মির্যা কাদিয়ানীর বৃটিশ তোষণ
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে আমাদের এ ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের আগমন এবং বণিকের বেশে ধীরে ধীরে এখানকার শাসনক্ষমতায় আরোহণ, অতঃপর পর্যায়ক্রমে এ মাটির বুক থেকে ইসলামের নাম চিরতরে মুছে ফেলার হীন লক্ষ্যে তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও চক্রান্তের ইতিহাস কমবেশী প্রায় সব শিক্ষিতজনেরই জানা আছে। উপমহাদেশের ইতিহাসের এ এক বেদনাদায়ক অধ্যায়, যা লিখিত হয়েছে মুসলমানদের তাজা রক্তে।
সুদীর্ঘ প্রায় দুইশ বছর তারা এই উপমহাদেশ শাসন করেছে। ইতিহাস সাক্ষী- ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য তারা অনেক মসজিদ-মাদরাসা গুড়িয়ে দিয়েছে। শহীদ করেছে শত শত আলেমেদ্বীনকে। তাদের পাশবিক নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে মানবতা হয়ে পড়েছিল বিধ্বস্ত, বাকরুদ্ধ এবং চরম অসহায়। মুসলমানদের প্রতি সীমাহীন অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে তারা এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ও সাম্রাজ্যের ভিতকে দৃঢ় ও পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় তাদের সে জুলুমের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
এ দীর্ঘ সময়ে তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। কখনও তার আত্নপ্রকাশ ঘটেছে ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে; যার নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ববাংলার হাজ্বী শরীয়তুল্লাহ রাহ.। কখনও তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন পশ্চিমবাংলার মাওলানা নেছার আলী ওরফে ‘তিতুমীর’ রাহ.। যে তিতুমীরের ‘বাঁশের কেল্লা’-র কথা আমরা সকলেই জানি। এরূপ আরও অনেক সংগ্রামী সাধক এ পথে নিজের জীবনোৎসর্গ করেছেন। যাদের অবিরাম সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কারণেই বৃটিশ বেনিয়ারা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
ইতিহাস সাক্ষী, এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতা লুট করার জন্য এবং মুসলমানদের প্রতিরোধ-আন্দোলনকে দমন করার জন্য ইংরেজরা মীর জাফর ও মীর সাদেকের ন্যায় অনেক বিশ্বাসঘাতককে ব্যবহার করেছে। যারা নিজ জাতি ও ধর্মের সাথে গাদ্দারী করে ইংরেজ বেনিয়াদের সহোযোগিতা করে। ফলে ভারতবর্ষে তাদের আগ্রাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকড় দৃঢ় ও মজবুত হয়ে যায়।
এতকিছুর পরও যখন তাদের বিরূদ্ধে ক্ষণেক্ষণে প্রতিরোধ আন্দোলন চলতেই থাকে এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে মুসলমানদের বুকের ভেতরের দীর্ঘদিনের ছাইচাপা আগুনের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখন তারা আন্দোলনের এ ধারা চিরতরে বন্ধ করার জন্য নতুন এক জঘন্য কৌশল বেছে নেয়। তারা ভেবে দেখল, ভারতবর্ষের মুসলমানরা অত্যন্ত ধর্মভীরু। আল্লাহ ও রাসূলের কথার সামনে তারা সবকিছু বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা মানলে শুধু তাদের নবীর কথাই মানে। কারণ, নবীদের মুখের কথা সাধারণ কথা নয়; তা স্বয়ং খোদার তরফ থেকে আগত ওহী। আর ওহীর নির্দেশ পালন মুসলমানদের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ ফরয বিধান। অতএব, যদি কাউকে ব্যবহার করে ওহীর দোহাই দিয়ে ইংরেজদের পক্ষে কথা বলানো যায় এবং মুসলমানদেরকে বৃটিশ শাসনের আনুগত্যের দীক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে জনসাধারণের মনের বৃটিশবিদ্বেষ কিছুটা লঘু করা সম্ভব হতে পারে।
এ নীলনকশা বাস্তবায়নে তারা নির্বাচন করল পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাশপুর জেলার কাদিয়ান নামক গ্রামের এক ব্যক্তিকে। যার নাম মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। যে ব্যক্তি ইংরেজদের ছত্রছায়ায় তাদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নবুওতের দাবি করে। অথচ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই শেষ নবী। তাঁর পরে কোনো ব্যক্তি নবুওতের আসনে অধিষ্ঠিত হবে না। তাঁর পরে যে কোনো ধরনের নবুওতের দাবিদার নিঃসন্দেহে কাফের ও বেঈমান। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে সকল যুগের মুসলিম উম্মাহর আকীদা-বিশ্বাস এটাই ।
মির্যা কাদিয়ানীর নবুওত দাবি
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী স্পষ্ট ভাষায় নবুওতের দাবি করেছে। কখনও বলেছে-
“আমার দাবি হল, আমি নবী ও রাসূল।” -মালফুযাত ৫/৪৪৭ নতুন সংস্করণ, ১০/১২৭ পুরাতন সংস্করণ
মির্যা কায়িানীর স্বলিখিত পুস্তিকা দাফেউল বালাতে লিখেছে-
“প্রকৃত সত্য খোদা তিনিই, যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল প্রেরণ করেছেন।” -দাফেউল বালা (বাংলা, পৃ. ১২), রূহানী খাযায়েন ১৮/২৩১
অন্যত্র বলেছে-
“আমি ঐ খোদার কছম করে বলছি, যার হাতে আমার জীবন, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম নবী রেখেছেন।” -তাতিম্মা হাকিকাতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন ২২/৫০৩
মির্যা কাদিয়ানীর এজাতীয় আরও অনেক বক্তব্য আছে, যেখানে সে নিজেকে নবী আখ্যা দিয়েছে। তার দাবিদাওয়ার তালিকা অনেক লম্বা। শুরুতে মুজাদ্দিদ, মামূর মিনাল্লাহ, মুলহাম, পর্যায়ক্রমে যুগ ইমাম, ইমাম মাহদী ও ঈসা ইবনে মারইয়াম হওয়ার দাবি করেছে। অবশেষে নবুওতের দাবি করেছে।
বক্ষমান প্রবন্ধে এটি আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা এখানে আলোচনা করব, কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় মির্যা কাদিয়ানী দাবিদাওয়া করার ও স্বতন্ত্র দল গঠনের প্রয়াস পেয়েছে। আর তাদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সে আমৃত্যু সাধনা করে গেছে।
[উল্লেখ্য, এই প্রবন্ধে যত উদ্ধৃতি আছে তার সবই মির্যা গোমাল আহমদ কাদিয়ানী ও তার খলিফাদের লিখিত বই-পুস্তক থেকে সরাসরি উদ্ধৃত হয়েছে। আর রূহানী খাযায়েন হল, মির্যা কাদিয়ানীর লিখিত পুস্তকসমূহের সমগ্র বা সমষ্টির নাম।]
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার গোটা জীবন অতিবাহিত করেছে বৃটিশ তোষামোদ, চাটুকারিতা ও গুণকীর্তন করে। তার স্বলিখিত এমন কোনো গ্রন্থ নেই, যেখানে সে বৃটিশের গুণগান করেনি। সে নিজেই বলেছে-
“সুদীর্ঘ এই সতের বছর ধরে আমি যে পরিমাণ গ্রন্থ রচনা করেছি, তার সবগুলোতেই বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের প্রতি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করেছি।” -কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন ১৩/৬-৭
বাস্তবে ঘটেছেও তা-ই। সে তার প্রতিটি গ্রন্থেই মুসলমানদেরকে জালেম বৃটিশের আনুগত্যের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা এখানে তার কয়েকটি মাত্র বক্তব্য তুলে ধরছি। পাঠকমাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, আসলেই মির্যা কাদিয়ানী ও তার দল বৃটিশ কর্তৃক সৃষ্ট, তাদের মদদপুষ্ট এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগী।
বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের আহ্বান
যুগে যুগে যখনই নবীগণ এসেছেন সমকালীন অত্যাচারী শক্তির মোকাবেলা করেছেন। তারা তাগুতের সামনে কখনো মাথা নত করেননি। বাতিলের সামনে হকের কালিমা বলতে বিন্দুমাত্র ভয় পাননি ও বিচলিত হননি। তারা ভয় পেতেন একমাত্র আল্লাহকে। কোনো জালিমশাহীর তোষামোদ ও চাটুকারিতা তারা করেননি। পরোয়াও করেননি।
ভারতবর্ষে বৃটিশ বেনিয়াদের স্বেচ্ছাচার এবং মুসলমানদের উপর তাদের অবর্ণনীয় নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। নবুওতের মিথ্যা দাবিদার মির্যা কাদিয়ানী মুসলমানদের চির শত্রু বৃটিশ বেনিয়াদের চাটুকারিতা ও তোষামোদের জন্য যে ভাষা-শব্দ ব্যবহার করেছে তা যে কোনো ভদ্র ও আত্মমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির মনেই ঘৃণার উদ্রেক করবে।
মির্যা কাদিয়ানী তার অনুসারীদেরকে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের আনুগত্যের দীক্ষা দিতে গিয়ে বলছে-
نہایت تاکید سے نصیحت کرتا ہوں کہ وہ میری اس تعلیم کو خوب یاد رکھیں۔ جو تقریبا ২৬برس سے تقریری اور تحریری طور پر ان کے ذہن نشین کرتا آیا ہوں۔ یعنی یہ کہ اس گورنمنٹ انگریزی کی پوری اطاعت کریں۔ کیونکہ وہ ہماری محسن گورنمنٹ ہے۔ ان کی ظل حمایت میں ہمارا فرقہ احمدیہ چند سال میں لاکھوں تک پہنچ گیا ہے
আমি (আমার অনুসারীদেরকে) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উপদেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন আমার সেই নসীহত ভালোভাবে মনে রাখে, যা প্রায় ২৬ বছর যাবৎ আমি বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে তাদের দিল-দেমাগে বদ্ধমূল করে আসছি। তা হল, তারা পরিপূর্ণরূপে এই ইংরেজ সরকারের আনুগত্য করবে। কেননা তারা আমাদের কল্যাণকামী সরকার। তাদের সাহায্য-ছায়ায় থেকেই আমাদের জামাতে আহমাদিয়া (কাদিয়ানী সম্প্রদায়) মাত্র কয়েক বছরে কয়েক লাখে পৌছে গেছে। -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/৭০৮, নতুন সংস্করণ, ৩/৫৮২ পুরাতন সংস্করণ
মির্যা কাদিয়ানীর এ বক্তব্যে একথা সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে যে, কাদিয়ানী জামাত বৃটিশদের ছত্রছায়ায় ও তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে সামনে অগ্রসর হয়েছে।
বৃটিশ সরকারের উপর মির্যা কাদিয়ানীর অবদান
মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে-
“আমার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে এই ইংরেজ সরকারের সাহায্য ও তাদের সমর্থন কুড়িয়ে। আমি জিহাদের বিরুদ্ধে ও ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের বিষয়ে এত বিপুল পরিমাণ গ্রন্থ রচনা করেছি এবং প্রচারপত্র বিতরণ করেছি, যে গ্রন্থ ও প্রচারপত্রগুলো যদি এক স্থানে একত্রিত করা হয় তাহলে তা দ্বারা ৫০ টি আলমারি ভরে যাবে। আর এগুলো আমি সকল আরবদেশে; মিশর, সিরিয়া ও কাবুলে এবং রোমদেশ পর্যন্ত পৌছে দিয়েছি। সর্বদাই আমার চেষ্টা ছিল, যেন মুসলমানরা এই বৃটিশ সরকারের হিতাকাক্সক্ষী হয়ে যায়। -তিরয়াকুল কুলুব, রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৫-১৫৬
বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য বায়আতের অন্যতম শর্ত
মির্যা কাদিয়ানীর হাতে কেউ বায়আত হতে চাইলে তার জন্য এই শর্ত জুড়ে দিত যে, বৃটিশদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য করতে হবে। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে-
“আমি একজন শান্তিপরায়ণ মানুষ। (বৃটিশ) সরকারের আনুগত্য ও আল্লাহর বান্দার প্রতি সহানুভূতি-ই হল আমার নীতি। আর এটা এমনই এক নীতি, যা আমার মুরীদদের বায়আতের জন্য পূর্বশর্ত।” -কিতাবুল বারিয়্যাহ, রূহানী খাযায়েন ১৩/১০
বৃটিশ-আনুগত্য মুসলমানদের উপর ফরয!
মির্যা কাদিয়ানীর আকীদামতে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনীয়াদের আনুগত্য করা দেশের প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয। মির্যা কাদিয়ানী লিখেছে-
“আমি এখানে মুসলমানদেরকে নসীহত করছি। তাদের উপর ফরয, তারা যেন আন্তরিকভাবে (বৃটিশ) সরকারের আনুগত্য করে।” -লেকচার লুধিয়ানা (বাংলা, পৃ. ২৯), রূহানী খাযায়েন ২০/২৭২
বৃটিশদের অবাধ্যতা পাপ
মির্যা কাদিয়ানীর দাবি, যেহেতু মুসলমানদের জন্য বৃটিশদের আনুগত্য করা ফরয তাই তাদের অবাধ্যতা গোনাহের কারণ। মুসলমানদের জন্য এই ফরয অলঙ্ঘনীয়। মির্যা লিখেছে-
“মুসলমানদের জন্য ফরয হল, তারা যেন এই বৃটিশ সরকারের একনিষ্ঠ হিতাকাক্সক্ষী হয়ে যায় এবং তাদের জন্য নিজের জীবনোৎসর্গকারী হয়ে যায়। আর এই ফরয ত্যাগ করলে তারা গোনাহগার হবে।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত- ২/৩৫৫ নতুন সংস্করণ, ৩/১৪০ পুরাতন সংস্করণ
ইসলামের দুটি অংশ!
মির্যা কাদিয়ানী বলেছে, ইসলামের অংশ দুটি। আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও বৃটিশদের আনুগত্য। লিখেছে-
“বারবার আমি আমার যে নীতি প্রকাশ করেছি তা হল, ইসলামের দুটি অংশ : এক. আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা। দুই. যে সরকার (সমাজে) নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপন করেছে (!!) এবং জালেমদের কবল থেকে রক্ষা করে আমাদেরকে নিজেদের আশ্রয়ে নিয়েছে সে সরকারের আনুগত্য করা। আর তারা হল, বৃটিশ সরকার।” -শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০
বৃটিশ সরকার খোদার রহমত!
বৃটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কারো অজানা নয়। তারা জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা লুণ্ঠন করেছে। মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংস করেছে। মুসলমানদের সন্তানদের ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ নষ্ট করার হীনচেষ্টা করেছে। তাদের ছত্রছায়াতেই পুরো ভারতবর্ষজুড়ে খ্রিস্টানমিশনারী ও পাদ্রীদের অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ভূখণ্ডে তাদের আধিপত্য ছিল মুসলমানদের জন্য আসমানী আযাব। ভারতবর্ষের সবাই জানত, বৃটিশরা আল্লাহর দুশমন। আল্লাহর রাসূলের দুশমন। ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন। তারা কখনও মুসলমানদের বন্ধু ও কল্যাণকামী হতে পারে না। অপরদিকে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বক্তব্য হল, উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন মূলত খোদার রহমত, নিআমত ও তাঁর পক্ষ থেকে বরকতস্বরূপ। লক্ষ করুন-
گورنمنٹ انگلشیہ خدا کی نعمتوں سے ایک نعمت ہے۔ یہ ایک عظیم الشان رحمت ہے۔ یہ سلطنت مسلمانوں کے لئے آسمانی برکت کا حکم رکھتی ہے۔
ইংরেজ সরকার খোদার অসংখ্য নিআমতের অন্যতম নিআমত। এটা মহামর্যাদাপূর্ণ এক রহমত। আর এ সরকার মুসলমানদের জন্য আসমানী বরকততুল্য। -শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮৮-৩৮৯
আরো লিখেছে-
“প্রকৃতপক্ষে বৃটিশ সরকারের অস্তিত্ব খোদার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য এক নিআমত ছিল, যা আমরা পেয়েছি দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পরে। তাই এই নিআমতের বারবার আলোচনা করা আমাদের কর্তব্য।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/১৯১ নতুন সংস্করণ, ৩/১২ পুরাতন সংস্করণ
বৃটিশ সরকার আল্লাহর পক্ষ থেকে ঢালস্বরূপ
বৃটিশ সরকারকে সে নিজেদের জন্য ঢাল আখ্যা দিয়েছে। যেমনিভাবে ঢাল মানুষকে আপতিত হামলা থেকে রক্ষা করে তেমনি বৃটিশরাও কাদিয়ানীকে সব ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে; এই বিশ্বাস নিয়েই কাদিয়ানী বলেছে-
سو انگریزی سلطنت تمہارے لئے ایک رحمت ہے، تمہارے لئے ایک برکت ہے اور خدا کی طرف سے تمہاری سپر ہے پس تم دل و جان سے اس سپر کی قدر کرو۔
সুতরাং ইংরেজ সরকার তোমাদের জন্য (আল্লাহর) রহমতস্বরূপ। তোমাদের জন্য তা এক বরকত এবং তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তোমাদের সুরক্ষার ঢাল। (যা তোমাদের উপর নিপতিত হামলা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করবে -সংকলক)। সুতরাং তোমরা মনেপ্রাণে এই ঢালের কদর কর। -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/৭০৯ নতুন সংস্করণ, ৩/৫৮৪ পুরাতন সংস্করণ
আরো লিখেছে-
خداوند رحیم نے اس سلطنت کو مسلمانوں کے لئے ایک باران رحمت بھیجا ۔
মহান রাব্বুল আলামীন ইংরেজ সরকারকে তোমাদের কল্যাণে রহমতের বারিধারার ন্যায় প্রেরণ করেছেন। -শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮৯
মির্যা কাদিয়ানীর আলোচিত বক্তব্যগুলোর কোনো ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। স্পষ্ট ভাষায় সে বৃটিশ সরকারকে আল্লাহর রহমত, নিআমত এবং বরকত আখ্যা দিয়েছে। আর কোনো নিআমত লাভ করার পরে তার শুকরিয়া জানানোও তো কর্তব্য! তাই সে ঘোষণা করল- এই ‘নিআমত’-এর শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক!
বৃটিশ সরকারের শুকরিয়া
যেহেতু মির্যা কাদিয়ানী ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নিকট বৃটিশ সরকার ছিল খোদা তাআলার এক মহান নিআমত, তাই সে এই নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের প্রতি তাগিদ করতে গিয়ে লিখেছে-
“উপমহাদেশের সকল মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক হল তারা যেন মহান ইংরেজ জাতির শাসনকে খোদার নিআমত মনে করে। আর যেমনিভাবে তারা অন্য নিআমতরাজির শুকরিয়া আদায় করে, তেমনি (বৃটিশ শাসনের) এই নিআমতেরও যেন শুকরিয়া আদায় করে।” -বারাহীনে আহমদিয়া (বাংলা, খ. ৩, পৃ. ১০), রূহানী খাযায়েন ১/১৪০
বৃটিশদের অকৃতজ্ঞতা নিমকহারামী!
যারা নিজেদের জান বাজি রেখে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলন করেছে তাদেরকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাদের বীরত্ব উপমা হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। অথচ তাদেরকে-ই মির্যা কাদিয়ানী অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম বলেছে। লিখেছে-
“পাঞ্জাবের মুসলমানেরা খুবই অকৃতজ্ঞ প্রমাণিত হবে, যদি তারা (ইংরেজদের) এই শাসনকে আল্লাহ তাআলার এক মহা নিআমত মনে না করে। বস্তুত তাদের জন্য এটি (খোদার) এক অসীম রহমত।” -বারাহীনে আহমাদিয়া (বাংলা, খ. ৩, পৃ. ১০), রূহানী খাযায়েন ১/১৪০
আরও বলেছে-
“আল্লাহ তাআলা রহমতের বারিধারার ন্যায় এই (ইংরেজ) সরকারকে আমাদের শান্তির জন্য প্রেরণ করেছেন। এরপরেও যদি আমরা এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় না করি তাহলে তা হবে মারাত্মক ধরনের নিমকহারামী। এই নিআমতের মহত্ব ও তাৎপর্য তো আমাদের শিরা-উপশিরায় ও মনেপ্রাণে অঙ্কিত হয়ে আছে।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/১৯১ নতুন সংস্করণ, ৩/১২ পুরানত সংস্করণ
বৃটিশ শাসনের জন্য মির্যার শুকরিয়া জ্ঞাপন!
নিজ দীক্ষা, হিতোপদেশ ও নীতি অনুসারে মির্যা কাদিয়ানী সারা জীবন ইংরেজ শাসনের এই ‘নিআমত’-এর ‘শুকরিয়া’ জ্ঞাপন করে গেছে নানাভাবে, নানা ভাষায়। তাদের শুকরিয়া আদায় করতে গিয়েই তাদের পক্ষে ও তাদের হিতাকাক্সক্ষী হয়ে গ্রন্থ রচনা করেছে। তার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেগুলো বিতরণ করেছে। এমনকি তৎকালীন বড় বড় মুসলিম দেশেও বৃটিশ আনুগত্যের প্রতি উৎসাহিত করতে গ্রন্থ পাঠিয়েছে। যাতে করে মুসলমানরা বৃটিশদেরকে নিজেদের বন্ধু ও কল্যাণকামী ভাবতে শেখে। যেমন-
“আর যদিও আমি এই (সরকারের) শুকরিয়া আদায় করার জন্য উর্দূ, আরবী ও ফার্সী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেছি, যেগুলোতে আমি ভারতবর্ষের মুসলমানদের উপর মাননীয় মহারাণীর অসংখ্য অনুগ্রহের কথা আলোচনা করেছি এবং তা বিভিন্ন মুসলিমদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর প্রত্যেক মুসলমানকে (বৃটিশ সরকারের প্রতি) খাঁটি আনুগত্য ও তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে অনুপ্রাণিত করেছি।” -তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১২/২৫৫
আরো লিখেছে-
“আমার বয়স এখন প্রায় ষাট বছর। শুরুজীবন থেকে আজ পর্যন্ত বক্তৃতা ও লিখনীর মাধ্যমে আমি নিজেকে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে সর্বদা ব্যস্ত রেখেছি যে, কীভাবে মুসলমানদের অন্তরকে বৃটিশ সরকারের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা, তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা ও সহমর্মিতার দিকে আকৃষ্ট করতে পারি।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/১৯০ নতুন সংস্করণ, ৩/১১ পুরাতন সংস্করণ
খোদার ইলহামে বৃটিশপ্রীতি!
বৃটিশদের তোষণ করতে গিয়ে মির্যা কাদিয়ানী এ মিথ্যারও অবতারণা করেছে, তাকে নাকি এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইলহাম করা হয়েছে। তার বক্তব্যটি লক্ষ্য করুন-
“সকল মুসলমানের মধ্যে আমিই হলাম
ইংরেজ সরকারের প্রথম সারির হিতাকাক্সক্ষী। কেননা তিনটি বিষয়ের কারণে আমি তাদের কল্যাণকামিতার প্রতি উৎসাহিত হয়েছি। এক. আমার মরহুম পিতার প্রভাবে। (তিনিও ইংরেজদের একজন একনিষ্ঠ কল্যাণকামী ছিলেন।) দুই. আমার প্রতি এই সরকারের অনুগ্রহ-অনুকম্পা। তিন. আল্লাহ তাআলার ইলহাম (প্রত্যাদেশ)।” (আল্লাহ তাআলা ইলহামযোগে আমাকে ইংরেজ সরকারের হিতাকাক্সক্ষী হওয়ার ইঙ্গিত করেছেন।) -তিরইয়াকুল কুলূব, রূহানী খাযায়েন ১৫/৪৯১
বৃটিশ সরকারের জন্য আন্তরিক দুআ
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইংরেজ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর তাদের জন্য দুআ করেছে এবং তাদের শত্রুদের পরাজয়ের দুআ করেছে। লিখেছে-
“আমরা এই সরকারের এমন এমন অনুগ্রহ দেখেছি, যার কৃতজ্ঞতা আদায় করা অত সহজ নয়। তাই আমরা আমাদের মহামান্য সরকারকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমরা এই সরকারের প্রতি তেমনই আন্তরিক ও কল্যাণকামী, যেমন ছিলেন আমাদের পূর্বসূরীগণ। আমাদের পক্ষে দুআ ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে!! সুতরাং আমরা দুআ করছি, আল্লাহ তাআলা সব ধরনের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে এই সরকারকে রক্ষা করুন। আর তার শত্রুদেরকে অপদস্থ ও পরাজিত করুন।” -শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন ৬/৩৮০
রাণী ভিক্টোরিয়া ও মির্যা কাদিয়ানী
যাদের হাত লক্ষ মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, যারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের পশু ছাড়া অন্য কিছু গণ্য করত না, সেই বৃটিশ সরকারের মহারাণী ভিক্টোরিয়া, যার নামে সদর ঘাটের ঐ পার্কটির নামকরণ করা হয়, যার গাছে গাছে ১৮৫৭ সালে বহু মুসলিম বিপ্লবীর লাশ ঝুলেছিল, সেই রাণীর উদ্দেশ্যে মির্যা কাদিয়ানী যেভাবে কৃতজ্ঞতা, অভিনন্দন, আন্তরিক ভালবাসা আর আসমানী সাহায্যের প্রার্থনা করে করে মুখে ফেনা তুলেছিল, তা ঈমানদার মুসলমানের হৃদয়ে চরম ঘৃণা ও ধিক্কার সৃষ্টি না করে পারে না।
এ বিষয়ে তার বক্তব্যটি লক্ষ করুন-
“ঐ খোদার শুকরিয়া, যিনি আমাদেরকে আজকের এই মহাখুশীর দিনটি দেখার তাওফীক দিয়েছেন যে, আমরা আমাদের মহান সম্রাজ্ঞী, ইংল্যান্ড ও হিন্দুস্তানের (ভারতের) অধিপতি মহারাণীর শত বার্ষিকী জুবিলি দেখতে পেয়েছি। আজকের এই দিনটি পেয়ে আমাদের অন্তরে যে আনন্দস্রোত বয়ে যাচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমাদের কল্যাণকামী বরকতময় সম্রাজ্ঞীকে আমাদের পক্ষ থেকে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি। আল্লাহ সম্রাজ্ঞী মহারাণীকে সর্বদা সুখে-শান্তিতে রাখুন। -তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন-১২/২৫৪
রাণী ভিক্টোরিয়াকে উদ্দেশ্য করে মির্যা কাদিয়ানী আরও লিখেছে-
“ভারতবর্ষের অধিপতি হে মহান সম্রাজ্ঞী, আল্লাহ আপনাকে সৌভাগ্য ও আনন্দপূর্ণ দীর্ঘায়ু দান করুন। আপনার শাসনামল কতই না বরকতময় যে, খোদার আসমানী সাহায্য আপনার মিশনকে শক্তিশালী করছে। প্রজাবর্গের প্রতি আপনার সহানুভূতিশীলতা ও সদিচ্ছার পথকে ফিরিশতাগণ সুগম করছে। আপনার সুবিচারের মেঘমালা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যাতে গোটা সাম্রাজ্যকে ফুলে ফুলে সুশোভিত করে দেয়। নিকৃষ্ট সে, যে আপনার শাসনামলের মুল্যায়ন করে না। আর অসভ্য সে, যে আপনার অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর জানা কথা যে, মনের টান শুধু মন দিয়েই অনুভব করা যায়। তাই আপনাকে যে আমি মন দিয়ে ভালবাসি এবং বিশেষভাবে আমার অন্তকরণে আপনার প্রতি রয়েছে যে অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা- সেকথা মুখ দিয়ে প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করি না। আপনার জন্য আমাদের দিনরাতের দুআ জলস্রোতের ন্যায় অব্যাহত আছে। আমরা রাজনৈতিক চাপের কারণে আপনার অনুগত হইনি, বরং আপনার বিভিন্ন ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট আমাদের অন্তরকে আপনার প্রতি আকর্ষিত করেছে।
ভারতবর্ষের অধিপতি হে বরকতময় (?) সম্রাজ্ঞী, আপনার এই সম্মান ও সুখ্যাতি সুদীর্ঘ হোক। খোদার দৃষ্টি ঐ রাজ্যের উপর রয়েছে, যার উপর আপনার দৃষ্টি আছে। আর খোদার রহমতের হাত সে প্রজাবর্গের উপর আছে, যাদের উপর আপনার হাত রয়েছে। -সিতারায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন. ১৫/১১৯-১২০
আরও লিখেছে-
“আমি আমার সকল সাথী নিয়ে দু’হাত তুলে দুআ করছি- হে আল্লাহ, ভারতবর্ষের এই বরকতময় সম্রাজ্ঞীকে আমাদের মাঝে দীর্ঘদিন নিরাপদে রাখো। আর তার প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার সাহায্যছায়া দান করো।” -সিতারায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১৫/১১৪
‘রহমতের ছায়া’!
মির্যা কাদিয়ানী বৃটিশ সরকারের সহায়তা ও তাদের সহযোগিতাকে রহমতের ছায়া আখ্যায়িত করেছে। এবং এই কারণে নিজের উপর তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ওয়াজিব মনে করছে। তবে তার নিম্নোক্ত বক্তব্যে একথার সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি বিদ্যমান যে, এই বৃটিশ সরকার ব্যতীত অন্য কোনো সরকারের অধীনে মির্যা তার মিশন (??) কখনও বাস্তবায়ন করতে পারত না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বৃটিশের পৃষ্ঠপোষকাতার কারণেই মির্যা তার মিশনকে অগ্রসর করার প্রয়াস পেয়েছে। মির্যার বক্তব্য লক্ষ্য করুন-
“আমি ঐ আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি, যিনি আমাদেরকে এমন এক সরকারের রহমতের ছায়াতলে (!!!) আশ্রয় দিয়েছেন, যার আশ্রয়ে থেকে আমি স্বাধীনভাবে নিজের ওয়াজ-নসীহতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছি। যদিও এই অনুগ্রহশীল সরকারের শুকরিয়া আদায় করা প্রত্যেক প্রজার জন্য ওয়াজিব, কিন্তু আমি মনে করি, আমার উপর বেশি ওয়াজিব। কেননা আমার এই মহান মিশন, যা মহামান্য সম্রাজ্ঞীর ছায়াতলে থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা অন্য কোনো সরকারের অধীনে থেকে কখনও বাস্তবায়িত হত না। হোক না তা কোনো ইসলামী সরকার।” -তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন-১২/২৮৩-২৮৪
পাঠক, মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য পড়ুন এবং নিজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন, কাদিয়ানী সম্প্রদায় কোন্ বিবেকে এই ব্যক্তিকে নবী হিসেবে বরণ করে নিয়েছে!! যে জালেম ও মুসলমানদের রক্তশোষণকারী ইংরেজ সরকারের তোষামোদ ও চাটুকারিতায় এমন নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে যা শুনলে লজ্জা ও ঘৃণায় যেকোনো মুসলমানের দেহমন রিরি করে উঠবে।
বৃটিশ সরকারের তাবিজ
সত্যি, অত্যাচারী বৃটিশের চাটুকারিতায় মির্যা কাদিয়ানীর কোনো জুড়ি ছিল না। না চাইতেই বৃটিশদের জন্য এত প্রশংসা-প্রার্থনা, স্তুতি-বন্দনা আর শব্দবাক্যের অবিরাম বর্ষণ! একদিকে সে ইংরেজদেরকে এ দেশবাসীর জন্য আল্লাহর রহমত, বরকত এবং নিআমত আখ্যা দিয়েছে, অন্যদিকে নিজেকে ইংরেজদের জন্য বালা মুসিবত থেকে রক্ষাকারী তাবিজ বলতেও ছাড়েনি। যেন তাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, “যতদিন আমি আছি তোমরা ভারতবর্ষে নিরাপদ। কারণ, আমি তো তোমাদের আনুগত্যের পক্ষে-ই মানুষকে উৎসাহিত করে যাচ্ছি। যা তাবিজের ন্যায় কার্যকরী ভূমিকা রাখবে!” পাঠক, তার বক্তব্যটি লক্ষ্য করুন-
پس میں یہ دعویٰ کر سکتا ہوں کہ میں ان خدمات (برطانیہ کی) میں یکتا ہوں اور میں یہ کہہ سکتا ہوں کہ میں ان تائیدات میں یگانہ ہوں اور میں کہہ سکتا ہوں کہ اس گورنمنٹ کے لئے بطور ایک تعویذ کے ہوں اور بطور ایک پناہ کے ہوں جو آفتوں سے بچاوے اور خدانے مجھے بشارت دی اور کہا کہ خداایسا نہیں کہ ان کو دکھ پہنچاوے اور تو ان میں ہو پس اس گورنمنٹ کی خیرخواہی اور مدد میں کوئی دوسرا شخص میری نظیر اور مثیل نہیں عنقریب یہ گورنمنٹ جان لےگی اگر مردم شناسی کا اس میں مادہ ہے۔
সুতরাং আমি এই দাবি করতে পারি যে, এই ধরনের সেবা করার ক্ষেত্রে আমিই একক ব্যক্তি। আমি বলতে পারি, (বৃটিশদের) সাহায্য-সহযোগিতায় আমি অদ্বিতীয়। আমি একথাও দাবি করতে পারি যে, আমি এই (বৃটিশ) সরকারের জন্য একটি রক্ষাকবচ তাবিজ। যা (তাদেরকে) নানা ধরনের বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করবে। আল্লাহ তাআলা আমাকে সুসংবাদ দান করে বলেছেন- আল্লাহ তাআলা এমন নন যে, তুমি তাদের মাঝে বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তাদের কোনো ধরনের দুঃখ-কষ্ট দেবেন। সুতরাং এই সরকারের কল্যাণকামিতা ও সাহায্যে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে অন্য কোনো ব্যক্তি আমার সমকক্ষ ও সমতুল্য নেই। আর যদি সরকারের মধ্যে মানুষ চেনার যোগ্যতা থাকে তাহলে তারা অচিরেই আমার এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবে। -নূরুল হক, রূহানী খাযায়েন ৮/৪৪-৪৫
ইংরেজ সরকার কাদিয়ানীদের আশ্রয়স্থল
যেহেতু এ বিষয়টা সুপ্রমাণিত যে, কাদিয়ানী মতবাদ মূলত বৃটিশ সরকার কর্তৃক সৃষ্ট। যে মতবাদের মূল ভিত্তিই হচ্ছে, ভারতবর্ষে মুসলমানদেরকে বৃটিশ সরকারের গোলামী ও আনুগত্যের প্রতি উৎসাহিত করা। মির্যা কাদিয়ানী যথাযথভাবেই তার উপর আরোপিত এ গুরুদায়িত্ব (!) পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। একপর্যায়ে ইংরেজদেরকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলেছে যে, সে বৃটিশ সরকারের তাবিজস্বরূপ। তার বিদ্যমানতায় তাদের কোনো ধরনের ক্ষতি ও দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে না।
মির্যা কাদিয়ানী তার অনুসারীদেরকে পরামর্শ দিতে গিয়ে এ কথাগুলোই বলেছে। লক্ষ্য করুন-
“এ সরকার সকল ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্যে দণ্ডায়মান। তোমাদের বন্ধুবান্ধব ও বাসস্থানের ব্যাপারেও তারা কত চমৎকার আচরণই না করেছেন এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, তারা তোমাদের আশ্রয়স্থল ও নিরাপত্তাস্থল। এখন তোমাদের উপর এই অনুগ্রহের হক পাওনা হয়ে আছে। ...অতএব, এই সরকারের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা এবং তাদের স্মরণ ও প্রশংসা করার ক্ষেত্রে বোবা ও বেহুঁশ হয়ে থেকো না। কেননা, অনুগ্রহের বদলা অনুগ্রহ দিয়েই দিতে হয়। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে শিথিলতা প্রদর্শন অকৃতজ্ঞতার শামিল। আমি আল্লাহ তাআলার নামে কসম করে বলছি, এই সরকার তোমাদের জন্য নিরাপত্তাদানকারী এক মহা তাবিজ, যার উপস্থিতিতে অন্য কোনো সাহায্যকারী আমাদের দরকার নেই।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/৫৪৩-৫৪৪ নতুন সংস্করণ, ৩/৪৫৮-৪৫৯ পুরাতন সংস্করণ
আরও লিখেছে-
“এ সরকারের মাধ্যমে আমরা যে কতটা শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করেছি, তা প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত শব্দভাণ্ডার আমাদের আয়ত্বে নেই। আমরা এই দুআই করতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা এই অনুগ্রহশীল সরকারকে উত্তম প্রতিদান দিন। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন যেমন তারা আমাদের প্রতি মঙ্গল করেছে।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/১৯১ নতুন সংস্করণ, ৩/১২ পুরাতন সংস্করণ
আরও লিখেছে-
“অথচ আমি জানি, আল্লাহ তাআলা তার বিশেষ করুণায় এই সরকারকে আমার ও আমার জামাতের আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন। এই সরকারের অধীনে আমাদের যে নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে তা আমরা মক্কা-মদীনা বা রোমের শাসনাধীন কন্স্ট্যান্টিনোপলেও পেতাম না। -তিরইয়াকুল কুলুব, রূহানী খাযায়েন ১৫/১৫৬
আজও কাদিয়ানী সম্প্রদায় নাড়ির টানে লন্ডনে গিয়ে চির হিতৈষী বৃটিশদের ‘রহমতের ছায়াতলে’ আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখানেই নিজেদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছে।
সেখান থেকে তারা যতটা নিরাপত্তা ও প্রতিবন্ধকতা মুক্ত হয়ে নিজেদের কুফুরী মতবাদ পরিচালনা করতে পারবে, জানা কথা বিশ্বের কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে বসে তা সম্ভব হবে না। যা মির্যা কাদিয়ানী নিজেই স্বীকার করেছে যে, আমি ইংরেজদের ছায়াতলে যে স্বাধীনতা ও বাধাহীনতার সাথে আমার কার্যক্রম চালাচ্ছি তা মক্কা মদীনাতেও সম্ভব হবে না। তোহফায়ে কায়সারিয়া, রূহানী খাযায়েন ১২/২৮৩-২৮৪
প্রথম দিকে তাদের মূল কেন্দ্র ছিল ভারতের কাদিয়ানে। পরবর্তীতে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে তারা পাকিস্তানে গিয়ে আস্তানা গাড়ে এবং চনাব নদীর তীরে বিশাল এক এলাকা লিজ নিয়ে সে এলাকার নামকরণ করে রবওয়া। সেই রবওয়াই ছিল ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাদের মূল কেন্দ্র। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে তাদের চতুর্থ খলীফা মির্যা তাহের লন্ডনে গিয়ে সেখানে মূল কেন্দ্র স্থাপন করে।
তাদের তথাকথিত খলীফা সেই লন্ডন থেকেই সারা বিশ্বের কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়, এমনকি জুমার খুতবা পর্যন্ত দেয়। সেই খুতবা অনুসরণ করেই আমাদের দেশের কাদিয়ানীরা জুমার নামায আদায় করে।
ইংরেজদের নুনখাওয়া সম্প্রদায়
মির্যা কাদিয়ানী আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, তার দল মূলতঃ বৃটিশদেরই নুনখাওয়া দল। যারা বৃটিশদের অনুগ্রহে ও তাদেরই ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত। লক্ষ্য করুন মির্যার বক্তব্য-
“মোটকথা, এরা (আমার অনুসারীরা) এমনই এক সম্প্রদায়, যারা বৃটিশ সরকারের নুন খেয়ে বেড়ে উঠেছে এবং সুখ্যাতি অর্জন করেছে। যারা সরকারের দয়ার পাত্র।” -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/১৯৭ নতুন সংস্করণ, ৩/২০ পুরাতন সংস্করণ
যারা ইংরেজদের বিরূদ্ধে আন্দোলন করেছে তাদের ব্যাপারে মির্যার বক্তব্য
যদি বৃটিশদের হাত থেকে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে না পারতাম তাহলে আজও হয়ত আমাদের গলায় বৃটিশ গোলামীর জিঞ্জির ঝুলে থাকত। যাদের ত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন তারা আমাদের হৃদয়ে চির-ভাস্বর। তাদের ব্যাপারে মির্যা কাদিয়ানীর বক্তব্য হল-
“প্রত্যেক সৌভাগ্যশীল মুসলমানের এ দুআ করা উচিত, যেন এখন ইংরেজের বিজয় হয়। কারণ তারা আমাদের করুণাকারী। আমাদের উপর বৃটিশ সাম্রাজ্যের অশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। নিতান্ত মূর্খ, অতিশয় নির্বোধ ও অপদার্থ সেই মুসলমান, যে এই সরকারের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। যদি আমরা তাদের কৃতজ্ঞতা না জানাই তবে আমরা আল্লাহ তাআলারও অকৃতজ্ঞ গণ্য হব।” -ইযালা আওহাম, রূহানী খাযায়েন ৩/৩৭৩
বৃটিশদের লাগানো চারা
মির্যার উপরোল্লিখিত বক্তব্যসমূহের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, মির্যা কাদিয়ানী ও কাদিয়ানী সম্প্রদায় প্রকৃতপক্ষে বৃটিশদের-ই লাগানো চারা। মির্যা স্পষ্ট ভাষায় তা স্বীকারও করে নিয়েছে। ঘটনাটি হচ্ছে, এক ব্যক্তি মির্যা কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে বৃটিশ বিচারকের কাছে অভিযোগ করেছিল। আদালত থেকে তলব আসলে মির্যা কাদিয়ানী সেই ইংরেজ অফিসারের উদ্দেশ্যে বলছে-
صرف یہ التماس ہے کہ سرکار دولت مدار ایسے خاندان کی نسبت جس کو پچاس برس کے متواتر تجربہ سے ایک وفادار جان نثار خاندان ثابت کر چکی ہے۔اور جس کی نسبت گورنمنٹ عالیہ کے معزز حکام نے ہمیشہ مستحکم رائے سے اپنی چٹھیات میں یہ گواہی دی ہے کہ وہ قدیم سے سرکار انگریزی کے پکے خیرخواہ اور خدمت گزارہیں اس خود کاشتہ پودا کی نسبت نہایت جزم اور احتیاط اور تحقیق اور توجہ سے کام لے اور اپنے ماتحت حکام کو اشارہ فرمائے کہ وہ بھی اس خاندان کی ثابت شدہ وفاداری اور اخلاص کا لحاظ رکھ کر مجھے اور میری جماعت کو ایک خاص عنایت اور مہربانی کی نظر سے دیکھیں۔ ہمارے خاندان نے سرکار انگریزی کی راہ میں اپنے خون بہانے اور جان دینے سے فرق نہیں کیا اور نہ اب فرق ہے۔
মহামান্য সরকারের প্রতি শুধু এটুকু আবেদন জানাই যে, এ বংশ, যাদেরকে তারা সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায় নিজেদের জন্য অনুগত ও নিবেদিতপ্রাণ পেয়েছেন। এবং যাদের সম্পর্কে মাননীয় সরকারের উচ্চ পদস্থ বিচারকগণ সবসময় নিজেদের চিঠিপত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে এই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এরা ইংরেজ সরকারের দীর্ঘদিনের সত্যিকার হিতাকাক্সক্ষী ও সাচ্চা খাদেম। নিজেদের হাতে লাগানো সেই চারার প্রতি বিশেষ মনোযোগ, বিচার-বিবেচনা এবং একান্ত যত্নের আচরণ করবেন। এবং নিজ অধীনস্ত শাসকবর্গকে বলে দিন, তারা যেন আমাকে ও আমার জামাতকে বিশেষ দৃষ্টি ও গুরুত্বের সাথে দেখে। আমাদের খান্দান বৃটিশ সরকারের জন্য রক্ত প্রবাহ করতে ও নিজেদের জান দিয়ে দিতে কোনো তোয়াক্কা করেনি আর না এখন কোনো তোয়াক্কা আছে। -মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত ২/১৯৮ নতুন সংস্করণ, ৩/২১ পুরাতন সংস্করণ
মির্যা মাহমুদের বক্তব্য
মির্যা কাদিয়ানী তার গোটা জীবনে কখনও ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যবহার করেনি। সারা জীবন তাদের চাটুকারিতা ও তাদের স্তুতি-বন্দনা করে গেছে। এবং গর্ব করে বলেছে, “আমার বক্তব্যে এমন কোনো শব্দ পাওয়া যাবে না, যা বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যায়।” -পয়গামে সুলহ (বাংলা, পৃ. ৩৪), রূহানী খাযায়েন ২৩/৪৮৪
একারণেই কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খলীফা, মির্যা কাদিয়ানীর বড় ছেলে মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ বলেছে-
“যদি আমি কাউকে এমন কথা বলতে শুনি, যা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যায় তাহলে আমি (ক্রোধে) কেঁপে উঠি। কারণ, এ ধরনের কথা বলা তো নেমকহারামী।” -আনোয়ারে খেলাফত, আনোয়ারুল উলূম ৩/১৫২
উপরের নাতিদীর্ঘ আলোচনা থেকে অন্তত এতটুকু কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, কাদিয়ানীবাদ মূলত ইংরেজদেরই সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট একটি গোষ্ঠী। ইংরেজরা নিজেদের ভিত্তি মজবুত করার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করেছে। তাই তারা সারাজীবন ইংরেজদের গুণকীর্তন করে গিয়েছে। যদি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিবেকবান শ্রেণি বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করতেন! হ