মুহাররম ১৪৩৯   ||   অক্টোবর ২০১৭

শি   ক্ষা   -    দী   ক্ষা
তথ্যসন্ত্রাস

আবু মুহাম্মাদ

শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা যদি ন্যায় ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত না হয় তাহলে একে আর যা-ই হোক সুশিক্ষা ও শুভ সাহিত্য বলা চলে না। অথচ এরই এখন সবচেয়ে বেশি অভাব। বর্তমানের সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যবিকৃতি ও সত্যগোপনের হাতিয়ার। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটে এর একটি উদাহরণ বিপ্রদাস বড়ুয়ার ভ্রমণকাহিনী মংডুর পথেলেখাটি। এটি আমাদের জাতীয় শিক্ষা-কারিকুলামে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠ্য।

আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর দশকের পর দশক ধরে চলছে জাতিগত নির্মূলাভিযান। সম্প্রতি চরম নিপীড়নের শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বদেশে এরা নাগরিকত্বের স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত। এদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রচারণা, ‘এরা বাঙালী। অথচ বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক আইন উভয় দিক থেকে এটা অসত্য ও অবাস্তব।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আরাকানকে মুসলিমশূন্য করতে চাইছে, অথচ আরাকান ছিল মুসলিম-ভূখণ্ড। বার্মার বৌদ্ধ রাজা এই মুসলিম-ভূখণ্ডটি দখল করে নেয়। ইতিহাস তো গবেষকদের সামনেই আছে। এখানে যা দেখাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, একটি ভ্রমণকাহিনীর ছদ্মাবরণে কীভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে তার একটি নমুনা।

মংডুর পথেশীর্ষক লেখাটিতে বিপ্রদাস বড়ুয়া লিখেছেন, ‘...সারা মিয়ানমারে আমাদের রিকশার বদলে পাইক্যা। স্থানীয় মুসলমানেরা এর একচেটিয়া চালক। মংডুর ব্যবসাও প্রায় ওদের দখলে। আর হিন্দুরাও আছে। এরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে আছে।

মুসলমানেরা কি তবে রিকশা চালিয়ে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করেও খেতে পারবে না? ‘একচেটিয়াএবং দখলেএই শব্দগুলো ব্যবহারের পর স্থানীয় মুসলমানদের ব্যাপারে তার সাধারণ ফয়সালা- ‘এরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, দীর্ঘদিন ধরে আছে।অথচ ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণের দ্বারা এ সত্য প্রমাণিত যে, রোহিঙ্গা মুসলিমগণ আরাকান রাজ্যে বসবাস করছেন শত শত বছর ধরে। আর অভিবাসনের কথা যদি বলা হয় তাহলে সেটা আছে দুই দিক থেকেই।

এই ভ্রমণকাহিনীর আরেক জায়গায় আছে, ‘ওখান থেকে একটু এগিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলাম। মালকিন বসে আছে চেয়ারে। রোয়াইংগা মুসলিম বয় আছে দুজন। ওরা মূলত চট্টগ্রামের।

জানি না লেখক কীভাবে এই দুইজন সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন যে, ‘ওরা মূলত চট্টগ্রামের।’ ‘মূলতকথাটিই সংশয় সৃষ্টি করে যে, তিনি সম্ভবত এদের দুজন সম্পর্কে আলাদা অবগতির ভিত্তিতে নয়; বরং ঐ অসত্য প্রচারণা বিস্তারের জন্যই মনগড়াভাবে কথাটা বলে দিয়েছেন।

ভ্রমণাকাহিনীরূপী ঐ লেখাটাতে বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে বাস্তব ইতিহাসের সম্পূর্ণ বিপরীত দর্শন পাঠকের মনে গেঁথে দেয়ার প্রয়াস বেশ স্পষ্ট।

উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, এই ধরনের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াস সম্বলিত একটি লেখা আমাদের জাতীয় সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত কীভাবে হয়ে গেল। শুধু ইতিহাস বিকৃতিই নয়, এটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী একটি প্রয়াসও বটে। আমাদের ধার্মিক ও দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদদের এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া অতি প্রয়োজন। দেশের স্বার্থবিরোধী ও মুসলিম ভ্রাতৃঘাতী যে কোনো অপপ্রয়াসের ব্যাপারে সাবধান থাকা আমাদের দ্বীনী দায়িত্ব।

মিসর-বিজেতা হযরত আম্র ইবনুল আস রা.-এর ঐতিহাসিক উক্তিটি স্মরণ রাখা দরকার। মিসর বিজিত হওয়ার পর তিনি তাঁর সঙ্গীদের সম্বোধন করে বলেছেন- اعلموا انكم في رباط دائم

মনে রেখো তোমরা এখন নিয়োজিত এক নিরবচ্ছিন্ন সীমান্ত-প্রহরায়-মা-যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন ১/১৩৪

বলাই বাহুল্য, এখানে সীমান্ত-প্রহরারঅর্থ শুধু ভূখণ্ডের সীমান্ত-প্রহরা নয়। দ্বীন, আদর্শ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য সব ক্ষেত্রেই অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালনের নির্দেশনাই তিনি তার সঙ্গীদের দান করেছিলেন।

এখানে মনে পড়ছে সাম্প্রতিক সময়ের এক প্রখ্যাত মিসরীয় শিক্ষাবিদ শায়েখ মুহাম্মাদ মুতাওয়াল্লী আশশারাভীর কিছু কথা। মুসলিমভূখণ্ডে সামরিক আগ্রাসনের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও বিজাতীয় আগ্রাসন সম্পর্কে সজাগ থাকার গুরুত্ব বর্ণনা করে তিনি এই কথাগুলো বলেছেন। সূরা আলে ইমরানের শেষ আয়াতে ورابطواশব্দের অধীনে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামের এক বড় ত্রুটি হচ্ছে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার অন্ধ অনুকরণ। ইতিহাস-প্রকৃতি সব কিছুর পাঠই এখানে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা অনুসারে। অনেক ক্ষেত্রেই যা বাস্তবতা ও ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। এসব ক্ষেত্রেও আমাদের মধ্যে প্রহরীর চেতনা ও যোগ্যতা থাকতে হবে। যেমন ধরুন, পশ্চিমের সিলেবাস সম্পন্নকারী কোনো ইতিহাসবিদ যখন বলবেন, ফরাসী  বিপ্লবই সর্বপ্রথম মানবাধিকারের ঘোষণা প্রদান করেছে তখন আমাদের পক্ষ হতে প্রশ্ন আসতে হবে যে, এই বিপ্লব কত সালে হয়েছে? এ তো মোটে দুশ বছর আগের কথা। ইসলাম তো মানবাধিকারের ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করেছে চৌদ্দশ বছর আগেই। আমাদের প্রত্যেক ছাত্রকে এই তাত্ত্বিক আগ্রাসনের ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।

কোনো প্রকৃতিবিদ যখন বলবে, -প্রকৃতি অমুক প্রাণীকে এই বর্ণ দান করেছে শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে আত্মরক্ষায় সক্ষম হওয়ার জন্য। তখন আমাদের ছাত্রদের বলতে হবে, প্রকৃতি কিছুই দান করতে পারে না, প্রকৃতি নিজেই সৃষ্ট এবং সে নিজেই  গ্রহণ করেছে স্রষ্টা থেকে। -তো সীমান্ত প্রহরা শুধু সামরিক শক্তি দিয়েই নয়, জ্ঞান-গবেষণার শক্তি দিয়েও।

ক্রুসেড পরবর্তী যুগে ইসলামের প্রতিপক্ষ মুসলিমসমাজে নানা ব্যবস্থা- শিক্ষা-ব্যবস্থা, সমাজ-ব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আগ্রাসন পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে ওদের প্রাচ্যবিদ আর আমাদের পশ্চিম-বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মুসলিমসমাজে সরবরাহ করছে- আলাদা ইতিহাস, আলাদা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। কাজেই সীমান্ত-রক্ষার নির্দেশনায় সামরিক আগ্রাসনের পূর্বে চিন্তা-চেতনাগত যে আগ্রাসন পরিচালিত হয়ে থাকে সে সম্পর্কে প্রস্তুতি ও সতর্কতাও শামিল।

তো হযরত আমর ইবনুল আস্ রা. মিসরের স্বাধীন ভূমিতে দাঁড়িয়ে মুসলিম জনতাকে যে ভবিষ্যত-কর্মপন্থা নির্দেশ করেছিলেন তা প্রত্যেক মুসলিম ভূখণ্ডের আদর্শপ্রিয় ও স্বাধীনতাপ্রেমী জনতার জন্যই এক অনির্বাণ আলোক শিখা।

 

advertisement