অন্যরকম প্রতিযোগিতা
মাদরাসার বার্ষিক প্রতিযোগিতা। দৌড় প্রতিযোগিতা, হামদ-নাত, কেরাত প্রতিযোগিতা আরো অনেক কিছু। উস্তাদজী বললেন, এবার এসকল প্রতিযোগিতার সাথে ‘অন্যরকম’ একটি প্রতিযোগিতা হবে। তবে আগে থেকে বলা হবে না- সেই প্রতিযোগিতার নাম।
সবাই ভাবতে লাগল- কী প্রতিযোগিতা, যার নাম বলা হবে না! উস্তাদজী বললেন, এ প্রতিযোগিতার পুরস্কারও হবে সবচেয়ে বড়।
সকলের মনোযোগ এই প্রতিযোগিতার দিকে। অন্য সব প্রতিযোগিতায় নাম লেখাক বা না লেখাক, সকলেই এই ‘অন্যরকম’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখাল। রাশেদ, খালেদ, লাবীব, হাবীব, আইমান কেউ বাদ থাকল না নাম লেখাতে। উস্তাদজী যেহেতু বলেছেন, এ প্রতিযোগিতার পুরস্কার হবে সবচেয়ে বড়, সুতরাং এতে নাম না লিখিয়ে কি থাকা যায়!
প্রতিযোগিতার দিন সকল প্রতিযোগী উপস্থিত। সকলের কৌতূহলী প্রতীক্ষা! এমন সময় উস্তাদজী বললেন, এবারের প্রতিযোগিতার বিষয় হল, নামায। তোমরা সকলে লাইনে দাঁড়িয়ে যাও। একজন একজন করে সামনে আসবে আর দুই রাকাত নামায পড়বে। এটাই প্রতিযোগিতা।
শুরু হল প্রতিযোগিতা। একজন একজন করে সামনে আসে আর দুই রাকাত নামায পড়ে চলে যায়। উস্তাদজী একটা কাগজে নাম্বার দেন। খালেদের আগে রাশেদের পালা। খালেদ দেখল, রাশেদ খুব ধীরে-সুস্থে নামায পড়ছে। কেরাত পড়ছে ধীরে ধীরে, রুকু করছে ধীরে, রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে একটু দাঁড়াচ্ছে, সুন্দরমত রব্বানা লাকাল হাম্দ বলে সিজদায় যাচ্ছে ধীরেসুস্থে; যেমনটি তার আব্বার কাছ থেকে শিখেছে। তেমনি নবীজীর এক সাহাবীকে নবীজী ধীরেসুস্থে নামায পড়তে শিখিয়েছেন- আব্বুর কাছ থেকে সেই হাদীসও সে শুনেছে। এ দেখে খালেদ ভাবল, ওর নামায পড়তে সময় লেগেছে; ও প্রথম হতে পারবে না।
যখন খালেদের সময় এল। সে খুব দ্রুত নামায পড়ল আর ভাবল, সে-ই প্রথম হবে। কারণ, সে-ই সবার চেয়ে দ্রুত নামায পড়েছে, কেরাত পড়েছে। তার নামায শেষ হতে একটুও সময় লাগেনি। অন্য কেউই তার মত দ্রুত নামায পড়তে পারেনি।
এবার পুরস্কারপর্ব। সকলের ভাবনা- আমিই প্রথম হব। খালেদ তো নিশ্চিত। কারণ, সে খুব ভালো করে লক্ষ করেছে, কেউই তার মত দ্রুত নামায পড়তে পারেনি। দৌড় প্রতিযোগিতায় সে সবার চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পেরেছে বলেই তো প্রথম হয়েছে। এখানেও সে সবার চেয়ে দ্রুত শেষ করেছে।
উস্তাদজী পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা শুরু করলেন- নামায প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে, রাশেদ। রাশেদের নাম শুনেই খালেদ থ। কী ব্যাপার! রাশেদ না সবার চেয়ে ধীরে নামায পড়েছে। অনেক সময় নিয়েছে নামায পড়তে। আমার ধারণা ছিল সে কিছুই হবে না। সে-ই দেখি প্রথম হয়ে গেল! ব্যাপারটা কী?! এরপর একে একে অন্যদের নামও ঘোষণা করলেন উস্তাদজী। কিন্তু খালেদের নাম বললেন না। খালেদ ব্যাপারটা কিছু বুঝে উঠতে পারল না।
পুরস্কার বিতরণ শেষে উস্তাদজী বললেন, আজকের নামায প্রতিযোগিতায় তোমরা কেউ পেয়েছ ৯০ নাম্বার। কেউ পেয়েছ ৮০, কেউ ৭০, ৬০। আবার কেউ পেয়েছ ১০।
এখন তোমাদের কেউ ৯০ পেয়েছে আবার কেউ ফেল করেছে; জানো তোমরা- এমনটি কেন হয়েছে? আমি তোমাদের একটি গল্প শোনাই। তাহলেই তোমরা বুঝতে পারবে।
একবার নবীজী মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। নবীজী মসজিদে প্রবেশের পর এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল। সে খুব তাড়াহুড়া করে নামায পড়ল। নবীজী তার নামায পড়া দেখলেন। নামায শেষে সে নবীজীর কাছে এল এবং সালাম দিল।
নবীজী তার সালামের উত্তর দিলেন এবং বললেন, যাও, আবার নামায পড়, তুমি নামায পড়নি!
সে আবার নামায পড়ল এবং নবীজীর কাছে এল। নবীজী এবারও বললেন, যাও, আবার নামায পড়, তুমি নামায পড়নি! সে আবার নামায পড়ল; কিন্তু তৃতীয়বারেও নবীজী তাকে আবার নামায পড়তে বললেন। (কারণ সে খুব তাড়াহুড়া করে নামায পড়ছিল।)
এরপর, ঐ সাহাবী নবীজীকে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমি এর চেয়ে সুন্দর করে নামায পড়তে পারি না; আমাকে শিখিয়ে দিন- কীভাবে নামায পড়তে হয়।
তখন নবীজী বললেন-
إِذَا قُمْتَ إِلَى الصّلاَةِ فَكَبِّرْ، ثُمّ اقْرَأْ مَا تَيَسّرَ مَعَكَ مِنَ القُرْآنِ، ثُمّ ارْكَعْ حَتّى تَطْمَئِنّ رَاكِعًا، ثُمّ ارْفَعْ حَتّى تَعْدِلَ قَائِمًا، ثُمّ اسْجُدْ حَتّى تَطْمَئِنّ سَاجِدًا، ثُمّ ارْفَعْ حَتّى تَطْمَئِنّ جَالِسًا، وَافْعَلْ ذَلِكَ فِي صَلاَتِكَ كُلِّهَا.
যখন তুমি নামাযে দাঁড়াবে, আল্লাহু আকবার বলে নামায শুরু করবে।... এরপর ধীরেসুস্থে রুকু করবে (ধীরে ধীরে সুন্দর করে রুকুর তাসবীহ পড়বে)। রুকু থেকে ধীরেসুস্থে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবে (সুন্দরভাবে রব্বানা লাকাল হাম্দ বলবে)। এরপর ধীরেসুস্থে সিজদা করবে (সুন্দর করে ধীরে ধীরে সিজদার তাসবীহ পড়বে)। এরপর ধীরেসুস্থে সিজদা থেকে উঠে সোজা হয়ে বসবে। এভাবে পুরো নামায ধীরেসুস্থে আদায় করবে। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৭)
এতক্ষণে খালেদ বুঝে ফেলেছে; কেন সে লাড্ডুগুড্ডু হয়েছে নামায প্রতিযোগিতায়। দৌড় প্রতিযোগিতা আর নামায প্রতিযোগিতা এক নয়; দৌড়াতে হয় দ্রুত আর নামায পড়তে হয় ধীরেসুস্থে।
এরপর উস্তাদজী বললেন, আমরা যখন আল্লাহর সামনে নামাযের জন্য দাঁড়াই আল্লাহও আমাদের এভাবে সওয়াব-পুরস্কার দেন। আমরা কখনও নামাযের দশ ভাগের এক ভাগ সওয়াব পাই; অর্থাৎ ১০ নম্বর পাই। আবার কেউ দুই ভাগের এক ভাগ সওয়াব পায় অর্থাৎ ৫০ নাম্বার পায়। আবার কেউ পূর্ণ সওয়াব পায়। একটি হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنّ الرّجُلَ لَيَنْصَرِفُ وَمَا كُتِبَ لَهُ إِلّا عُشْرُ صَلَاتِهِ تُسْعُهَا ثُمْنُهَا سُبْعُهَا سُدْسُهَا خُمْسُهَا رُبْعُهَا ثُلُثُهَا نِصْفُهَا.
ব্যক্তি নামায পড়ে, কিন্তু সে তার নামাযের দশ ভাগের এক ভাগ সওয়াব পায়। কেউ পায় নয় ভাগের এক ভাগ, কেউ আট ভাগের এক ভাগ, সাত ভাগের এক ভাগ, ছয় ভাগের এক ভাগ, পাঁচ ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ, তিন ভাগের এক ভাগ আবার কেউ পায় অর্ধেক সওয়াব।... -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮৯৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৮৮৯
অনুষ্ঠান শেষে খালেদ মনে মনে উস্তাদজীর উদ্দেশে বলল- জাযাকাল্লাহু খাইরান। আল্লাহ উস্তাদজীকে উত্তম বিনিময় দিন। আজকের পুরস্কার পেলাম না তো কী হয়েছে! সারা জীবনের নামাযের পুরস্কার কীভাবে পাব- তা তো বুঝে ফেললাম। ইনশাআল্লাহ, আজ থেকে আমি সুন্দরমত ধীরেসুস্থে নামায আদায় করব এবং আল্লাহর কাছে নামাযের পূর্ণ সওয়াব পাব; ১০০ নাম্বার পাব।