মানুষ মানুষের জন্য
বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা ও জাগ্রত মুসলিম জনতা
‘রোহিঙ্গা মুসলমান’ মাসখানেক সময়ের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ। বিগত কয়েক শতাব্দীর নিকৃষ্টতম বর্বরতা, জাতিনিধনমূলক হত্যাযজ্ঞ, নারী-শিশুদের উপর পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিপর্যস্ত লক্ষ লক্ষ মাজলুমের এ জনস্রোত এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। কিছুটা দেরিতে হলেও সরকার তাদের হায়েনাদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার নীতি থেকে সরে এসেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এলাকাগুলো এখন সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী সেখানে এখন অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত আমরা মজলুম রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে তো দিলাম, কিন্তু তা করলাম টাইমিং এ পিছিয়ে পড়ে। আমাদের পূর্বেই ভিনদেশের ফাস্ট লেডি ও উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী-আমলারা পৌঁছে গিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের পাশে। কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকাগুলো বড় বড় বিলবোর্ডে সেজে আছে এখন, যাতে লেখা ‘মাদার অফ হিউমেনিটি’, ‘চ্যাম্পিয়ন অফ হিউমেনিটি’ ইত্যাদি বাক্য। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে দেয়া এসব উপাধি সম্বলিত বিলবোর্ডগুলো সম্ভবত সরকারি উদ্যোগেই লাগানো। কিন্তু তাঁর উপদেষ্টাগণ তাঁকে এ খেতাবের সত্যিকার উপলব্ধি করতে দিলেন কোথায়।
মা তো থাকবেন সবার আগে, মানবতাকে কোলে উঠাবেন একনম্বরে। মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর উপদেষ্টাগণ তাঁকে সেখানে পৌঁছাতে এত সময় নিলেন কেন। কেন শুরুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেন তারা। যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারার মাশুল অনেক সময় বেশ বড় করেই দিতে হয়। যাই হোক বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে।
যদিও এখনো নীতিগত বিষয়গুলো রয়ে গেছে সমন্বয়হীনতার মধ্যেই। যেমন রোহিঙ্গাগণ কি শরণার্থী না অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সে বিষয়ে সরকারের একজন সচিব গতকালও বললেন যে, তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী নয়। এর পূর্বেও সরকারের বিভিন্ন মহলের কথায় ও কাজে তাদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবেই দেখানো হয়েছে। অবাক লাগে, কত বিপরীতমুখী আমাদের নীতি। একদিক থেকে আমরা বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয়দাতা হিসাবে পেশ করছি। নিজেরা হচ্ছি মানবতাবাদী। অন্যদিকে পাষণ্ড-জালেমদের হাত থেকে ভয়ে পালিয়ে আসা ঐ নিরীহ লোকগুলোকে এখনো ‘অবৈধ’ খেতাবে ভূষিত করে যাচ্ছি। এর সাথে যোগ হয়েছে কোনো কোনো কর্তাব্যক্তির বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য। যেমন রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও মাদক পাচারের আশংকা ইত্যাদি। এই সময়ে এসব বলে কি আমরা নিজেদেরকে খাটো করছি না? বিপদগ্রস্তদের আশ্রয় দেয়ার সম্মানে কি কিছুটা কলঙ্ক লেগে গেল না? সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাগণ বিষয়গুলো যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই জাতির মঙ্গল।
রোহিঙ্গাদের প্রবেশ শুরু হওয়ার পর পরই একশ্রেণির লোক একটি কথা বার বার উচ্চারণ করছে, তা হচ্ছে আমরা এতগুলো লোকের বোঝা নিতে পারব না। আমরা জনবহুল গরীব রাষ্ট্র ইত্যাদি। আসলে কি তাই? যদি মায়ানমারের হঠকারিতার কারণে সকল রোহিঙ্গা এদেশে থেকেও যায় তবু তো আমাদের জনসংখ্যা ১%-এর কমই বৃদ্ধি পাবে। ৯৯%-এর জায়গা হলে ১%-এর জন্য কি খুব বেশি টানাটানি হয়ে যাবে?
আর দারিদ্র! আমরা তো মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছি এবং এগিয়ে যাচ্ছি দুর্বার গতিতে। আর এদেরকে রাখলে আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, না ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কী প্রমাণিত হচ্ছে? আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও বৈদেশিক অনুদানের ঘোষণা তো ভিন্ন কথাই বলে।
মায়ানমার সরকার কর্তৃক এ জাতিনিধন ও হত্যাযজ্ঞের প্রতিকারে বিশ্বসংস্থাগুলো ও স্বঘোষিত বিশ্বনেতারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এমন অভিযোগ এখন আমাদের মুখে মুখে, কিন্তু আমাদের তো আসলে আক্ষেপ করা দরকার নিজেদের উপর। যদি আজ খ্রিস্টান, ইহুদী বা হিন্দুদের উপর আক্রমণ হত এবং কোনো প্রতিকার না হত তাহলে ওসব কথা মানাতো। যেখানে আক্রান্ত জাতি মুসলমান সেখানে তারা ব্যবস্থা নেবে কেন? এক্ষেত্রে তারা বিবৃতি দিচ্ছে, হুমকি-ধমকি শোনাচ্ছে এটাই তো বেশি! ওরা মানবতার কথা মুখে যতই বলুক মুসলমানদের ব্যাপারেও যে ঐসব কথা প্রযোজ্য তা কে বলবে?! প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা মুসলমানেরা অর্থাৎ ওআইসি নামক মেশিন! মুসলিম দেশগুলোর ক্ষমতাবানরা, খাদেমুল হারামাইনরা কী করছি। আমাদের হাতে কি কিছুই করার ছিল না বা নেই? ওআইসি কি জরুরি সভা ডেকে বার্মার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের ডাকও দিতে পারত না! অনেকগুলো মুসলিম দেশকে নিয়ে সৌদীআরব ইসলামী সামরিক জোট বানাল, ঐ সামরিকবাহিনী কি শুধুই নিজেদের মধ্যে লড়াই করার জন্য, শুধুই ক্ষমতাসীনদের মসনদে অবস্থান দীর্ঘায়িত করার জন্য? আসলে স্বজাতিকে বিপর্যস্ত রেখে, নিপীড়িতদের জন্য কোটি নাগরিকের অন্তর-কান্না বন্ধ না করে কোনো বাহিনী বা সামরিক জোট দিয়েই যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তা আমরা বারবার ভুলে যাই। মুসলিম বিশ্বের নেতারা এ সত্য ভুলে যান বলেই তারা বুঝতে চান না- কেন এবং কীভাবে উগ্রপন্থা তৈরি হয়। আজ থাক সে প্রসঙ্গ, কথা অনেক লম্বা হয়ে যাবে।
চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রের উপর আমাদের অনেকের অনুযোগ, তারা প্রকাশ্যে বার্মার অপকর্মে সমর্থন জোগাচ্ছে। এ অনুযোগ করা কি ঠিক হচ্ছে? যেখানে তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সেখানে একটি জাতির নিধন তেমন আর কী! এটি তো বরং আরো ভাল হবে; মেরে, বিতাড়িত করে কয়েক লাখ লোককে সরিয়ে দিলে বরং বিশাল একটি এলাকা খালি হবে, সেখানে গড়ে তোলা যাবে নতুন আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিশ্ব মোড়লদের কাছে মানুষের রক্তের চেয়ে ডলারের মূল্য বেশি হয়ে গেছে তো অনেক আগে থেকেই। তেলের জন্য সামরিক অভিযানে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানির ইতিহাস তো এখনো পুরাতন হয়নি। তো সে দেশগুলোর কাছে করুণা ভিক্ষা চাওয়ার প্রয়োজন কী? আমরা কি আমাদের করণীয়টার চিন্তা করেছি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কি পারে না মায়ানমারকে সমর্থনকারী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাণিজ্য বন্ধ করতে? এমন চাপ সম্মিলিতভাবে সৃষ্টি হলে তারা কি নিজেদের অবস্থানে অটল থাকতে পারবে?
আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী বার্মায় উড়ে গিয়ে তাদের কৃতকর্মের প্রতি সমর্থন দিয়ে এলেন, আমরা কূটনৈতিকভাবে কিছুই করতে পারলাম না। এ হল বন্ধু-বন্ধু সম্পর্ক। মোদী বাবুকে নিয়ে তো বলার কিছুই নেই, গুজরাটের নরেন্দ্র মোদী মহোদয়কে কে না চেনেন! কিন্তু যখন দেখি, আমাদের মন্ত্রীরা এ বলে জিগির তোলেন যে, ভারত আমাদের পাশেই আছে! ক্ষমতাসীন দলের সেক্রেটারী নিজে গিয়ে তাদের ত্রাণ গ্রহণ করেন এবং বারবার বলতে থাকেন ভারত বাংলাদেশের পাশেই রয়েছে, তখন মানুষ নিজ কানকে বিশ্বাস করতেও বারবার ভাবে। যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে খুনী সূচী ও বার্মার সামরিক জান্তার কর্মকাণ্ডে সমর্থন ব্যক্ত করে এসেছেন সেখানে আমরা মানুষকে শোনাচ্ছি ভিন্ন কথা। তবে হাঁ, ভারত তো আমাদের পাশেই আছে! বাংলাদেশ ভূখণ্ডের তিন দিকেই তো ভারত, মন্ত্রী মহোদয়গণ ভুল বললেন কৈ? আমাদের যদি সামান্য গায়রাত তথা আত্মমর্যাদাবোধ থাকত তবে কি খুনীদের সমর্থনকারীদের ত্রাণ গ্রহণ করতে পারতাম? সময় ও মানুষের তফাৎ কত দ্রুত সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়া সত্ত্বেও মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ইন্ডিয়ান বাহিনীকে এদেশছাড়া করতে দ্বিধা করেছিলেন কি? ভারতের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি লাহোরের ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সৎ সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধ না থাকলে কি তা সম্ভব হত!
আমাদের কথা হল যারা বার্মার জান্তা ও সূচীর খুনী কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে তারা যে দেশেরই হোক তাদের কোনো ত্রাণ রোহিঙ্গাদের জন্য গ্রহণ না করা হোক। প্রত্যাখ্যান করা হোক ওসব ভিক্ষা, তাদেরকে বলা হোক ‘ভিক্ষা লাগবে না তোর ...সামলা’।
پہلے خود كانٹے بچهائے اہل دل كى راه ميں * ہو گئےزخمى تو ان پر پهول برسائےگئے
বেশ! আহলে দিলের পথে বিছিয়ে কাঁটা নিজে/ রক্ত ঝরার পর এসেছ ফুল ছিটাবে বলে?!
আঘাতে আঘাতে আহত করার পর লোকদেখানো সমবেদনা জানাবার অপসংস্কৃতি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
গণমানুষের মনে ও মুখে বারবার আলোচিত হচ্ছে আমাদের নতজানু কূটনীতি ও সমরনীতির কথা। মিয়ানমার যদি অর্থনৈতিক কারণে ভারত, রাশিয়া, চীনকে পাশে রাখতে পারে, তাহলে আমরা পারি না কেন? আমাদের কাছে কি তাদের কোনো অর্থনৈতিক স্বার্থ নেই? বারবার আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করছে বর্মী বাহিনী, তাদের হেলিকপ্টার আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করছে। আমরা ‘কড়া প্রতিবাদ’ করে যাচ্ছি। আমাদের দু-একটি সামরিক হেলিকপ্টার কি আমরা নাফ নদীর উপর দিয়েও ঘুরিয়ে আনতে পারি না? আমরা তা করার বদলে বরং বার্মা থেকে ১ লাখ টন আতপ চাল কিনে এনে প্রকারান্তরে তাদেরকে পুরস্কৃত করেছি।
অনেকেই বলছেন, সরকার আগামী নির্বাচনের স্বার্থেই জন সমর্থনের আশায় শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করেছে। সে যে কারণেই হোক, আমরা এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কিন্তু শুধু অতটুকুতেই জনগণের মন ভরবে বলে মনে হয় না। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম নাগরিকগণ দেখতে চাইবে সরকারের আগামী পদক্ষেপগুলো। শরণার্থীদের সাথে দায়িত্বশীলদের আচরণ, তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মিটছে কি না, দেশী-বিদেশী সাহায্যগুলো যথাস্থানে পুরোপুরি যাচ্ছে কি না, মধ্যসত্ত্বভোগীদের ভাগ-বাটোয়ারার হার বেড়ে যাচ্ছে না তো! এবং সর্বোপরি দক্ষ কূটনীতির মাধ্যমে তাদেরকে সম্মানজনকভাবে স্বীয় মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তো! এ সবই নজরে রাখবে নাগরিকগণ সামনের দিনগুলোতে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সেনাবাহিনী। ব্যক্তি পর্যায়ের ত্রাণ তৎপরতা এখন কার্যত বন্ধ। অবশ্যই শৃঙ্খলার জন্য সেনাবাহিনীর খেদমত অব্যাহত রাখতে হবে, তবে পাহাড়ী দুর্গম এলাকাগুলোতে অবস্থান নেয়া মানুষগুলোর কাছে খাদ্য, পানীয় ও জরুরি চিকিৎসা-সেবা পৌঁছে দেয়া, তাদের একক উদ্যোগে কতটুকু সম্ভব হবে তা সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া দরকার। জাতিসংঘ এবং এর অধীনস্থ সংস্থাগুলো এত কষ্ট করবে কি না তাদের গাড়ীগুলো দেখে অন্ততঃ তা মনে হয়নি। কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ী বহরগুলো সম্ভবত রোহিঙ্গাদের ত্রাণ তদারকে নিয়োজিত অফিসারদের জন্যই কেনা হয়েছে। সেসব গাড়ী কিন্তু বর্তমান ক্যাম্পগুলোর কাছেও পৌঁছবে না। আর সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার একশ্রেণির মতলবী এবং বদদ্বীন এনজিওদের কার্যক্রমের প্রতিও। সেবার আড়ালে যেন তারা ভিন্ন কিছু না করতে পারে। বড় বড় কোনো কোনো এনজিওর তো এখন পোয়াবারো। ভেতরে অত কাজ দেখা না গেলেও শরণার্থী এলাকার পাহাড়গুলো ভরে গেছে একটি বৃহৎ এনজিওর গোলাপী ব্যানারে। হয়ত বা তাদের দাতাদের নজর কাড়ার জন্যও।
প্রসঙ্গ : গণজাগরণ
শত কষ্টের মাঝে সুখের ফোঁটা, নির্জন অন্ধকারে একটু আলো! হাঁ, সে আলোর দেখা মিলছে স্পষ্টভাবেই। সে আলো হচ্ছে রোহিঙ্গা বিষয়ে গণজাগরণ। বলতে গেলে এক ধরনের অঘোষিত জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে। মুসলমানদের জন্য মুসলমানের প্রাণ কাঁদে, তারা পরস্পরে একই দেহের অঙ্গবিশেষ- এ কথাগুলোর কিছুটা হলেও বাস্তবরূপ দেখা গেছে গত কয়েক সপ্তাহে। উখিয়া-টেকনাফ অভিমুখে সারা দেশ থেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ নিয়ে গণমানুষের ঢল সে কথারই প্রমাণ দিয়েছে। আর এক্ষেত্রে অবশ্যই মূল ভূমিকা পালন করেছেন উলামায়ে কেরাম ও ইমাম-খতীবগণ। বেশিরভাগ গণমাধ্যমের ইতিবাচক প্রচারণার কথাও বলতে হবে। চারদিকের বদদ্বীনীর সয়লাবে আমল-আখলাকে মানুষের অবস্থা যেখানে গিয়েই ঠেকুক, যথাযথভাবে নাড়া দিতে পারলে যে মুসলমানের ঈমান ঠিকই কথা বলে উঠে তার চাক্ষুস প্রমাণ মিলেছে এবারও। উলামায়ে কেরামের প্রতি, মসজিদের সম্মানিত খতীবদের প্রতি মানুষের এখনো যে আস্থা বহাল আছে তার জন্য তো আর ভিন্ন প্রমাণ খোঁজার দরকার নেই। আমরা মনে করি, যদি কোনো বিদেশী সাহায্য নাও আসে তবুও এদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় তাদের রোহিঙ্গা ভাই-বোনেরা সম্মানজনকভাবে অবস্থান করতে পারবে এদেশে। দেশের শেষ প্রান্ত টেকনাফ-উখিয়া অভিমুখে শত শত মাইল দূর থেকে ছুটে যাওয়া মানুষগুলোর চোখ-মুখ থেকেই ফুটে উঠে তাদের ঈমানী জযবা ও দুঃখী ভাই-বোনের প্রতি দরদের কথা। সীমিত আর্থিক সামর্থ্য নিয়েও মাদরাসা-মসজিদগুলোর আলেম সমাজের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা এক্ষেত্রে ছিল অনুধাবন করার মত। এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেকেরই। একশ্রেণির বক্র চিন্তার লোক, যারা আলেম সমাজকে কথায় কথায় হেয় করতে দ্বিধা করেন না তাদের বোঝা দরকার পেশিশক্তি এবং বড় ধন-দৌলত কোনো কিছু না থাকার পরও এ লোকগুলো গণমানুষের হৃদয়কে কীভাবে জয় করতে পারে। শিক্ষা রয়েছে দ্বীনের খাদেমদেরও। সে শিক্ষা হতাশাগ্রস্ত না হওয়ার, সে শিক্ষা উঁচু লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার, সে শিক্ষা আমানত ও দায়িত্ববোধের এবং ...। আর শিক্ষা নিতে পারেন অতি জযবাতী আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা তরুণ-যুবকেরাও। দাওয়াতের ক্ষেত্র যে অতি প্রশস্ত এবং হিকমাহ, প্রজ্ঞা, শক্তি-সামর্থ্য ও শর্তাবলী দ্বারা সমৃদ্ধ তাও বুঝার সুযোগ রয়েছে এ গণজাগরণ থেকে। মানুষের কাছে পৌঁছার, তাদের হৃদয় নাড়া দেয়ার এ কৌশলগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে সবসময়, সবখানে। আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, রোগী-দুঃখী লোকজনের পাশে দাঁড়ালে দাওয়াতী কাজ করা যে অনেক সহজ হয়ে যায় তা তো আর বিশ্লেষণ করে বলার প্রয়োজন নেই।
হাঁ, বলা দরকার শুধু বাংলার মুসলমানগণই জাগেনি, জেগেছে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মুসলিমগণও। তুর্কী তো তুর্কীই। তার উপ-প্রধানমন্ত্রী তো সস্ত্রীক ত্রাণ বিভাগের প্রধানকে নিয়ে শরণার্থী এলাকাতেই অবস্থান করছেন। অপেক্ষায় আছেন রোহিঙ্গা ভাই বোনদের আবাসন ও চিকিৎসায় ৪০০ কোটিরও বেশি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের। কক্সবাজারের হোটেলগুলো শুধু তুরস্কের সাহায্যদাতা মুসলিম দিয়ে ভরে যায়নি, সেখানে রয়েছেন আরববিশ্ব ও অন্যান্য প্রান্ত থেকে আসা অসংখ্য মুসলিম নর-নারীও। তাদের সরকারগুলোর অবস্থান যাই হোক, সে তোয়াক্কা তারা করেননি; বরং নিজেদের যা আছে তা নিয়েই হাজির হয়েছেন দ্বীনী ভাই-বোনদের পাশে। মানুষ-মানুষের জন্য এ কথার প্রমাণ মুসলমানগণ না দিতে পারলে আর কে দিবে? যতই বিলম্ব হোক একসময় যে পুরো বিশ্বের মুসলমানের একত্রে জেগে ওঠা আর কোনো ক্রমেই ঠেকানো যাবে না, সে কথার ইঙ্গিত কখনো কখনো মিলে বৈ কি।
রোহিঙ্গা মুহাজিরদের কয়েক গজ করে পলিথিনে মোড়ানো জায়গা দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেললে চলবে না। সামনে কঠিন শীতের সময়। তার আগেই তৈরি করতে হবে নিরাপদ আবাসন। এ ছাড়া শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতেও ব্যাপক কাজ করা দরকার। স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানি ব্যবস্থাও এখন পর্যন্ত খুবই অপ্রতুল। আর শিশুদের ব্যবস্থা তো নেই বললেই চলে। প্রয়োজন মহিলাদের জন্য পৃথক টয়েলেট ও গোসলের ব্যবস্থাও। আমাদের সুপারিশ হল, সরকার এক্ষেত্রে একটি নীতিমালার আওতায় রেখে বেসরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলোকেও সুযোগ করে দিক। আর রোহিঙ্গাদের নৈতিক শিক্ষা তাদের এবং আমাদের সকলের স্বার্থেই ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের সমর্থন-সহযোগিতা সরকার না চাইলেও পাবেন। তাবলীগী জামাত এবং অন্যান্য সহীহ দাওয়াতী কাফেলাগুলোকে সেখানে নির্বিঘ্নে সেবামূলক দাওয়াতী কার্যক্রম চালাতে দেওয়া দরকার। রোহিঙ্গাদের ঈমানী অবস্থা বোঝার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, এক জিল্দ কুরআন শরীফ নেয়ার জন্য তাদের অনেকের মধ্যেই হাহাকার দেখা যায় খাবার গ্রহণ থেকেও অধিক।
বিভিন্ন সেবাদাতা বাহিনী এবং স্থানীয় ও দূর থেকে সাহায্য দিতে আসা জনগণ নির্বিশেষে আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা মুহাজির। আমরা তাদের আনসার। মদীনার আনসারদের মত নিজেদের সম্পত্তির অর্ধেক তাদেরকে না দিতে পারি, আন্তরিকতা, ভালবাসা, নম্র-ভদ্র আচরণ দিতে কার্পণ্য করা কিছুতেই উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে, আমরা তাদের উপর করুণা করছি না, বরং নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব কিঞ্চিত আদায় করছি মাত্র।
قَوْلٌ مَعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةٍ يَتْبَعُها أَذىً وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَلِيمٌ
যে দানের পর ক্লেশ দেওয়া হয় তা থেকে ভালো কথা ও ক্ষমা শ্রেয়। আল্লাহ অভাবম্ক্তু, পরম সহনশীল।-সূরা বাকারা (২) : ২৬৩
ইসলামের এ নীতিকে সামনে নিয়ে কোনো কোনো মুহাজির ভাই থেকে সংঘটিত ভুল-ভ্রান্তি বা অন্যায় কিছু চোখে পড়লেও তা চর্চা ও প্রচার করা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। আল্লাহ্ই তাওফীকদাতা, সকল প্রশংসা তাঁরই।
চলতি সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হল। দু’জন মুরব্বী পণ্ডিত লেখকের সাথে তারুণ্যের সংমিশ্রণ করেছেন আলকাউসারের সহকারী সম্পাদক নিজে। সাথে রয়েছে হিজরী নববর্ষ উপলক্ষে আরেকটি লেখা। ১৪৩৯ হিজরীতে আলকাউসারের সম্মানিত পাঠকবর্গ এবং সংশ্লিষ্ট সকলের ঈমান আমলের আরো উন্নতি হোক। সবাই হায়াতে তাইয়েবার সাথে থাকুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার কাছে এই মিনতি।