Safar 1443   ||   September 2021

অবিশ্রান্ত দাঈ শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ খোজা রাহ.
[জন্ম : ১৯৩১ ঈ. - মৃত্যু : ২০২১ ঈ.]
বার ও ক্যাসিনোতেও যিনি দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন

Waliullah Abdul Jalil

জাপানের রাজধানী টোকিও। এখানকার ঝলমলে রাতে কিছু এলাকা সারা রাত জেগে থাকে। ক্লাব-মদ-মৌজ-মাস্তির ঢেউ ওঠে সেখানে। সে ঢেউয়ে যেন কখনোই ভাটা পড়ার নয়। কিন্তু এমনটা হয় না। পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে জোয়ারের পর যেমন ভাটা আসে তেমনি ঝলমলে রাতের ঐ মৌজ-মাস্তিতেও ভাটা পড়ে। ফূর্তির চরমে থাকা মানুষগুলোর দেহ ক্লান্ত হয়ে আসে। প্রয়োজন পড়ে বিশ্রামের। মনে পড়ে নীড়ে ফেরার কথা। ফিরে যেতে হবে ঠিকানায়। কিন্তু সেই ঠিকানায় শান্তি নেই বলেই তো ডুব দিয়েছিল মদের নেশায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে নেশা ছুটে যাবে। পৃথিবী হয়ে উঠবে আগেরই মতো অশান্ত। ছুটে চলবে অশান্তি ভুলতে আবার সেই পঙ্কিল ঝলমলে জগতে। এভাবেই এক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে আরেক বড় অশান্তিতে ডুবতে থাকে ঝলমলে দুনিয়ার এ মানুষগুলো।

কে তাদেরকে শান্তির পথ দেখাবে? বের করে আনবে পঙ্কিলতার নর্দমা থেকে শান্তি ও পবিত্রতার সরোবরে। কে তাদেরকে বোঝাবে অশান্তি থেকে রক্ষা পেতে শান্তির পথে ছুটতে হয়। পথ সবসময় চেনা থাকে না, সবটুকু পথ একসঙ্গে দেখাও যায় না। তাই পথ চিনতে পথচেনা মানুষের সহায়তা নিতে হয়। পথের স্বল্প পরিচয়কে অবলম্বন করেই বাকি পথটুকু চিনতে হয় এবং সে পথ ধরে চলতে হয়। কিন্তু যন্ত্র যাকে উদ্ভ্রান্ত গতি দিয়েছে, বস্তুবাদ যখন হুঁশ কেড়ে নিয়েছে তখন পথ হারানোর অনুভূতিই বা আসবে কী করে? সে পথের সন্ধানই বা করবে কী করে? সে তো দিন দিন হারিয়ে যায় বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে।

এমন পরিস্থিতিতেই আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠান। বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে নিমজ্জমান মানবকূলকে তাঁরা তুলে আনেন মুক্তির রাজপথে। পৃথিবী এখন অন্তীম সময় পার করছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আর নবী-রাসূল আসবেন না। কিন্তু নবীজীর কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য তাঁর ওয়ারিসগণ আছেন, তাঁর উম্মত আছে। আজকে এমনই এক নবীর ওয়ারিসের কথা বলব। তিনি তৃতীয় সহস্রাব্দের ঝলমলে আধুনিক শহরে অভিনব পন্থায় লাখ খানেক মানুষকে অশান্তির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে শান্তি ও মুক্তির জীবনে নিয়ে এসেছিলেন। যাঁর কথা বলছি তিনি হলেন, শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ খোজা১। তাঁর দাওয়াতের পন্থা ছিল বেশ অভিনব। এ পদ্ধতির দাওয়াতের কথা যেদিন আলকাউসারের সম্পাদক মহোদয়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি একটি ভিজিটিং কার্ড ছাপেন। কার্ডে তাঁর ঠিকানা ও নয়টি ভাষায় কালেমা তায়্যিবার অর্থ লেখা ছিল। মদ-জুয়ার আসর শেষরাতে যখন ভেঙ্গে যেত তখন তিনি ঘর ফেরত মানুষকে দাওয়াত দিতেন। তার চেহারা ছিল ফর্সা। গাল ভর্তি ছিল দাড়ি। হাসির মধ্যে ছিল নূরানী সম্মোহন। মুচকি হাসির এ বুযুর্গের দাওয়াতে আধা নেশাশক্ত ঘরফেরত মানুষগুলো দাঁড়িয়ে যেত। তিনি তাদেরকে জাপানি ভাষায় সালাম দিতেন। তাদের বলতেন, ‘এ জগতের মাালিক মহান আল্লাহ। তোমরা ইসলামের পথে আসো।

এখনো সকাল হয়নি। ট্রেন আসতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। মাতালদের বড় একটি অংশ তাঁর পাশে জড়ো হয়ে যেত। ইসলামের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনত। এর মধ্যে বুযুর্গ মানুষটি তার পকেট থেকে কার্ড বের করে হাতে হাতে বিলি করতেন। তিনি জাপানিদের অনুরোধ করতেন কার্ডে লেখা কালিমা তায়্যিবা জোরে পড়তে। কেউ কালেমা পড়ে ফেলতে পারলে তার আনন্দ হতো দেখার মতো। একাজ তিনি প্রতিদিনই করতেন। পরিবর্তন হতো শুধু এলাকা। এভাবে তার হাতে দলে দলে জাপানি ইসলাম গ্রহণ করে। যে জন্য আরবরা তাঁকে মুজাহিদুল ইয়াবান-জাপানের মুজাহিদবলে স্মরণ করে।

তিনি প্রবাসী মুসলিমদের বলতেন, ‘দ্বীন-ইসলামের শিক্ষা নিজের মধ্যে ধারণ করুন এবং অন্যের সামনে ফুটিয়ে তুলুন। যেন জাপানিরা আপনাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। পরিচ্ছন্নতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তাঁর রাসূলেরই শুধু পছন্দ নয় জাপানিরাও পছন্দ করে। পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তুলে জাপানিদেরও প্রভাবিত করুন। মসজিদের বাইরে গাড়িগুলো এমনভাবে পার্ক করুন যেন এর মধ্যেও ইসলামের নিয়ম-শৃঙ্খলার শিক্ষা নজরে পড়ে। আপনারা যদি নিজেদের কাজ-কর্ম ও ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে জাপানিদের প্রভাবিত করতে না পারেন তাহলে ইসলামের শিক্ষা তাদের পর্যন্ত পৌঁছানো আরও অসম্ভব ব্যাপার।

তিনি জাপানিদের অনেক মূল্যায়ন করতেন। সবাইকে তাদের প্রতি খেয়াল রাখতে বলতেন। তিনি বলতেন, জাপানিরা আমাদের মূলধন, যাদের মাধ্যমে জাপানে ইসলাম প্রসার লাভ করতে পারে।

শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ষাটটিরও বেশি দেশ সফর করেন। মুসলমানদেরকে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুশীলন করতে বলতেন। আর অমুসলিমদের বলতেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে। ১৯৭৯ সালের কথা, জার্মানির বার্লিনে শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ তুর্কিদের এক মসজিদে বয়ান করছিলেন। দুই-তিন ঘণ্টা বয়ান করার পর শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আর লোকজন কোথায়?

শ্রোতারা বলল, তাদের কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন? আমাদেরকে বয়ান করুন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনে যাব।

শায়েখ বললেন, আমাকে বলো তারা কোথায়, আমি তাদের কাছে যেতে চাই।

শ্রোতারা জবাব দিল, তারা তো পানশালায়।

শায়েখ বললেন, আমি তাদের কাছে যাব। আমার সঙ্গে একজন রাহবার দাও।

শায়েখ রাহবারের সঙ্গে পানশালায় গেলেন। একেবারে তাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে মুজাহিদরা, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ!

তারা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। এখানে মুজাহিদ কোত্থেকে এল?

শায়েখ বললেন, তোমরাই তো মুজাহিদ। তিন কারণে তোমরা মুজাহিদ :

এক. তোমরা মুসলিম নাম নিয়ে জার্মানিতে চলা-ফেরা করছ। তোমাদের একেকজনের নাম, আহমদ, খলীল, ইবরাহীম ইত্যাদি। তোমাদের নামই তো মানুষকে ইসলামের কথা মনে করিয়ে দেয়।

দুই. তোমরা জার্মানিতে এসেছো মা-বাবা, সন্তান-সন্ততির জন্য হালাল রিজিকের সন্ধানে। এটাও তো এক প্রকার জিহাদ।

তিন. তোমরা উসমানীদের বংশধর। তারা ছিলেন মুজাহিদ। সে হিসেবে তোমরা তো মুজাহিদদের উত্তর পুরুষ।

এরপর শায়েখ বলতে লাগলেন, আমি মদিনা শরীফ থেকে এসেছি। সেখান থেকে তোমাদের জন্য সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। সুসংবাদ হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তোমরা এই কালেমা পড়লে তোমাদের দরুন আল্লাহ আমাকে প্রতিদান দেবেন।

সবাই সমস্বরে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে উঠল।

তিনি বললেন, বহু বছর ধরে আমি মসজিদে মানুষকে দ্বীনের কথা বলি। তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার কর্তব্য ছিল। যেমনিভাবে নবীগণ মানুষের সভা-সমাবেশে গিয়ে সত্যধর্মের দাওয়াত দিতেন।

শায়েখের কথায় সবাই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তারা শায়েখকে আরো কিছু বলতে অনুরোধ করতে লাগল। বলল, একটু বসুন, এখানকার ইট তো আর হারাম নয়।

শায়েখ বললেন, এখানে বসার অর্থ হল, হারাম কাজে সঙ্গ দেয়া। যাইহোক এখন তোমরা জান্নাতবাসী। এখন আমি অন্যদের দাওয়াত দিতে যাব।

তারা আরো কিছু বলতে অনুরোধ করল। শায়েখ বললেন, কতক্ষণ আর কথা বলব? তোমরা তো এখন পরকালের জান্নাতের বাসিন্দা, এখন আমি তোমাদেরকে দুনিয়ার জান্নাত মসজিদে ডাকছি। এরপর শায়েখ বললেন, তোমাদের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণে কি তোমরা সহায়তা করবে? শায়েখের অভিজ্ঞতা ছিল , যারা মদ পান করে তারা মসজিদে দানের বেলায় উদারহস্ত।

তারা সমস্বরে বলল, শায়েখ আমরা দান করব, আমরা দান করব। কিন্তু আমরা মসজিদে যাব কী করে? আমাদের মাঝে এমন মানুষও আছে, যার গোসলের প্রয়োজন।

শায়েখ বললেন, তারা মসজিদের গোসলখানায় গোসল করে নেবে। পানি ঠাণ্ডা। কিন্তু আমি তো ইতিপূর্বে বলেছি, তোমরা মুজাহিদ। শীতকালে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করা জিহাদের মধ্যে গণ্য।

তারা বলল, মাতালরা কী করবে?

শায়েখ বললেন, বেশি মাতালকে কম মাতাল দুজন উঠিয়ে নিয়ে যাবে।

তারা একে অপরকে উৎসাহিত করেছিল। বলছিল, আমরা না মুসলমান। চলো আমরা মসজিদে যাই।

শায়েখ চল্লিশজনকে নিয়ে মসজিদে গেলেন। তাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করল। কেউ বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। শায়েখ নিম্মোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করে তরজমা পড়তে লাগলেন-

قُلْ یٰعِبَادِیَ  الَّذِیْنَ  اَسْرَفُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ  لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَۃِ اللهِ ؕ اِنَّ اللهَ یَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِیْعًا ؕ اِنَّهٗ  هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِیْمُ .

বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

خِيَارُكُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِي الْإِسْلَامِ.

জাহিলিয়াতে তোমাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ ছিল ইসলামেও তারা শ্রেষ্ঠ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০২৯৬

তাদের কেউ কেউ বলল, শায়েখ আমাদের কিছু আত্মীয় অমুক পানশালায় আছে। চলুন তাদের কাছে যাই।

এই ঘটনার তিন বছর পরের কথা। শায়েখ মদীনার মসজিদে নববীতে বসা। শ্মশ্রুমণ্ডিত, জুব্বা, পাগড়ি পরা এক তুর্কি এসে সালাম দিয়ে বলল, শায়েখ আমাকে চিনতে পেরেছেন?

শায়েখ বললেন, চিনব না কী করে? আমি তো তুরস্কের অধিকাংশ শহর-গ্রাম ভ্রমণ করেছি। আপনি ওখানকার কোনো ইমাম বা মুফতী হয়ে থাকবেন।

আগন্তুক বলল, আমি আপনাকে ভালো করে চিনি। আপনি আমাকে হাজার বছর চেষ্টা করলেও চিনবেন না। আমি হলাম বার্লিনের সর্বশেষ মদ্যপ। যাকে দুই ব্যক্তি পানশালা থেকে উঠিয়ে মসজিদে নিয়ে গিয়েছিল। আপনি আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে তুমি অনেক দামি। তোমাকে তাঁর ঘরে কবুল করেছেন।আমি মাতাল হলেও আপনার কথা বুঝতে পারছিলাম। নেশা দূর হওয়া পর্যন্ত মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করি। এরপর গোসল করে নামায পড়ে আল্লাহর কাছে তওবা করলাম। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি নিয়মিত নামায পড়ি, ইবাদত করি। আমার স্ত্রীও এখন পর্দা করে। আমরা একসঙ্গে ওমরা করতে এসেছি। আল্লাহর শুকরিয়া যে, আল্লাহ আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন।

এমন ঘটনা শায়েখ নেয়ামতুল্লাহর জীবনে এক-দুবার ঘটেছে এমন নয়, তিনি নিয়মিত পানশালাগুলোতে গিয়ে হাজির হতেন। মাতালদেরকে মসজিদে নিয়ে আসতেন। তারা আন্তরিকভাবে তওবা করত। এদের মধ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ থাকত। তাঁর হাতে তাওবাকারী অনেকেই দ্বীনের দাঈ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তিনি যেমন দাওয়াত নিয়ে পানশালায় যেতেন তেমনি যেতেন জুয়াড়িদের আড্ডাখানায়। তাঁর দাওয়াতে এত মানুষ ইসলাম গ্রহণের কারণে কখনো যেন মনে একথা না আসে- আমি তাদের হেদায়েতের পথে আনছিসেজন্য তিনি নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন-

هُوَ الَّذِیْ یُصَلِّیْ عَلَیْكُمْ وَ مَلٰٓئِکَتُهٗ لِیُخْرِجَكُمْ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ ؕ وَکَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا.

তিনিই তোমাদের প্রতি রহমত করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও রহমতের দুআ করেন- অন্ধকার থেকে তোমাদেরকে আলোতে বের করার জন্য। তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৩

মজার কথা হল, তিনি জুয়াড়িদের দাওয়াত দেওয়ার সময় বলতেন, তোমাদের মাঝে তো নবী, সাহাবী ও আউলিয়ায়ে কেরামের গুণ আছে। কারণ, তোমরা তো শেষ রাত পর্যন্ত জেগে থাকো।

তখন সবাই জুয়ার টেবিল ছেড়ে দিত। অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে তার সঙ্গে মসজিদে যেত। তাদের কেউ বলতো, বাবা তো আমাকে আমপারা পুরোটাই মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি কেবলমাত্র লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ-এর মাধ্যমেই মানুষকে দাওয়াত দিতেন। তিনি বলতেন, এই কালিমা পড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তিনি এ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন নবীজীর ওই হাদীস থেকে-

يَا أَيّهَا النّاسُ، قُولُوا: لَا إِلهَ إِلّا اللهُ تُفْلِحُوا.

হে লোকসকল, তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহবলো, সফল হবে। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৫৯

এ পদ্ধতিতে তাঁর হাতে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে আছেন বিখ্যাত দাঈ আব্দুল্লাহ আল-ফ্রান্সি। তাঁর হেদায়েতের গল্প শুনুন তাঁর মুখ থেকেই-

ইসলাম গ্রহণের পূর্বের কথা। আমি জিব্রাল্টা (جبل الطارق) থেকে মরক্কোগামী প্লেনে উঠলাম। আমার পাশে বসা ছিল এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ মুসলমান। তাঁর দাড়ি ছিল ধবধবে সাদা। আমরা পরস্পর পরিচিত হলাম। আমি অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। তিনি আমাকে দুশ্চিন্তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি আমার ঘর ও কর্মস্থলের সমস্যার অনেক কথা বললাম। এসব কারণে আমার গভীর মানসিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব সময় আমাকে ওষুধ সেবন করতে হয়।

তিনি বললেন, আমি তোমাকে একটা পরামর্শ দেব, যেটা তোমার এসব ওষুধের চেয়ে বেশ কাজে দেবে।

আমি বললাম, ধন্যবাদ, কী সেটা?

বললেন, কয়েকটি শব্দ। প্রয়োজন হলে কয়েকবার আওড়াবে।

সত্য কথা হল, তার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কী করে কয়েকটি বাক্য ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকর হবে? কিন্তু কেন যেন আমি শায়েখকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তি নিয়েই আমার মন বলল, পরীক্ষা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই। তিনি আমাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহশিখিয়ে দিলেন।

একবার বলার পর সত্যি সত্যি প্রশান্তি বোধ করছিলাম। শায়েখকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। এরপর আমরা দুজন দুদিকে চলে গেলাম।

নিয়মিত আমি শব্দগুলো আওড়াতাম এবং হালকা ও আরাম বোধ করতাম। একসময় এর অর্থ জানতে ইচ্ছে হল। অনেককে জিজ্ঞেস করেও এর উত্তর পাইনি। অবাক করা ব্যাপার হল, আমি অন্যদেরকে এ শব্দগুলো শেখাতাম। তারা শব্দগুলো বলে পরিবর্তন অনুভব করত। কেউ অর্থ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আসলে আমি এর অর্থ জানি না। একদিন আমি অনেকের সামনে শব্দগুলো বললাম। এজন্য যে এর মধ্যে জাদুকরী উপশম আছে। তাঁদের মধ্যে এক ইহুদী যুবক ছিল। সে বলল তুমি কি মুসলিম?

আমি বললাম, না।

সে বলল, এ শব্দগুলো তো মুসলমানরা বলে থাকে।

তার কথায় আমি যেন ধনভাণ্ডার খুঁজে পেলাম। জানতে পারলাম, মুসলমানদের নির্ধারিত জায়গা আছে, যেখানে তারা সমবেত হয়। সে স্থানটিকে তারা মসজিদ বলে থাকে। একদিন সবচেয়ে কাছের মসজিদে গেলাম। ইমাম সাহেবকে এ বাক্যের অর্থ জিজ্ঞেস করলাম। ইমাম সাহেব সরল অর্থ বলে দিলেন। আমি তখন আনন্দের চূড়ান্ত সীমায়।

ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কালিমায়ে তাওহীদ নিয়ে এ আগ্রহের কারণ কী?

তখন সবকিছু খুলে বললাম। এরপর দীর্ঘ একটি সময় এই ইমামের সাহচর্য গ্রহণ করলাম। তিনি আমাকে ইসলামের ব্যাখ্যা বললেন। ইসলামের সৌন্দর্য আমার সামনে তুলে ধরলেন। আলহামদু লিল্লাহ আমি এখন মুসলিম। আমার পুরোনো নাম বদলে নাম রাখলাম আব্দুল্লাহ। মানুষ এখন আমাকে আব্দুল্লাহ আল-ফ্রান্সি নামে চেনে।

বিশিষ্ট দাঈ সালেহ মাহদী আসসামাররাবী বলেন, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারির কথা। শতাধিক জাপানি শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ে ইসলামিক সেন্টার জাপান দাওয়াতি সভার আয়োজন করে। উস্তায আলী আয-যুবী ইসলাম সম্পর্কে বক্তৃতা করেন এবং দুঘণ্টাব্যাপী প্রশ্নের উত্তর দেন। আমাদের সেন্টার এবং সারা দুনিয়ার অন্যান্য সেন্টার কী করে? আমরা সবাই এপর্যন্ত এসে থেমে যাই। এরচেয়ে অগ্রসর হয়ে কিছু করলে যা করে তা হল, কিছু প্রচার-পত্র, ছোট পুস্তিকা বিতরণ করে। ফলে দুএকজন ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু শায়েখ নেয়ামতুল্লাহর স্বতন্ত্র ও ফলপ্রসূ একটি পদ্ধতি আছে। এই ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়। উস্তায আলী আয-যুবীর বক্তৃতার পর শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ রাহ. সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়াতে বিশ্বাস করে এবং মুখে বলবে সেইতো মুসলিম।

একথা শুনে সবাই কালেমা পড়তে প্রস্তুত হয়ে গেল। শায়েখ তৎক্ষণাৎ সবাইকে একসঙ্গে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ পড়ালেন । শতাধিক মানুষের ইসলামী নাম কিভাবে দেওয়া হবে তা নিয়ে শায়েখ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তখন বুদ্ধি করে বললেন, All men Mohamaed, All women Fatima.

যারা পুরুষ আছে তাদের প্রত্যেকের নাম মুহাম্মদ। আর নারীদের প্রত্যেকের নাম ফাতিমা।

শায়েখ নেয়ামাতুল্লাহ খোজার জন্ম ১৯৩১ সালে উত্তর তুরস্কের আমাসিয়া প্রদেশের তাশোফা অঞ্চলে। তাঁর বাবার নাম ইব্রাহীম। মায়ের নাম খাতুন য়ুর্ত। অল্প বয়সেই শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ বাবার সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের মজলিসে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৫৫ সালে ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমদ জামে মসজিদে মুআযযিনের দায়িত্ব পালন করেন। বাবার সঙ্গে মক্কা শরীফে চলে যাওয়ার পূর্বে সহকারি ইমামের দায়িত্বও পালন করেন। মক্কায় তিনি ৩৩ বছর ছিলেন। জাবালে নূরের কাছে এক মসজিদে ইমামতি করেন।

তিনি ছয়টি ভাষা জানতেন। ১৯৮১ সালে চীনে তিনি ২০,০০০ কপি মুসহাফ (কুরআন) পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। তার বন্ধু ওমর ফারুক উজাক জাদাহ আনাদুল এজেন্সিকে বলেন, তিনি তুর্কি, আরবী, ফারসি, জাপানি ও ইংরেজি ভাষা এতটুকু আয়ত্ত করেছিলেন, যতটুকু দিয়ে সহজেই দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। তিনি প্রায় বেদনা নিয়ে বলতেন, ‘কিয়ামতের দিন নবীজীর চেহারার দিকে কী করে তাকাব?! আমাদের কর্তব্য, পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া।

উজাক জাদাহ বলেন, শায়েখ নেয়ামতুল্লাহ জাপানে ৪০১টি মসজিদ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। তিনি জাপানী টেলিভিশনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে এক লাখেরও বেশি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।

হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ইস্তাম্বুলের একটি হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়। অসুস্থতা সত্ত্বেও মসজিদে দরস বন্ধ করেননি। ছয় মাস আগে অবস্থার অবনতি হলে ইস্তাম্বুলের একটি সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকেন। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০২১ শনিবার অবিশ্রান্ত এ দাঈ মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দেন। রবিবার দিন আলফাতিহ মসজিদে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আইয়ুব সুলতান কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন- আমীন। হ

 

advertisement