Rabiul Auwal 1429   ||   March 2008

মনে যেন কারো না দেই আঘাত

মাহমুদাতুর রহমান

তোমরা অনেকেই হয়তো ভারতের ন্যায়পরায়ণ শাসক সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের নাম শুনে থাকবে। বড় ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। ভারত উপমহাদেশের মতো এত বড় দেশের শাসক হওয়ার পরও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার ছিল না। অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। তোমরা শুনলে আশ্চর্য হবে যে, তিনি কুরআনের কপি হাতে লিখে এবং টুপি বানিয়ে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর ঘরে কোনো পরিচারিকা ছিল না। বেগম নিজ হাতে রান্না-বান্না করতেন। একবার হল কি? রান্না করতে গিয়ে বেগমের হাত পুড়ে গেল। তখন তিনি রান্নাঘরে গিয়ে পাকশাকের কাজ সমাপ্ত করলেন। ভাবতে পার কত বড়ো মহত্ব এটা।

আসলে এটাই হল আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ। তিনি গৃহস্থালির অনেক কাজ নিজ হাতে করতেন। ঘর ঝাড়ু দিতেন, জুতো সেলাই করতেন, ছাগলের দুধ দুইতেন। আর নিজের কাজ নিজে করাতে লজ্জার কিছু নেই, বরং তা গৌরবের বিষয়। যারা নিজের কাজ নিজে করে আল্লাহ তাআলা তাদের ভালোবাসেন।

চল আমরা আবার সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের গল্পে ফিরে যাই। শুরুতেই আমরা জেনেছি যে, তিনি টুপি বানিয়ে ও কুরআনের কপি নিজ হাতে লিখে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তো একদিন তিনি কামরায় বসে গভীর মনোযোগের সাথে কুরআনের কপি লিখছিলেন। কাছে তাঁর বিশেষ খাদেম ছাড়া আর কেউ ছিল না। তখন কিন্তু কম্পিউটারের যুগ ছিল না। যত কিতাবপত্র দলিল-দস্তাবেজ সব মানুষকে হাতেই লিখতে হত, হাতেই কপি করতে হত। এ সময় হঠাৎ এক আগন্তুক এসে সুলতানের সাথে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করল। সুলতান অনুমতি দিলেন। লোকটি কক্ষে প্রবেশ করে সুলতানের সাথে কথা বলতে লাগল। কথার ফাঁকে সে সুলতানের লিখিত কপির দিকে লক্ষ করছিল। একটি পৃষ্ঠায় সে একই লাইনে একই শব্দ দুবার লেখা দেখতে পেয়ে সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, মাননীয় সুলতান! এখানে একই শব্দ দুবার লেখা হয়ে গেছে। তার কথায় সুলতান কপিটি দেখলেন। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর কোনো কথা না বলে পেন্সিল দিয়ে শব্দটির চারপাশে গোলাকার বৃত্ত এঁকে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর লোকটি কথাবার্তা শেষ করে সুলতানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর সুলতান কিছুক্ষণ পূর্বে আঁকা বৃত্তটি মুছে ফেললেন।

পাশে বসা সুলতানের বিশেষ খাদেমটি এই দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। সে বলল, সুলতান! আমি অনেকদিন ধরে আপনার কাছে আছি। এর মধ্যে আপনার অবাক করা অনেক আচরণ আমি লক্ষ করেছি। কিন্তু আপনার আজকের আচরণটা আমার কাছে বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছে। আপনি লোকটির কথা শুনে একবার বৃত্ত অাঁকলেন, সে চলে যাওয়ার পর আবার তা মুছে ফেললেন। আপনার এই বৃত্ত আঁকা ও মুছে ফেলা আমার কাছে বড় আশ্চর্যকর মনে হচ্ছে।

সুলতান তার কলমের নিচের অর্ধলিখিত পৃষ্ঠার দিকে ইশারা করে বললেন, দেখ এখানে একই শব্দ দুবার লেখা হয়েছে, এটা আমি ঠিকই লিখেছি। কুরআন শরীফে এমনই রয়েছে। কিন্তু লোকটিকে যদি আমি এটা বলে দিতাম তবে সে এতে লজ্জিত হত। তার মনে কষ্ট আসত। তাই আমি তার সামনে একটি শব্দে বৃত্ত এঁকে বুঝিয়েছি যে, হাঁ! তোমার কথাই ঠিক। তোমার পরামর্শ গ্রহণযোগ্য। সে চলে যাওয়ার পর যেহেতু আর প্রয়োজন ছিল না তাই বৃত্তটি মুছে ফেলেছি।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সুলতান আবার বললেন- দেখ ভাই! কাগজের ব্যথা মোছা বড় সহজ, কিন্তু হৃদয়ের ব্যথা মোছা বড় কঠিন।

সুলতানের এই অনুপম মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে খাদেমটি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল। ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আপ্লুত দৃষ্টিতে সে এক ধ্যানে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রিয় কিশোর বন্ধুরা! এস আমরাও শপথ নিই- কখনও কাউকে কষ্ট দেব না, আমাদের দ্বারা কারও হৃদয়ে ব্যথা লাগবে না। আমরা গড়ে উঠব ফুলের মতো পবিত্র নিষ্পাপ-আলোকিত মানুষরূপে। #

 

advertisement