দানে বাড়ে ধন
সে অনেক আগের কথা। আজ থেকে এক-দুই যুগ? না। এক-দুই শতাব্দী? তা-ও না! প্রায় দু’হাজার বছর আগের গল্প। সুদূর আরবের ইয়েমেন রাজ্যের রাজধানী ‘ছানআ’। তার থেকেও ছয় মাইল দূরে অবস্থিত ‘যারওয়ান’। সেথায় থাকতেন এক জমিদার। ধনেজনে তার কোনো কমতি ছিল না। অঢেল সম্পদের পাশাপাশি মনটাও ছিল তার বেশ উদার। ন্যায়পরায়ণ ও নিষ্ঠাবান এ জমিদার অত্যন্ত নেককার আল্লাহওয়ালা ছিলেন। আল্লাহর বান্দাদের মুখে হাসি ফোটানোর মাঝেই যেন জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতেন।
বাড়ীর অদূরেই ছিল জমিদারের বিশাল খামার। মাঠভরা ফসল আর গাছভরা ফল- সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিত। মনোরম বাগানের পাতানো মাচাগুলো যেন টসটসে আঙ্গুরের থোকায় নুইয়ে পড়ত। মাঠঘিরে খর্জুর বৃক্ষের সুবিশাল সারি গোটা ময়দানটাকে পাহারা দিত। আর মৌ-ভোমরের গুঞ্জরণ ও পাখ-পাখালির কলকাকলি যেন শেষই হতে চাইত না। জমিদারের মনে এতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত। লোকেরাও খুশি হত ঢের। কারণ সে এবার তাদেরকে খুব দিতে পারবে। কোঁচড় ভরে দিতে পারবে। আর তারাও তার জন্য দুআ করবে। একেবারে প্রাণখুলে। এভাবে সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টা খুশি হয়ে পরের বছর আরো দেবেন। আর জমিদারও আল্লাহর বান্দাদের দিয়ে যাবেন দু’হাতে।
‘তোমাদের সম্পদে রয়েছে বঞ্চিতদের জন্য অংশ ও অধিকার’- [সূরা যারিয়াত (৫১) : ১৯] একথা স্মরণে রেখে জমিদার অকাতরে বিলিয়ে যেতেন আর আল্লাহ পাকও উত্তরোত্তর তার সম্পদ বাড়িয়ে দিতেন।
। দুই ।
ফসলগুলো পেকে এসেছে। ফলগুলোও লাল হয়ে এসেছে। এগুলো কেটে এখন ঘরে তোলার সময়। সারা বছরের অন্ন-ব্যবস্থা এখান থেকেই নির্বাহ করতে হয়। এ মৌসুমের ফসল সংগ্রহের উপরই যে তা নির্ভর করে! ফলে আমীর-ফকীর সবাই ব্যস্ত থাকে যার যার গোলা-ঘটি ভরায়।
জমিদারের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাকেও এ সময়টায় সংগ্রহ করে রাখতে হয় পুরো বছরের খাবার। স্ত্রী-পুত্র ও পরিবার-পরিজন নিয়ে বিশাল সংসারের ব্যয়ভার যে তারই কাঁধে ন্যস্ত! কিন্তু তার আবাদী জমির তুলনায় হৃদয়-ভূমি ছিল অনেক বিস্তৃত। তাতে জায়গা করে রাখত গরীব-মিসকীন ও অসহায় পরিবারের ভুখা-নাঙ্গা সদস্যরা।
ফসল কাটার সময় ভিড় জমিয়ে রাখত তারা। জমিদার তাদের জন্য জমিতেই কিছু রেখে আসতেন। আংশিক কেটে আনতেন। কর্তিত ফসল ঘর পর্যন্ত আনতে আনতে পথেও বিলাতে থাকতেন। রয়ে গেল মাড়াইপর্ব। মাড়াই করেও কোনোরকম একবছর চলে- এ পরিমাণ ফসলে গোলা ভরে বাকিগুলো তাদের জন্য রেখে দিতেন। ব্যস, এভাবে ফসল কাটা থেকে শুরু করে গোলাভরা পর্যন্ত কেবল দিয়েই চলতেন নেককার এ জমিদার।
তেমনি আঙ্গুর বাগান ও খর্জুর উদ্যানের ফলগুলোও সব আহরণ করতেন না। যা করতেন তা থেকেও পথে দিতে থাকতেন। ঘরে এনেও তাদের জন্য কিছু আলগা করে রাখতেন। এভাবে জমিদার নিজের পরিবারের সাথে সাথে অসহায় পরিবারগুলোরও চলার ব্যবস্থা করতেন।
। তিন।
দিনকাল ভালোই চলতে লাগল। আল্লাহ-বিল্লাহ করে সবাইকে নিয়ে জমিদার দিন কাটাতে লাগলেন বেশ। এভাবে একদিন দু’দিন করে চিরাচরিত ‘সেই দিনটি’ এসে গেল। জমিদার হাসলেন। সবাই কাঁদল। জমিদার চলে গেলেন। চিরদিনের জন্যই চলে গেলেন। সবকিছু রেখে গেলেন। নিয়ে গেলেন মানুষের পশলা পশলা দুআ ও মনের ভালবাসা। আজ সবাই আছে, সবকিছুই আছে। স্ত্রী-পুত্র, প্রতিবেশী সবাই আছে। সুজলা-সুফলা বিস্তৃত উদ্যান পড়ে আছে। সারি সারি খর্জুরবৃক্ষ, আঙ্গুরগুল্মের পাতানো মাচা... সবই আছে। কিন্তু নেই শুধু তিনি!
জমিদারের ছিল একে একে তিনটে পুত্র। দেখতে শুনতে কোনোটা কম নয়। সুঠামদেহী টগবগে যুবক। পিতার মৃত্যুর পর তারাই এখন জমিদার। অঢেল ধন আর বিস্তৃত ভুবনের মালিক এখন তারা। হঠাৎ করে এতগুলো সম্পদ হস্তগত হওয়ায় তারা যেন অন্ধ হয়ে গেল। পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির প্রাবল্যে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে লাগল। ‘যত আছে তত লাগে’ মানসিকতায় তারা সম্পদের মোহে বিভোর হয়ে থাকল। ভুলে গেল তাদের সম্পদে যে অন্যের হকও রয়েছে। ভুলে গেল বাবার রেখে যাওয়া আদর্শ।
নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানবপ্রকৃতির এ বাস্তবতাটি যথার্থভাবেই চিত্রায়ণ করেছেন-
আদমের বেটার যদি দু’টি উপত্যকাভর্তি সম্পদ থাকে, তাহলেও সে তৃতীয়টির তালাশে থাকবে। তার লোভাতুর ‘খালি পেটটি’ কেবল কবরের মাটিই পূর্ণ করতে পারবে। তবে যে তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২২২৮, ১৯২৮০, ২১১১১
। চার।
অর্থই সকল অনর্থের মূল। অর্থের টানে মানুষ নাড়ীর টানেও ছেদ ঘটায়, কুণ্ঠিত হয় না। জীবনভর অনুগ্রহের কথা মুহূর্তেই ভুলে যায়, দ্বিধা করে না। নিছক অর্থের জন্য। আজ তাদের এই ঐশ্বর্যের একমাত্র অবলম্বন যে তাদের পিতা ও তার বিশেষ অনুগ্রহ, সেকথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। উপরন্তু উদ্ধত অবাধ্য সন্তানের মত বলে উঠল, বুড়ো ভারি বেকুব ছিল। তাই দিয়ে দিয়ে সব শেষ করত। সে এত এত না দিলে আজ আমাদের আরো কত থাকত! যাক, বুড়ো নেই। ভালোই হয়েছে। এখন থেকে আমরা আর কাউকে কিছু দেব না। সংসারে এমনিতেই খরচের শেষ নেই। তার উপর আবার অন্যকে দেওয়া! থাক যা দেওয়ার বুড়ো মিয়াঁ আগেই দিয়ে দিয়েছে। এখন কাউকে কিছু দেওয়া যাবে না।
এ দম্ভপূর্ণ উচ্চারণের মাধ্যমে তারা বিলক্ষণে পিতার উপর একরাশ আক্রোশ ঝেড়ে নিল। পিতা যেহেতু তাদেরকে অনেক ‘পিছে’ ঠেলে দিয়েছে, তাই আজ তাদেরকেই ‘এগিয়ে’ যেতে হবে।
। পাঁচ।
ওদিকে ফসলগুলো পেকে আসছে। এই তো কর্তনের দিনই আবার লোকেরা কিছু নেবার জন্যে ভীড় জমাবে। আগের দিনগুলোর মতো। এত লোকের সমাগম হলে কাউকে কিছু না দিয়ে সহীহ-সালামতে ঘর পর্যন্ত আসতেও হিমশিম খেতে হবে। আবার কিছু দিলে যে কিছু কমে যাবে! এখন তো আর কমানোর সুযোগ নেই, ‘কামাই করে’ বাড়ানোর সময়।
কীভাবে কী করা যায়? তারা পরামর্শে বসল-
যেভাবেই হোক আগামীকাল সকাল সকাল আমরা ফসলগুলো কেটে আনব। এক-দু’দিন আগে ফসল কাটা হচ্ছে- সমস্যা নেই। তবে খুব ভোরেই আবছা আবছা আঁধার থাকতে আমাদেরকে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ফর্সা হতে দেওয়া যাবে না। ফকীরের বাচ্চারা ফের না এসে ভীড় জমায়!!
ধমনীতে পিতার রক্ত প্রবাহিত হলেও ভেতরে তার আদর্শ বলতে ছিল না। আগামীকাল পর্র্যন্ত বাঁচবে, ফসলও অক্ষত থাকবে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে, তবেই তো ফসল আনতে পারবে! কিন্তু না, আল্লাহ-খোদার নাম নেই। বৈভবের মোহে এতটা বিভোর হয়ে পড়েছিল, আল্লাহর নাম নিতেও ভুলে গেল। আরে আল্লাহর নাম মনে থাকলে কি আর এতটা দাম্ভিক হত! ঠকালে ঠকতে হয়- এ সত্যও কি আর ভুলে বসত!
এক ভাই কিছুটা নীতি-নৈতিকতার ধার ধারত। মনে মনে পিতার আদর্শ কিছুুটা হলেও লালন করত। আমতা আমতা করে বলে উঠল, ভাই! এভাবে বলো না। কাউকে দিলে কমে না আর খাওয়ালেও ক্ষয় হয় না। আল্লাহর বান্দাদের খুশি রাখলে আল্লাহও খুশি থাকেন। তখন তিনি নিআমত আরো বাড়িয়ে দেন।
কিন্তু কার কথা কে শোনে! সীমাহীন অহংবোধের কারণে কথাগুলো যেন কারো কানে পড়ল না। আফসোসের কথা হল, শেষ পর্যন্ত এ ভাইও তার কথার উপর আর থাকতে পারল না। ‘সঙ্গদোষে অঙ্গ নষ্ট’ বলে কথা। সেও ভাইদের সাথে মিশে গেল।
। ছয়।
রাত এখনও অন্ধকার। ভোর হতে বেশ দেরি। কিন্তু আর তর সইছে না। বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে রাখাটা মুশকিল ঠেকছে। একে অপরকে ফিসফিসিয়ে ডেকে তুলতে লাগল। এই, যাবি না! চল চল, তড়িৎ প্রস্তুত হ!
তিনে মিলে অতি সন্তর্পণে পা বাড়াল খামারের দিকে। আজ তাদের খুশির অন্ত নেই। মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। চাপাস্বরে ফিসির ফিসির করছে। পাছে কেউ না আবার শুনে ফেলে!
-এই, আজ কোনোভাবে যেন একটা মিসকীনও আঁচ করতে না পারে।
-আঁচ করবে কীভাবে? আমরা যেভাবে চলছি!
-তারপরও এক দুইটা যদি এসে পড়ে, একেবারে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব না!
দাঁত কিটমিটিয়ে বলল কথাটি।
কথা বলতে বলতে কথা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সময়ও ফুরিয়ে আসছে। পথও অনেক দূর পেরিয়ে গেছে। ঘুটঘুটে ভাবটাও কিছুটা ফর্সা ফর্সা দেখা যাচ্ছে।
-কী রে, আমরা ভুল পথে চলছি না তো!
-না না, আমাদের জমি তো এ পথেই।
-তাহলে এত দেরি কেন? আমরা কি ঠিকমত চলছি?
-আরে, এ এলাকাটা দেখি বিলকুল ধূসর। যেন শুকনো ঘাসে আগুন ধরিয়ে ছাইয়ের ক্ষেত বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। না না, এটা আমাদের জমি না। আমরা ভুল পথেই চলছি।
বলতে বলতে তারা নিজেদের জমির সামনেই ঠায় দাঁড়াল। আলামত দেখে নিশ্চিত হল, জায়গা মতোই আছে তারা। হকচকিয়ে বলে উঠল- না না, ঠিক পথেই তো আছি আমরা। তবে কি আমরা ভুল কিছু দেখছি?
হিসাব নিকাশ আর বাস্তবতা একসাথে মিলে উঠতে পারছিল না। বুঝতে পারল, পরকে ঠকাতে গেলে নিজেকেই ঠকতে হয়।
আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট দেবে? কীভাবে আল্লাহ মেনে নেবেন?! আল্লাহর বান্দাদের বঞ্চিত করবে? কীভাবে বঞ্চনার শিকার না হয়ে থাকবে! ঘুমের ঘোরেই তাদের অজান্তে এসে গেছে আল্লাহর আযাব। জ্বালিয়ে পুুুড়িয়ে সব ভস্ম করে দিয়েছে আসমানী আগুন। সবুজ-শ্যামল বিস্তৃত প্রান্তরটি যেন এখন একরাশ ছাইয়ের পুরু আস্তরণ। সারি সারি বৃক্ষরাজি যেন এখন একেকটি অগ্নিদগ্ধ কয়লাখ-।
স্বপ্নের সুরম্য অট্টালিকা মুহূর্তেই ধসে পড়ল। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল যতসব কল্পনা-জল্পনা। হাস্যোজ্জ্বল চেহারাগুলো নিমিষেই ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল।
। সাত।
বিপদে পড়লে খোদারে মনে পড়ে। বুঝতে বাকি নেই, আসমানী আযাব নিপতিত হয়েছে। তারা বলে উঠল- হায়, বঞ্চিত করতে গিয়ে তো আমরা নিজেরাই বঞ্চনার শিকার হলাম!
ভালো ভাইটি আবারও তাদের স্মরণ করিয়ে দিল- দেখ ভাই, আমি আগেই বলেছিলাম, তোমরা আল্লাহ-খোদার নাম নাও। কাউকে দিলে কখনোই কমে না। চর্মচক্ষে যদিও দেখা যায় কমে গেছে। কিন্তু অন্য অনেকভাবে অনেক বেশি পাওয়া যায়। দেখনি, বাবা কীভাবে বিলিয়ে চলতেন আর আল্লাহ পাকও তাঁকে কীভাবে ঢেলে দিতেন! কিন্তু না, তোমরা আল্লাহকে সঠিক উপলব্ধি করলে না। দানে আনে, দানে বাড়ে- এ সত্যকে উপেক্ষা করে চললে। কী আর জমাবে! এখন তো সব হারাতে বসেছ।
কিন্তু এ ভাইটি এ সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও যেহেতু অন্যদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি তাই আল্লাহর নিপতিত আযাব থেকে তারও রেহাই মিলল না।
সম্বিত ফিরে পেল তারা। সমস্বরে বলে উঠল- প্রভু হে! আমরা তোমাকে সঠিক উপলব্ধি করতে পারিনি। তোমার শানে আমাদের ধারণা ঠিক হয়নি। তুমি এরচে বহু ঊর্ধ্বে। তুমি মহা পবিত্র। দয়াময়! আমরা জুলুম করেছি। তোমার বান্দাদের বঞ্চিত করতে চেয়েছি। ফলে নিজেরাই বঞ্চিত হয়েছি। অন্যের উপর যেভাবে জুলুম করেছি তেমনি নিজের উপরও।
এভাবে তারা স্বীয় কৃতকর্মের জন্য সীমাহীন অনুশোচিত হল। অনুতপ্ত হয়ে তওবা করল।
। আট।
কোনো সমষ্টিগত কর্মের ফলাফল শুভ হলে এককভাবে এর কৃতিত্ব একজন লুফে নিতে চায়। কিন্তু সেই একই কাজে যদি অনাকাক্সিক্ষত পরিণাম দেখা দেয় তখন একে-অপরের কাঁধে দোষটা চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত রাখতে চায়। তাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটল না। একে অপরকে দুষতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই হুঁশ ফিরে এল- এভাবে আমরা বিবাদে লিপ্ত হয়ে ফের না আল্লাহর রহমত থেকে আরো ছিটকে পড়ি!
আবার তারা আল্লাহমুখী হল। কায়মনোবাক্যে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরল- দয়াময় হে! তোমার নাফরমানি করে ফেলেছি। তুমি রক্ষা না করলে আর উপায় নেই। দুনিয়াতে শাস্তি দিয়েছ। ইবরত গ্রহণ করেছি। আখেরাতের জন্য আর কিছু রেখে দিও না। সে শাস্তি যে আরো ভয়াবহ!
এভাবে তারা খুব কাঁদল। খুব তওবা করল। যেভাবে একজন মুমিনকে আল্লাহর শানে আশা রাখতে হয় তেমনি তারা আশান্বিত হয়ে বলল- আমরা যদি খাঁটি তওবা করতে পারি, আল্লাহমুখী হয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে পারি তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে এরচে অনেক ভালো কিছু দেবেন। দুনিয়াতে যা দেন, দেবেন। আখেরাতে তো অবশ্যই দেবেন।
আল্লাহ তাআলা তাদের তওবার বদলা দিলেন। বিস্তৃত ধূসর ময়দান ফের সজীব প্রান্তরে পরিণত হল। বাগানের পোড়া কয়লা গাছগুলো সবুজ সতেজ হয়ে উঠল। কিছুদিনের মধ্যেই কানন-উদ্যান-ময়দান ফুলে-ফলে-ফসলে ভরে উঠল।
বান্দার তওবায় আল্লাহ তাআলা খুশি হন। দুনিয়াতেই যদি এত দেন, তাহলে আখেরাতে...!
[দ্রষ্টব্য : সূরা ক্বলাম (৬৮) : ১৭-৩৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ও রূহুল মাআনী সংশ্লিষ্ট তাফসীর]
। নয়।
ঘটনাটি তৎকালীন আরব সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল। কাফেরদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা এদিকে ইঙ্গিত করেন। উদ্দেশ্য হল, বাহ্যিক শক্তি-সামর্থ্য এবং সক্ষমতায় প্রবঞ্চিত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এগুলো আল্লাহর দেওয়া নিআমত এবং পরীক্ষা। তাই অর্থশক্তি, পেশিশক্তি ও প্রতিপত্তিতে ধোঁকায় না পড়ে যিনি এগুলো দিয়েছেন তাঁর শোকরগোযার হওয়ার মাঝেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।
এখন চলো, কুরআনে বর্ণিত এ ঘটনাটি শোনা যাক কুরআনের ভাষায়-
اِنَّا بَلَوْنٰهُمْ كَمَا بَلَوْنَاۤ اَصْحٰبَ الْجَنَّةِ ۚ اِذْ اَقْسَمُوْا لَیَصْرِمُنَّهَا مُصْبِحِیْنَ. وَ لَا یَسْتَثْنُوْنَ. فَطَافَ عَلَیْهَا طَآىِٕفٌ مِّنْ رَّبِّكَ وَ هُمْ نَآىِٕمُوْنَ . فَاَصْبَحَتْ كَالصَّرِیْمِ. فَتَنَادَوْا مُصْبِحِیْنَ. اَنِ اغْدُوْا عَلٰی حَرْثِكُمْ اِنْ كُنْتُمْ صٰرِمِیْنَ. فَانْطَلَقُوْا وَ هُمْ یَتَخَافَتُوْنَ. اَنْ لَّا یَدْخُلَنَّهَا الْیَوْمَ عَلَیْكُمْ مِّسْكِیْنٌ. وَّ غَدَوْا عَلٰی حَرْدٍ قٰدِرِیْنَ. فَلَمَّا رَاَوْهَا قَالُوْۤا اِنَّا لَضَآلُّوْنَ. بَلْ نَحْنُ مَحْرُوْمُوْنَ. قَالَ اَوْسَطُهُمْ اَلَمْ اَقُلْ لَّكُمْ لَوْ لَا تُسَبِّحُوْنَ. قَالُوْا سُبْحٰنَ رَبِّنَاۤ اِنَّا كُنَّا ظٰلِمِیْنَ. فَاَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلٰی بَعْضٍ یَّتَلَاوَمُوْنَ. قَالُوْا یٰوَیْلَنَاۤ اِنَّا كُنَّا طٰغِیْنَ. عَسٰی رَبُّنَاۤ اَنْ یُّبْدِلَنَا خَیْرًا مِّنْهَاۤ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا رٰغِبُوْنَ.كَذٰلِكَ الْعَذَابُ ؕ وَ لَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَكْبَرُ ۘ لَوْ كَانُوْا یَعْلَمُوْنَ.
আমি তাদেরকে (মক্কাবাসীদেরকে) পরীক্ষায় ফেলেছি, যেমন পরীক্ষায় ফেলেছিলাম উদ্যান অধিপতিদেরকে। যখন তারা শপথ করেছিল, ভোর হওয়া মাত্র আমরা বাগানের ফল আহরণ করব। এবং (একথা বলার সময়) তারা কোনো ব্যতিক্রম রাখছিল না। (অর্থাৎ সীমাহীন আত্মম্ভরিতায় তারা আল্লাহ-খোদার নাম নিল না এবং বলল না ইনশাআল্লাহ।) অতঃপর ঘটল এই যে, তাদের উপর হানা দিল তোমার রবের পক্ষ থেকে এক বিপর্যয়, যখন তারা ঘুমিয়ে ছিল। ফলে তা দগ্ধ হয়ে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল। ভোর হতেই তারা একে অপরকে ডেকে বলল, তোমরা যদি ফসল সংগ্রহ করতে চাও তাহলে সকাল সকাল বাগানে চল। অতঃপর তারা চুপিসারে একে অন্যকে এই বলতে বলতে রওনা হল, আজ যেন কোনো মিসকীন তোমাদের কাছে এ বাগানে ঢুকতে না পারে। এবং তারা নিবৃত্ত করতে সক্ষম- এই মনোভাব নিয়ে বের হয়ে পড়ল। এরপর যখন তারা বাগানের অবস্থা দেখল, বলে উঠল, আমরা নিশ্চয়ই রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। (কিছুক্ষণ পর বলল, না,) বরং আমরা তো বঞ্চিত হয়েছি। তাদের মধ্যে যে সবচে ভালো ছিল, সে বলল, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, তোমরা তাসবীহ পড়ছ না কেন? তখন তারা বলল, আমরা আমাদের প্রতিপালকের তাসবীহ (তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা) করছি। নিশ্চয়ই আমরা জালেম (অপরাধী) ছিলাম। তারপর তারা একে-অপরের প্রতি দোষারোপ করতে লাগল। এরপর তারা (একযোগে তওবা করে) বলল, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো অবাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। অসম্ভব কিছু নয়, আমাদের প্রতিপালক এ বাগানের পরিবর্তে (দুনিয়াতে, না হয় আখেরাতে তো অবশ্যই, ইনশাআল্লাহ) আরো উত্তম উদ্যান আমাদের দান করবেন। আমরা অবশ্যই আমাদের রবের অভিমুখী হচ্ছি।
(আল্লাহ তাআলা বলেন) শাস্তি এমনই হয়ে থাকে। আর পরকালের শাস্তি তো আরো ভয়াবহ। যদি তারা (মক্কার কাফেররা) বুঝতে পারত! -সূরা ক্বলাম (৬৮) : ১৭-৩৩ হ