যিয়ারতে বাইতুল্লাহ : মুমিনের সাধ, মুমিনের স্বপ্ন
বাইতুল্লাহ! কী সুন্দর নাম! এ নাম শোনার সাথে সাথে মুমিনের মনেস্নিগ্ধ অনুভ‚তি সৃষ্টি হয়। অন্যরকম ভালোলাগা মনকে দোলা দেয়। হৃদয়ের ভেতর ‘বাইতুল্লাহ’ যিয়ারতের আকুতি জেগে ওঠে। তাই একজন মুমিন হৃদয়-গভীরে বাইতুল্লাহ যিয়ারতের স্বপ্ন পুষতে থাকে। আর এ স্বপ্ন তার ঈমানকে নতুনভাবে সজীব করে তোলে।
যুগে যুগে কত মানুষ বাইতুল্লাহ যিয়ারতের স্বপ্ন দেখেছে! এ স্বপ্নের মধুর বেদনা হৃদয়ে বহন করেছে। তবে সবার স্বপ্নই কি পূরণ হয়েছে? কারো স্বপ্ন পূরণ হয়েছে একবার, কারো দুবার, কারো বহু বার। আর কারো স্বপ্ন তাদের সাথে সাথে মাটির নিচেই ঘুমিয়ে গেছে। বাইতুল্লাহ যিয়ারতের স্বপ্ন কারো জীবনে কত বিস্ময়করভাবে পূর্ণ হয়েছে! পার্থিব যুক্তিতে যাকে বিচার করা যায় না।
এখন যিয়ারতে বাইতুল্লাহ আগের চেয়ে সহজ। আরামদায়ক সফর। বিমানে ওঠার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চলে যাওয়া যায় পবিত্র হিজায ভ‚মিতে। কিন্তু একটা সময় এটা ছিল জীবনের কঠিনতম সফরের একটি। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে কিংবা সাওয়ারীতে চড়ে; তবেই পৌঁছা যেত বাইতুল্লাহ্য়-আল্লাহর ঘরে। কেউ বা যেত সাগর পথে। প্রতি মুহূর্তে যেখানে মৃত্যুর ভয় থাকত মনের ভেতর। কারো কারো স্বপ্ন আবার মাঝপথেই সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে যেত। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখত যিয়ারতে বাইতুল্লাহর।
বাইতুল্লাহর সফর শারীরিকভাবে যেমন কষ্টের ছিল তেমনি আর্থিকভাবেও এর জন্য অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘ সফরের পথ-খরচ, পরিবারের খরচ, সেখানে থাকার খরচ সব মিলিয়ে প্রয়োজন ছিল অনেক অর্থের। যা জোগাড় করা সবার পক্ষে সহজ ছিল না।
কিন্তু কেউ যদি হিম্মত ও সাহস করে, প্রকৃতপক্ষে যিয়ারতে বাইতুল্লাহর স্বপ্ন দেখে, ইশকের আগুনে তার হৃদয় জ্বলতে থাকে, তাহলে আর্থিক অসচ্ছলতা তার সামনে বাধা হতে পারে না।
এমন অসংখ্য ঘটনা ইতিহাস আলো করে আছে, যেখানে আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষ ত্যাগের নযরানা পেশ করে যিয়ারতে বাইতুল্লাহর স্বপ্ন পূরণ করেছে। অতীত ইতিহাসে এর নযীর যেমন অসংখ্য, নিকট ইতিহাসেও এর দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
হজ্বের জন্য দৃঢ় সংকল্প করি এবং প্রস্তুতি নেই
কোনো আমলের জন্য দৃঢ় সংকল্প করার বিশেষ ফযীলত রয়েছে। বান্দা যখন কোনো আমলের নিয়ত করে কিন্তু ওযরের কারণে আমলটি করতে পারে না, আল্লাহ তাআলা তাকে সে আমলের সাওয়াব দান করেন। এক হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ سَأَلَ اللهَ الشّهَادَةَ بِصِدْقٍ، بَلّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشّهَدَاءِ، وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ.
যে ব্যক্তি মন থেকে আল্লাহর কাছে শাহাদাতের তামান্না করে আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেন; যদিও সে নিজ বিছানায় মৃত্যুবরণ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৯
আল্লাহ তাআলা রাহীম ও কারীম। অসীম তাঁর দয়া। সীমাহীন তাঁর দান। বান্দাকে দেয়ার জন্য তিনি শুধু বাহানা খোঁজেন। তাই এখন থেকে আমরা যদি হজ্বের দৃঢ় সংকল্প করি এবং কিছু কিছু করে এর জন্য অর্থ সঞ্চয় করি তাহলে আশা করা যায় এই ওসীলায় আল্লাহ আমাদেরকে হজ্ব করার তাওফীক দান করবেন। হজ্ব না করতে পারলেও নিয়তের কারণে হজ্বের সাওয়াব দান করবেন।
এ প্রসঙ্গে তাকী উসমানী দা. বা.-এর বোনের ঘটনাটি আমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয়। তাকী উসমানী দা. বা. লেখেন, একবার তিনি (বড় বোন নাঈমা খাতুন) আব্বাজানের খেদমতে আরয করলেন, আমার জন্য দুআ করুন- আল্লাহ যেন হজ্বের সৌভাগ্য দান করেন। আব্বাজান জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি হজ্বের খুব শওক? তিনি হাঁ সূচক উত্তর দিলেন। আব্বাজান বললেন, নাহ্, তোমার শওক নেই। আপা হয়রান হয়ে বললেন, সত্য বলছি, বাইতুল্লাহ যিয়ারতে আমার বড়ই আকাক্সক্ষা!
আব্বাজান জিজ্ঞেস করলেন, এত বড় কাজের জন্য তুমি কোনো রাহা খরচ জমা করছ? তিনি বললেন, না। আব্বাজান বললেন, এর অর্থ হল, তোমার এ আকাক্সক্ষা নিছক মুখের জমাখরচ। সত্যি যদি তামান্না হত তাহলে কিছু না কিছু তুমি সঞ্চয় করতেই! আপা ওজর পেশ করে বললেন, সংসার থেকে কিছু বাঁচলে তো সঞ্চয় করব! আব্বাজান বললেন, তুমি কি এক-দু আনাও এ কাজের জন্য বাঁচাতে পার না? তিনি বললেন, এতটুকু তো বাঁচাতে পারি। কিন্তু এর দ্বারা হজ্বের খরচ কীভাবে পুরা হবে?
আব্বাজান বললেন, বান্দা যখন কোনো নেক কাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সাহায্য আসে। তারপর যদি সে নেক আমল পূর্ণ নাও হয়, ইনশাআল্লাহ তার আজর ও সওয়াব তো অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু চেষ্টাহীন, উদ্যোগহীন আকাক্সক্ষায় কোনো কাজ হয় না।
এর বহু দিন পর ১৯৫৬ সালে যখন আপার ইনতেকাল হল এবং ওয়ারিছগণ তাঁর মীরাসের খোঁজ-খবর নিলেন তখন দেখা গেল, তাতে কাপড়ের ছোট্ট একটি থলে রয়েছে, যার গায়ে লেখা- ‘হজ্বের রাহাখরচ’। খুলে দেখা গেল, সম্ভবত পঁয়ষট্টি টাকা। আব্বাজান যখন এ থলে দেখলেন বে-ইখতিয়ার তাঁর চোখে পানি চলে এল। তখন তিনি সবাইকে এ ঘটনা আগাগোড়া শোনালেন। পরে আব্বাজান এ অসামান্য মেহনতের সামান্য সঞ্চয়ের সাথে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগ করে তাঁর বদলী হজ্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। (আমার স্মৃতি : কিছু সুখের, কিছু দুঃখের, পৃষ্ঠা, ৪-৬)
আরেকটি ঘটনা। দারুল উলূম দেওবন্দের সদ্য প্রয়াত শাইখুল হাদীস সাঈদ আহমদ পালনপুরী রাহ.-এর মামার।
হযরত বলেন- ‘আমাদের খান্দানে তিনিই সর্বপ্রথম হজ্ব করেন।’ তিনি কীভাবে হজ্ব করেছেন তার অবাক করা কাহিনীও বলেছেন পালনপুরী রাহ.। হযরত বলেন, তখনকার যুগে চার শ রুপিতে হজ্ব করা যেত। পড়াশোনার সময় পকেট খরচ হিসেবে তার বাবা যে টাকা দিতেন তার থেকে কিছু সঞ্চয় করে রাখতেন তিনি। এতে মোটামুটি বেশ টাকা জমা হয়ে যায়। পড়াশোনা শেষ করেই তিনি হজে¦র প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং পৌনে চার শ টাকায় হজ্ব সম্পন্ন করেন। পঁচিশ রুপি তার উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
দরিদ্রতা, অর্থকষ্ট, বৈরি পরিবেশ সত্তে¡ও যিয়ারতে বাইতুল্লাহর স্বপ্ন পূরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এসব ঘটনা। এখান থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।