নবীজীর দস্তরখানে
৪৬. আঙুল চাটার আগে মোছা বা ধোয়া নয়
খাবার গ্রহণের সাথে ক্ষুধা নিবারণের যেমন সম্পর্ক তেমনি খাবারের বরকত লাভও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাবারের বরকত লাভের জন্য হাদীস শরীফে অনেকগুলো নির্দেশনা এসেছে- শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা, পাত্রের একপাশ থেকে খাওয়া, মাঝখান থেকে না খাওয়া, অসহনীয় গরম খাবার না খাওয়া, সহনীয় ঠান্ডা করে খাওয়া, সমবেতভাবে খাওয়া, খাবার পড়ে গেলে তুলে পরিষ্কার করে খাওয়া, পাত্র চেটে খাওয়া ইত্যাদি। হাঁ, খাদ্যের বরকত লাভের জন্য এত এত আয়োজন!
চিন্তা করে দেখ, এগুলোর অধিকাংশ কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের সাথে সম্পৃক্ত নয়; যদিও ক্ষুধা নিবারণ হওয়ার সাথেও বরকতের সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং খাবারের বরকত লাভও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার মাধ্যমে আমরা আত্মিক শক্তি লাভ করি।
খাবারের বরকত লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আঙুল চেটে খাওয়া। আমরা অনেকসময় আঙুল চেটে না খেয়েই টিস্যু ইত্যাদিতে হাত মুছে ফেলি বা ধুয়ো ফেলি। ফলে আঙুলে লেগে থাকা খাবার থেকে আমরা মাহরূম হই। সাথে সাথে বরকত থেকেও। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আঙুল চাটার আগে হাত মুছতে নিষেধ করেছেন। কারণ, হতে পারে আঙুলে লেগে থাকা খাবারের অংশেই আজকের খাবারের বরকত রয়েছে। জাবের রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
...وَلَا يَمْسَحْ يَدَهُ بِالْمِنْدِيلِ حَتّى يَلْعَقَ أَصَابِعَهُ، فَإِنّهُ لَا يَدْرِي فِي أَيِّ طَعَامِهِ الْبَرَكَةُ.
...এবং আঙুল চাটার আগে যেন কেউ রুমাল দিয়ে তার হাত মুছে না ফেলে। কারণ, তার জানা নেই- খাবারের কোন্ অংশে বরকত রয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫২৩৭
আল্লাহ আমাদের খাবারের বরকত লাভের সকল পথ গ্রহণ করার তাওফীক দিন এবং বরকত দান করুন।
৪৭. গোশত, পনির ইত্যাদি কি চাকু দিয়ে কেটে খাওয়া যাবে?
কোনো বিবাহের অনুষ্ঠানে গিয়েছ। বরকে আপ্যায়ন করা হয়েছে আস্ত এক খাসি দিয়ে। আস্ত ভুনা খাসি হাজির মস্তবড় এক খানচায়! জামাইয়ের সাথে অনেক মানুষ এ খানচায় শরীক। এখন সবাই চিন্তায় পড়ে গেল, কীভাবে খাবে এই আস্ত খাসি। হাত দিয়ে টেনে-ছিঁড়ে কি আর কুলিয়ে ওঠা যায়? চাকু দিয়ে কি কেটে খাওয়াটা যাবে? এটা খাবারের আদব পরিপন্থী না তো!
না, এটা খাবারের আদব পরিপন্থী নয়। প্রয়োজনের সময় চাকু দিয়ে কেটে খাওয়া যায়। ইবরে ওমর রা. বলেন-
أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِجُبْنَةٍ فِي تَبُوكَ، فَدَعَا بِسِكِّينٍ، فَسَمَّى وَقَطَعَ.
তাবুকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে পনির পেশ করা হল। তখন তিনি চাকু চাইলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে কাটলেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮১৯
জাফর ইবনে আমর ইবনে উমাইয়া বলেন, তার পিতা আমর ইবনে উমাইয়া তাকে বলেছেন-
أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَحْتَزُّ مِنْ كَتِفِ شَاةٍ فِي يَدِهِ، فَدُعِيَ إِلَى الصَّلاَةِ، فَأَلْقَاهَا وَالسِّكِّينَ الَّتِي يَحْتَزّ بِهَا...
তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, তিনি বকরির সামনের রান হাতে নিয়ে চাকু দিয়ে কাটছেন। নামাযের সময় হলে চাকু-গোশত রেখে নামাযে চলে গেলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪০৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮৩৬
এক হল অমুসলিমদের সংস্কৃতি; হাত দিয়ে না খেয়ে চাকু ও কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া। আরেক হল, চাকু দিয়ে কেটে খাওয়ার প্রয়োজন হওয়া- দুটো এক বিষয় নয়। মোটকথা, প্রয়োজনের সময় পনির, গোশত ইত্যাদি চাকু দিয়ে কেটে খাওয়া যায়।
৪৮. অন্যরা যদি অপছন্দ না করে তাহলে বেছে বেছে খাওয়া যায়
কখনো এমন হয়, কোনো খাবারের বিশেষ কোনো জিনিস পছন্দ হয়। যেমন, আলু, লাউ, টমেটো দিয়ে কোনো তরকারি রান্না করা হয়েছে। এখন কারো আলু পছন্দ। তখন সে আলু বেছে বেছে খেল। এটা করা যেতে পারে, যদি দস্তরখানের অন্যরা এটি অপছন্দ না করে বা এর কারণে অন্যদের খেতে কষ্ট না হয়।
আনাস রা. বলেন-
إِنّ خَيَّاطًا دَعَا رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لِطَعَامٍ صَنَعَهُ، قَالَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ: فَذَهَبْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِلَى ذَلِكَ الطّعَامِ، فَقَرّبَ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ خُبْزًا وَمَرَقًا، فِيهِ دُبّاءٌ وَقَدِيدٌ، فَرَأَيْتُ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَتَبّعُ الدّبّاءَ مِنْ حَوَالَيِ القَصْعَةِ، قَالَ: فَلَمْ أَزَلْ أُحِبّ الدّبّاءَ مِنْ يَوْمِئِذٍ.
একবার এক দর্জি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত করল। আমিও সাথে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রুটি ও ঝোল তরকারি পেশ করা হল, যাতে লাউ ও কাদীদ (শুকনো গোশত) ছিল। খাবারের সময় নবীজীকে দেখলাম, খাবারের পাত্র থেকে লাউ বেছে বেছে খাচ্ছেন। (তখন আমি বুঝলাম, লাউ তাঁর পছন্দের খাবার।) সেদিন থেকে আমিও লাউ পছন্দ করতে শুরু করলাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৭৯
বুখারী রাহ. এ হাদীসের অধ্যায়-শিরোনাম দিয়েছেন-
بَابُ مَنْ تَتَبَّعَ حَوَالَيْ القَصْعَةِ مَعَ صَاحِبِهِ، إِذَا لَمْ يَعْرِفْ مِنْهُ كَرَاهِيَةً.
(অধ্যায় : পাত্রের বিভিন্ন পাশ থেকে বেছে বেছে খাওয়া, যদি সঙ্গি বিষয়টি অপছন্দ না করে)।