প্রসঙ্গ : হজ্ব নিয়ে স্বেচ্ছাচার এবং সৌদি সরকারের অধিকার!
মনের ভেতরের গভীর বেদনা থেকে এই লেখাটি লিখতে বসেছি। আরো আগেই লিখতে চেয়েছিলাম। সৌদি আরবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে প্রথমে যখন ওমরা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখনই মনে হয়েছিল কিছু কথা বলি। পরক্ষণেই মনে হয়েছে, কী হবে আমাদের বেদনার কথাগুলো বলে! নীরব থেকেছি। কিন্তু ক’দিন আগে যখন দেখলাম এবার হজ্বের আয়োজন প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ থেকেই কোনো হজ্বযাত্রী হজ্ব পালনের জন্য সৌদি আরবে যেতে পারবেন না, তখন এ বেদনা আর চাপিয়ে রাখতে পারিনি। অন্তরের বেদনা ও তাড়না থেকেই লিখতে বসেছি।
এবার যদিও হজ্বে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো প্রস্তুতি ছিল না, তবুও এটা অনুধাবনযোগ্য বিষয় যে, লাখো লাখো আল্লাহপ্রেমিক মুসলমান হজ্বে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। একটি ভালো পরিস্থিতি হবে, সুন্দর সিদ্ধান্ত হবে এবং তারা হজ্বে যেতে পারবেন। আশায় আশায় তাদের দিন পার হচ্ছিল। তাদেরকে প্রতীক্ষায় রেখে সৌদি কর্তৃপক্ষও নানারকম আশ্বাসের বাণীও শুনিয়ে আসছিল। একবার বলা হচ্ছিল ১০ তারিখ সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আরেকবার বলা হচ্ছিল ১৫ তারিখে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০ তারিখ সিদ্ধান্ত দিয়ে জানানো হল, হজ্ব বন্ধ। সৌদি আরবের বাইরে থেকে কেউ হজ্বে অংশ নিতে পারবে না। আর সৌদি আরব থেকেও হজ্বে অংশ নিতে পারবেন হাতে গোনা অল্পকিছু মুসলমান। এ সিদ্ধান্তের খবর জানতে পেরে লাখো আল্লাহ্প্রেমিক হজ্বযাত্রীর হৃদয় ভেঙ্গে গেছে। তারা প্রচÐ আঘাত পেয়েছেন।
হজ্ব বন্ধের এ সিদ্ধান্ত জানানোর সময় গণমাধ্যমগুলো বলেছে, এবার ‘প্রতীকী হজ্ব’ পালন হবে। হজ্ব নিয়ে এসব সংকুচিত আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা দেখে মনে হচ্ছে, সৌদি সরকার একটা তামাশা শুরু করেছে। এরকম তামাশার চিত্র আগেও দেখা গেছে। হারাম শরীফে তাওয়াফ-যিয়ারাহ বন্ধ থাকার পর যখন সরকার খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিল, তখনও সাধারণ মুসলমানদেরকে হারামে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না। শুধু হারামের খাদেম-কর্মচারীদেরকেই হারামে নামায আদায় করতে দেওয়া হল। ভাবখানা তাদের এমন ছিল যে, তাওয়াফ-যিয়ারত, ওমরাহ, হারামে নামায আদায়- এই ইবাদতগুলোর প্রয়োজন যেন মানুষের নেই; মানুষ যেন ইবাদতের মুখাপেক্ষী নয়। বরং সৌদি প্রশাসনের আচরণের ভাষ্য ছিল এমন যে, মসজিদে হারামকে দেখানো হচ্ছে, কিছু মানুষ তার মাঝে তাওয়াফ করছে। যেন প্রয়োজন হারামের, প্রয়োজন মানুষের নয়! যেন হারাম শরীফে কিছু মানুষের ইবাদত পাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার দায় পড়ে গেছে! (নাউযু বিল্লাহ)
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আ.-কে খেতাব করে ইরশাদ করেছেন-
وَ اَذِّنْ فِی النَّاسِ بِالْحَجِّ یَاْتُوْكَ رِجَالًا وَّ عَلٰی كُلِّ ضَامِرٍ یَّاْتِیْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِیْقٍ.
এবং মানুষের মাঝে হজ্বের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে, যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) শীর্ণ হয়ে গেছে। -সূরা হজ্ব (২২) : ২৭
এরপর থেকেই হজ্বের জন্য মক্কা মুকাররমায় পুরো দুনিয়া থেকে মানুষের আগমন অব্যাহত ছিল। হঠাৎ কখনো বিশেষ বড় কোনো প্রতিবন্ধকতার জন্য স্থগিত হলেও কোনো মুসলিম শাসক এভাবে হুকুম দিয়ে মানুষের গমন বন্ধ করার নজির নেই। এবার যখন তারা হজ্বে যোগ না দেওয়ার এমন একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন, দুনিয়ার নানা প্রান্তে বসবাসরত হজ্ব গমনেচ্ছু মানুষ হৃদয়ে আঘাত পেয়েছেন। শাশ্বত ধারা ও নীতিকেই থামিয়ে দেওয়ার নজির স্থাপিত হল। সৌদি আরবে এজাতীয় বেদনার প্রেক্ষাপট কি হঠাৎ এসেছে, না এরও কোনো পটভূমি রয়েছে? একটু পেছনে ফিরে দেখা যেতে পারে।
সৌদি শাসনের অতীত-বর্তমান
কিতাবের তাকে এনে রাখা সৌদি আরবের ইতিহাস বিষয়ে ১৫ খণ্ডের একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ নামিয়ে গত কয়েকদিন উল্টে দেখেছি। গ্রন্থটির নাম-
المملكة العربية السعودية في مائة عام
দশ হাজারের অধিক পৃষ্ঠার কলেবরের ১৫ খণ্ডের এই গ্রন্থটি মূলত বাদশাহ আবদুল আযীয ১৯০২ সালে রিয়াদ দখল করার শত বছর পূর্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে। এর প্রথম খণ্ডেই (গ্রন্থ প্রকাশকালীন) রিয়াদের গভর্নর সালমান ইবনে আবদুল আযীযের একটি ভূমিকামূলক আলোচনা রয়েছে। তিনি তখন রিয়াদের গভর্নর এবং সৌদি আরব শত বর্ষপূর্তি আয়োজনের চেয়ারম্যান। তার আলোচনায় তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, সৌদি আরবের দেশ পরিচালনা ও শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হল, কুরআনে কারীম। তার ওই বক্তব্যে ফুটে উঠেছে, সৌদি রাষ্ট্রটির বুনিয়াদ ইসলাম ও কুরআনের ওপর। তার ভূমিকামূলক লেখাটি ছাড়াও প্রথম খণ্ডে উপস্থাপিত দীর্ঘ সূচিপত্রে বর্ণিত বিভিন্ন রচনার শিরোনামেও সৌদি রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি ও বন্ধনকে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করে দেখানোর চেষ্টা চোখে পড়েছে। রিয়াদের সেই গভর্নর সালমানই এখন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান। অথচ তিনি আর তার ছেলে এমবিএস মিলে এখন তাদের বর্ণিত সেই সৌদি আরবকেই কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন! আধুনিকতা আনয়নের নামে সৌদি আরবের দ্বীনী বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বলতাকে কীভাবে তারা ম্লান করে দিচ্ছেন! বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে বা যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে বিজাতি সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সৈন্য বাহিনীকে তো আগেই অনেকটা স্থায়ী জায়গা করে দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে। তার সাথে এখন ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তাহযীব-তামাদ্দুনের সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে।
প্রসঙ্গত এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যে, সৌদি আরবের উত্থান অথবা অন্য শব্দে বললে, জাযীরাতুল আরবে সৌদি শাসকদের দখল ও বিজয়ের পর্বটিকে সমগ্র দুনিয়ার মুসলিম মনীষীরা দুঃখ ও বেদনা নিয়েই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম মনীষীরা গভীর মর্মবেদনা অনুভব করেছিলেন এজন্য যে, বর্তমান সৌদি শাসকদের পূর্ব-পুরুষেরা উসমানী সালতানাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে, বৃটিশ শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আর এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম নেতৃত্ব ও মুসলিম মনীষীরা বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন, তুরস্কভিত্তিক ইসলামী খেলাফত টিকে থাকুক। সেসময় খেলাফতের প্রতিনিধিদের সরিয়ে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠাতাদের ক্ষমতা দখলের ঘটনাটিকে ভালো চোখে দেখার সুযোগ ছিল না। এসব কারণে সৌদি আরবের প্রতি মুসলিম বিশ্বের মনীষীদের বিরূপ ধারণা ও মূল্যায়ন বহাল ছিল।
কিন্তু এরপর যখন ধীরেধীরে তাদের শাসনব্যবস্থা ও দেশপরিচালনায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইসলামী বিধানের অনুসরণ দেখা গেল, ইনসাফের নীতির চর্চা শুরু হল এবং প্রকাশ্যে শরীয়তবিরোধী কর্মকাÐ চলতে দেয়া হল না, যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নীতিতে অনেক কঠোরতা ও প্রান্তিকতার মিশ্রণ ছিল, তবুও প্রকাশ্যে গুনাহের কাজ করতে না দেওয়া, শরীয়া নীতি অনুসরণ করা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রপরিচালনার ধারা দেখে মুসলিম বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও জনসাধারণ সৌদি শাসকদের প্রতি ধীরেধীরে কোমলতা অবলম্বন করেছেন। সমর্থন ও সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করেছেন। কিন্তু চলতি শতাব্দীতে এসে এ কোমল মনোভাবে আবার ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে। সৌদি আরবের শাসকদের প্রতি মুসলিম দেশে দেশে বিরূপ ধারণা নতুন করে তৈরি হচ্ছে।
বাদশাহ আবদুল্লাহর পর সালমান ইবনে আবদুল আযীয যখন সৌদি আরবের মসনদে বসলেন, এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। প্রথমে যুবরাজ বা বাদশাহ-পরবর্তী উত্তরাধিকারী বানানো হল বাদশাহর এক ভাতিজাকে। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, ওই যুবককে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় বসানো হল বাদশাহর ছেলেকে। এরপর থেকেই জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি সৌদি আরবে অনুসৃত শরীয়া বিধি ও নীতিকে রাতারাতি পাল্টে দেওয়ার নানা রকম উদ্যোগ শুরু হল। প্রকাশ্য গুনাহের আয়োজনে রাষ্ট্রীয় মদদ য্ক্তু হল। শুরু হল সৌদি আরবের দ্বীনী সংস্কৃতি ও জীবনাচারে পাশ্চাত্যায়নের খোলামেলা মহড়া। এর আগে বাদশাহ আবদুল্লাহর আমলেই লোহিত সাগরের পাড়ে ইউরোপীয় ধাঁচে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সহশিক্ষার পরিবেশপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে সফর হয়েছে আমার। সে যেন পুরোপুরি পশ্চিমা সংস্কৃতির একটি অঙ্গন পবিত্র হারামাইনের মাঝামাঝি ভ‚মিতে। আর বর্তমান বাদশাহ ও তার পুত্রের এসব কর্মকাÐ দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল, সৌদি আরবের দ্বীনী সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বদলে যেতে পারে। আশংকা করা হচ্ছিল, ওই পবিত্র ভূমি থেকে রূহানিয়াতপূর্ণ পরিবেশ ধীরেধীরে সরে যেতে থাকবে। সেটারই প্রকাশ এখন ঘটছে।
কোভিড-১৯ যখন এল, সৌদি আরবের অবস্থা এমন দাঁড়াল, যারা ঈমান-আকীদার ‘সবক’ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে দেওয়ার চেষ্টায় রত, তারাই عَدْوى বা ছোঁয়াচে রোগের ধারণায় সবচেয়ে বেশি হাবুডুবু খেতে লাগল। যে সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পড়াশোনা করে আসা ব্যক্তিরা বিভিন্ন দেশে শিরক ও বিদআর বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ-ভূমিকা পালন করতে গিয়ে নানারকম কঠোর কথাবার্তা বলে থাকেন, বাড়াবাড়ি করে থাকেন; সেই সৌদি আরবের শাসকদের মধ্যেই ছোঁয়াচে রোগের ভীতি প্রকট হয়ে উঠল।
এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করল সৌদি আরব এবং তা অব্যাহত রাখল গত মাসের শেষ পর্যন্ত। তারপরও কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে সেখানে কোভিড-১৯ আক্রান্তের হার বেশি। আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ১৭ হাজার পার হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তাহলে এই কঠোর লকডাউন এবং এভাবে ওমরাহ, তাওয়াফ-যিয়ারাহ সব বন্ধ করে দেওয়ায় কী লাভ হল? আসলে এর প্রধান কারণ হচ্ছে ভীতির আধিক্য। একজন বড় আলেম এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, মুসলমান যখন আকীদা-বিশ্বাস ও দ্বীন থেকে দূরে সরে যায়, আল্লাহর ওপর ভরসা এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার অনুভূতি ও অবস্থান থেকে দূরে সরে যায় তখন তার অন্তরে ভীতি বাসা বাঁধে। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের এই সময়ে তাদের এতসব কঠোরতা ও ইবাদতবিমুখ-ব্যবস্থাপনার পেছনে এজাতীয় ভীতির ভূমিকাই বড়।
হজ্ব : স্বেচ্ছাচারের অধিকার কি আছে?
এই যে দ্বীন এবং দ্বীনী চেতনা-বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে সৌদি শাসকদের এত দূরে সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে এবং ঘটেছে, এরপর তাদের ‘খাদেমুল হারামাইন আশশারীফাইন’ পরিচিতি বহন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সৌদি আরব নামক একটি রাষ্ট্র তারা শাসন করছেন, এটুকু চাইলে তারা করুন। তাদের এই শাসন-নিয়ন্ত্রণ আইনি ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ না অবৈধ, সেটা ভিন্ন তর্ক। সে তর্কের মীমাংসার জন্য স্বতন্ত্র আলোচনার প্রয়োজন। কিন্তু হারামাইন শারীফাইনের ব্যবস্থাপনায় তাদের এই ভীতিকাতরতা ও দুর্বলচিত্ততা এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে যে, হারামাইনের খাদেম হওয়ার যোগ্যতা তাদের আছে কি না! এ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার তাদের আছে কি না!
হৃদয়ের আক্ষেপ আর আত্মিক তাড়না থেকেই আমরা কথাগুলো বলছি। কারণ, অসংখ্য মুসলমানের অন্তরে এই কষ্ট ও বেদনাটা আছে। হারামাইন বন্ধ করে রাখা, হজ্ব বন্ধ করে রাখায় লাখ লাখ মুসলিমের প্রাণ কাঁদছে। হয়ত তারা তাদের মনের বেদনাভরা কথাগুলো বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। লাখ লাখ মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন- হারামাইনে হাজির হবেন। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করবেন। সেখানে নামায আদায় করবেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র মসজিদ ও রওযায়ে আতহার যিয়ারত করবেন। আল্লাহ তাআলার কাছে এই দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য দুআ করবেন। আল্লাহ্প্রেমিকদের দুআয় আল্লাহ তাআলা দুনিয়াবাসীর প্রতি দয়া করবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হল না। কারণ, ওমরাহ-তাওয়াফ বন্ধ করে রাখা হল। এখন হজ্ব পালনেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেওয়া হল।
যেদিন ওমরাহ ফ্লাইটের উপর নিষেধাজ্ঞা এল সেদিনই আমার ঘনিষ্ঠ মানুষদের একটি পরিবার সব প্রস্তুতি নিয়েও শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় আর ওমরায় যেতে পারেননি। তাদের হৃদয়ে এখনো কান্না। শাসক হিসেবে, খাদেমুল হারামাইন হিসেবে এই ধরনের অধিকার সৌদি আরবের শাসকরা রাখেন না।
সৌদি আরবের প্রশাসন চাইলে নিজ দেশে এবং সৌদি আরবের বিমানবন্দরে পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ ন্যাগেটিভ ব্যক্তিদের জন্য ওমরাহ করার সুযোগ খোলা রাখতে পারত। এমনকি ওই দেশে বসবাসরত বহু মুত্তাকী, আল্লাহওয়ালা মুসলমান আছেন, যারা নফল ইবাদত ও দান-খয়রাতে নিমগ্ন থাকেন, তাদের জন্য হারামের দরজা খুলে রাখতে পারত। হারাম বন্ধ থাকায় সেখানে বসবাসরত বহু মানুষের অন্তরে ও চোখে কান্না। এসব নেককার মানুষ হারামে প্রবেশ করতে পারলে সেখানে গভীর অনুতাপ ও অন্তরের বিগলন নিয়ে ইবাদত করতেন, দুআ করতেন। কিন্তু সৌদি আরবের প্রশাসন এককভাবে সবকিছু বন্ধ করে দিল এবং বন্ধ করে রাখল।
পবিত্র সব স্থান বন্ধ করে রাখার পাশাপাশি সৌদি প্রশাসন আরেকটি উদ্ভট কাজ করছে এবং গণমাধ্যমে প্রচার করছে। ক’দিন পরপর দেখানো হচ্ছে, হারাম শরীফ জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। তাদের আচরণে মনে হচ্ছে, কত কত জীবাণু যেন সেখানে গিজগিজ করছে! পবিত্র হারাম সম্পর্কে একটা ভুল চিত্র ও অনুভূতি এতে তৈরি করা হচ্ছে।
আচ্ছা, একটু ভেবে দেখুন তো, স্বাভাবিক সময়ে ওমরাহ ও হজ্বে কত লাখ লাখ লোক সেখানে হাজির হন? সমবেত হওয়া সব মানুষ কি সুস্থ থাকেন? ওমরাহ এবং হজ্ব উপলক্ষে হারামে সমবেত মানুষের মাঝে বহুজন কি অসুস্থ থাকেন না? চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় যেসব রোগ-ব্যাধিকে ‘ছোঁয়াচে’ বলা হয়, এমন রোগ-ব্যাধি নিয়েও কি মানুষ হজ্ব-ওমরাহ করতে হারামে হাজির হন না? নিজের দেশ থেকে নামকাওয়াস্তে একটা টিকা নিয়ে হারামে হাজির হয়ে যান লাখো লাখো মানুষ। এর মধ্যে বহু মানুষই বিভিন্ন ‘ছোঁয়াচে’ রোগেও আক্রান্ত থাকেন। কিন্তু এমন কি হয়েছে যে, ওইসব রোগীদের সংস্পর্শে এসে হাজার হাজার সুস্থ মানুষ নিজ দেশে এসে অসুস্থ হয়ে গেছেন? এমন কোনো রিপোর্ট ও পরিসংখ্যান নেই। আসলে হারামের বরকতে আল্লাহ তাআলা অনেককে সুস্থও করে থাকেন। কিন্তু সৌদি আরবের সরকার এসব কিছুর বিবেচনা না করে ওমরাহ, তাওয়াফ, যিয়ারাহ এবং হজ্ব বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যেই সমাধান খুঁজে পেল। এ এক আশ্চর্যজনক বিষয়! সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক ঘটনা হল হজ্ব ‘বন্ধ’ করে দেওয়া। বাইরের কোনো দেশ থেকে কেউ এবার হজ্বে যেতে পারবেন না- এমন সিদ্ধান্ত তারা হঠাৎ করেই চাপিয়ে দিলেন।
প্রশ্নের মুখে একক কর্তৃত্ব
ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন বা স্তম্ভ হল হজ্ব। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির একপর্যায়ে হজ্ব পালনের আয়োজন নিয়ে কথা উঠল। প্রথমদিকে এ বিষয়ে কোনো খবর বা খবরের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল না। হজ্বযাত্রীরা দেশে দেশে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেশের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘হজ্বের প্রস্তুতি নিতে থাকুন। সৌদি সরকার অনুমতি দিলেই আমরা সেখানে যাব।’ এরইমধ্যে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ইন্তেকাল করলেন। হজ্ব পালনে কোনো রকম প্রস্তুতির খবরও পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ সৌদি সরকার ঘোষণা করল, হজ্বের সময় কোনো দেশ থেকেই হাজ্বী সাহেব সৌদি আরবে যাবেন না। শুধু সৌদি আরবে বসবাসরত অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক (তাদের ভাষায়- عدد قليل جدا) লোক এবার হজ্ব করতে পারবেন। গণমাধ্যমে সেটাকে বলা হল, ‘প্রতীকী হজ্ব’। প্রস্তুতি নেওয়া অপেক্ষমাণ হজ্বযাত্রীদের মন ভেঙ্গে গেল, মনে আঘাত লাগল শুধু তারা নয়, সকল মুসলমানের হৃদয়ে আঘাত লাগল। আর এ সবকিছুই হল সৌদি সরকারের একক সিদ্ধান্তে।
আসন্ন হজ্বের দিনগুলোতে হাজ্বী সাহেবদের মনের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। হজ্ব তো ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন-স্তম্ভ। এটা মুসলমানদের অধিকার; যিনি যে দেশেই থাকুন না কেন। হজ্বের জায়গা এবং হারামাইন এলাকা সৌদি শাসকগণ তাদের মানচিত্রে নিয়ে গেছেন বলে এ স্থানগুলোতে বিশ্বের সাধারণ মুসলমানদের যাতায়াত আটকে দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। এটা একটা প্রধান আপত্তির জায়গা। তারা তো মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং করে এ ব্যাপারে মতামত নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাইকে অপেক্ষায় রেখে হঠাৎ হজ্বে অংশগ্রহণের সুযোগ বাতিল করে দিলেন একক সিদ্ধান্তে। ঘোষণা করলেন সামান্য সংখ্যক লোকের অংশগ্রহণে ‘প্রতীকী হজ্ব’ পালন হবে। বিশ্বের মুসলমানদের হজ্বে শরীক হতে না দেওয়ার এই একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তাদের নেই; না শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে, না নৈতিক বিবেচনায়।
মক্কা-মদীনা হিজাযে মুকাদ্দাসের এলাকা। এই অঞ্চল ইসলামী খেলাফত ছাড়া অন্য কোনো একক রাষ্ট্রের তত্ত¡াবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী ইসলামী খেলাফত থাকলে তার অধীনে থাকত হারামাইন। পৃথিবীতে এখন বহু স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র। যেসব রাষ্ট্রে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অবস্থায় এই পবিত্র ভূমির ওপর একটি রাষ্ট্রের এমন একচ্ছত্র অধিকার ও কর্তৃত্ব থাকা যে, মনগড়াভাবে যাকে ইচ্ছা তাকে সেখানে হাজিরে বাধা দিতে পারবে- এটা চলতে পারে না। হজ্বে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া-না দেওয়ার ব্যাপারে তাদের এমন স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ চলতে থাকলে অধিকারের এই গোড়ার কথায় যেতে চাইবেন বিশে^র মুসলিম সমাজ। আগেও এমন কথা উঠেছে। এজাতীয় পরিস্থিতি বারবার ঘটালে এবং বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতেই থাকলে ধীরেধীরে হারামাইন শরীফাইনকে সৌদি আরবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার দাবি বাড়তে থাকবে।
হজ্ব : তারা যা করতে পারতেন
প্রশ্ন উঠেছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিশ্বের সব রাষ্ট্র থেকে মুসলমানদের হজ্বে যেতে নিষেধ করার বিকল্প কোনো উপায় নিয়ে কি ভাবা যেত না? সৌদি সরকার কি বিশেষ উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে ভেবে দেখতে পারত না? যদিও বর্তমানে এশিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্রে কোভিড-১৯ আক্রান্তের হারও বাড়তির দিকে, তবুও একথা বিশ্লেষকরা বলছেন, গণমাধ্যমে আসছে যে, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরের সমস্যাগুলোর মাত্রা দেশেদেশে কমে আসছে। আগে যতটা ক্ষতি করত, এখন সে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সৌদি সরকার এবার হজ্বের ক্ষেত্রে বাছাইকরণ পদ্ধতিতে হাজ্বী সাহেবদের যেতে দিতে পারতেন। প্রত্যেক দেশের হজ্বযাত্রীর সংখ্যা বা হার কিছু কমিয়ে দিতে পারতেন। এমনকি অর্ধেক করে দিতে পারতেন প্রয়োজনে। সেক্ষেত্রে যারা প্রথমবার যাচ্ছেন তাদের অগ্রাধিকার দেয়া যেত।
প্রত্যেক দেশের সরকার এবং প্রয়োজন হলে সৌদি সরকার এসব ক্ষেত্রে বাছাইকরণে ভূমিকা রাখতে পারতেন। হজ্বযাত্রীর নিজ দেশে এবং সৌদি আরবে যাওয়ার পর সে দেশেও কোভিড-১৯ ন্যাগেটিভ নিশ্চিত হয়ে নিতে পারতেন। সৌদি আরবে পৌঁছার পর আল্লাহ না করুন, কেউ কোভিড পজিটিভ হলে তাকে তার হোটেলে কোয়ারেন্টিনেও রেখে দেওয়া যেত। এসব ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়ে সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য হজ্ব পালনের সুযোগ দেওয়া যেত। সৌদি সরকারের জন্য এজাতীয় ব্যবস্থাপনা তেমন কোনো দুরূহ ব্যাপারই ছিল না; কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হারাম বন্ধ এবং হজ্ব বন্ধ করে দেওয়ার বিকল্প কোনো ভাবনা মাথাতেই নিতে চাননি তারা। তারা দাবি করেছেন, তারা হারামাইনকে ‘ভাইরাসমুক্ত’ রাখতে চান এবং মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে চান। হজ্বে গমনকারী মুসলমানদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রধান ভাবনা তো তাদের নিজেদের। অনেকেই মনে করেন, তারা এসব কঠোর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সৌদি আরবের আমীরদের, রাজা-বাদশাহদের জীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই করতে চান।
‘ভাইরাসমুক্ত’ রাখা আর জীবনের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে সরাসরি বাইরের দেশ থেকে হজ্বযাত্রীর যাওয়াকে বন্ধ করে দেওয়া- এর কোনো শরয়ী বা নৈতিক অধিকার তাদের আছে- একথা বলা মুশকিল।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিশ্ব মুসলিমের হজ্ব পালনের ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখতে সৌদি সরকার কী করতে পারতেন- এ প্রশ্ন অনেকে করতে চান, অনেকে জানতে চান। আমি অপর একটি গণমাধ্যমে এ প্রশ্নটি নিয়ে কথা বলেছি। সৌদি আরবের তিনটি বিমানবন্দর দিয়ে হজ্ব ও ওমরাহকারীরা সাধারণত প্রবেশ করে থাকেন- জেদ্দা, মদীনা, ইয়াম্বু। ধরে নিলাম, আন্তর্জাতিক বড় টার্মিনাল এবং সৌদিদের বড় বাণিজ্যনগরী হওয়ায় জেদ্দাকে এ খাত থেকে বাদ রাখা হল। হাজ¦ী সংখ্যা সীমিত রাখলে মদীনা ও ইয়াম্বু এ দুটি বিমানবন্দর দিয়ে হজ্বযাত্রীদের ঢুকতে দেওয়া যেত এবং এরপর মক্কা ও মদীনা এ দুটি শহরেই হজ্বযাত্রী ও ওমরাহকারীদের বিচরণ সীমাবদ্ধ রাখা যেত। জেদ্দায় তাদের যেতে না দিলেও কোনো সমস্যা নেই। এতে হজ্ব, যিয়ারাহ সব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়ে যেতে পারত এবং বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে তাদের পরীক্ষা চলতে পারত। কিন্তু এজাতীয় উদ্যোগ তারা নেননি। একক সিদ্ধান্তে হজ্ব ও ওমরাহ বাতিল করেছেন। যদি ভবিষ্যতেও স্বেচ্ছাচারিতাপূর্ণভাবে যখন যাকে মনে চাইবে, হজ্ব-ওমরার অনুমতি দেবে এবং যাকে চাইবে না, দেবে না- এমন আচরণ তারা বহাল রাখেন, তাহলে হারামাইনের ওপর তাদের অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন এবং দাবি বাড়তে থাকবে বৈকি।
সৌদি আরবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যও হতাশাজনক। দুই মসজিদে হারামের প্রেসিডেন্সির চেয়ারম্যান বড়ই আশ্চর্যজনক একটি কথা বলেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকদিন বন্ধ থাকার পর দুই মসজিদ যখন খুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হল, তিনি বললেন, মসজিদ খুলে দেওয়ার জন্য শুকরিয়া, তবে নামায হবে মসজিদের স্টাফদের নিয়ে। বাইরের মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না। তার এই অভিব্যক্তি মারাত্মক হতাশাজনক ও আশ্চর্যজনক। তার এই কথার মানে হল, সৌদি আরবের বাসিন্দা, যারা হারামের কর্মকর্তা-কর্মচারী নন, মসজিদে হারামে ঢুকতে পারবেন না। কেন পারবেন না? তার ব্যাখ্যাও তিনি এ বলে দিলেন, যেন হারামাইনকে ‘ভাইরাসমুক্ত’ রাখা যায়।
তাদের কথায়-অভিব্যক্তি থেকে এমন মনে হয় যে, হারামাইন যেন এমন জায়গা, যেখানে ভাইরাসের স্তুপ জমে থাকে! এখানেই প্রশ্ন জাগে যে, তাদের এসব অতি কঠোর উদ্যোগ কি হারামাইনকে ‘ভাইরাসমুক্ত’ রাখার জন্য, নাকি তাদের নেতা ও আমীরদের থেকে ভাইরাসকে দূরে রাখার জন্য। তাদের নেতাদের মৃত্যুভয় প্রকট হয়ে উঠেছে। মৃত্যু থেকে বাঁচতে তারা হারামাইন বন্ধ করে রাখতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। আল্লাহপ্রেমিক বান্দাদের বাধা দিচ্ছে। মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। মানুষ তাদের পক্ষ থেকে এজাতীয় বক্তব্য আশা করে না। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য পীড়াদায়ক এমন বক্তব্য ও আচরণ অব্যাহত থাকলে মানুষের মুখ খুলবে এবং হারামাইনের সঙ্গে বিশেষত মুসলমানদের অধিকার ও সম্পর্কের দাবি জোরালোভাবে উচ্চারিত হবে।
অনেকেই মনে করেন, সৌদি আরবের রাজ্য সৌদিদের কাছেই থাকুক। কিন্তু মক্কা-মদীনা এই দুটি পবিত্র ভূমিকে হজ্ব-ওমরাহ ও যিয়ারতকারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। সৌদি শাসকদের পরিবর্তে খোদ জাযীরাতুল আরব কোনো ইসলামী খেলাফতের অধীনে এলে তখন অবশ্য ভিন্ন বিষয়। চিরকাল তো এই অবস্থা থাকবে না। ইনশাআল্লাহ একদিন মুসলমানদের পবিত্র ভূমিগুলো কোনো ইসলামী খেলাফতের আওতায় আসবে। তখন সেই সরকারের সিদ্ধান্ত হবে মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির অনুকূল, ইবাদত-আমলের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। আর যতদিন সেই পরিস্থিতি না হবে, সম্মানিত দুই শহরের ক্ষেত্রে সৌদি সরকার উদ্যোগী ও অংশগ্রহণমূলক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পারে।
হজ্ব-ওমরার জন্য বিশেষ অঞ্চল
মক্কা-মদীনা দুটি শহরের দূরত্ব উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার। এ পুরো অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা মরুভ‚মি ও খালি। এ দুটি শহরসহ এর মাঝখানে যোগাযোগের জন্য পুরো জায়গাকে সৌদি সরকার হজ্ব ও ওমরাহকারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। হজ্ব-ওমরার একাধিক বিমানবন্দর ওই এলাকায় নির্মাণ করা যায়। হজ্ব ও ওমরাহকারীদের চলাচল, থাকা, বিচরণ ও যিয়ারাহর জন্য ওই অঞ্চলটুকু বিশেষ ব্যবস্থাধীন রাখা যায়। ওই এলাকায় সৌদি নাগরিকরা চাইলে বসবাস করবেন, কিন্তু হজ্ব-ওমরাকারীদের ওই দুই শহর ও মাঝের নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও যেতে দেওয়া হবে না। এতে কোনো সমস্যা হবে না। সৌদি আরবের অন্যান্য অঞ্চলের সবরকম নিরাপত্তা অটুট থাকবে। অপরদিকে হজ্ব ও ওমরাহকারীরাও তাদের ইবাদত-আমল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। এবং কোনো জটিল মুহূর্তে হজ্ব-ওমরাহ করতে পারা-না পারার বিষয়ে কোনো বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে এবং ওই নির্দিষ্ট এলাকায় বহির্বিশ্ব থেকে আগত মুসলমানদের প্রবেশ করতে দেওয়া-না দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা এককভাবে সৌদি আরব নেবে না; বরং বিশ্বব্যাপী নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরাম ও মুসলমানদের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
উপরোক্ত প্রস্তাবিত এই নির্দিষ্ট পুরো এলাকাটিতে যদি বিশ্ব মুসলিমের সঙ্গে মশওয়ারার ভিত্তিতে হজ্ব-ওমরার কার্যক্রম পরিচালিত হয়, এককভাবে স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তাহলে সেটাই হবে সুন্দর ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। মুসলিম উম্মাহ হজ্ব-ওমরাহ ও যিয়ারাহর ক্ষেত্রে তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। হঠাৎ একক সিদ্ধান্তে হজ্ব-ওমরাহ বন্ধ হওয়ার মতো কষ্টদায়ক পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পারবে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, এটি একটি প্রস্তাবনা। এ ধরনের আরো চিন্তাও হতে পারে এবং মুসলিম বিশ্বের যথোপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বিত চিন্তার মাধ্যমে উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল হয়- এমন যে কোনো চিন্তাই করা যেতে পারে।
কথাগুলো এমনেই আমরা বলছি না, বিশ্বের মুসলিমসমাজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছে যে, সৌদি আরব ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সকল অমুসলিম ধনী রাষ্ট্রের নাগরিকদের এক মিনিটে অনলাইন/অন অ্যার্যাইভাল ভিসা দিচ্ছে, অথচ মুসলমানদের পবিত্র ওমরার জন্য এখনো ৪০ বছর হওয়ার শর্ত অব্যাহত রেখেছে (কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া)। তারা হয়ত বলবে, এর চেয়ে কম বয়েসীরা গেলে অনেকে সৌদিতে থেকে যায়। এজন্যই আমরা বলছি, এতই যখন আপনাদের শঙ্কা তবে হারামাইনের এলাকায় বেষ্টনি দিয়ে সেখানেই হজ¦-ওমরাকারীদের সীমিত রাখুন এবং সে এলাকা স্বতন্ত্র ব্যবহারের অধিনে রাখুন। যাতে করে পুরো বিশ্বের মুসলিম সমাজ তাদের হারামাইনে গমনের অধিকার সুচারুরূপে ভোগ করতে পারে।
পক্ষান্তরে ব্যবস্থাপনা ও কর্মপদ্ধতি এমন না হয়ে যদি সৌদি সরকারের একক সিদ্ধান্তের স্বেচ্ছাচারিতা সেখানে প্রকট হয়ে ওঠে, তাহলে ধীরেধীরে হারামাইন শরীফাইন থেকে তাদের একক কর্তৃত্ব মুক্ত করার দাবি উঠবে। কারণ, একটা ভূখÐ দখল বা আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার কর্তৃত্ব থাকার কারণে হারামাইন শরীফাইনও ওই ভূখণ্ডের ভেতরে থাকায় তাদের একক কর্তৃত্বে থাকতে হবে- এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।
হারামাইন বিশ্ব মুসলিমের মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ। মুসলমানদের কোনো খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে হারামাইন তাদের ব্যবস্থাপনার আওতায় যেতে পারে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকা বা ভূখÐকে নিয়ন্ত্রণকারী কোনো রাজা-বাদশাহর আওতায় থাকতে বাধ্য নয়। রাজা-বাদশাহরা তাদের মনমতো হারামাইনের ব্যবস্থাপনা আঞ্জাম দেবেন। ইচ্ছে হলে মানুষকে প্রবেশ করতে দেবেন, ইচ্ছে হলে আটকে দেবেন- শরীয়তের দৃষ্টিতে এবং নৈতিকভাবে এই সুযোগ তাদের নেই।
তাই বারবার আমরা বলতে চাই, হারামাইন শরীফাইনের ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকারের উচিত, স্বেচ্ছাচারিতামূলক একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং সতর্ক হওয়া। তাদের কোনো পদক্ষেপে যেন বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে আঘাত না লাগে- এ ব্যাপারে তাদের পূর্ণ সতর্কতা ও সচেতনতা বজায় রাখতে হবে।
দরবারি কথা নয়, প্রকৃত জনমত শুনুন
সৌদি শাসকরা যদি ‘খাদেমুল হারামাইন আশশারীফাইন’ এই উপাধি ও মর্যাদা বহন করে যেতে চান তাহলে দ্বীনী বিষয়ে তাদের ঐতিহ্যগত পথে ফেরত যেতে হবে। অতীতে যেমন শরীয়া অনুসরণ এবং আল্লাহর নাফরমানী ও প্রকাশ্য পাপাচারের বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয়নি, সে অবস্থানে তাদের ফিরে যেতে হবে। তবেই ‘খাদেমুল হারামাইন’ উপাধিটি তাদের জন্য সার্থক হবে। একইসঙ্গে হজ্ব-ওমরার বিষয়ে কোনো বিশেষ পরিস্থিতি সামনে এলে ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যেনতেনভাবে কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
স্বেচ্ছাচারের পক্ষে অনেক সময় অনুগত লোকজনের সমর্থন পাওয়া যায়; রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশে কিছু লোককে অনুগত বানিয়ে নেওয়া যায় অথবা কিছু লোকের কাছ থেকে শাসকদের মন-মর্জিমতো ‘ফতোয়া’ আদায় করেও নেওয়া যায়; কিন্তু এতে সঠিক মতামত ও জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। দেশে দেশেই বিদ্যমান দরবারি শায়েখ, দরবারি ‘ফতোয়া’। অনেক সময় সরকারের মনোভাব আন্দাজ করে দরবারি লোকেরা অগ্রিম ফতোয়া কিংবা অগ্রিম সাফাই বক্তব্য প্রস্তুত করে রাখে। কিন্তু তাতে সচেতন জনমতকে প্রভাবিত করা যায় না।
মুসলিম উম্মাহর বক্তব্য, জনমত ও দেয়ালের লিখন অনুধাবন করার জন্য মুসলিম শাসক ও রাজা-বাদশাহদের আমরা অনুরোধ করি, যদি তারা তাদের হঠকারিতা ও স্বেচ্ছাচার বজায় রেখেই চলেন, তাহলে দিনদিন মানুষের দুঃখ বাড়বে। প্রতিবাদী দাবি বাড়বে। পরিস্থিতি সে পথে এগিয়ে গেলে পরিণতি কী হবে, তারা এখন হয়ত অনুভবও করতে পারবেন না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, সৌদি আরবের নিষেধাজ্ঞায় বিভিন্ন দেশ থেকে যারা এবার ফরয হজ্ব করতে যেতে পারেননি, তাদের এই অপারগতা ‘ইহসার’ বা বাধাপ্রাপ্তির হুকুমে পড়বে। এ সম্পর্কে হাদীসের বর্ণনা রয়েছে এবং ফিকহের কিতাবে সবিস্তার আলোচনা রয়েছে। ফরয হজ্ব আদায়ে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা এবার হজ্ব পালন করতে না পারায় গুনাহগার হবেন না। তারা ভবিষ্যত সুযোগে হজ্ব করার চেষ্টা করবেন, হজ্ব করবেন।
শেষ কথা
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنْ اَوْلِیَآؤُهٗۤ اِلَّا الْمُتَّقُوْنََ.
শুধু মুত্তাকীগণই এর (মসজিদে হারামের) তত্ত¡বধায়ক। -সূরা আনফাল (৮) ৩৪
আমরা দুআ করি, হারামাইন শরীফাইনের ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের হাতে দিন, যারা মুত্তাকী। যারা নেককার, সদাচারী এবং যারা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য নয়; শুধু আল্লাহ তাআলাকে রাজি-খুশি করার জন্য কাজ করবেন। অথবা এখন যারা হারামাইন শরীফাইনের দায়িত্বে আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে যোগ্যতা দান করুন। তাদেরকে নেককার বানিয়ে দিন। এই আমানতের যিম্মাদারি বহন করার শক্তি দিন। হারামাইন শরীফাইনকে আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন- আমীন।
১৩ যিলকদ, ১৪৪১ হি. হ