তবুও আমরা আশাবাদী
দু’মাস পর আবারো আমরা পাঠকবৃন্দের সামনে হাজির হতে পেরেছি। এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে জানাই লাখো কোটি শুকরিয়া। আলকাউসারের বিগত সংখ্যাটি ছিল রমযান-শাওয়াল যৌথ সংখ্যা, যা আগস্টের শুরুতে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান সংখ্যাটি শাওয়াল সংখ্যা, প্রকাশিত হল অক্টোবরের শুরুতে। তাই অন্যান্য সংখ্যার তুলনায় এ দুটি সংখ্যার মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল দ্বিগুণ। এই দীর্ঘ সময় পাঠকবৃন্দের সামনে হাজির হতে না পারলেও তাদের আমরা স্মরণ করেছি, আর এখন হাজির হতে পেরে আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারী করছি আলহামদুলিল্লাহ’।
ইতিমধ্যে দেশের বেশ ক’জন বুযুর্গ ও প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। আমরা তাঁদের সবার জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে মাগফিরাত কামনা করছি এবং সম্মানিত পাঠকবৃন্দের কাছেও দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন করছি। তাদের মধ্যে দু’জন বুযুর্গ শায়খে কাতিয়া হযরত মাওলানা আমীনুদ্দীন রাহ. ও হযরত মাওলানা আবু সায়ীদ মোহাম্মাদ ওমর আলী রাহ. সম্পর্কে দুটি স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হল। মাওলানা আইনুদ্দীন আলআযাদ রাহ. সম্পর্কেও তার একজন সহকর্মী স্মৃতিচারণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা এই আলোচনাগুলি দ্বারা আমাদের সবাইকে উপকৃত করুন এবং মওতের আগেই মওতের তৈয়ারি গ্রহণের তাওফীক দান করুন।
আমরা সবাই কি ভালো আছি? আমাদের মুসলিম ভাইরা কি ভালো আছেন? দেশ ও দেশের জনগণ কি ভালো আছে? সত্যি কথা এই যে, এসব প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। আমরা ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করতেই পছন্দ করি, তবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়। কারণ কুরআন মজীদের ভাষায় অবাস্তব আশাবাদকে যূনুন ও আমানী বলে নিন্দা করা হয়েছে। অতএব মুমিন কখনো যূনুন ও আমানী তথা অলীক কল্পনা ও অবাস্তব আশাবাদের শিকার হতে পারে না। তাই বাস্তবতা যতই তিক্ত হোক তা স্বীকার করেই আমাদেরকে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
আমাদের সামগ্রিক অবস্থা খুব ভালো নয়। পত্রিকার পাতা খুললেই নৈতিক অধঃপতনের দৃষ্টান্ত খুব বেশি চোখে পড়ছে। সমপ্রতি বাবা-মার পরকীয়ার জের ধরে শিশু সন্তানের হত্যা ও আত্মহত্যার যেসব ঘটনা পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে তা তো আমাদের বিশ্বাসের মূলে তীব্র ঝাকুনি দিয়ে গেছে।
রিপুর কাছে মাতৃত্বের এই যে পরাজয়-এটা শুধু মা ও শিশুই নয় গোটা সমাজের জন্যই এক চরম বিপদ-সংকেত। কিন্তু এতে কি আমাদের চেতনা হবে? সাধারণ মানুষের কথা হয়তো ভিন্ন, আমাদের বুদ্ধিজীবী-সমপ্রদায়ের যে চেতনা হয়নি এবং তারা যে কোনো অবস্থাতেই তাদের পূর্বসংস্কার ত্যাগ করতে রাজি নন তা তো তাদের ছাফাই-ব্যাখ্যা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এসব মর্মান্তিক ও দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনো মুসলমান যদি পর্দা-পুশিদা ও ইসলামী হুকুম-আহকামকে প্রয়োজনীয় মনে করে বসেন তা-ই তারা সমস্বরে চেঁচাতে আরম্ভ করেছেন যে, না, না, পর্দা-না থাকার কারণে এসব সমস্যা নয়, আসলে শিক্ষা-দীক্ষার সঠিক বিস-ার হলেই এগুলো আর থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু প্রশ্ন হল সেই শিক্ষা-দীক্ষা নামক বস্তুটি আসলে কী? প্রকারান্তরে তারা কি এই সত্যকেই স্বীকার করে নিচ্ছেন না যে, এতদিন পর্যন্ত শিক্ষার নামে যা কিছু দান করা হয়েছে তা আসলে শিক্ষা নয়? শিক্ষার মূল উপাদানই তাতে অনুপস্থিত?
অবশ্য তাদের স্বীকার বা অস্বীকারে কিছুই যায় আসে না। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোর অবস্থা আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে এবং বলাবাহুল্য, সে অবস্থা সুখকর নয়। দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ নেই। বর্তমান সংখ্যার কোনো কোনো নিবন্ধে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে।
কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম যে নেই তা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু তীব্র প্রতিকূল স্রোতে তারা অনেকটাই বিপন্ন। এর সামপ্রতিক দৃষ্টান্ত হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিধান-সংক্রান্ত শিক্ষামন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্র। এ প্রসঙ্গেও বর্তমান সংখ্যায় আলোচনা করা হয়েছে।
আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায়ের হীনম্মন্যতা ও ইসলাম-ফোবিয়া যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা এক সাবেক বিচারপতির উক্তি থেকেই বোঝা যায়। এক টিভি-টকশোতে তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে জাতীয় ঈদগাহ করা অধর্ম হয়েছে।(নাউযুবিল্লাহ)
আমরা মনে করি, উক্তিটি টকশোতে না করে খোলা জায়গায় করলেই ভালো হত। এতে উক্তি ও উক্তিকারী উভয়েরই যথার্থ মূল্যায়ন হতে পারত! সম্ভবত বিজ্ঞ আলোচক বিষয়টি বোঝেন তাই তিনি কৌশল ও মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন! তিনি তো সরাসরিই বলতে পারতেন যে, ‘এ দেশ মন্দিরে মন্দিরে ছেয়ে গেলে সেটাই হয় সর্বাধিক পুণ্যের কাজ।’ তবুও একটি কথা থেকে যায়। তারা হয়তো লক্ষ করেছেন যে, যাদের চিন্তা-চেতনার নামাবলি গায়ে দিয়ে তারা জাতে উঠার প্রয়াস পেয়ে থাকেন, তারা কিন্তু অত রাখঢাকের তোয়াক্কা করে না। পাকিস্তানের বিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকীকে সমপ্রতি ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে! ফ্লোরিডার সেই প্যাস্টরের কথা পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। আল্লাহর কালাম পোড়ানোর প্রকাশ্য ঘোষণা দেওয়ার পরও তার কেশাগ্র স্পর্শ করাও সম্ভব হয়নি। কার পক্ষে সম্ভব হয়নি? ধর্ম-নিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী আমেরিকার সরকার ও প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাদের আইন-কানুন ও সংবিধানে এমন কোনো ব্যবস্থাই নেই যার দ্বারা ঐ প্যাস্টরকে নিবৃত্ত হতে বাধ্য করা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সবাই শুধু কাকুতি-মিনতি করে গেলেন, কোনো শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হল না। এই হল ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের ‘স্বর্গরাজ্য’ আমেরিকার কাহিনী। ভারতের মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু ছিল না। ১৯৭৬ সালে তৱকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সংশোধনী এনে তাতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করলেন।কিন্তু সে এমনই শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষতা যে, মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতিবিজড়িত বাবরী মসজিদ হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়ে গেল, কিন্তু ধর্ম-নিরপেক্ষতা রইল নিরব দর্শক হয়ে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অবস্থা দেখুন, এদেশে একজন হিন্দু পর্যন্ত একটি সম্পূর্ণ অসত্য দাবির উপর ভিত্তি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে ‘জালেম, কাফের, ফাসেক’ আখ্যা দেওয়ার দুঃসাহস প্রদর্শন করতে পেরেছে। একজন মুসলমানের জন্য এর চেয়ে বড় অপমান আর কিছুই হতে পারে না। গোটা জাতির জন্য মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার পরও কি তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
কোনো মুসলিম যদি এই দাবি তোলেন যে, শিরক ও মূর্তিপুজা শুধু কুরআনবিরোধীই নয়, এ হচ্ছে মানবেতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট কুসংস্কার অতএব তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। তদ্রূপ ধর্ম-পুস্তক নামক যেসব বইপত্র যুবসমাজের চরিত্র-বিধ্বংসী অশ্লীল বিবরণে পরিপূর্ণ তা অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা হোক তাহলে কি তিনি এত সহজে পার পেয়ে যাবেন? জঙ্গি, মৌলবাদী ও সামপ্রদায়িক প্রভৃতি অসংখ্য বিশেষণে কি স্বয়ং আমাদের বুদ্ধিজীবীরাই তাকে ভূষিত করবেন না?
যাইহোক, এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমরাও যথারীতি চোখ-মুখ বন্ধ করে ‘সংযমে’র পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছি।
তবুও আমরা আশাবাদী। কারণ সাধারণ মানুষের ইসলামপ্রিয়তা। মাহে রমযানের পবিত্র রজনীগুলোতে আমাদের মসজিদগুলো তো কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। বলাবাহুল্য, এটা তাদের ঈমানী চেতনা ও ঈমানী শক্তির কারণেই সম্ভব হয়েছে। আমরা মনে করি, এটাই এ জাতির অন-র্নিহিত শক্তি। এই ঘুমন্ত শক্তিকে যদি আমরা জাগিয়ে তুলতে পারি তাহলেই পাল্টে যেতে পারে সময়ের গতিপথ। তাই আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা রেখে আমাদের অবতীর্ণ হওয়া উচিত ঈমানের সংস্কার-সাধনায়।
আমরা যদি আমাদের বিশ্বাস ও কর্মকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হই তাহলে অবশ্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিবর্তন করবেন আমাদের তাকদীর।