পশু জবাইয়ের ছবি ক্যামেরায় ধারণ নয়... : হৃদয়ে ধারণ করি ত্যাগ ও সমর্পণের শিক্ষা
কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। স্মৃতিবিজড়িত ও মহিমান্বিত বিশেষ ধরনের ইবাদত। ত্যাগ, নিষ্ঠা, প্রেম ও ভালবাসার স্মারক। শর্তহীন আনুগত্যের আলোকবর্তিকা, অনুপম আদর্শ। সামর্থ্যবান মুমিন বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থায় তাদের কুরবানীর পশু আল্লাহর নামে জবেহ করবে এবং মহান প্রভুর উন্মুক্ত আপ্যায়ন গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করবে।
কুরবানী : চাই তাওহীদ ও সুন্নাহ, ইখলাস ও তাকওয়া
তাওহীদের ধর্ম ইসলাম। কোনো একটি আমল মহান মালিকের দরবারে কবুল হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত, ইখলাসের সাথে হওয়া এবং শিরকমুক্ত হওয়া। ইরশাদ হয়েছে-
فَمَنْ كَانَ یَرْجُوْا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْیَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا.
সুতরাং যে-কেউ নিজ রবের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ১১০
শিরকের রয়েছে নানান রূপ এবং প্রকৃতি। রিয়া বা লোকদেখানোও এক প্রকার শিরক-‘শিরকে আসগর’। এমন আরো অনেক ছোট ছোট শিরক মিশে আছে আমাদের বিভিন্ন আচরণ-উচ্চারণে। মুমিনের দায়িত্ব, হক্কানী উলামায়ে কেরাম থেকে এসকল শিরকের বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করা।
আবরার-অতি সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্যই হল ইখলাস। তাদের এ বৈশিষ্ট্য কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে এ ভাষায়-
اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا.
আমরা তোমাদের খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান আমরা চাই না এবং কোনো কৃতজ্ঞতাও না। -সূরা দাহর (৭৬) : ৯
আর কুরবানীর ক্ষেত্রে ইখলাসের বিষয়টি আরো উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত। ইখলাসই যেন সব- কুরবানীর আমলের ক্ষেত্রে। ইখলাস নেই, কুরবানী নেই। কুরবানী সংক্রান্ত এ আয়াত যেন এ আমলের ক্ষেত্রে আমাদের ইখলাসকে জাগ্রত করার জন্যই-
لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ.
আল্লাহর নিকট এদের গোস্ত এবং রক্তের কিছুই পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭
ইবাদতের আরেক বৈশিষ্ট্য ইহসান। সদা-সর্বদা আল্লাহ তাআলার যিকির ও স্মরণ হৃদয়ে জাগ্রত থাকা। হাদীসের ভাষায়-
أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنّهُ يَرَاكَ.
আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে কর যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। তা যদি সম্ভব না হয়, তো এতটুকু অনুভূতি হৃদয়ে অবশ্যই জাগ্রত রাখ যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮
মুমিনের ইবাদত আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার আরেকটি শর্ত, ইবাদতটি সুন্নাহসম্মত পন্থায় হওয়া। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ইবাদত যে পদ্ধতিতে নিজে আদায় করেছেন এবং প্রিয় সাহাবীদের শিখিয়েছেন সেই পদ্ধতিতেই ইবাদতটি সম্পন্ন হওয়া।
মোটকথা, ইখলাস, ইহসান ও সুন্নাহসম্মত ইবাদত-ই কেবল প্রাণবন্ত ইবাদত। বলা বাহুল্য, ইবাদতের উপরোক্ত শর্ত এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ কুরবানীর আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাম্য।
আফসোস, বর্তমানে এই কুরবানীকে ঘিরে ইখলাস ও ইহসান পরিপন্থী, রিয়া ও লৌকিকতাসূলভ নানান জিনিসের বিস্তার ঘটছে সমাজে। একসময় ছিল, কেবল পশুর গলায় সুন্দর সুন্দর মালা পরানো হত এবং লোকের ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি কামনা করা হত। তারপর আরেকটু অগ্রসর হল; নামি-দামি হাঁটের সেরা পশুটি কিনে প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ঢাকঢোল পেটানো এবং লোকের ‘বাহবা’ কোড়ানো! এখন অবস্থা আরো শোচনীয়; পশুকে স্পর্শ করে তার ছবি, ভিডিও কিংবা সেলফি তোলা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা। এমনকি নিরীহ পশুটির একদম কাঁধে চড়ে ছবি তোলার মতো অমানবিক দৃশ্যও নজরে পড়ে! আরো দুঃখজনক বিষয় হল, পশু জবাইয়ের সময় আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা এবং জবাইয়ের ছবি-ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা! যা কখনো কখনো অমুসলিমদের জন্য ভুলবুঝাবুঝিরও কারণ হতে পারে।
ইবাদতকে বিনোদনে পরিণত করা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়
আমাদের ভেবে দেখা উচিত, এসব আচরণের দ্বারা নিজের ইবাদত এবং বন্দেগীটা বিনোদনে পরিণত করা হয়ে গেল কি না? বা ইবাদতটা হাস্যরস ও ক্রীড়া-কৌতুকে পর্যবসিত হয়ে গেল কি না? অথচ পবিত্র কুরআন ইবাদতকে বিনোদনে পরিণত করা কাফের এবং জাহান্নামীদের স্বভাব বলে চিহ্নিত করেছে। কুরআন কারীমের ভাষায়-
الَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا دِیْنَهُمْ لَهْوًا وَّ لَعِبًا وَّ غَرَّتْهُمُ الْحَیٰوةُ الدُّنْیَا فَالْیَوْمَ نَنْسٰىهُمْ كَمَا نَسُوْا لِقَآءَ یَوْمِهِمْ هٰذَا .
যারা নিজেদের দ্বীনকে তামাশা এবং ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছিল এবং পার্থিব জীবন ওদের ধোঁকায় ফেলেছিল। সুতরাং আজ আমি তাদেরকে ভুলে যাব যেভাবে তারা এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল। -সূরা আরাফ (৭) : ৫১
মক্কার মুশরিকরা বাইতুল্লাহ্য় গিয়ে কোন্ ধরনের কাÐ-কীর্তিকে ইবাদত হিসেবে চালিয়ে দিত, তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে পবিত্র কুরআনে-
وَ مَا كَانَ صَلَاتُهُمْ عِنْدَ الْبَیْتِ اِلَّا مُكَآءً وَّ تَصْدِیَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ .
ওদের ‘সালাত’ কা‘বার নিকট শীষ এবং তালি দেওয়া ছাড়া আর কিছু ছিল না। অতএব, শাস্তি আস্বাদন কর। কারণ তোমরা কুফরি করতে। -সূরা আনফাল (৮) : ৩৫
কাজেই মুমিনের জন্য কখনো সমীচীন নয়- ইবাদতকে বিনোদন ও খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত করা।
সত্য কথা হল, সেলফি তোলা, ভিডিও করা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা ইত্যাদি- এর মাধ্যমে ইবাদতের মূল আবেদনটাই ক্ষুণœ হয়ে যায়। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বোধ-বুদ্ধিরও প্রয়োজন হয় না।
পশু জবাইয়ের ছবি নয়, হৃদয়ে জাগ্রত হোক পিতা-পুত্রের ত্যাগ ও সমর্পণের ছবি!
মুসলমানদের কুরবানী-হজ্ব এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ইবাদত। যদিও আজ আত্ম-প্রচার প্রবণতা বা বলি, আত্ম-প্রচার উন্মাদনা থেকে মুসলমানদের হজ্ব ও কুরবানীর মতো মহান ইবাদতগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না! আমরা যদি একটি বারের জন্যও ভেবে দেখি, এতে আমার হজ্ব-কুরবানীর মত গুরুত্বপূর্ণ আমল ইখলাস ও তাকওয়া-শূন্য হয়ে পড়ছে না তো? একথা তো আমাদের সবারই জানা, কুরবানীর এ সুন্দর সুঠাম পশুর রক্ত-গোস্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না; পৌছবে কেবল আমাদের নেক নিয়ত ও অন্তরের তাকওয়া। ইরশাদ হয়েছে-
لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ .
আল্লাহর নিকট এদের গোস্ত এবং রক্তের কিছুই পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭
হাদীসেও এ মর্ম বর্ণিত হয়েছে-
إِنّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদের দিকে তাকান না। তিনি তাকান তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪
লোকের ‘বাহবা’ কুড়ানোর মানসিকতা ইখলাস ও তাকওয়া পরিপন্থী কাজ। আমাদের সবকিছু তো আল্লাহর জন্য; মানুষের বাহবা দিয়ে আমাদের কী লাভ! শুনুন কুরআনের ঐশী বাণীতে মুমিনের ভাষ্য-
اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মরণ আল্লাহরই জন্য। যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। -সূরা আনআম (৬) : ১৬২
কুরবানীর পশু জবাইয়ের সময় দুআ হিসেবে উপরের বাক্যগুলোও আমরা উচ্চারণ করি। অথচ এর শিক্ষা ও মর্ম থেকে আমরা অনেকেই গাফেল থাকি।
শেষকথা, মুসলিমের কোনো আমলই আচারসর্বস্ব নয়। কুরবানীও তেমনি নিছক আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর কোনো আমল নয়। এতে রয়েছে তাওহীদ ও আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্বের প্রকাশ। তাঁর স্মরণ ও আনুগত্যের শিক্ষা, সর্বোচ্চ সমর্পণের দীক্ষা। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কীভাবে আল্লাহর হুকুমের সামনে নিঃশর্ত আনুগত্যের নযরানা পেশ করেছেন! কীভাবে ছোট্ট শিশু মহান প্রভুর নির্দেশের সামনে মাথা পেতে দিয়েছেন! কীভাবে মহান শিশু-নবীর পরিবর্তে জান্নাতী পশু কুরবানী হল! এসব কার কারিশমা? আমরা যদি কুরবানীর সময় নবীদ্বয়ের স্মৃতিচারণ করি। পিতা-পুত্রের সেই ত্যাগ ও সমর্পণের শিক্ষা অন্তরে জাগ্রত করি, ছবি-সেলফি নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে যদি আমরা মহান আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করি এবং মনে মনে দুআয় মগ্ন থাকি তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরবানী কবুল করবেন। সুতরাং পশু জবাইয়ের ছবি নয়, হৃদয়ে জাগ্রত হোক পিতা-পুত্রের ত্যাগ ও সমর্পণের ছবি!
[‘দরসে আলআদাবুল মুফরাদ, মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম’-এর আলোকে প্রস্তুতকৃত।]