Safar 1442   ||   October 2020

সন্তানদের সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তাঁর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটেছে আসমানী ওহীর আগমনধারা এবং পূর্ণতা পেয়েছে ওহীর তালীম ও শিক্ষা। তিনি ওহীর শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়ন করে জগদ্বাসীর জন্য রেখে গেছেন নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। তিনিই আমাদের উসওয়া ও আদর্শ। ইরশাদ হয়েছে-

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوا اللهَ وَ الْیَوْمَ الْاٰخِرَ وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِیْرًا.

নিশ্চয় আল্লাহ্র রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ- এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে। -সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

তাঁর কথা ও মৌনতা, হাসি-কান্না, উঠা-বসা, চলাফেরা সবকিছুতেই রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। শিক্ষক হিসাবে তিনি আদর্শ শিক্ষক। স্বামী হিসাবে আদর্শ স্বামী। পিতা হিসাবে আদর্শ পিতা। বন্ধু হিসাবে আদর্শ বন্ধু। সেনাপতি হিসাবে আদর্শ সেনাপতি। শাসক হিসাবে আদর্শ শাসক।

দয়া-মমতা, হায়া-লজ্জাশীলতা, ক্ষমা ও সহনশীলতায় তিনি উৎকৃষ্ট উপমা। অনুগ্রহ-বদান্যতা, আখলাক-চরিত্র, সুস্থ রুচি, উন্নত চিন্তায় তিনি প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইখলাস-একনিষ্ঠতা, ইবাদত-বন্দেগি, তাকওয়া-আল্লাহভীতি ও দুনিয়াবিমুখতায় তিনি সর্বোত্তম উসওয়া। মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ সাধনে তাঁর উসওয়া ও আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।

তিনি তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন। আর এসব বিষয়ের প্রতি তাঁর ঈমানই ছিল সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। তিনি ইবাদত ও তাকওয়ার প্রতি আহ্বান করেছেন আর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় আবেদ ও মুত্তাকী। তিনি বান্দার হকের দাওয়াত দিয়েছেন, আর এই হক আদায়ের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম উপমা। তিনি উত্তম চরিত্রের দাওয়াত দিয়েছেন আর তিনিই ছিলেন সুন্দর আখলাকের অনুপম দৃষ্টান্ত। তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সাম্য ও সমতা, ন্যায় ও ইনসাফ, সেবা ও খেদমত, সততা ও আমানতদারি, আত্মত্যাগ ও স্বার্থত্যাগ, নসীহত ও হিতকামনা, সুস্থ নীতি ও উন্নত নৈতিকতার প্রতি আহ্বান করেছেন আর তিনিই ছিলেন সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। এভাবে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আগত শিক্ষা ও বিধানের তিনিই ছিলেন বাস্তব নমুনা।

মোটকথা, জীবন ও জগতের সকল অঙ্গনে সঠিক ও শ্রেষ্ঠ দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্যই তাঁর আগমন এবং তাঁর পবিত্র সীরাত ও আদর্শই আমাদের আদর্শ। তাঁর সেই আলোকিত আদর্শ ও সীরাত থেকে আজকের নিবন্ধে সংক্ষেপে একটি বিষয় আলোচনা করব।

 

পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

নবীজীর ছিল তিন পুত্র; কাসেম রা., আবদুল্লাহ রা. ও ইবরাহীম রা.। এবং চার কন্যা; যয়নব রা., রুকাইয়া রা., উম্মে কুলসুম রা. ও ফাতেমা রা.।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন ছেলে-মেয়েদের খুব মহব্বত করতেন, আদর- স্নেহ করতেন। মায়াভরা আদর-যত্নে, হৃদয় উজাড় করা ভালবাসায় তাদের লালন-পালন করেছেন। ইবরাহীমের জন্ম হলে দুধ পান করানোর জন্য তাকে আবু সাইফ নামক এক সাহাবীর স্ত্রীর হাতে সোপর্দ করা হয়। আবু সাইফের বাড়ি মদীনার ‘আওয়ালী’তে। মদীনার আশপাশের গ্রামগুলোকে ‘আওয়ালী’ বলা হয়। মদীনা হতে আওয়ালীর নিকটমত গ্রামের দূরত্ব ছিল দুই মাইল এবং দূরতম গ্রামের দূরত্ব আট মাইল।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তানদের প্রতি কত গভীর স্নেহ ও ভালবাসা লালন করতেন- এর একটা বিবরণ দিয়েছেন সায়্যিদুনা আনাস রা.। তিনি বলেন, ইবরাহীম মদীনার আওয়ালীতে দুধ পান করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে যেতেন। আমরাও তাঁর সঙ্গে যেতাম। তিনি তাদের ঘরে প্রবেশ করতেন। ঘর থাকত ধূয়রাচ্ছন্ন। কারণ, ধাত্রীর স্বামী ছিল কর্মকার।

ঘরে প্রবেশ করে নবীজী ইবরাহীমকে কোলে নিতেন, আদর করে চুমু খেতেন। এরপর চলে আসতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১৬

আরেক বর্ণনায় এসেছে, তিনি তাকে কোলে নিয়েছেন, আদর করে চুমু খেয়েছেন এবং নাকে-মুখে লাগিয়েছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩০৩

সন্তানের প্রতি হৃদয়ের গভীরে কেমন মায়া-মমতা থাকলে পরিবারের হক, রাষ্ট্রের দায়িত্ব, উম্মতের দাওয়াতী ও ইসলাহী যিম্মাদারি আদায়ের সাথে সাথে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে চলে যেতেন শিশু-পুত্র ইবরাহীমকে শুধু দেখার জন্য! শুধু তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর-স্নেহ করার জন্য!

নবীজীর পুত্রগণ শৈশবেই ইনতিকাল করেন। ইবরাহীম রা. ষোল বা আঠারো মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ওফাতের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ে কেমন ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা ছেয়ে গিয়েছিল তা বোঝা যায় সায়্যিদুনা আনাস রা. এর বর্ণনা থেকে-

ইবরাহীমকে দেখার জন্য নবীজীর সাথে আমরা আবু সাইফের বাড়িতে গেলাম। ইবরাহীমের তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল।

আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিও (কাঁদছেন)? তিনি বললেন, এটা হল রহমত। এরপর আবারও তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল এবং তিনি বললেন-

إِنَّ العَيْنَ تَدْمَعُ، وَالقَلْبَ يَحْزَنُ، وَلاَ نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا، وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ يَا إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ.

নিশ্চয় চক্ষু অশ্রু ঝরাচ্ছে এবং হৃদয় বিগলিত হচ্ছে। তবে আমরা মুখে কেবল তাই বলব, যা আমাদের রব পছন্দ করেন। তোমার বিরহে আমরা বড়ই ব্যথিত হে ইবরাহীম! -সহীস বুখারী, হাদীস ১৩০৩

কন্যার প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয় ছিল আদর-স্নেহ ও প্রীতি-ভালবাসায় ভরপুর। নবীজীর বড় মেয়ে যয়নব রা.-এর বিয়ে হয় আবুল আস ইবনে রবীর সঙ্গে। হিজরতের সময় আবুল আস রা. ইসলাম গ্রহণ করেননি। কুরাইশ যখন যুদ্ধ করার জন্য বদর প্রান্তে রওয়ানা হল আবুল আসও তাদের সঙ্গী হলেন এবং কুরাইশ বন্দীদের সাথে তিনিও বন্দী হলেন। উম্মুল মুনিনীন আয়েশা রা. বলেন, মক্কার লোকেরা নিজেদের বন্দীদের মুক্তির জন্য মুক্তিপণ পাঠায়। যয়নব রা.-ও আপন স্বামী আবুল আসের মুক্তির জন্য কিছু জিনিস পাঠান। তাতে একটা হার ছিল, যা খাদীজা রা. যয়নব রা.-কে বিবাহের সময় দিয়েছিলেন। হারটি দেখে (কন্যার স্নেহে) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় বিগলিত হয়ে পড়েন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

إِنْ رَأَيْتُمْ أَنْ تُطْلِقُوا لَهَا أَسِيرَهَا، وَتَرُدُّوا عَلَيْهَا الَّذِي لَهَا، فَافْعَلُوا.

তোমরা ভালো মনে করলে যয়নবের বন্দীকে মুক্তি দিয়ে দাও এবং তার হারটি ফেরত পাঠিয়ে দাও।

তারা বললেন, অবশ্যই, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরপর তারা আবুল আসকে মুক্তি দিয়ে দেন এবং যয়নবের হারটি ফেরত পাঠিয়ে দেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৩৬২ 

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বিতীয় কন্যা হযরত রুকাইয়া রা.। তার বিয়ে হয় হযরত উসমান রা.-এর সাথে। বদরযুদ্ধের সময় রুকাইয়া রা. খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর সেবা-শুশ্রূষার জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান রা.-কে যুদ্ধে না গিয়ে মদীনায় থাকার নির্দেশ দেন এবং তাঁকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন-

إِنَّ لَكَ أَجْرَ رَجُلٍ مِمَّنْ شَهِدَ بَدْرًا وَسَهْمَهُ.

নিশ্চয় তুমি বদরযুদ্ধে যোগদানকারী একজন মুজাহিদের সমান সওয়াব এবং তার সমপরিমাণ গনীমতের অংশ পাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৩০

তৃতীয় কন্যা উম্মে কুলসুম রা.-এর ওফাতের পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কবরের পাশে গিয়ে বসলেন। তাঁর চোখ থেকে তখন অবিরাম অশ্রু ঝরছিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৮৫

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা হযরত ফাতেমা রা.। তাঁর প্রতি নবীজীর আদর- সোহাগ ছিল সবচে বেশি। তিনি নবীজীর ঘরে এলে পিতৃস্নেহের উষ্ণতা দিয়ে তাঁকে বরণ করতেন। আয়েশা রা. শোনাচ্ছেন যে, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে উঠা-বসা, আচার-অভ্যাস, চালচলন, আখলাক-চরিত্রে ফাতেমার চেয়ে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকে আমি দেখিনি। ফাতেমা নবীজীর কাছে এলে তিনি এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরতেন, তাকে চুমু দিতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যখন ফাতেমার কাছে যেতেন তিনিও উঠে এসে পিতাকে চুমু দিতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২১৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪২১০

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো কন্যাদের সাদর সম্ভাষণ জানাতেন। আয়েশা রা. বলেন, একবার ফাতেমা হেঁটে আসছিল। তার হাঁটার ধরন ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতই। তাকে আসতে দেখে নবীজী বলে উলঠেন-

مَرْحَبًا بِابْنَتِي.

আমার কন্যাকে স্বাগতম!

এরপর তাকে নিজের ডানে বা বামে বসালেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৬২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৫০

এই ঘটনা ক’টি নিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায়, সন্তানের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্নেহ-ভালবাসা কত গভীর ছিল!

 

সন্তানদের দুনিয়াবিমুখতার তরবিয়ত

সকল দরদী ও মমতাবান পিতাই সন্তানের কল্যাণ প্রত্যাশা করে, নিজ নিজ বিবেচনা অনুযায়ী। কারো কাছে আখেরাতের চিন্তা-ফিকির নেই বা থাকলেও তা গৌণ, দুনিয়াটাই মুখ্য। তারা সন্তানের জন্য দুনিয়ার কল্যাণের আকাক্সক্ষা করে। কেউ অর্থ-বিত্তকে কল্যাণের চাবিকাঠি মনে করে নিজের সন্তানের জন্য সম্পদের প্রাচুর্যের আশা করে। কেউবা পদ-পদবীকে সফলতার মানদ- মনে করে সন্তানের উচ্চ পদে সমাসীন হওয়ার কামনা করে। যে জাগতিক শিক্ষাকে সফলতার বিন্দু বিবেচনা করে সে ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এভাবে যার বিবেচনায় যে বিষয় সুখ-শান্তি ও সফলতার মাধ্যম সে ঐ ক্ষেত্রে আপন সন্তানের সার্থক পদচারণার স্বপ্ন দেখে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পার্থিব কোনো বিষয়ই কল্যাণ ও কামিয়াবীর কেন্দ্রবিন্দু নয়। তাই জাগতিক কোনো বিষয়ের প্রতি তাঁর কোনো বাসনা ছিল না। দুনিয়া তো তাঁর নিকট মশার পাখা থেকেও হীন। [দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৮৫] বরং ত্রুটিযুক্ত মৃত ছাগলছানা থেকেও তুচ্ছ। [দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৫৭] তাঁর দৃষ্টিতে দুনিয়া ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের জায়গা নয়। বরং দুনিয়া ও দুনিয়ার বিলাস সামগ্রী হল প্রবঞ্চক, প্রতারক। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে, তিনি সন্তানদের জন্য বিত্ত-বৈভব ও বিলাস সামগ্রি পছন্দ করবেন না। 

এক্ষেত্রে আলী রা. ও ফাতেমা রা.-এর জীবন হল সুন্দর উদাহরণ। তাঁদের সংসারে দৈন্য ও অভাব-অনটন ছিল নিত্য বিষয়। সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম ফাতেমা রা. নিজ হাতে সম্পাদন করতেন। তিনি অনেক কষ্ট-ক্লেশের কাজ নিজে আঞ্জাম দিতেন। হাদীস ও সীরাতের কিতাবাদিতে সেসবের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি নিজ হাতে জাঁতা চালাতেন। এরপর নিজেই রুটি তৈরি করতেন। জাঁতা চালাতে চালাতে তার উভয় হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭০৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৭০৭, ৩৭০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৫৫১)

মশক দিয়ে পানি টানতে টানতে তাঁর গায়ে দাগ পড়ে গিয়েছিল। নিয়মিত আগুনে রান্না করাতে তাঁর জামা-কাপড় কালচে হয়ে থাকত এবং প্রত্যহ ঘর ঝাড় দেওয়ায় তাঁর কাপড়-চোপড় ধুলা-ধূসরিত হয়ে যেত। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৯৮৮, ৫০৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩১৩)

তাঁরা যে চাদরটা গায়ে দিয়ে ঘুমাতেন তা এত ছোট ছিল যে, পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যেত, মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত। (দ্র. মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৩৮)

এভাবে ফাতেমা রা. কষ্ট-কঠিন জীবনযাপন করে যাচ্ছিলেন। এরই মাঝে একবার নবীজীর নিকট গনীমতের মাল এবং কিছু গোলাম এল। ফাতেমা রা. নবীজীর খেদমতে নিজের করুণ অবস্থার কিছু বিবরণ দিলেন এবং একজন খাদেমের আবেদন করলেন।

চিন্তা করুন, একজন পিতা, যার রয়েছে সন্তানের প্রতি হৃদয় উজাড় করা স্নেহ-মমতা, কলিজার টুকরা প্রিয় কন্যার এমন কষ্টের কথা শুনলে তার মনে কেমন তোলপাড় সৃষ্টি হতে পারে! কিন্তু নবীজী কী করলেন? শুনুন আলী রা. এর যবানে-

আলী রা. বলেন, রাতে নবীজী আমাদের ঘরে এলেন। আমি এবং ফাতেমার মাঝখানে আমাদের সাথে লেগে বসলেন এবং বললেন-

أَلاَ أَدُلُّكُمَا عَلَى خَيْرٍ مِمَّا سَأَلْتُمَا؟ إِذَا أَخَذْتُمَا مَضَاجِعَكُمَا أَوْ أَوَيْتُمَا إِلَى فِرَاشِكُمَا فَسَبِّحَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَاحْمَدَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَكَبِّرَا أَرْبَعًا وَثَلاَثِينَ، فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمَا مِنْ خَادِمٍ.

শোনো, তোমরা যা চেয়েছ তারচে উত্তম জিনিস কি তোমাদের বলব না? তোমরা যখন রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদু লিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। এটা তোমাদের জন্য খাদেমের চেয়ে উত্তম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১১৩, ৫৩৬২, ৩৭০৫, ৫৩৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২৭, ২৭২৮

অপর বর্ণনায় এসেছে, তখন ফাতেমা রা. উত্তরে বলেছেন-

رَضِيتُ عَنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَعَنْ رَسُولِهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সন্তুষ্ট। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৯৮৮

শরীয়তের সীমার মাঝে থেকে শোভা-সৌন্দর্য গ্রহণ করাটা দূষণীয় নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্নেহের মেয়েদের জন্য এটাও পছন্দ করতেন না। ইবনে উমর রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সফর থেকে ফিরলে) সাধারণত প্রথমে ফাতেমা রা.-এর সাথে দেখা করতেন। একদা তিনি  ফাতেমা রা.-এর গৃহে এলেন। তার দরজায় পর্দা ঝুলানো দেখে তিনি ভিতরে প্রবেশ করেননি। আলী রা. ঘরে এসে দেখেন ফাতেমা রা. বিষজিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে? বললেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উদ্দেশ্যে এসেছেন, কিন্তু আমার সাথে সাক্ষাৎ না করেই চলে গেছেন। আলী রা. নবীজীর খেদমতে এসে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ফাতেমার সাথে দেখা করার জন্য গেলেন, এরপর দেখা না করে চলে এলেন! ফাতেমা এতে খুব কষ্ট পেয়েছে। তিনি বললেন-

وما أنا والدنيا؟ وما أنا والرقم؟ إِنِّي رَأَيْتُ عَلَى بَابِهَا سِتْرًا مَوْشِيًّا.

আমার সাথে দুনিয়ার কী সম্পর্ক? আমার সাথে কারুকার্যের কী সম্পর্ক? আমি তার দরজায় নকশাকৃত পর্দা দেখেছি।

আলী রা. ফাতেমার কাছে এসে নবীজীর কথা শোনালেন। ফাতেমা রা. বললেন, আল্লাহ্র রাসূলকে বলুন, তিনি যা ইচ্ছা আমাকে নির্দেশ দিতে পারেন। তখন নবীজী বললেন, ফাতেমাকে বল, সে যেন পর্দাটি অমুক অভাবী পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬১৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদী ৪১৪৯

ফাতেমা রা.-এর বিয়ের অনেক অনেক দিন পরের ঘটনা। সাওবান রা. বলেন, একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমার গৃহে আগমন করলে ফাতেমা রা. গলা থেকে একটি স্বর্ণের হার খুলে নবীজীকে দেখালেন  এবং বললেন, হাসানের পিতা (আলী রা.) আমাকে এটা হাদিয়া দিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

يَا فَاطِمَةُ بِالْعَدْلِ أَنْ يَقُولَ النَّاسُ فَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ، وَفِي يَدِكِ سِلْسِلَةٌ مِنْ نَارٍ؟

এটা কি ইনসাফ হবে যে, মানুষ বলাবলি করবে, ফাতেমা হল মুহাম্মাদের মেয়ে, অথচ তোমার হাতে আগুনের হার?

ফাতেমা! এরপর ফাতেমাকে কঠিন ভর্ৎসনা করলেন এবং বের হয়ে চলে গেলেন। আর একটুও বসলেন না।

তখন ফাতেমা রা. হারটি বিক্রি করে দিলেন এবং এর মূল্য দিয়ে একটি গোলাম খরিদ করে তাকে আযাদ করে দিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে বললেন, ‘আল্লাহু আকবার’।

الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِي نَجَّى فَاطِمَةَ مِنَ النَّارِ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র, তিনি ফাতেমাকে আগুন থেকে রক্ষা করলেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৯৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫১৪০

 

সন্তানদের নেক আমলের উৎসাহ প্রদান

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো তাঁর উম্মতের সকল সদস্যের জন্যই ইহকালীন মুক্তি ও নিরাপত্তা এবং পরকালীন শান্তি ও সফলতার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। সুতরাং তিনি স্নেহের কন্যাদের জন্য আখেরাতের অধিক সওয়াব ও মর্যাদার বিষয়ে চিন্তা করবেন, এটাই  তো স্বাভাবিক। তাই আদরের কন্যাদের সবরের অনুশীলন করানোর সাথে সাথে নেক আমলের প্রতিও উৎসাহ দিতেন।

অধিক সওয়াব ও মর্যাদার একটি আমল হল তাহাজ্জুদ নামায। কলিজার টুকরো সন্তান এর সুফল ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে- এটা কি মানা যায়? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ রাতে প্রিয় মেয়ে ফাতেমার গৃহে গিয়ে তাহাজ্জুদের জন্য জাগিয়ে দিতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭৫

আনাস রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমা রা.-কে বললেন-

হে ফাতেমা! গুরুত্ব দিয়ে আমার উপদেশ শোনো। সকাল ও সন্ধ্যায় তুমি বলবে-

يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ، أَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلُّهُ، وَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ.

[হে চিরঞ্জীব! হে মহানিয়ন্ত্রক! আমি তোমার রহমতের সাহায্য চাই। আমার সকল কর্ম ও অবস্থা শুধরে দিন। এবং এক পলকের জন্যও আমাকে নিজ দায়িত্বে ছেড়ে দিবেন না। (কখনো আপনার সাহায্য ও রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন না।)] -সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ১০৩৩০; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৬৩৬৮

সারকথা, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যাদের খুব ভালবাসতেন, আদর-স্নেহে লালন-পালন করতেন। তাদের প্রতি অত্যধিক মহব্বতের কারণে তিনি চাইতেন না যে, আদরের দুলালীরা নিজেদের সৎকর্মের কিছু পুরস্কার দুনিয়াতেই ভোগ করে ফেলবে। তেমনিভাবে তারা যেন বেশি বেশি নেক আমল করে আখেরাতে সুউচ্চ মাকাম ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারে, সে তামান্নাও করতেন।

সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ হল, পুত্র-কন্যাদের হৃদয় উজাড় করে ভালবাসা ও আদর-যত্ন করা এবং তাদের জন্য পার্থিব সুখ-শান্তি ও সফলতার তুলনায় আখেরাতের সুখ-শান্তি ও সফলতাকে প্রাধান্য দেওয়া।

 

advertisement