মুহাররম ১৪৩৯   ||   অক্টোবর ২০১৭

মানবতা
বিপদগ্রস্তের সেবা

Ibne Naseeb

মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। এক মানুষ অপর মানুষকে কষ্ট দিবে না; বরং একের কষ্টে অন্যজন এগিয়ে আসবে- এই স্বভাব দিয়েই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর সাথে পরিচিত করেছেন এবং আল্লাহপ্রদত্ত মানবীয় সদগুণাবলীর বিকাশ সাধন করেছেন। সর্বশেষ দ্বীন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্লাহর হক ও বান্দার হকের পূর্ণাঙ্গতম ধারণা ও তা আদায়ের স্পষ্টতম বিধান ও নির্দেশনা। মানবীয় সুকমারবৃত্তি ও সদগুণাবলীর বিকাশে এই দ্বীনের প্রভাব তাই অতি গভীর। এ কারণে অন্য সকল ধর্ম- সমাজের চেয়ে মুসলিমসমাজে মানবীয় উদারতা ও মানবসেবার দৃষ্টান্ত অনেক বেশি পাওয়া যায়। যদিও অতীত ও বর্তমানে ইসলাম সম্পর্কেই বিরুদ্ধ-প্রচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

সম্প্রতি ভারত জুড়ে গোরক্ষার নামে মুসলিম হত্যার যে রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে চলেছে- এ সম্পর্কে সবাই ওয়াকিফহাল। সম্প্রতি কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভিও বলেছেন, বিজেপির গোরক্ষা নীতির অর্থ হচ্ছে, সংখ্যালঘু জনগণকে হত্যা করা। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ছত্তিশগড়ে বিজেপি নেতা হরিশ ভার্মার খামারে খাদ্য ও ওষুধের অভাবে  যে ২০০ গবাদি পশু মারা গেছে তার জন্য রাজ্যটির সরকারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না।

তো ভারতের ভিতরেও বিজেপির এই সাম্প্রদায়িকতা ও গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিষয়টি আলোচিত। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন  জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম হচ্ছে, ‘হিন্দু সাধুদের বাঁচালেন মুসলিমরা।ঘটনার বৃত্তান্ত নিম্নরূপ :

গত কয়েক দিন আগে ভারতে কলিঙ্গ উৎকল এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ১৪টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ২৩ জনের মৃত্যু ঘটে এবং অনেক যাত্রী আহত হয়। ট্রেনটিতে ভগবান দাস মহারাজ নামক একজন গেরুয়াধারী সাধু ছয় শিষ্য সহকারে সফর করছিলেন। তারা মধ্যপ্রদেশের মোরানা থেকে হরিদ্বার যাচ্ছিলেন। এরপরের ঘটনা স্বয়ং মহারাজের যবানিতে :

আমার মনে আছে, আমার মাথা সামনের সিটে ঢুকে গিয়েছিল। প্রায় দুটো সিট এগিয়ে পড়েছিলাম আমি। খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। সবদিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল। যদি ঐ এলাকার মুসলিমরা না থাকতেন তাহলে আমরা বাঁচতাম না। তারা দুর্ঘটনাস্থলে এসে আমাদের ট্রেন থেকে বের করেন। আমাদের পানি এনে দেন। আমাদের জন্য চিকিৎসকেরও ব্যবস্থা করেন। আমরা তাদের এই ব্যবহার ভুলব না।

ঐ দলের আরেক সন্ন্যাসী মণিদাস বলেন, ‘আমরা ভগবানে বিশ্বাস করি। দুর্ঘটনার পর আমরা তার প্রভাব দেখেছি। মানুষ হিন্দু-মুসলিমদের নিয়ে রাজনীতি করে, কিন্তু দুই দলের মধ্যে সব সময় ভালবাসা থাকে।’ (জি নিউজের বরাতে দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২২ আগস্ট ২০১৭)

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাজনীতিতে যে ধর্ম বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উৎকট ব্যবহার হচ্ছে উপরের বক্তব্যটি এর একটি সাক্ষ্য। বিষয়টা সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায়ের কিছু বিবেকবান মানুষকে ভাবিত ও পীড়িত করছে। এখানে দুটো ব্যাপারই সুন্দর। একদিকে সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায় কর্তৃক চরম নির্যাতিত হয়েও তাদের বিপদে মুসলমানদের এগিয়ে আসা অন্যদিকে অপর পক্ষ থেকে অকুণ্ঠচিত্তে উপকারীর উপকার স্বীকার করা।

এই টুকরো ঘটনায় আমাদের মুসলিম সমাজের সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য আছে অনেক বড় শিক্ষা। আর তা হচ্ছে, ভালো কাজের স্বীকৃতি ও স্বীকারোক্তি দ্বারা কেউ ছোট হয় না। লজ্জাজনক হলে সত্য যে, আমাদের ঐ সকল বুদ্ধিজীবী স্বজাতির ভালো কাজের স্বীকৃতি দানে চরম কুণ্ঠিত থাকেন। অথচ একই কাজ বিধর্মী কারো দ্বারা হলে শুধু স্বীকৃতি নয়, যেন শতকণ্ঠে ফেটে পড়েন। এই অবস্থান সঠিক নয়। কোনো মুসলিমের কোনো একটি ভালো কাজের স্বীকৃতির দ্বারা যে জাত যায় না তা ঐ হিন্দু সাধুরা দেখিয়ে দিয়েছেন। ইসলামী শিক্ষা থেকে এই গুণ অর্জনে কুণ্ঠাবোধ করলে অন্তত হিন্দু সাধুদের থেকে তা অর্জন করুন। তবে একই সাথে নিজের ঈমানেরও কিছু তত্ত্ব-তালাশ নিন- তা আছে, না বিদায় নিয়েছে!

ভীরুতা ও হীনম্মন্যতাও সাম্প্রদায়িকতার মতোই এক মারাত্মক ব্যাধি, যা শুভ ও কল্যাণের বিকাশে অতি বড় বাধা।

এই বাধা অপসারিত হোক, মনের কপাট খুলুক এবং সত্য-ন্যায়ের আলোকধারায় আবার এই পৃথিবী আলোকিত হোক- এই প্রার্থনা।

 

advertisement