Muharram 1442   ||   September 2020

মা ইনদাকুম ইয়ানফাদু...
[...مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ]

Mawlana Muhammad Abdul Malek

হামদ ও সালাতের পর :

লাইলাতুল জুমুআ এবং ইয়াওমুল জুমুআ গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ কিছু আমলও রয়েছে এদিন। দরূদ শরীফ বেশি বেশি পড়া, সূরা কাহফের তিলাওয়াত করা। আর অন্যান্য আমল তো আছেই। জুমাকেন্দ্রিক হাদীস শরীফে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, শুধু জুমার রাতকে শবগুযারির জন্য খাস কোরো না। শুধু জুমার দিনকে রোযার জন্য খাস কোরো না। অন্য কোনো দিন রোযা রাখে না, শুধু জুমার দিন রাখে, অন্য কোনো রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে না, শুধু জুমার রাতে পড়ে- এমনটা করো না। হাদীসে এ ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। এই নিষেধের কী অর্থ? তার মানে অন্যান্য দিন যেহেতু কর না, জুমার দিনও কোরো না- হাদীসের উদ্দেশ্য কি এটা? উদ্দেশ্য হল, বিশেষ ফযীলত মনে করে শুধু এ রাতেই তাহাজ্জুদ পড়ছ, বিশেষ ফযীলত মনে করে শুধু এই দিনেই রোযা রাখছ- এটা ঠিক না।

কোনো সময়ের গুরুত্ব থাকলে সে গুরুত্বটা আমি কীভাবে অর্জন করব? কোনো সময়ের বিশেষ ফযীলত থাকলে সে ফযীলতটা হাসিল করব কীভাবে- সেটাও শরীয়তের শেখানো পদ্ধতিতে করতে হবে। শরীয়তের হুকুমের মতো করে নিজের থেকে একটা আমল নির্ধারণ করে নেওয়া- এটা ঠিক নয়। রাতের কিছু অংশ ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানো, এটা তো প্রতি রাতের-ই বিধান। তদ্রƒপ নফল রোযা যদি সম্ভব হয়, যেকোনো দিনেই হতে পারে। কিন্তু নিজের থেকে শুধু এই রাতকেই খাস করে নেওয়া যে, এই রাতেই তাহাজ্জুদ পড়ব, এই দিনেই শুধু রোযা রাখব- এমনটা ঠিক না।

এই হাদীসে অনেক শিক্ষা আছে। একটি শিক্ষা হল, শুধু ব্যাপক ফযীলতের ভিত্তিতে বিশেষ ইবাদত আবিষ্কার করা যে বিদআত- সে বিদআতের খণ্ডন এই হাদীসে আছে। আরেকটা হল, এই আমলগুলোর প্রতি অন্য সময়ও যতœ নিতে হবে। অন্যান্য রাতেও যদ্দুর পারা যায় তাহাজ্জুদের প্রতি খেয়াল রাখা। যার দ্বারা সম্ভব নফল রোযা রাখা। সোমবার, বৃহস্পতিবারের রোযা তো আছেই।

যাইহোক, আমি ‘শবগুযারি’ শব্দ বলেছি। হাদীসে আছে মনে হয় ‘কিয়াম’। হাদীসের পাঠ-

لَا تَخْتَصّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللّيَالِي، وَلَا تَخُصّوا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيّامِ، إِلّا أَنْ يَكُونَ فِي صَوْمٍ يَصُومُهُ أَحَدُكُمْ.

কিয়াম’ মানে রাতজাগা। রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা। কিয়াম শব্দ বলে যেসব ইবাদতের প্রতি ইঙ্গিত তার মধ্যে প্রথমেই হল নামায। যদিও অন্যান্য ইবাদতও আছে; কিন্তু নফল নামাযের প্রতি-ই ইঙ্গিতটা বেশি হয়। যেহেতু এখানে রাত জাগার বিষয়টা রয়েছে, সেজন্য আমি শবগুযারি শব্দ বলেছি। কিন্তু আমাদের ওরফে আবার ‘শবগুযারি’ শব্দ বিভিন্ন পরিভাষার জন্য ব্যবহৃত হয়। তাবলীগের কাজের সাথে যারা যুক্ত, তাদের শবগুযারি হল সাধারণত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে। বিভিন্ন পয়েন্টে সবাই জড়ো হয়, সেখানে কিছু বয়ান হয়, কিছু ইনফেরাদি আমল হয়, রাতে থাকা হয়।

আবার যারা কোনো বুযুর্গের সাথে সম্পর্ক রাখেন, কিছু ইসলাহী ফিকির করেন, তাদের ওখানেও শবগুযারি আছে। তাবলীগের শবগুযারিটা সাধারণত সাপ্তাহিক আর ওটা হয় সাধারণত মাসিক। এক রাত বা দু-তিন রাতও হয়। সেটাকে ইসলাহী জোড়ও বলে।

শবগুযারি এটা ফার্সি শব্দ। শব মানে, রাত। গুযারনা মানে, যাপন করা। শবগুযারি মানে, রাতযাপন করা। কিন্তু এগুলো হল একটা ব্যবস্থাপনাগত বিষয়। এটাকে মাসআলার মতো করে পালন করা যায় না। এবং এটা শুধু ইবাদতের জন্য নয়, তালীম এবং আলোচনাসহ বিভিন্ন মাকসাদে হতে পারে। সাথে কিছু ইবাদত-বন্দেগীও হল। হাদীস শরীফে যে বলা হয়েছে, শুধু এই রাতকে কিয়ামুল লাইলের জন্য খাস করবে না এবং এই দিনকে রোযার জন্য খাস করবে না- ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায় মনে হয় এটা পড়ে না। তাবলীগের শবগুযারি বা খানকার দ্বীনী মজলিসগুলো ওই নিষেধাজ্ঞার আওতাতে আসবে না মনে হয়। কারণ এটা ইন্তেযামি বিষয়।১

যাহোক, আমরা জড়ো হলাম, আল্লাহ তাআলা আমাদের এই জড়ো হওয়া এবং বসাকে কবুল করুন। যেই ফিকির নিয়ে বসেছি সে ফিকির যাতে আমলেও বাস্তবায়ন হয় আল্লাহ তাআলা সেই তাওফীক দান করুন- আমীন।

কুরআনে কারীমের সূরা নাহলে একটি আয়াত আছে-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ  وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ .

তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী। যারা ধৈর্য ধারণ করে নিশ্চয় আমি তাদেরকে তাদের কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। -সূরা নাহল (১৬) : ৯৬

আসলে কুরআনে কারীমের তালীমের একটা বৈশিষ্ট্য হল, তার একেকটা তালীম একেকটা সূত্র। এই এক সূত্র ধরে যদি মানুষ চলতে থাকে তাহলে এটি আল্লাহ তাআলা মানুষকে যত আহকাম ও হেদায়েত দিয়েছেন, যতগুলো তালীমাত ও শিক্ষা দিয়েছেন সবগুলোর দিকে টেনে নিয়ে যায়। এটা কুরআনে কারীমের বড় বৈশিষ্ট্য।

আমি যদি আমার ইসলাহ চাই, আমার ঈমানের তারাক্কি চাই বা আপনি যেই ভাষায়-ই বলেন না কেন, দ্বীন-দুনিয়া এবং আখেরাতকেন্দ্রিক যা-ই চাই তার জন্য বিভিন্ন ধরনের মুরাকাবা-মুহাসাবা আছে, যা আমার কাজগুলোকে সহজ করে দেয়। কুরআনে কারীমে এরকম অনেকগুলো মুরাকাবা দেওয়া আছে। মানুষ তো নিজের থেকে কত ধরনের মুরাকাবা আবিষ্কার করে। বিদআতীদের কথা বলছি। অথচ কুরআনের মধ্যে অনেক মুরাকাবার সূত্র দেওয়া আছে। এই একটা সূত্র-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ

তোমাদের কাছে যা আছে শেষ হয়ে যাবে।’ কারণ সেটা ক্ষণস্থায়ী ও সামান্য সময়ের বিষয়। আর وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ -আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা চিরস্থায়ী।’ সবসময় থাকবে। তার কোনো শেষ নেই।

এটি ইসলামী শিক্ষা এবং আল্লাহর দেওয়া হেদায়েতগুলোর মধ্যে মৌলিক একটি হেদায়েত। চিন্তা, মুরাকাবা, মুহাসাবা, নিজের ইসলাহের ফিকির যেভাবেই বলেন আপনি, সবকিছুর জন্য মৌলিক একটা সূত্র হল-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ.

তোমাদের কাছে যা আছে, ওটা শেষ হয়ে যাবে। কোনোটার-ই কোনো স্থায়িত্ব নেই। আর আল্লাহর কাছে যা আছে, বাকি থাকবে।

এখানে একেবারে সহজভাবেই দুটো কথা এসে যায় :

এক. তোমার কাছে যা আছে তা খুব তাড়াতাড়ি আল্লাহর কাছে পাঠাও। যা আছে মানে কেবল ধন-সম্পদ নয়; বরং তোমার সময় আছে, মেধা আছে, শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে, মোটকথা যা আছে দুনিয়াতে- তোমার সব তাড়াতাড়ি আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দাও! এমনভাবে পাঠাবে, যাতে তোমার এই ইতমিনান হয় যে, আল্লাহর কাছে পৌঁছেছে; তাহলেই না আল্লাহর কাছে হল। আমার আমানতটা আল্লাহর কাছে পৌঁছেছে- এটা নিশ্চিত হতে হবে না?

আল্লাহর কাছে পাঠাও, তাহলে এটা স্থায়ী হবে। এটা এই আয়াতের একেবারে স্পষ্ট একটা শিক্ষা।

দুই. আরেকটা শিক্ষা হল- আমরা দ্বীন এবং আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে পারি না কেন? আমাদের কাছে যেগুলো আছে সেগুলোর কারণেই তো। আমার খেয়াল-খুশি, এটাও তো একটা জিনিস।  مَا عِنْدَكُمْ -এর মধ্যে তো এটাও আছে। এই খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে কারো ইবাদত-বন্দেগীতে ত্রুটি হয়, কারো জন্য গোনাহ থেকে বাঁচা কঠিন হয়ে যায়। তো এখানে আমাকে চিন্তাগতভাবে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে- مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ -তুমি যে খাহেশ, মনোবাসনা এবং সাময়িক নফসের ভালোলাগা, যেগুলোর কারণে গোনাহে লিপ্ত হচ্ছ, ইবাদত ছেড়ে দিচ্ছ, এটা তো সাময়িক বিষয়। সামান্য সময়ের বিষয়। এই আনন্দ এই ফুর্তি কতক্ষণের? এই বিনোদন কতক্ষণের? একেবারেই ক্ষণিকের। কাজেই তা বাদ দিয়ে কিছুক্ষণ আল্লাহর যিকির কর, আল্লাহর বন্দেগী কর। গোনাহ করতে যে সাময়িক ভালোলাগা সে ভালোলাগাটাকে কুরবানী করে দাও। আল্লাহর কাছে পাব- এই আশায়। আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর থেকে পাওয়ার আশায় যদি ছেড়ে দাও আল্লাহ তা জমা রাখবেন। কেবল বাকি-ই থাকবে না, বাড়তে থাকবে।

মানুষ অর্থের মহব্বত, ধন-সম্পদের মহব্বত, মান-মর্যাদার মহব্বত বা নিজের নফসের তাড়না এবং খাহেশের দুর্বলতায় পড়েই হয় ইবাদত ছাড়ে, নয়তো গোনাহ করে। সেকথা-ই আল্লাহ পাক বলেছেন- مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ -তোমাদের কাছে যা আছে সব শেষ হয়ে যাবে।  وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ-আল্লাহর কাছে যা আছে সব বাকি থাকবে। কাজেই এগুলোর পিছনে পড়ে আল্লাহর কাছে যা তুমি আশা কর তা ছাড়বে না। বরং সেটাকেই প্রাধান্য দিতে থাকো!

এমনিতে স্বাভাবিক বিচারেও যেটা ক্ষণিকের, তারচে’ মানুষ স্থায়ী জিনিসকে-ই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এখানে আয়াতের মধ্যে আল্লাহ্ও সেই সূত্রটাই ধরিয়ে দিয়েছেন। শুধু এতটুকু উপদেশ-ই যথেষ্ট ছিল যে, আমাদেরকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত ওই জিনিসকে, যা আল্লাহর কাছে বাকি থাকবে। তারপরেও আল্লাহ-ই যেহেতু আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি জানেন, এই প্রাধান্যটা দিতে বান্দার অনেক কষ্ট হবে। যদিও আমি নীতিগতভাবে এটা বুঝি, দুনিয়ার এসব সাময়িক-ক্ষণস্থায়ী, আখেরাতেরটা স্থায়ী; এই সাময়িক জিনিসটার গলত ব্যবহার করলে স্থায়ী ক্ষতি, আর তার সঠিক ব্যবহার করলে স্থায়ী ফায়দা; কাজেই আমার স্থায়ীটাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত, কিন্তু প্রাধান্য দিতে কষ্ট হয়। এই যে কষ্ট হয়, এটা আল্লাহ তাআলা জানেন। কারণ তিনিই তো আমাদের সৃষ্টি করেছেন। এজন্য তিনি আয়াতের দ্বিতীয় অংশে বলেছেন-

وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.

আল্লাহর কাছে যা তা বাকি থাকবে, তারপরেও সেটাকে যে প্রাধান্য দিতে তোমার কষ্ট হবে, ওই কষ্টটা একটু করো। একটু সবর করো। দেখ না কী হয়! সবর না করলে তো কাজ হবে না। যারা সবর করে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে সেটাকে কষ্ট করে প্রাধান্য দেয়; নিজের নফস এবং মনোবাসনার বিরোধিতা করে, এই বিরোধিতা করতে গিয়ে যে কষ্ট ও সবর করল, তার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে আজর ও সওয়াব দান করবেন-

بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.

যেটি তাদের আমলের মধ্যে সবচে সুন্দর আমল, সেটাকে আসল ধরে আল্লাহ তাআলা আজর দান করবেন। আরেকটা হল, সে যা আমল করেছে এরচে’ ভালো এবং উত্তম প্রতিদান তাকে আল্লাহ দান করবেন। সে আমল করেছে সামান্য, কিন্তু আল্লাহ তাকে প্রতিদান দেবেন এরচে বেশি ও উত্তম। দুটো তরজমাই হতে পারে।

وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ

আয়াতের দ্বিতীয় অংশ যদি এমনে পড়ে চলে যাই, এর আসল মর্ম ধরা মুশকিল হবে। অথচ এটা প্রথম অংশের সাথে খুব গভীরভাবে জড়িত।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে মূলনীতিও দিয়েছেন আবার এই মূলনীতি যে একশ ভাগ সত্য- তার উপর ঈমান ও বিশ্বাসও আছে, বুঝিও, উপলব্ধিও করি, তারপরও বাস্তব ক্ষেত্রে এর উপর আমল করতে আমার কষ্ট হবে- এটা আল্লাহ জানেন, সবর যদি আমি না-করি পারব না, সবর আমাকে করতেই হবে, সেজন্য আল্লাহ পরে সবরের উপর প্রতিদান দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। কারণ সবরের কষ্টটুকু বরদাশত করতে হয়, না-হয় তারাক্কি হয় নামানুষের ইসলাহ এবং তারাক্কির জন্য সবরের কষ্টটুকু সহ্য করতেই হবে, সেজন্যই আল্লাহ বলে দিয়েছেন-

وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ.

যারা ধৈর্য ধারণ করে নিশ্চয় আমি তাদেরকে তাদের কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।

সবরের তো কয়েকটা প্রকার রয়েছে। প্রত্যেক প্রকারের মধ্যেই এই কথাটা প্রযোজ্য-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ.

সবরের যে প্রকারটা আমাদের নিকট বেশি প্রসিদ্ধ এবং প্রথম চিন্তাতেই যেটা আমাদের মাথায় আসে সেটা হল-الصبر على المصائب والشدائدআপদ-বিপদ, বলা-মসিবত, কষ্ট-পেরেশানি এসব হালাত আসলে সবর করা। এটা সবরের একটা প্রকার। মসিবত তো মানুষের কত প্রকারের! এর কি কোনো শেষ আছে? একটা প্রকারের মসিবত হল কোনো সন্তানের ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এই মসিবত এবং কষ্টের সময় স্মরণ করা-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ  وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ

যে সন্তানটা আমার এখনো হায়াতে আছে তারও তো সময় আসবে, আরে, এমনকি আমারও তো সময় এসে যাবে। তাহলে ওর সময় এসে গেছে তাতে কী? তাকে আল্লাহ নিয়ে গেছেন, এতে আমার কী? তাছাড়া সে তো থাকার জন্য আসেওনি। এসেছেই যাওয়ার জন্য। আমি যদি এটাকে এভাবে নিই যে, আল্লাহর নিআমত আল্লাহ নিয়ে গেছেন; ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! তাহলে এটা আল্লাহর কাছে জমা হয়ে যাবে। আর  وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ     আল্লাহর কাছে যেটা আছে সেটা বাকি থাকবে।

সবর করলে কেবল আমার সবরটা আল্লাহর কাছে জমা থাকবে- তা কিন্তু নয়; বরং সন্তানসহ জমা থাকবে। আর সে আখেরাতে আমার জন্য যখীরা হবে। আখেরাতে যখন আমার আর কোনো ব্যবস্থা হবে না তখন এ-ই আমার কাজে আসবে। সন্তানটাই আল্লাহর কাছে আমার আমানত থাকবে। আর যদি এই সবর না করতে পারি তো সন্তান হারিয়েছি তো হারিয়েছিই; সবই হারিয়েছি। কারণ বে-সবরি করলেই যে সন্তান চলে আসবে- এমন তো না, তখন দুনিয়ার জন্যও হারালাম, আখেরাতের জন্যও হারালাম। আর যদি সবর করি, তাহলে এখন যদিও হারিয়েছি কিন্তু  وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ    -পরকালের জন্য বাকি থাকবে এবং-

وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ .

আর আমি সবরকারীদেরকে তাদের প্রতিদান অবশ্যই দান করব, সেসব সৎকর্মের জন্য, যা তারা করত।

তো, এই যে সবর, যেমন ব্যবসায় লস হয়ে গেছে তো সবর। কারণ مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُআরে, লস না হলেও আর কত দিন-ই বা এ সম্পদ থাকত তোমার কাছে? কিন্তু সবর যদি করি তো-

وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ.

সবর যদি করি, তো যেটা হারিয়েছি সেটাসহ জমা থাকবে। তার বিকল্প ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেও দেবেন, আখেরাতেও দেবেন। বিকল্প মানে উত্তম বিকল্প। এজন্যই তো মসিবতের সময় দুআ শেখানো হয়েছে-

إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ، اللَّهُمَّ اؤْجُرْنِيْ فِيْ مُصِيْبَتِي وَاخْلُفْ لِيْ خَيْرًا مّنِْهَا.

আল্লাহ, এই যে মসিবত দিলেনমসিবত আসল, তার বিনিময়ে আপনি আমাকে উত্তম আজর ও প্রতিদান দান করুন। এবং এর পরিবর্তে আমি যেন এরচে ভালো কিছু আপনার কাছে পাই।  সেটা দুনিয়াতেও হতে পারে, আখেরাতেও হতে পারে। বা উভয় জায়গায় হতে পারে। ভালো তো অবশ্যই। দুনিয়ার ভালোটা তো বাহ্যিকভাবে আসবে, কিন্তু আখেরাতের ভালোটা তো এমনিতেই স্পষ্ট। দুনিয়ার ভালোটা বাহ্যিকভাবে ভালো হলে বুঝবে যে ভালো। কিন্তু যদি অন্য কোনো দিক থেকে ভালো হয় তাহলে নজরে পড়বে না- ভালো কি ভালো না? কিন্তু আখেরাতেরটা যে ভালো তা তো একেবারে স্পষ্ট।

সবরের আরেক প্রকার হল-الصبر عن المعصية আসসবরু আনিল মা‘সিয়াহ- গোনাহ থেকে বাঁচার জন্য সবর। নফস, শয়তান এবং পরিবেশ সবাই টানছে গোনাহের দিকে,  (নফস আর শয়তান-এর সাথে আরেকটা বাড়ালাম- পরিবেশ। পরিবেশ বলতে আমার চারপাশও লাগে না এখন। আজকাল পরিবেশ একা একাও হতে পারে; বরং একা থাকলে গোনাহের পরিবেশ আরো বেশি জমে)।  তো সব আমাকে টানছে গোনাহের দিকে, কিন্তু আমাকে সবর করতে হবে। যতই আমাকে টানুক, আমি চেষ্টা করব আল্লাহর নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকতে। এই হল সবর। এটা সবরের গুরুত্বপূর্ণ প্রকার এবং ফরয। ওই সবরের চেয়ে এই সবর বড় ফরয। ওটাও ফরয কিন্তু এটা বড় ফরয।

তো গোনাহের মধ্যেও যে একটা আনন্দ-ফুর্তি, একটা মজা এবং ভালোলাগা থাকে, এটা يَنْفَدُ -সাময়িক এবং সামান্য সময়ের বিষয়। কিছুক্ষণ পরে এই মজা আর থাকবে না। কিন্তু যদি এই গোনাহ থেকে বেঁচে থাক, তাহলে এর বিনিময়ে আল্লাহ যে সওয়াব ও ফায়দা দান করবেন- তা বাকি থাকবে। দুনিয়াতেও এর পরিবর্তে যে ভালো দিকগুলো দান করবেন- সেটাও স্থায়ী। যেহেতু সেটা নিজের ঈমান ও আমলের কাজে লাগছে এজন্য এটাও  وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ -এর আওতায় চলে যাবে। আল্লাহর কাছে জমা হয়ে যাচ্ছে; সেজন্য এটাও স্থায়ী হয়ে যাবে।

সবরের আরেকটা প্রকার- الصبر على الطاعة আসসবরু আলাত তাআহ- নেক আমলের জন্য সবর করা। যদিও নেক আমল করতে মন তৈরি হয় না; কিন্তু আমাকে সবর করতে হবে। ফরয নামায ছাড়া যাবে না। তদ্রƒপ নফল নামায যদিও নফল, কিন্তু আমি যেহেতু এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি বা চেষ্টা করছি কাজেই এটাও আমি ছাড়ব না। এজন্য নয় যে, এটা ফরয; বরং এজন্য যে, নফলের অভ্যাস করে নেওয়া আল্লাহ পছন্দ করেন। পরিমাণে কম হলেও যদি এটাকে সর্বদা করা হয়- আল্লাহ খুব পছন্দ করেন। কাজেই এটাকে স্থায়ী করে নেওয়ার চেষ্টা করা। চেষ্টা করা- এটা যাতে না ছোটে। তিলাওয়াত না ছোটে, তাসবীহ না ছোটে, দরূদ শরীফ না ছোটে। এই ‘না-ছুটা’-এর জন্যও একটা সবরের দরকার হয়। সেটাও ‘আসসাবরু আলাত তাআত’-এর মধ্যে শামিল।

যে আমল যত গুরুত্বপূর্ণ সে আমলের জন্য সবর তত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যদি এখানে আমি বে-সবরি করি, আজকের তিলাওয়াত ছেড়ে দিলাম, বা অন্য কোনো আমল ছেড়ে দিলাম, তো কেন ছাড়লাম? দুনিয়ার কোনোকিছুর জন্যই তো ছাড়লাম। বা এমনিই আজকে বেকার থাকতে মন চেয়েছে, এটাও দুনিয়া। কোনো খারাপ কাজে সময় দিচ্ছি সেটা তো স্পষ্ট। গল্প-গুজব এবং অহেতুক সময় নষ্ট করছি সেটাও দুনিয়া। মানে, আমি যে আজকের নেক আমলটা ছেড়ে দিলাম, যে জন্যই ছেড়েছি, তা অবশ্যই দুনিয়া। এবং مَا عِنْدَكُمْ ‘তোমাদের কাছে যা আছে’-এর অংশ। কাজেই এটা يَنْفَد   শেষ হয়ে যাবে। কারণ বাকি থাকার যেটা, সেটা কেবলই আমল। এজন্য আল্লাহ তাআলা আমলের নাম দিয়েছেন- الْبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ 

পুরো আয়াত হল-

اَلْمَالُ وَ الْبَنُوْنَ زِیْنَةُ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ الْبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَّ خَیْرٌ اَمَلًا.

ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা এবং স্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাক্সিক্ষত হিসেবেও উৎকৃষ্ট। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৪৬

আরেক জায়গাতেও আছে-

وَ الْبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَّ خَیْرٌ مَّرَدًّا.

এবং স্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং তার (সামগ্রিক) পরিণামও শ্রেষ্ঠতর। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৭৬

এখানে একথাও মনে রাখা দরকার যে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির ব্যাপারে যদি শরীয়তের শিক্ষার প্রতি লক্ষ রাখা হয়, সম্পদ উপার্জন ও ব্যায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আল্লাহর বিধানের প্রতি লক্ষ রাখা হয়, সন্তানকে আল্লাহর নিআমত মনে করে তার দ্বীনী তরবিয়তের প্রতি খেয়াল রাখা হয় এবং তার হক আদায় করা হয় তখন এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি শুধু দুনিয়ার যীনত থাকবে না বরং আখেরাতের যখীরা হয়ে যাবে এবং  عِنْدَ اللهِ بَاقٍ -এর মধ্যে শামিল হয়ে الْبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰت-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

সুবহানাল্লাহ! নেক আমলের নাম দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা ‘আলবাকিয়াতুস সালিহাত’। بَاقِيَات এটা باقية  শব্দের বহুবচন। ওইসমস্ত নেক আমল, যেটা সবসময় বাকি থাকবে। মানে সব নেক আমল, যা সবসময় বাকি থাকবে। এজন্য হাদীস শরীফে َالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ -এর ব্যখ্যার মধ্যে একেবারে সহজ আমল যেটা সেটা এসেছে। সুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদু লিল্লাহ, ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার! একেবারে সবচে সহজ আমল যেটা, সেটা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে- আলবাকিয়াতুস সালিহাত-এর। তার মানে সব নেক আমল। সমস্ত নেক আমল এমন যে, আল্লাহ তার উপাধি-ই দিয়ে দিয়েছেন ‘আলবাকিয়াত’। কাজেই তুমি যদি দুনিয়ার জন্য নেক আমল ছেড়ে দাও তো আল্লাহর কাছে যা, তা হারাবে। আর যদি একটু কষ্ট এবং সবর করে নেক আমল না ছেড়ে দুনিয়াটা ছেড়ে দিলে তাহলে আল্লাহ বলেন-

وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ .

যারা ধৈর্য ধারণ করে নিশ্চয় আমি তাদেরকে তাদের কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।

সবরের গুরুত্বপূর্ণ যে তিন প্রকার, তিন প্রকারের ক্ষেত্রেই এই কথা। বরং আরেকটা প্রকারও আছে সবরের। সেটা আরো সূ² এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ। নেক আমলের ক্ষেত্রে যে সবর তার দুটো দিক। এক হল, আমলটা যেন না ছোটে। আরেকটা হল, আমলটা যেন যথাযথ আদায় হয়। নামাযে দাঁড়ালাম, শুরু হয়ে গেল তাড়া; কখন শেষ হবে! একটা হল জরুরত বা ঠেকার কারণে নামায সংক্ষিপ্ত করা, এতে দোষ নেই। সে সংক্ষিপ্ত করার মধ্যেও আমি নিয়ত রাখব, এটা শরীয়তের হুকুম। আমার এখন যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে শরীয়তের হুকুম হল, নামায সংক্ষিপ্ত করা, এজন্য আমি সংক্ষিপ্ত করছি। এটাও একটা নেক আমল। আসলে সংক্ষিপ্ত করা তো সমস্যা নয়, সমস্যা হল ত্রুটিযুক্ত করা। এটাই সমস্যা। সংক্ষিপ্ত হলেই ত্রুটিযুক্ত হয় না। সংক্ষিপ্ত হলেই যে ত্রুটিযুক্ত হয়ে যায়, এমন কোনো কথা নেই। লম্বা নামায হয়েও ত্রুটিযুক্ত হতে পারে। নামাযকে ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করা- এর জন্য সবরের প্রয়োজন হয়। কেবল নামায কেন, যে কোনো নেক আমল, এটা যেন যথাযথ হয় এবং ত্রুটিমুক্ত হয় সে চেষ্টা করা। এই যথাযথ হওয়ার জন্য যে সবর, সেটাও সবরের একটা প্রকার। ওই সবরের মধ্যেও এই কথা-

وَ لَنَجْزِیَنَّ الَّذِیْنَ صَبَرُوْۤا اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ

আমরা যদি আগামী এক মাস এই সূত্রে মুরাকাবা এবং মুহাসাবা করি-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ.

যখনই আমার আমলের মধ্যে শৈথিল্য, অলসতা বা উদাসীনতা আসতে দেখব, তখন-ই বলব-

مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللهِ بَاقٍ.

আর এরকম ছোট্ট ছোট্ট বাক্যগুলো তো মুখস্থ হয়ে যাওয়া দরকার। মানে সূত্রটা যদি কুরআনের ভাষায় মুখস্থ হয়ে যায় এবং দিলে বসে যায় এটা অনেক ভালো।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক নসীব করুন।

 

[মারকাযুদ দাওয়াহ মসজিদ, হযরতপুর প্রাঙ্গণ-এ প্রদত্ত বয়ান

০৩ সফর ১৪৪১হি./০৩-১০-২০১৯ ঈ. বৃহস্পতিবার

শ্রুতিলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]

 

advertisement