পথে। কিন্তু দু’দিনের এ দুনিয়ায় তাঁরাই আসল সফলকাম, যারা নিজেদের জীবনে রেখে যেতে পারেন দুনিয়াবাসীর জন্য কিছু আদর্শ ও পাথেয়। ডক্টর আবদুল কাদীর খান এমনই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবন থেকে নেয়ার আছে অনেক শিক্ষা। বিশেষত উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী মুসলিমদের জন্য তিনি এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। সর্বোপরি যেসব বিরল বৈশিষ্ট্যের জন্য (বিশেষত বর্তমান সময়ে) তিনি অনন্য তার মধ্যে রয়েছে :
মেহনত ও অধ্যবসায়
উচ্চমেধা তো আল্লাহর দান। কিন্তু তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগায় খুবই কম মানুষ। মেধায় জোর বেশি থাকায় অল্প চেষ্টায় কিছু সফলতা পেয়ে যায়। তাতেই তুষ্ট থাকে। কিন্তু যেসকল মেধাবী জানতোড় মেহনতের মাধ্যমে বড় কিছু করার জন্য নিজের দিন-রাত এক করে দেয় সফলতা তাঁদের পায়ে চুমু খায়। এমন কর্ম-ক্লেশের মাধ্যমে সফল হয়েছিলেন ড. খান।
সততা ও নিষ্ঠা
বর্তমানে একটু উঁচু জায়গায় পৌঁছতে পারলেই শিক্ষিত লোকদের অনেকের সততার পরীক্ষা হয়ে যায়। মানুষ তাদেরকে দেখতে পায় ভিন চেহারায়। কিন্তু এই সততা ও নিষ্ঠাই ছিল আবদুল কাদীর খানের বড় পাথেয়। ভাবা যায়! মাত্র একটি এফ ১৬ বিমানের মূল্য পরিমাণ খরচে পারমাণবিক অস্ত্র এবং নিজের মিশন সফল হওয়ার পর সম্পূর্ণ দরবেশী জীবন যাপন!
লক্ষ্য যখন তারকাসম উঁচু
দুনিয়ায় তারাই মহান ব্যক্তিত্ব, যাদের লক্ষ্য থাকে আকাশচুম্বি এবং তা অর্জনে তাঁরা থাকেন অবিচল। বড় বড় খেতাব অর্জন, কাড়ি কাড়ি সম্পদের পাহাড় গড়া এসব তো অনেকেই করতে পারেন। কিন্তু ড. খানের মত ব্যক্তিরাই অসাধারণ কিছু করেন।
দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ
স্বজাতি ও নিজ দেশের জন্য অসাধারণ কিছু করেই মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকে। আর সেটি যদি হয় মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলমানদের প্রতিরক্ষার জন্য তবে তো তার তুলনা সে নিজেই হয়।
নেক স্ত্রী
হাদীসে নেক স্ত্রীকে خير متاع الدنيا দুনিয়ার উত্তম সম্পদ বলা হয়েছে। ড. খান যখন জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছ থেকে দেশে এসে কাজ শুরু করার প্রস্তাব পান তখন স্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেন। স্ত্রী ছিলেন বিদেশী; শুনেই তিনি আকাশ থেকে পড়েন। বলছ কি তুমি? আমাদের সহায় সম্পদ আমার মা-বাবা সব কিছু ওখানে। আমরা তো এখানে বেড়াতে এসেছি।
খান সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ঠিক আছে তাহলে ফিরে যাই।
একথা শোনার পর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, আসলেই তুমি তোমার দেশ ও ইসলামের জন্য কিছু করতে পারবে?
তিনি বললেন, আমি পারব ইনশাআল্লাহ।
স্ত্রী বললেন, তাহলে আমি রাজি। তুমি এখানেই থাক। আমি গিয়ে সব কিছু গুছিয়ে আসি।
বিবাহের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করা এই নওমুসলিম নারী সারা জীবন ড. খানকে সঙ্গ দিয়েছেন।
আল্লাহভক্তি
আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে আবদুল কাদীর খানের অসাধারণ আল্লাহভক্তি। তার লেখার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠত ঈমান ও তাকওয়ার সৌন্দর্য। এত বড় একজন বিজ্ঞানীর আল্লাহ ও রাসূল প্রেম, কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী কিতাবাদীর গভীর অধ্যয়নে সত্যিই মুগ্ধ ছিলাম আমি।
আল্লাহ আবদুল কাদীর খানের সকল গুনাহ-খাতা মাফ করে দিয়ে তাকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন। দুনিয়ার শিক্ষিত মুসলিম যুবকদের তাকে অনুসরণ করার তাওফীক দিন। হ