যখন আমি সর্বপ্রথম আমেরিকায়
[পাঁচ মিনিটের একটি আলোচনা। ১৯৭৮ সনে হযরত সর্বপ্রথম আমেরিকা সফর করেন। সেই কারগুযারি উল্লেখ করেছেন বয়ানটিতে। দিলের দরদ নিয়ে বলেছেন, কীভাবে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করা যায়। সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্য। সকল অভিভাবকের জন্য, বিশেষ করে পশ্চিমে পাড়ি জমানো প্রবাসী বন্ধুদের জন্য রয়েছে এতে চিন্তা ও শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ভিডিও ক্লিপ থেকে আলোচনাটির অনুবাদ পাঠকের খেদমতে পেশ করা হল।]
আমি আপনাদেরকে একটি অভিজ্ঞতার গল্প শোনাই। ১৯৭৮ সাল, আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। সর্বপ্রথম আমার আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ হয়। সেখানকার মুসলিম সংগঠনগুলোর একটি জোট ছিল। তাদের বাৎসরিক কনভেনশনে আমার দাওয়াত আসে। আমি তাতে অংশগ্রহণ করি।
অনুষ্ঠানে গিয়ে যেন আমি আসমান থেকে পড়ি। মুসলমানদের অনুষ্ঠান। রাতের বেলার প্রোগ্রাম। অথচ উপস্থিত ব্যক্তিদের মাঝে দ্বীনের ন্যূনতম কোনো আলামত দেখা যাচ্ছিল না। মানে ইসলামের লেশমাত্র তাদের মাঝে নেই। যুবতীদের অর্ধনগ্ন বিচরণ। নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা। একসাথে সবাই বসে আছে।
এরপর আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, খাবারের সময় ঘোষণা এলÑ যারা হালাল খাবার গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারা মাছ খেতে পারেন। মানে মুসলমানদের প্রোগ্রাম হলেও তাতে হালাল খাবারের বাছবিচার নেই। আমাদের জন্যে সেই মজলিসে বসাটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে আমরা পৃথক একটি জায়গায় চলে গেলাম। এরপর শুনেছি, সেই প্রোগ্রামে নাচগানের পর্বও ছিল। তাদের কী যেন একটা ভোটাভুটির ব্যাপার ছিল। তো সেখানে ভোটাভুটিও হয় এবং কনসার্টও হয়। গোটা উপস্থিতি সেই কনসার্টেই বুঁদ হয়ে থাকে।
এসব দেখে তো আমি সীমাহীন হতবাক! আমাদের যিনি মেযবান ছিলেন, তিনি এই প্রোগ্রামের কর্তাব্যক্তিত্বও, এক লেবাননী আরব, তার কাছে আমি আপত্তি তুললামÑ ভাই, এ কী হালত! আপনি মুসলিম সংগঠন করেন। মুসলমানদের একত্র করে প্রোগ্রাম করছেন। কিন্তু এগুলো কোন্ ধরনের কথা! এখানে তো ইসলামের ন্যূনতম কোনো আলামত নজরে পড়ছে না। অথচ এটা কি না মুসলমানদের প্রোগ্রাম! আপনি কী কারণে এমন প্রোগ্রামের আয়োজন করতে গেলেন?
আমার এমন প্রশ্নে তার চোখে পানি চলে এল। তিনি আমাকে বললেনÑ মাওলানা, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে এরা এমন এক সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে, এখন এদের ব্যাপারে আমাদের কেবল এতটুকুই আশাÑ এরা যেন অন্তত নিজেদেরকে মুসলিম ইউনিটির সদস্য মনে করে। এরা নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিকÑ আপাতত আমরা শুধু এতটুকুই চাই। এখন যদি কমসে কম তারা নিজেদের ‘মুসলিম’ ভাবতে থাকে তাহলে আমরা নিজেদেরকে সফল মনে করব। নতুবা আপনি যা দেখছেন তাই, ইসলামের সাথে এদের ন্যূনতম সম্পর্কটুকুও নেই। এদের বাপ-দাদারা রুটি-রুজির তালাশে, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যে এখানে পাড়ি জমিয়েছিল। সন্তানদের তালীম-তরবিয়তের ব্যাপারে তাদের কোনো ফিকির ছিল না। এমনই ধর্মহীন পরিবেশে তারা বেড়ে উঠেছে। ফলে আজ তাদের মাঝে ইসলামের দূরবতীর্ কোনো আলামতও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমাদের প্রচেষ্টা কেবল এতটুকুই, আপাতত এদেরকে এই শিরোনামে একত্র করাÑ ভাই, তোমরা মুসলমান। নিজেদেরকে মুলিম বলে তোমরা পরিচয় দিতে থাক। ব্যস এতটুকুই। নতুবা বাস্তবতা তাই, যা আপনি বললেনÑ মুসলিম শব্দের সাথে নামের সম্পর্ক ব্যতীত ইসলামের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা এই নামের সম্পর্কটুকুর সাথেই তাদের বেঁধে রাখতে চাচ্ছি।
১৯৭৮ সনে এ দৃশ্য আমি স্বচক্ষে দেখি। আমার তখন উপলব্ধি হয়, মুসলিম অভিভাবকগণ যদি নিজের সন্তানদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের তালীম-তরবিয়তের প্রতি মনোযোগী না হন, তাহলে আল্লাহ না করুন আল্লাহ না করুন, আমার প্রবল আশঙ্কা হয়, তারা আবার না মুরতাদ হয়ে বসে। আল্লাহ না করুন, আমাদের উদাসীনতা এবং অবহেলার দরুন যদি পরবর্তী প্রজন্ম গোমরাহ হয়ে বসে তাহলে এর খেসারত আমাদেরকেই দিতে হবে। কুরআনে কারীমে তো আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এসেছেÑ
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ اَهْلِیْكُمْ نَارًا.
হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর। Ñসূরা তাহরীম (৬৬) : ৬
শুধু নিজের জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিবারকে রক্ষা করাও তার নিজেরই দায়িত্ব। আমাদের বাপ-দাদাদের মেহনত ও কুরবানীতে আজ আমরা ঈমান ও ইসলামের নিআমত উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে গিয়েছি, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ না করুন, আমাদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে যদি আমাদের প্রজন্ম বিপথগামী হয়ে পড়ে তাহলে এরচে লজ্জার আর আফসোসের কথা আর কী হতে পারে! কাজেই এ বিষয়টির প্রতি যতটা মনোযোগী হওয়া দরকার আমরা ততটা খেয়াল করছি না।
আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী, এখন অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকাতেও মুসলমানগণ এর প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। এখন সেখানে বড় বড় দ্বীনী প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। কিন্তু যতটুকু গুরুত্বের সাথে বিষয়টি আমলে নেওয়া দরকার সেক্ষেত্রে আরো ঘাটতি রয়েছে। আমি এর একমাত্র নিরাময় এতেই মনে করি, নতুন প্রজন্মের জন্য যার যার অন্তরে এ দরদ-ব্যথা রয়েছে তারা যেভাবেই হোক এ ধরনের (বহুমুখী দাওয়াতী এবং তালীমী) দ্বীনী প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করবেন এবং সার্বিকভাবে এর সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন। আর নিজেদের সন্তানদেরকে সেসকল প্রতিষ্ঠানের সাথে জুড়ে রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দেবেন।
ভাষান্তর :
মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর