তাকওয়া : এক মহিমান্বিত গুণ
তাকওয়া মুমিনের একটি অপরিহার্য গুণ। কুরআন মাজীদে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য অনেক সুসংবাদ বর্ণিত হয়েছে। আল্লামা ফাইরোযাবাদী রাহ. তাঁর কিতাব بصائر ذوي التمييز -এ কুরআনে কারীমে বর্ণিত সুসংবাদগুলো উল্লেখ করেছেন। কুরআনে কারীমের প্রায় ২৭ স্থানে মুত্তাকীদের জন্য সুসংবাদ উল্লেখিত হয়েছে। কিছু সুসংবাদের আয়াত এখানে উল্লেখ করা হল-
১. আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের সুসংবাদ :
اِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِیْنَ اتَّقَوْا وَّ الَّذِیْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁদের সাথে থাকেন, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। -সূরা নাহল (১৬) : ১২৮
২. গুনাহ মাফ এবং বিরাট আজরের সুসংবাদ :
وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یُكَفِّرْ عَنْهُ سَیِّاٰتِهٖ وَ یُعْظِمْ لَهٗۤ اَجْرًا.
যে তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন এবং তাকে বিরাট আজর দান করেন। -সূরা ত্বলাক (৬৫) : ৫
৩. মাগফিরাতের সুসংবাদ :
وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। -সূরা আনফাল (৮) : ৬৯
৪. সকল কাজ সহজ হওয়ার সুসংবাদ :
وَ مَنْ یَّتَّقِ اللهَ یَجْعَلْ لَّهٗ مِنْ اَمْرِهٖ یُسْرًا.
যে তাক্বওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তার সব বিষয় সহজ করে দেন। -সূরা ত্বলাক (৬৫) : ৪
৫. সফলতার সুসংবাদ :
اِنَّ لِلْمُتَّقِیْنَ مَفَازًا.
নিশ্চয়ই মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা। -সূরা নাবা (৭৮) : ৩১
৬. প্রশস্ত রিযিকের সুসংবাদ :
وَّ یَرْزُقْهُ مِنْ حَیْثُ لَا یَحْتَسِبُ.
এবং তাকে রিযিক দান করেন অকল্পনীয়ভাবে। -সূরা ত্বালাক (৬৫) : ৩
৭. সম্মান-মর্যাদার সুসংবাদ :
اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰىكُمْ.
নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হচ্ছে মুত্তাকীগণ। -সূরা হুজুরত (৪৯) : ১৩
৮. আল্লাহর মহব্বতের সুসংবাদ :
اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُتَّقِیْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন। -সূরা তাওবা (৯) : ৪
৯. কবূলিয়্যাতের সুসংবাদ :
اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِیْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের থেকে কবুল করেন। -সূরা মায়েদা (৫) : ২৭
১০. শ্রেষ্ঠত্বের সুসংবাদ :
وَ الَّذِیْنَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ.
যাঁরা তাকওয়া অবলম্বন করে তারা কিয়ামতের দিন তাদের (কাফেরদের) উপরে থাকবে। -সূরা বাকারা (২) : ২১২
১১. শাস্তির ভয় থেকে মুক্ত থাকার সুসংবাদ :
فَمَنِ اتَّقٰی وَ اَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ.
যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সৎ থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা কখনো দুঃখিত হবে না। -সূরা আরাফ (৮) : ৩৫
১২. জান্নাতে বিভিন্ন নিআমতের এবং আল্লাহর দীদার লাভের সুসংবাদ :
اِنَّ الْمُتَّقِیْنَ فِیْ جَنّٰتٍ وَّ نَهَرٍ، فِیْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِیْكٍ مُّقْتَدِرٍ.
যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে তারা থাকবে উদ্যানরাজি ও নহরে। সত্যিকারের মর্যাদাপূর্ণ আসনে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহা সম্রাটের সান্নিধ্যে। -সূরা ক্বমার (৫৪) : ৫৪-৫৫
এখানে কিছু সুসংবাদ ও পুরস্কারের কথা উল্লেখ করা হল। যবানে নবুওতেও তাকওয়া সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন, হযরত নুমান ইবনে বাশীর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
إِنّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ، وَإِنّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنّ كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ، فَمَنِ اتّقَى الشّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ، وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ.
হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্টই। এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা হল, ‘মুশতাবিহাত’ বা সন্দেহপূর্ণ (অর্থাৎ হালালও হতে পারে, হারামও হতে পারে)। অনেক মানুষ এ সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান রাখে না। সুতরাং যে শুবুহাত (সন্দেহপূর্ণ বিষয়) এড়িয়ে চলবে, সে তার দ্বীন ও সম্মান নিয়ে নিরাপদে থাকবে। আর যে ওই শুবুহাত তথা সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে জড়িয়ে পড়বে, সে হারামে নিপতিত হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৯
সাহাবায়ে কেরামের জীবন ছিল তাকওয়ার জীবন। হারাম জিনিস থেকে সতর্ক থাকার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে তাঁদের জীবনে। আবু বকর রা.-এর ঘটনা আমরা অনেকেই জানি। আয়েশা রা. বলেন-
كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ غُلاَمٌ يُخْرِجُ لَهُ الخَرَاجَ، وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِهِ، فَجَاءَ يَوْمًا بِشَيْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ، فَقَالَ لَهُ الغُلاَمُ: أَتَدْرِي مَا هَذَا؟ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: وَمَا هُوَ؟ قَالَ: كُنْتُ تَكَهّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الجَاهِلِيَّةِ، وَمَا أُحْسِنُ الكِهَانَةَ، إِلّا أَنِّي خَدَعْتُهُ، فَلَقِيَنِي فَأَعْطَانِي بِذَلِكَ، فَهَذَا الّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ، فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهُ، فَقَاءَ كُلّ شَيْءٍ فِي بَطْنِهِ.
আবু বকর রা.-এর একজন গোলাম ছিল। সে তার উপার্জনের একটি অংশ আবু বকর রা.-কে দিত। আবু বকর রা. তা খেতেন। একদিন সে কিছু (খাবার) নিয়ে এল। আবু বকর রা. তা থেকে কিছু খেলেন। তখন সে বলল, আপনার কি জানা আছে, এই খাবার আমি কীভাবে লাভ করেছি? আবু বকর রা. জানতে চাইলে সে বলল, জাহেলী যুগে আমি এক ব্যক্তির জন্য গণকের কাজ করেছিলাম। (অর্থাৎ গণকের মত ভবিষ্যতের বিষয় বলেছিলাম।) আমি তো গণকের কাজ পারি না; (তার কাছে গণক সেজেছিলাম) তাকে ধোঁকা দিয়েছিলাম। আজ তার সাথে দেখা হলে সে তার বিনিময়ে এ খাবার দিয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে আবু বকর রা. তার গলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং যা খেয়েছিলেন বমি করে সব বের করে দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৪২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫৩৮৬
পরবর্তীতে তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ, দূর এবং নিকট অতীতের সালাফে সালেহীন সকলেই ছিলেন মুত্তাকী, হারাম থেকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনকারী। তাঁদের জীবনের সবটুকুই ছিল তাকওয়ায় ভরপুর। তাঁদের তাকওয়ার এমন এত অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যেগুলোর উপর স্বতন্ত্র কিতাবও রচিত হয়েছে। যেমন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর ‘কিতাবুল ওয়ারা’।
ইমাম নববী রাহ. তাঁর ‘তাহযীবুল আসমা’ কিতাবে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। শাফেয়ী মাযহাবের বড় শায়েখ, ‘আলমুহাযযাব ফিল মাযহাব’ কিতাবের লেখক ইমাম আবু ইসহাক আশশীরাযী রাহ. ছিলেন খুবই দরিদ্র। কিন্তু সততা এবং তাকওয়ায় পাহাড়-কঠিন। একদিন তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন কিছু খেতে। বের হওয়ার সময় ভুলে এক দীনার ফেলে আসলেন। কিছুদূর গিয়ে তার মনে পড়ল, তিনি মসজিদে এক দীনার ফেলে এসেছেন। তখন তিনি আবার মসজিদে গেলেন এবং তার দীনারটি পেয়েও গেলেন। কিন্তু তখনই তাঁর হালত পাল্টে গেল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, কতজনের দীনারই তো এখানে পড়ে থাকতে পারে। এটা যদি আমার না হয়!
এটা তারই ফেলে যাওয়া দীনার- এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু যদি না হয়! হারামের এ সামান্য সন্দেহে তা আর নিলেন না। কারণ, হারাম পেটে যাবে, এটা তো মানা যায় না। তাই দীনারটি তিনি স্পর্শ করলেন না। ফিরে গেলেন। সুবহানাল্লাহ! কত কঠিন সতর্কতা। অথচ তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, একটি দীনার ছিল তাঁর জন্য অনেক বড় কিছু। (দ্র্র. তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত ২/১৭৩)
তাকওয়ার এত বড় বড় আজর ও পুরস্কার এবং মহামনীষীগণের তাকওয়ার প্রতি এত ইহতিমাম দেখে আমরাও উদ্বুদ্ধ হই তাকওয়া অবলম্বন করতে, মুত্তাকী হতে। তাহলে আমাকে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করতে হবে। হারাম থেকে এবং সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে হবে। গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
চারিদিকে এখন হারামের ছড়াছড়ি। এমনকি আমাদের অনেক খাবারেও এখন হারাম মিশ্রিত হওয়ার খবর শোনা যায়। সুতরাং আমরা সতর্ক ও সচেতন হব। যাচাই-বাছাই করে খাওয়ার অভ্যাস করব। আল্লাহকে ভয় করব।
মোটকথা, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে চলা- এরই নাম তাকওয়া। সুস্পষ্ট হারাম কী কী তা তো আমরা একটু অধ্যয়ন করলেই জানতে পারি। কিন্তু যেগুলো স্পষ্ট নয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা মুফতীগণের শরণাপন্ন হব এবং নিজের বুঝবুদ্ধি ব্যবহার করব। আল্লাহ আমাদেরকে তাকওয়াওয়ালা জীবন যাপনের তাওফীক দান করুন- আমীন।