দরসের টানে ...
ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দরস। দরসের এক কোণে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়া শুনছে যে বালকটি, তার নাম ইয়াকুব। লোকে বলে আবু ইউসুফ। জন্ম ইরাকের কুফা নগরীতে। হিজরী ১১৩ সালে। পড়ার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ তার। কিন্তু বাবা ইবরাহীম পড়াতে চান না। উপার্জনে লেগে যেতে বলেন। কারণ তারা খুবই গরিব।
কিন্তু আজকের এই আবু ইউসুফই একদিন পরিণত হন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ‘ফকীহ’রূপে। কুরআন-সুন্নাহ্য় ছিল যার অসম্ভব পাণ্ডিত্য। যুগের যে কোনো সমস্যার বিস্ময়কর সমাধান দিতে তিনি ছিলেন প্রবাদতুল্য পুরুষ। দ্বীনী ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ থেকে, দুনিয়াবি ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। একারণে লোকসমাজে তিনি পরিচিত হয়েছেন বিখ্যাত একজন ‘ফকীহ’ হিসেবে।
এই বালকই একসময় হয়ে উঠেছেন ইতিহাস বিখ্যাত একজন মুহাদ্দিস। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইয়াহইয়া ইবনে মাঈনের মতো জগতসেরা ফক্বীহ এবং মুহাদ্দিসদের তিনি ছিলেন প্রিয় উস্তায। আর ইমাম বুখারীর মতো অসাধারণ মুহাদ্দিসও ছিলেন তাঁর নাতি পর্যায়ের শাগরেদ।
সূর্যের আলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তার কথা। তার যোগ্যতা ও পাণ্ডিত্যের কথা। তার অসাধারণ মেধা খলীফা হারুনুর রশীদের চোখে লাগল। মনে ধরল। বানিয়ে নিলেন তাকে প্রধান বিচারপতি। প্রধান কাযী।
আবু ইউসুফের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, পরামর্শ এবং বুযুর্গি দেখে খলীফা পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যেতেন। কারণ তিনি শুধু ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং কাযীই ছিলেন না, ছিলেন উচ্চস্তুরের একজন মুফাসসির ও ইতিহাসবিৎও। বিশেষ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত ও তাঁর যুদ্ধবিষয়ক ইতিহাসে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। তিনি ইন্তেকাল করেন ১৮২ হিজরীতে, রবিউল আউয়াল মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার।
এই বালক যে এত বড় একজন মনীষী হবেন- তার বাবা ঠিক ঠাহর করতে পারেননি। গরিব-দরিব সরল মানুষ। তার কাছে দু-পয়সা উপার্জনই বড়। তাই তিনি আবু ইউসুফকে পড়াতে চান না। তারপরও আবু ইউসুফ কীভাবে কীভাবে জানি দরসে চলে আসে। এজন্য অবশ্য তাকে মাঝেমধ্যে বকুনিও খেতে হয়। কিন্তু এসব সে গা করে না। আজ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল দরসের পড়া। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনীয় কথা নোটও করছিল। হঠাৎ কোথা থেকে যেন আব্বু এসে হাজির। এমন মজার দরস ছেড়ে উঠে যেতে হবে, ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তার।
পথে আব্বু গাম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি আর এমুখো হবে না। কী বললাম বুঝতে পেরেছ?
আবু ইউসুফ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না সে।
আব্বু আগের কথার রেশ ধরে বললেন, আবু হানীফার সাথে কি তোমার তুলনা চলে? তিনি তো ধনী মানুষ। গোশত-রুটি খান। কিন্তু তুমি? তুমি তো গরিব। আয়-রোজগার না করলে খাবে কী?
বালক আবু ইউসুফ অনেক দিন হল বাড়িতে। আব্বুর সাথে কাম-কাজ করে। এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। এতে আব্বুর অনেকটা আরাম হয়। কাজও দু-পয়সার বেশি হয়। তবে লেখা-পড়ায় খুব বেশি ঢিল পড়ে যায়। বড় রকমের ভাটা পড়ে তাতে। এখন আগের মত দরসে যেতে পারে না।
সারাদিন আব্বুর সাথে কাম-কাজ করে। কিন্তু মন পড়ে থাকে দরসে। কী এক দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে নিজের মধ্যে। যেন কোনো অদৃশ্য-শক্তি তাকে টানতে থাকে দরসের দিকে। তবু দাঁতে ঠোঁট চেপে লেগে থাকে কাজে। কয়েকদিন পর বিরক্তিতে মন তেতে ওঠে তার। অসম্ভব কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে গলার নিচে এসে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে।
কী কষ্টে যে এভাবে কাটতে লাগল দিন- তা আর বলার নয়। তারপরও সে আব্বুর আদেশ অমান্য করতে চায় না। বাবা-মা’র অবাধ্য হওয়া খুব খারাপ কাজ; আবু হানীফার দরস থেকেই সে একথা জেনেছে। গুনাহ তো হয়-ই, সব কাজের বরকতও নষ্ট হয়ে যায়। এতে জীবনে অকল্যাণ নেমে আসে। তাই আবু ইউসুফ আব্বুর আনুগত্যকেই প্রাধান্য দিল। অনেক দিন হল দরসে যেতে পারে না। কিন্তু এ-ওর কাছ থেকে সে দরসের খোঁজ-খবর ঠিকই রাখত।
ওদিকে ইমাম আবু হানীফাও তার অনুপস্থিতি খুব করে অনুভব করতেন। কেন জানি তাঁর মনটাও প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠত। এমন একজন আগ্রহী, মনোযোগী এবং মেধাবী ছাত্রের দীর্ঘদিন দরসে না আসা খুবই চিন্তার বিষয়। বিপুল ¯েœহ উথলে উঠতে লাগল তার জন্য। অন্যান্য ছাত্রদেরকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাও করতেন।
একদিন আবু ইউসুফ হঠাৎ দরসে এসে হাজির। তাকে দেখেই অসম্ভব খুশিতে ভরে উঠল আবু হানীফার মন। ¯েœহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-
আবু ইউসুফ! এতদিন এলে না যে, কোনো অসুখ হয়েছিল কি?
আবু ইউসুফের চোখে-মুখে কষ্টের এক ধরনের ছায়া নামল। বলল, না মানে- আব্বু বলেছিলেন লেখা-পড়া বাদ দিয়ে কাজ-কর্ম করতে। উপার্জনমুখী হতে। তাই তাঁর কথা রক্ষা করতে গিয়েই...।
কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ধরে এল তার। বুক ফেটে কান্না আসতে চাচ্ছিল। অতি কষ্টে সে ভাবটা গোপন করল।
তার কথা শুনে ইমাম আবু হানীফার অবাক হওয়ার কথা। কিন্তু হলেন না। শুধু বললেন, ও-আচ্ছা। যেন তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, এমন একটা কিছু ঘটতে পারে।
দরস শেষে সব ছাত্র চলে গেল। ইমাম আবু হানীফা কাছে ডাকলেন আবু ইউসুফকে। একটি থলে বাড়িয়ে ধরলেন। বললেন, এটা রাখো। প্রয়োজন মতো খরচ কোরো।
দেখে তো আবু ইউসুফের চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। সে কী! এ তো দেখি পুরো একশ দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা)। এতগুলো দিরহাম কখনো সে হাতে ধরেই দেখেনি। অথচ আজ উস্তাদজী সবগুলো তাকে দিয়ে দিলেন! কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন ঠেকছে তার কাছে।
আবু হানীফা রাহ. ঠোঁটে হাসি মেখে বললেন, এখন থেকে নিয়মিত দরসে আসবে। একদিনও কামাই দেবে না।
বুকভরা অসীম স্নেহ যেন একেকটি শব্দ হয়ে বের হলো তাঁর মুখ থেকে।
তিনি আগের কথার রেশ টেনে বললেন, আর শোনো- এই দিরহামগুলো ফুরিয়ে গেলে সাথে সাথে আমাকে জানাবে, কেমন?
আবু ইউসুফ নির্বাক মাথা নাড়াল। মুখে তার এগাল-ওগাল হাসি। এখন থেকে সে নিয়মিত পড়তে পারবে। দরসে আসতে পারবে প্রতিদিন। অসম্ভব খুশিতে তার চোখ-মুখ কেমন ঝলমল করে উঠল।