‘ইসলাহ’ বিষয়ক কিছু মৌলিক কথা
কবীরা গুনাহ ও এর কিছু নতুন রূপ
[নিজের ইসলাহের ফিকির করা, ইসলাহের জন্য যথাযথ চেষ্টা করা এবং কার্যতভাবে ইসলাহে লেগে যাওয়া প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। ইসলাহ মানে হল, জীবনটা ঈমানী জীবন হওয়া। জীবনের প্রত্যেক শাখা ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ-আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া। বিষয়টি বলতে তো অনেক সহজ কিন্তু আমলী ময়দানে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের অনেক অবহেলা ও প্রান্তিকতা প্রকাশ পায়। যার বড় একটি কারণ হল, ইসলাহ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ইলমের অভাব।
এ অভাব দূর করার জন্য আমাদের এক দ্বীনী ভাই, যিনি নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার বন্ধু-বান্ধব আপনজনের জন্য সহজবোধ্য সংক্ষিপ্ত একটি লেখা প্রস্তুত করেন। লেখাটি নযরে সানী ও সম্পাদনার জন্য আমার কাছে পাঠান। আমার পরামর্শ মোতাবেক মাওলানা সায়ীদুল হক লেখাটির নযরেসানী করেন এবং অনেকগুলো জরুরি বিষয় তাতে যুক্ত করেন। তারপরও লেখাটি এখনো সংক্ষিপ্তই। আসলে সর্বস্তরের লোকদের জন্য সহজবোধ্য সংক্ষিপ্ত লেখাই বেশি উপযোগী।
এ লেখায় কবীরা গুনাহের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা এবং বর্তমান সময়ে প্রচলিত কবীরা গুনাহের ভয়াবহ কিছু রূপের আলোচনা হয়েছে। ব্যস, প্রয়োজন তো এটাই যে, আমরা যেন খুব গুরুত্বের সাথে এসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকি। শরীয়তের শিক্ষা তো হল, নেকীর কাজ ছোট হলেও তা ছাড়ব না। গুনাহের কাজ ছোট হলেও তা করব না। কিন্তু কবীরা গুনাহের বিষয়টি আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। এ ধরনের গুনাহের নামই তো হল موبقات অর্থাৎ ধ্বংসকারী গুনাহসমূহ, বরবাদকারী গুনাহসমূহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সমস্ত মুসলিম উম্মতকে ধ্বংসাত্মক গুনাহ থেকে হেফাযত করুন এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী আমলগুলো করার তাওফীক দান করুন।
মাওলানা মুহাম্মাদ ফজলুল বারী লেখাটি দেখে তা আলকাউসারের পাঠকদের জন্য পেশ করার আবেদন করলেন। এ প্রেক্ষিতে লেখাটি আবার সম্পাদনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা লেখাটি কবুল করেন। এর মাধ্যমে উম্মতকে উপকৃত করেন। যিনি এ লেখা প্রস্তুত করেছেন তাকে এবং তার খান্দানকে কিয়ামত পর্যন্ত ঈমান ও আফিয়াতের নিআমতে ভরপুর রাখেন এবং সমস্ত ফিতনা-ফাসাদ ও অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ রাখেন।
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
২৮-০১-১৪৪২ হি.
বৃহস্পতিবার]
। এক।
ইসলাহের পথে যে কাজগুলো করা জরুরি
ক. ফরয বা অত্যাবশ্যকীয় কর্ম।
আল্লাহর নৈকট্য, সওয়াব ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম ও প্রধান কাজ হল, ফরয ইবাদতগুলো যথাযথভাবে আদায় করা।
খ. ফরযের পর অতিরিক্ত নফল ইবাদত।
গ. ফরযের পরে নিয়মিত সুন্নাত ও নফল ইবাদত পালন বান্দাহকে আল্লাহর বন্ধুত্ব বা বেলায়েতের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।
ঘ. ফরয ইলম, আকীদা, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ¦, হালাল উপার্জন, সাংসারিক দায়িত্ব, পিতা-মাতা, সন্তান ও স্ত্রীর দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব, পেশাগত দায়িত্ব, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ ইত্যাদি সকল ফরয আমল (যার ক্ষেত্রে যতটুকু প্রযোজ্য) পালন না করে নফল ইবাদত পালন করা, নফল যিকির ইত্যাদি পালন বিশেষ কোনো উপকারে আসবে না।
ঙ. ফরয পরিত্যাগ করলে হারামের গুনাহ হয়। হারামের গুনাহরত অবস্থায় নফল ইবাদতের অর্থ হল সর্বাঙ্গে মলমূত্র লাগানো অবস্থায় নাকে আতর মাখা।
। দুই।
ইবাদত কবুলের পূর্ব-শর্তসমূহ
১. ঈমান
শিরক, কুফর ও নিফাকমুক্ত তাওহীদ ও রিসালাতের বিশুদ্ধ ঈমান সকল ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত।
২. ইখলাস
ইখলাস অর্থ বিশুদ্ধকরণ। ইবাদতটি একান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি বা অন্য কারো উদ্দেশ্যের সামান্যতম সংমিশ্রণ থাকলে সে ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না।
৩. ইত্তিবায়ে সুন্নত
কর্মটি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণে পালিত হতে হবে। সুন্নাতের ব্যতিক্রম কর্ম ইবাদত বলে গণ্য নয়।
৪. হালাল ভক্ষণ
ইবাদত পালনকারীকে অবশ্যই হালাল জীবিকা-নির্ভর হতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ.
অর্থাৎ যে দেহের বৃদ্ধি হারাম দ্বারা হয় সে দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৭২৩
। তিন।
আমরা কি ধোঁকার শিকার নই?
ফরয ও নফলের দুটি দিক রয়েছে। পালন ও বর্জন। কিছু কাজ করা যেমন ফরয, তেমনি কিছু জিনিস বর্জন করাও ফরয। আল্লাহর নৈকট্যের পথে কর্মের চেয়ে
বর্জনের গুরুত্ব বেশি।
যে ব্যক্তি (তার উপরে) ফরয কোনো কর্ম পালন করছেন না বা (তার জন্য) হারাম কোনো কাজে রত রয়েছেন অথচ বিভিন্ন নফল মুস্তাহাব কর্ম পালন করছেন তার কাজ নিশ্চিতভাবে ইসলামের শিক্ষাবিরুদ্ধ।
নিজেকে নোংরা, অপরিচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে এরপর যতটুকু সম্ভব সাজগোজ করতে হবে। এজন্য সকল নাজায়েয মাকরূহ কাজ বর্জন করা নফল ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাকরূহ কাজ করে ফেললে বেশি বেশি তাওবা-ইসতিগফার করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَاجْتَنِبُوهُ، وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ.
আমি তোমাদেরকে কোনো কিছু থেকে নিষেধ করলে তা বর্জন করবে; আর কোনো কিছু করতে নির্দেশ দিলে সাধ্যমত তা করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭২৮৮
। চার।
কবীরা গুনাহ বর্জন
যে সকল পাপের বিষয়ে কুরআনে কারীম বা হাদীস শরীফে কঠিন গযব, শাস্তি বা অভিশাপের উল্লেখ করা হয়েছে বা যে সকল কর্মকে কুরআন বা হাদীসে সরাসরি কবীরা গুনাহ বলা হয়েছে বা কঠিন পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোকে কবীরা গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া যে কোনো সাধারণ পাপও সর্বদা করলে তা বড় পাপে পরিণত হয়।
ইমাম যাহাবী রাহ. ‘আলকাবাইর’ গ্রন্থে কবীরা গুনাহ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসসমূহ সংকলন করেছেন। যে সকল পাপকে কুরআন বা হাদীসে বড় পাপ বা কঠিন শাস্তি, আযাব, গজব বা অভিশাপের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি সেগুলির তালিকা প্রদান করেছেন। ইমাম যাহাবী রাহ. ছাড়াও আরো অনেক মুহাদ্দিস ও ফকীহ এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন।
কুরআন-হাদীসের আলোকে মানুষের মূল দায়িত্ব দুটি ও পাপের সুত্রও দুটি। প্রথম দায়িত্ব, মানুষ তার মহান প্রভুর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্¦াস, অগাধ ভালবাসা ও আস্থা পোষণ করবে এবং এ আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায় এমন সকল কর্ম আল্লাহর মনোনীত রাসূলের শিক্ষা অনুসারে পালন করবে। (একে হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক বলে) আর এ দায়িত্বে অবহেলা সৃষ্টি করে এমন সকল কর্ম বা চিন্তা-চেতনাই প্রথম পাপ।
মানুষের দ্বিতীয় দায়িত্ব, এ পৃথিবীকে সুন্দর বসবাসযোগ্য করতে তার আশেপাশের সকল মানুষ ও জীবকে তারই মতো ভালোভাবে বাঁচতে সাহায্য করা। (একে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক বলে) আর এ দায়িত্বে অবহেলাজনিত কর্মই দ্বিতীয় প্রকারের পাপ। আল্লাহর সৃষ্টির কষ্ট প্রদান, ক্ষতি করা, শান্তি বিনষ্ট করা বা অধিকার নষ্ট করাই মূলত সবচেয়ে কঠিন অপরাধ।
। পাঁচ।
হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর অধিকার বিনষ্টকারী কবীরা গুনাহসমূহ
ক. ঈমান বিনষ্টকারী কবীরা গুনাহসমূহ
১. শিরক
* যেসব বিষয় ও গুণাবলি একমাত্র আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্য এবং যেসব বিষয় একমাত্র আল্লাহ তাআলার হক তাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত করা।
* আল্লাহ ছাড়া কাউকে শরীয়ত প্রদানের অধিকারী মনে করা, হালাল-হারাম নির্ধারণের অধিকারী মনে করা। শরীয়তের কোনো বিধান রহিত করার ক্ষমতাবান মনে করা।
* উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বের কোনো বিষয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাওয়া। যেমন, কোনো মাযারওয়ালার কাছে বা কোনো পীরের কাছে সন্তান প্রার্থনা করা, ধনাঢ্যতা চাওয়া, রোগমুক্তি প্রার্থনা করা।
* কবরে বা মাযারে তাওয়াফ করা।
* কবরে বা মাযারে সিজদা করা।
* আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মান্নত করা।
* আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পশু জবাই করা।
* ভাষ্কর্য তৈরি করা বা স্থাপন করা ইত্যাদি।
২. কুফর
* ঈমান গ্রহণ না করা। ইসলাম ধর্মকে অস্বীকার করা। ইসলামী শরীয়তকে অস্বীকার করা। কুরআন-সুন্নাহকে অস্বীকার করা। শরীয়তের যে কোনো অকাট্য বিষয়কে অস্বীকার করা। ইসলামের যে কোনো নিদর্শন নিয়ে উপহাস করা। রাসূলের অবমাননা করা। শরীয়তের যে কোনো নিদর্শনের অবমাননা করা। খতমে নবুওত অস্বীকার করা। নবুওতের কোনো মিথ্যা দাবিদারকে বিশ্বাস করা, তাকে মুজাদ্দিদ বা মাহদী বা মাসীহ-এর সদৃশ মনে করা।
* কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ত-বিরোধী আইন প্রণয়ন করা।
* শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দÐবিধি অস্বীকার করা।
* কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তের আইনী দিককে অস্বীকার করা।
* কুরআন সুন্নাহ্র স্পষ্ট বিপরীত আইনকে অনুসরণীয় মনে করা।
* ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মতবাদে বিশ্বাস করা।
* ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো চেতনা, সংস্কৃতি, মতবাদ, ভাবধারা পোষণ, লালন বা প্রসার করা।
* যেসব বিষয় অমুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক (বিশ্বাসগত হোক বা কর্মগত) সেসব বিষয়ে তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা।
৩. নিফাক
ক. আকীদাগত নিফাক।
খ. কর্মগত নিফাক।
* কুরআন সুন্নাহ্র বিপরীত আইন অনুযায়ী ফয়সালা করা।
* ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহক আলেমগণ বা দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র-মক্তব-মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষ রাখা।
৪. আকীদাগত বিদআত
৫. আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে নির্ভয় থাকা।
৬. আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া।
৭. তাকদীরে অবিশ্বাস করা।
৮. গণক বা জ্যোতিষীর কথা সত্য মনে করা।
৯. মক্কার হারামে কোনো প্রকার অন্যায় করা।
১০. যাদু শিক্ষা বা ব্যবহার করা।
১১. অশুভ, অমঙ্গল বা অযাত্রায় বিশ্বাস করা।
১২. নিজের জীবন, সম্পদ ও সকল মানুষের মহব্বতকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহব্বতের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া।
১৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীস বলা।
১৪. নিজের পছন্দে-অপছন্দে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত ও শরীয়তের অনুগত না হওয়া।
১৫. ফরয সালাত পরিত্যাগ করা।
১৬. যাকাত প্রদান থেকে বিরত থাকা।
১৭. ওযর ছাড়া রমযানে সিয়াম পালনে অবহেলা করা।
১৮. ওযর ছাড়া জুমার সালাত পরিত্যাগ করা।
১৯. সুযোগ থাকা সত্তে¡ও হজ্ব আদায় না করা।
এগুলোর অধিকাংশই ঈমানকে মূল থেকে বিনষ্ট করে দেয়। আর কোনো কোনোটি এমন না হলেও সেগুলো ঈমানকে প্রায় বিনষ্ট করে দেয়।
খ. হারাম খাদ্য ও পানীয়
১. মদ পান করা।
২. মৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা।
৩. হারাম প্রাণীর গোশত ভক্ষণ করা।
৪. শুকরের গোশত ভক্ষণ করা।
৫. স্বর্ণ বা রৌপ্যের পাত্রে পান করা।
৬. প্রবাহিত রক্ত পান করা।
গ. পবিত্রতা ও অন্যান্য অভ্যাস বিষয়ক
১. পেশাব থেকে পবিত্র না হওয়া।
২. মিথ্যা বলার অভ্যাস ।
৩. কৃত্রিম চুল লাগানো ।
৪. শরীরে খোদাই করে উল্কি লাগানো।
৫. পুরুষের জন্য-
* মেয়েলি পোশাক বা চালচলন বা আচরণ করা।
* টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পোশাক পরা।
* সোনা ও রেশম ব্যবহার।
* দাড়ি না রাখা।
৬. মেয়েদের জন্য-
* পুরুষালি পোশাক বা আচরণ করা।
* সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে বাইরে যাওয়া।
* মাথার চুল বা শরীরের কোনো অংশ অনাবৃত রেখে বাইরে যাওয়া।
* সুগন্ধি মেখে বাইরে যাওয়া।
ঘ. অন্তর বা মনের পাপ
১. অহংকার করা।
২. নিজেকে বড় ভাবা।
৩. কোন মানুষকে হেয় করা বা ছোট ভাবা।
৪. হক অস্বীকার করা বা হক মেনে নিতে টালবাহানা করা।
৫. আসাবিয়্যাত তথা অন্যায় পক্ষপাত।
৬. উজব তথা আত্মগুণমুগ্ধতা।
৭. রিয়া ও প্রদর্শনেচ্ছা।
৮. হিংসা।
৯. ক্রোধ ।
১০. প্রশংসা ও সম্মানের লোভ।
১১. সম্পদের লোভ।
১২. কৃপণতা।
১৩. নিষ্ঠুরতা।
১৪. ইলম গোপন করা।
১৫. দ্বীনী ইলম পার্থিব উদ্দেশ্যে শিক্ষা করা।
অহংকার, হিংসা, কাউকে হেয় ভাবা, কৃপণতা ইত্যাদি ব্যক্তিগত কবীরা গুনাহ হলেও এ ব্যাধি মানুষকে বান্দাহ্র হক নষ্ট বা ক্ষতিকারী অনেক পাপের দিকে প্ররোচিত করে। এগুলোর অভিব্যক্তি ব্যক্তির বাইরে প্রকাশিত হয়ে অন্যদের কষ্ট দেয়।
। ছয়।
হাক্কুল ইবাদ তথা সৃষ্টির অধিকার সংক্রান্ত কবীরা গুনাহ
১. আত্মহত্যা করা।
২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া বা তাদের কষ্ট দেয়া।
৩. সন্তান ও অধীনস্তদেরকে দ্বীনী শিক্ষা না দেয়া ও দ্বীনী তরবিয়ত তথা দ্বীনী মন-মানস ও রুচি-প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা না নেয়া।
৪. অন্যায় দেখেও সাধ্যমতো প্রতিকার ও প্রতিবাদ না করা।
৫. সুদ নেয়া, দেয়া, সুদ লেখা বা সুদের সাক্ষী হওয়া।
৬. ঘুষ নেয়া, দেয়া বা ঘুষ আদান-প্রদানের মধ্যস্থতা করা।
৭. যুলুম করা, আল্লাহর যে কোনো মাখলুকের প্রতি যে কোনো প্রকারের যুলুম করা। কারো জান, মাল বা মান-সম্মানে অন্যায় আঘাত করা।
৮. ওজন, মাপ বা দ্রব্যে কম দেয়া বা ভেজাল দেয়া।
৯. ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা।
১০. জুয়া খেলা।
১১. কারো জমি বা সম্পদ আত্মসাত করা।
১২. মীরাস বণ্টন না করে নিজে তা দখল করে রাখা।
১৩. জমির সীমানা পরিবর্তন করা।
১৪. রক্তের আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা।
১৫. আত্মীয়তার হক নষ্ট করা।
১৬. পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা।
১৭. বঞ্চিত ও দরিদ্রদেরকে খাদ্য প্রদানে ও সাহায্য দানে উৎসাহ না দেয়া।
১৮. কথাবার্তায় সংযত না হওয়া। যা কিছু শোনা হয় বিচার বিশ্লেষণ ও সত্যাসত্য নির্ধারণ না করে তা বলা।
১৯. মিথ্যা শপথ করা।
২০. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
২১. প্রয়োজনের সময় সত্য সাক্ষ্য গোপন করা।
২২. প্রয়োজনীয় পণ্যের অন্যায় মজুতদারী।
২৩. ওয়াদা ভঙ্গ করা।
২৪. আমানতের খেয়ানত এবং সকল প্রকারের দুর্নীতি।
২৫. ধোঁকা ও প্রতারণা।
২৬. বিশ্বাসঘাতকতা।
২৭. কর্কশ ব্যবহার ও অশ্লীল অশ্রাব্য কথা বলা।
২৮. অভিশাপ বা গালি দেওয়ায় অভ্যস্ত হওয়া।
২৯. মুসলিমগণকে কষ্ট দেয়া বা গালি দেয়া।
৩০. কোনো মানুষের উপকার করে পরে খোটা দেয়া।
৩১. কোনো উপকারীর উপকার অস্বীকার করা বা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
৩২. তিন দিনের অধিক কোনো মুসলিমের সাথে কথাবার্তা বন্ধ রাখা।
৩৩. নিজের পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলা বা বলানো।
৩৪. স্ত্রীর জন্য স্বামীর অবাধ্য হওয়া।
৩৫. একসাথে তিন তালাক দেয়া বা তালাক দিয়ে স্ত্রী-সন্তানের প্রতি যুলুম করা।
৩৬. স্বামীর জন্য স্ত্রীর টাকা বা সম্পদ তার ইচ্ছার বাইরে ভোগ বা দখল করা।
৩৭. স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক তাদের একান্ত গোপনীয় কথা অন্য কাউকে বলা।
৩৮. উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
৩৯. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া।
৪০. কারো বাড়ি বা ঘরের মধ্যে অনুমতি ছাড়া দৃষ্টি দেয়া।
৪১. সমাজের মানুষদেরকে কবীরা গুনাহের কারণে কাফের বলা বা মনে করা।
৪২. মানুষের গোপন কথা শোনা বা জানার চেষ্টা করা।
৪৩. চোগলখুরি করা।
৪৪. গীবত বা পরচর্চা করা।
৪৫. অসত্য দোষারোপ করা।
৪৬. পাপ বা বিভ্রান্তির দিকে বা খারাপ রীতির দিকে আহŸান করা।
৪৭. কারো প্রতি অস্ত্রজাতীয় কিছু উঠানো বা হুমকি প্রদান করা।
৪৮. জেদাজেদী ঝগড়া বা কলহ কোন্দল করা।
৪৯. কোনো মুসলিমের প্রতি হিংসা বা শত্রæতা পোষণ করা।
৫০. মুসলিমদের গোপন দোষ খোঁজা, জানা ও বলে দেয়া।
৫১. কোনো মুসলিমের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে অর্থ লাভ করা।
৫২. কোনো ব্যক্তিকে তার বংশের বিষয়ে অপবাদ দেয়া।
৫৩. ইসলাম-নির্ধারিত শাস্তিযোগ্য অপরাধে (চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি) অপরাধীর শাস্তি মওকুফের জন্য সুপারিশ বা চেষ্টা করা।
৫৪. যে অপরাধে কাউকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যায়- এমন কোনো অপরাধ ছাড়া কোনো মানুষকে হত্যা করা।
এমনকি ডাকাতি, খুন, ধর্মদ্রোহিতা ইত্যাদি ইসলামী বিধানে যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদÐ বলে নির্ধারিত সে অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিকেও কোনো ব্যক্তি নিজের হাতে শাস্তি দিলে তা জায়েয হবে না। একমাত্র উপযুক্ত আদালতের বিচারের মাধ্যমেই অপরাধীর অপরাধ, তার মাত্রা ও শাস্তি নির্ধারিত হবে। যথাযথ বিচারে অপরাধী প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী মনে করা বা শাস্তি দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে সৃষ্টির অধিকার নষ্টকারী কঠিন অপরাধ।
৫৫. রাষ্ট্র বা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ করা।
৫৬. রাষ্ট্র বা প্রশাসনের অন্যায় বা যুলুম সমর্থন বা সহযোগিতা করা।
৫৭. রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ বা ভোগ করা, তা যত সামান্যই হোক না কেন।
৫৮. জবরদস্তি, মিথ্যা মামলা বা অবৈধভাবে কোনো মানুষ থেকে কিছু গ্রহণ করা।
৫৯. (হাট-বাজার, রাস্তাঘাটে) চাঁদাবাজি করা।
৬০. মুসলিম সমাজে বসবাসরত অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দেয়া বা তার অধিকার নষ্ট করা।
৬১. আল্লাহর প্রিয় ধার্মিক বান্দাগণকে কষ্ট দেয়া বা তাদের সাথে শত্রæতা করা।
৬২. কোনো নবী বা রাসূলের সমালোচনা করা।
৬৩. মহান সাহাবীগণের সমালোচনা করা।
৬৪. মহান আহলে বাইতের সমালোচনা করা।
৬৫. মুজতাহিদ ইমামগণ এবং সালাফে সালেহীন তথা উম্মতের পূর্বসূরী অনুসরণীয় উলামা-মাশায়েখের সমালোচনা করা।
৬৬. কোনো মজলিসে এসে খালি জায়গায় না বসে মানুষের ঘাড় ডিঙিয়ে অন্যদের কষ্ট দিয়ে মজলিসের মাঝে এসে বসে পড়া বা এমনভাবে বসা, যাতে অন্য মানুষদের অসুবিধা হয়।
৬৭. নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অন্যকে প্রদান থেকে বিরত থাকা।
৬৮. কোন প্রাণির মুখে আগুনে পুড়িয়ে বা দাগ কেটে মার্ক করা।
৬৯. অবৈধ ঝগড়া বা গোলযোগে সহযোগিতা করা।
৭০. কেউ আল্লাহর দোহাই দিয়ে সাহায্য বা ক্ষমা চাইলে তার প্রতি বিরক্ত হওয়া বা তাকে ক্ষমা বা সাহায্য না করা।
৭১. নিরপরাধ মানুষকে বিশেষত মহিলাকে চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর সুস্পষ্ট সাক্ষ্য ছাড়া ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া।
৭২. সমাজে অশ্লীলতা প্রসার করে এমন কোনো গল্প-গুজব বা কথাবার্তা বলা বা প্রচার করা।
। সাত।
আরো কিছু কবীরা গুনাহ
১. কর্মগত বিদআত
ক. মাযারে বা দরবারে ওরস করা।
খ. ইসলামী শিক্ষার বিপরীতে জাহেলিয়াতের রীতি-নীতি অনুসরণ করা।
* মাযারে বা সমাধিতে বা স্মৃতিস্মারকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা।
* মৃতব্যক্তির লাশে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা।
* কবরের সামনে বা লাশের সামনে সম্মানার্থে নীরবতার প্রথা পালন করা ।
* মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালন করা।
২. প্রাণীর ছবি আঁকা।
৩. অফিস-আদালতে, ঘরে বা রুমে মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর ছবি বা প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা।
৪. ব্যাভিচার, সমকামিতা বা যৌন অনাচার।
৫. পরকীয়া।
৬. পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে যে কোনো ধরনের অবৈধ সম্পর্ক।
৭. স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীর অন্যের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ককে সমর্থন করা। তেমনিভাবে স্ত্রী কর্তৃক তার স্বামীর অন্যের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ককে সমর্থন করা।
(তবে এক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট শরীয়তসম্মত দলীল ছাড়া শুধু ধারণার ভিত্তিতে বা কোনো আলামতের উপর নির্ভর করে কারো প্রতিই কারো কুধারণা করা হারাম।)
৮. পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ছবি দেখা।
৯. কুদৃষ্টি করা।
১০. অশ্লীল উপন্যাস পড়া।
১১. টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইলের অবৈধ ব্যবহার। বিশেষ করে এগুলোর মাধ্যমে চোখ, কান বা মন-মস্তিষ্কের কোনো গুনাহে লিপ্ত হওয়া।
১২. স্ত্রীর জন্য স্বামীর মোবাইল বা স্বামীর জন্য স্ত্রীর মোবাইল চেক করা। এককথায় যে কোনো ধরনের ‘তাজাসসুস’ তথা অন্যের গোপন বিষয় অনুসন্ধানই নাজায়েয।
১৩. খেলাধুলাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করা।
১৪. মুনাফিক বেদ্বীন বা যে কোনো ইসলাম-বিদ্বেষীর ঢালাও প্রশংসা করা বা তাকে অনুসরণীয় বলা বা মনে করা।
১৫. অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব, পূজা-পার্বণে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করা।
উপরের সকল পাপই অত্যন্ত ক্ষতিকর। কুরআন ও হাদীসে এগুলোর ভয়ংকর শাস্তি ও খারাপ পরিণতির কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে কোনো কোনো পাপকে নেক আমলের কারণে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। আবার কোনো কোনো পাপ সকল নেক আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। সকল ইবাদত বিনষ্টকারী পাপের মধ্যে রয়েছে- শিরক, কুফর, আকীদাগত বিদআত, অহংকার, হিংসা, অপরের হক (অধিকার) নষ্ট করা, গীবত করা ইত্যাদি।
***
শেষ কথা হল, আমরা সবাই নিজেদের ইসলাহের প্রতি মনোনিবেশ করি; নিজেকে ধোঁকার মাঝে না রাখি। দ্বীন-ঈমানের পথে উন্নতি অর্জনের ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির শিকার না হই।
আল্লাহ তাআলা আমাকে, আপনাকে, সবাইকে তাওফীক দান করুন- আমীন।
وآخر دعونا أن الحمد لله رب العالمين.