Safar 1429   ||   February 2008

সাত ক্বারী চৌদ্দ রাবী : একটি আলোচনা

Mawlana Muhammad Abdul Malek

অনেক তালিবে ইলম, এমনকি সাধারণ শিক্ষিত অনেক মানুষের কাছেও সাত ক্বারী চৌদ্দ রাবী কথাটা পরিচিত। কিন্তু এই সাত ক্বারী বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে আর চৌদ্দ রাবীর পরিচয়ই বা কী তা সাধারণ মানুষের জানা থাকে না। এজন্য তাঁদের নাম-পরিচয় সম্পর্কে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত তাঁদের সনদ কী-এ সম্পর্কে আগ্রহী মানুষ প্রশ্ন করে থাকেন। আমিও এ প্রশ্নের কয়েকবার উত্তর দিয়েছি। বর্তমান নিবন্ধও এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে লেখা হয়েছিল। বিষয়টি পেশ করার আগে ভূমিকাস্বরূপ দুটি প্রয়োজনীয় বিষয় উল্লেখ করছি :

আজকালের প্রচলিত পরিভাষায় ক্বারী বলা হয়, যারা উত্তম সুরে তাজবীদের সাথে কুরআন পাঠ করতে পারেন। মকতবে বাচ্চাদের কুরআন শিক্ষাদানকারীকেও ক্বারী বলা হয়। কিন্তু উপরোক্ত শিরোনামে ক্বারী শব্দ এ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং ইসলামের প্রথম যুগে শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হত সে অর্থই এখানে উদ্দেশ্য। সে যুগে ক্বারী বা মুকরি শুধু এমন সৌভাগ্যবান বুযুর্গ ব্যক্তিদের উপাধি ছিল, যাঁরা ইলমে কিরাআত বা ইলমে তাজবীদের ইমাম ছিলেন। আর এ বিষয়ে অন্যরা তাঁদের শরণাপন্ন হত।

এ ধরনের ব্যক্তিত্ব তুলনামুলকভাবে কম হলেও প্রতি শতাব্দীতে কয়েকশ মনীষী এ পর্যায়ে উপনীত ছিলেন। আর তাঁদের নিকট থেকে ইলমে কিরাআত গ্রহণ করেছেন এবং কিরাআত বর্ণনা করেছেন তাঁদের হাজার হাজার বিশেষজ্ঞ শাগরিদ।

তৃতীয় শতাব্দীতে আল্লামা ইবনে মুজাহিদ (রহ. ২৪৫-৩২৪) ইলমে কিরাআত বিষয়ে একটি কিতাব রচনা করেছিলেন। সে রচনায় তিনি প্রথম শতাব্দীর কিরাআত ও তাজবীদে পারদর্শী ইমামদের এই সুবিশাল জামাআতের মধ্য থেকে সংক্ষিপ্ততার জন্য সাতজন ইমামকে নির্বাচন করেন আর তাঁদের অসংখ্য রাবীদের মধ্য থেকে শুধু দুজন করে রাবী নির্বাচন করেন। এঁদের সূত্রেই ইবনে মুজাহিদ রহ. ইলমে কিরাআত ও তাজবীদ পেশ করেছেন।

এক সময় এই কিতাব ব্যাপক পঠিত ছিল। ফলে সাত ক্বারী চৌদ্দ রাবী কথটা প্রশিদ্ধি লাভ করে এবং একটি পরিভাষা হয়ে যায়। এখান থেকে কেউ কেউ এ ধারণায় পড়ে গেলেন যে, কুরআন মাজীদের সর্বোমোট ক্বারী হলেন সাতজন আর তাদের রাবী হলেন চৌদ্দজন। অথচ উপরের প্রেক্ষাপট থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাস্তব বিষয় এমন নয়। ইবনে মুজাহিদ রহ. তো শুধু সংক্ষিপ্ততার খাতিরে এটা করেছেন। বাস্তবে ইলমে কিরাআত ও তাজবীদের ইমাম এবং তাদের শাগরিদ ও রাবীর সংখ্যা অগণিত। [التبيان لبعض المباحث المتعلقة بالقران، طاهر الجزائري ১১৪-১১২]

এই দুটি কথা পেশ করার পর এবার ইলমে কিরাআতের ওই সাতজন ক্বারী এবং তাদের চৌদ্দজন রাবীর নাম নিচে উল্লেখ করছি। সাথে প্রত্যেক ইমামের অনেক সনদের মধ্য থেকে নমুনা হিসেবে একটি করে সনদ উল্লেখ করা হল।

 

১. আসেম (ইবনে আবিন্নাজুদ) আলকুফী (মৃত্যু ১২৭হিজরী)

তাঁর রাবীদ্বয় : হাফস আলকুফী ও আবু বকর ইবনে আয়য়াশ আলকুফী।

সনদ : আসেম কুরআন শরীফ পাঠ করেছেন যথাক্রমে- আবু আব্দুর রহমান আসসুলামী, যির ইবনে হুবাইশ এবং আবু আমর আশশায়বানী থেকে। উল্লেখিত তিনজন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে এবং তিনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে। আবু আবদুর রহমান আস্সুলামী এবং যির ইবনে হুবাইশ দুজনই হযরত উসমান  রা. এবং হযরত আলী রা. থেকেও পাঠ গ্রহণ করেন।

আবু আবদুর রহমান সুলামী হযরত উবাই ইবনে কাব রা. এবং যায়েদ ইবনে ছাবেত রা.-এর নিকটও কুরআন পড়েছেন। হযরত ইবনে মাসউদ রা. আলী রা. উবাই ইবনে কাব রা. এবং যায়েদ ইবনে ছাবেত রা. সকলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের নিকট কুরআন পড়েছেন। -আন্নাশরু ফিল কিরাআতিল আশর ১/১১৫

 

২. নাফে আলমাদানী (মৃত্যু ১৬৯ হিজরী)

রাবীদ্বয় : ক্বালুন ও ওয়ার্শ্ আলমিসরী। নাফে কুরআন পাঠ করেছেন আবদুর রহমান আলআরাজ রহ.-এর নিকট। তিনি পড়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. ও আবু হুরায়রা রা.-এর নিকট। তাঁরা উভয়ে উবাই ইবনে কাব রা.-এর নিকট। আর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। -আন্নাশর ১/১১২

 

৩. আব্দুল্লাহ ইবনে কাছীর আলমাক্কী (মৃত্যু ১২০ হিজরী)

রাবীদ্বয় : (তাঁর শাগরিদদের মাধ্যমে) আহমদ আলবায্যী ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান কুন্বুল। আব্দুল্লাহ ইবনে কাছীর কুরআন পড়েছেন আবু সায়েব আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েবের নিকট। তিনি ওমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর নিকট। তিনি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। -আন্নাশর ১/১২০

 

৪. আবু আমর ইবনুল আলা আলবাসরী (মৃত্যু ১৫৪ হিজরী)

রাবীগণ : (তাঁর ছাত্র ইয়াহয়া ইবনুল মুবারকের মাধ্যমে) আবু আমর হাফ্স ইবনে ওমর আদ্দুরী ও আবু শুআইব সালেহ ইবনে যিয়াদ সুসী। আবু আমর কুরআন পড়েছেন যথাক্রমে নসর ইবনে আসেম এবং ইয়াহয়া ইবনে ইয়ামার রহ.-এর নিকট। তারা উভয়ে আবুল আসওয়াদ রহ.-এর নিকট। তিনি হযরত উসমান রা. এবং হযরত আলী রা.-এর নিকট। তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। -আন্নাশর ১/১৩৩

 

৫. আব্দুল্লাহ ইবনে আমের আলইয়াহসুবী (মৃত্যু ১১৮ হিজরী)

রাবীদ্বয় : (তাঁর শাগরিদদের মাধ্যমে) হিশাম ইবনে আম্মার ও ইবনু যাকওয়ান আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ। আব্দুল্লাহ ইবনে আমের কুরআন পাঠ করেন আবু হাশেম আলমুগীরা মাখযুমীর নিকট। তিনি হযরত উসমান রা.-এর নিকট, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পড়েন। -আন্নাশর ১/১৪৪

 

৬. হামযা ইবনে হাবীব আলকুফী (মৃত্যু ১৫৬ হিজরী)

রাবীদ্বয় : (তাঁর শাগরিদ সালিম-এর মাধ্যমে) খালাফ ইবনে হিশাম আলবায্যার ও খাল্লাদ ইবনে খালেদ আলকুফী। হামযা কুরআন পড়েন আবু ইসহাক সাবীয়ী-এর নিকট, তিনি আসেম ইবনে যামরাহ রহ.-এর নিকট; তিনি আলী রা.-এর নিকট। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। -আন্নাশর ১/১৬৫

 

৭. আলী ইবনে হামযা আলকিসাঈ (মৃত্যু ১৮৭ হিজরী)

রাবীদ্বয় : আবুল হারেছ লাইস ইবনে খালেদ ও আবু আমর হাফ্স ইবনে ওমর আদ্দুরী। কিসাঈ কুরআন পড়েছেন পূর্বল্লোখিত হামযা রহ.-এর নিকট। তার সনদ পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

কিসাঈ ঈসা ইবনে উমার হামাযানির নিকটও কুরআন পড়েছেন, তিনি আমাশের কাছে, তিনি ইয়াহ্য়া ইবনে ওয়াচ্ছাবের কাছে, তিনি উবাইদ ইবনে নুযাইলার কাছে, তিনি আলকামার নিকট, তিনি ইবনে মাসউদ থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পাঠ নেন। -আন্নাশর ১/১৭২, তাবকাতে ইবনে সাদ ৬/১৭১-১৭২

 

advertisement