Zilhajj 1441   ||   August 2020

শায়েখ আবদুল কাদের জিলানী রাহ.
ইলমের জন্য এভাবেই কোরবান হতে হয়

Mawlana Muhammad Tawheedul Islam Tayeib

শায়েখ আবদুল কাদের জিলানী। রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ৪৭১ হিজরী মোতাবেক ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে অবস্থিত জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা বাবা মারা গেলে মায়ের কাছেই শৈশব পার করেন। সেকালের বিদ্যানগরী ছিল বাগদাদ। তাই ৪৮৮ হিজরীতে ইলমের অন্বেষায় তিনি সেখানে যান। যাবার সময় মা চল্লিশ দিনার হাতে দেন। অল্পদিনেই সে অর্থ ফুরিয়ে গেলে তীব্র অর্থসংকটে দিনাতিপাত করেন। একদিনের ঘটনা। তিনি বলেন- আমি ক্ষুধার যন্ত্রণায় নদীর তীরে বেরিয়ে পড়তাম। সেখান থেকে বিভিন্ন গাছের পাতা, পড়ে থাকা ফলের খোসা এবং কাঁটাযুক্ত একপ্রকারের সবজি খেয়ে দিন কাটাতাম। বাগদাদে তখন দুর্ভিক্ষ। কয়েকদিনের একটানা অনাহারে আমি নদীর তীরে বেরুলাম। দেখি অন্য অনেকেই সেদিন আমার আগে চলে গিয়েছে। গাছের পাতা ও ফলের খোসা ইত্যাদি সংগ্রহ করছে। সংকোচে সেদিন কিছ্ইু সংগ্রহ না করে শহরে ফিরে এলাম। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা আবর্জনা থেকে কিছু কুড়াতে গেলে সেখানেও অনেককেই দেখা গেল। ফলে শূন্য হাতেই আমি এক মসজিদে গিয়ে উঠলাম। ক্ষুধার যন্ত্রণা, ক্লান্তিÍ আর দুর্বলতা নিয়ে এককোণে বসে পড়লাম। আমি তখন বাস্তবিক অর্থেই মৃত্যুমুখো। এমন সময় অনারব এক যুবক মসজিদে প্রবেশ করল। তার সঙ্গে রুটি-গোশত। সে খেতে শুরু করেছে। বড় লজ্জার কথা-সে যখন লোকমা মুখে উঠাত নিজের অজান্তেই আমি হা করে ফেলতাম। খুব অবাক লাগল। এ কী করছি আমি! যুবক ছেলেটি আমার কাণ্ড বোধহয় লক্ষ্য করেছে। তাই বলল, নাও ভাই একটু, বিসমিল্লাহ। আমি অস্বীকৃতি জানালাম। সে খুব জোর দিয়ে আল্লাহর নামে কসম করে বলল, নাও ভাই। আমার মন এতে রাজি হয়ে গেল। আমি মনের বিরোধিতা করলাম। তখন সে আবারও কসম দিয়ে বলল। আমি শেষে দাওয়াত কবুল করলাম।

সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কী? তুমি কোত্থেকে এসেছ? বললাম, আমি ফিকহ শাস্ত্রের একজন তালিবুল ইলম। জিলান থেকে এসেছি। সে বলল, আমিও জিলান থেকে এসেছি। আচ্ছা তুমি কি আবদুল কাদের নামে কোনো জিলানী যুবককে চেন? বাবার নাম আবু আবদুল্লাহ সাওমায়ী। উত্তরে বললাম, আমিই তো সে যুবক। এ কথা শুনে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে বলল, আল্লাহর শপথ, আমি বাগদাদে এসেছি তোমার কাছে। কিছু অর্থ দিয়ে তোমার মা আমাকে পাঠিয়েছেন। এসে কতজনকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এই তিন দিন হল, আমার নিজের খরচের অর্থও ফুরিয়ে গেছে। ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণায় তোমার মায়ের দেয়া আমানত খরচ করতে শুরু করেছি। এই রুটি গোশত সেই অর্থেই কেনা। তুমি আমার প্রতি দয়া কর- তৃপ্তির সাথে খাও। এ খাবার তোমারই। আমি তোমার মেহমান। খাওয়ার শুরুতে যেমন তুমি ছিলে আমার মেহমান। আর আমার অনন্যোপায় অবস্থা বিবেচনা করে তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

আমি তাকে শান্ত করলাম। এরপর অবশিষ্ট খাবার আর কিছু অর্থ দিয়ে বিদায় জানালাম। -যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা, খ. ১ পৃ. ২৯৮

এভাবে তাঁর মা কখনো কিছু অর্থ খরচ পাঠাতেন। কিন্তু বিরাট শহর সেই বাগদাদে তাঁর কাছে অনেক সময়ই তা পোঁছত না। খেয়ে না খেয়ে কষ্টে-সংকটে তিনি ইলম অর্জনে মগ্ন থাকতেন। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ হাফেয ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন, ‘তাফসীর, হাদীস, ফিকহসহ আবদুল কাদের জিলানী ছিলেন তেরোটি শাস্ত্রে পারদর্শী।-যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা, খ. ১ পৃ. ২৯৮

বাগদাদের বাবুল আযজে অবস্থিত একটি মাদরাসায় তিনি আবু সাদ আলমুখাররামী রাহ.-এর কাছে ইলমুল ফিকহ অধ্যয়ন করেন। তাঁর ইনতিকালের পর আবদুল কাদের জিলানী রাহ.-কে সেই দরসের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে তাঁর দরসে সমকালীন বড় বড় জ্ঞানী-গুণীরা বসতেন। তাঁর সীমাহীন কষ্টে অর্জিত বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিরাও বিপুলভাবে উপকৃত হতেন।

এরপর একসময় তিনি দেখলেন, সাধারণ জনগণের পর্যাপ্ত দ্বীনী ইলম না থাকায় সর্বক্ষেত্রেই নানা ফেতনা ছড়িয়ে পড়ছে। সেজন্যে ফিকহের দরসেই তিনি ওয়ায ও বয়ান আরম্ভ করলেন। সাধারণ জনগণ তখন যুগসেরা এই আলেমের বয়ানে ছুটে আসতে শুরু করল। এতে মাদরাসায় লোকদের সংকুলান না হওয়ায় শহরের উপকণ্ঠে একটি খানকা স্থাপন করেন। এরপর সেই মাদরাসার পরিধি আরো বাড়িয়ে নতুন করে নির্মাণ করা হলে তিনি আবার সেখানে আসেন।  বয়ান ও মানুষের  আতœশুদ্ধির মেহনতে নিরত থাকেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই খেদমত করেন। মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি অনেক অমুসলিমও  তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। -সিয়ারু আলামিন নুবালা খণ্ড ১৫, পৃ. ১৮৩

বয়ান ওয়ায ও আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি কয়েকটি কিতাবও তিনি রচনা করেন। তন্মধ্যে- আলগুনইয়া লিতালিবী তারিকিল হক, আলফাতহুর রাব্বানী ওয়াল ফাইযুর রাহমানী ও ফুতুহুল গাইব উল্লেখযোগ্য।

৫৬১ হিজরী মুতাবেক ১১৬৬ সালে উম্মতের দরদী এই মনীষী নব্বই বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তাঁর আজীবন খেদমতের সেই মাদরাসা প্রাঙ্গণেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

 

advertisement