মহিয়সী নারীদের জীবনকথা
মুহতারামা আমাতুল্লাহ তাসনীম আয়েশা রাহ. [সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর বোন]
তিনি ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা হাকীম সায়্যিদ আবদুল হাই হাসানী রাহ. একজন বিজ্ঞ আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। বড় ভাই মাওলানা ডাক্তার সায়্যেদ আবদুল আলী হাসানী রাহ. এবং মাতা মুহতারামা খাইরুন নিসা রাহ.Ñ এঁরা সবাই তখনকার যামানার অত্যন্ত পরহেযগার ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।
এসব মহান ব্যক্তিদের তত্ত¡াবধানে তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন। তাঁদের ইলম, তরবিয়ত ও ভালবাসা থেকে পুরোপুরি উপকৃত হয়েছেন। এমন দ্বীনী ও ইলমী পরিবেশে থেকে তিনি ইলম অর্জন করেছেন। পরবর্তীতে একজন মহান মুরুব্বী এবং আলেমা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর মহৎ গুণাবলির কারণে খান্দানের সবাই তাঁকে ভালবাসতো। তিনি সকলের প্রিয়পাত্র ছিলেন।
তাঁর বিবাহ হয়েছিল আপন মামাত ভাই সায়্যেদ আবুল খায়ের হাসানী মরুহুমের সাথে, যিনি একজন আলেম ও সাহিত্যিক ছিলেন।
স্বামীর সাহচর্যে তাঁর যে দিনগুলো কেটেছে সেটা ছিল তার প্রবন্ধ রচনা এবং সাহিত্য চর্চার সময়। তিনি এসময় অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন, যেগুলো ব্যাপকভাবে মুসলিম নারীদের দ্বীনী এবং ইসলাহী চাহিদা পূরণ করেছে। এ প্রবন্ধগুলো অধিকাংশই জালন্ধরের ‘মুসলিমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
হিন্দুস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর পত্রিকাটি যখন পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়ে গেল তখন ঐ পত্রিকায় তাঁর আর লেখালেখির সুযোগ হল না। ঐসময়ই তাঁর ভাতিজা মাওলানা সানী হাসানী রাহ. মুসলিম নারীদের জন্য নিজের এবং আমাতুল্লাহ তাসনীমের সম্পাদনায় একটি পত্রিকা বের করলেন। আলহামদু লিল্লাহ সেটা এখনো চলমান রয়েছে। এ পত্রিকাটি তাঁর পিপাসা নিবারণের মাধ্যম হয়েছিল। এটি দিয়ে তিনি তাঁর ইলমী ও সাহিত্য পিপাসা নিবারণ করতেন। যখন দৃষ্টিশক্তি কমে গেল তখন এ কাজও সীমিত হয়ে গেল। অবশ্য কিছু প্রবন্ধ তৈরি করতেন এবং কবিতা ও মুনাজাতের সিলসিলা চালু রাখলেন, যেগুলো স্বতন্ত্র কিতাব আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি জীবনের শেষ ত্রিশ বছর ভাইদের কাছে কাটিয়ে দিয়েছেন। ঐসময় আপন ভাই মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভীর সাথে হজ¦ করেছেন, সঙ্গে তাঁর মুহতারাম মা এবং ভাতিজা মাওলানা সানী হাসানী রাহ.ও ছিলেন। ঐ হজ¦ ও যিয়ারতের আলোচনা সবসময়ই করতেন। হজে¦র দিনগুলোতে তিনি কিছু মুনাজাত এবং না‘ত তৈরি করেছেন। যার মাঝে তাঁর অন্তরের ব্যথা এবং দ্বীনী জযবা প্রকাশ পায়। আমাতুল্লাহ তাসনীমের এ ত্রিশটি বছর কেটেছে ইলমী এবং তালীমী ব্যস্ততায়।
খান্দানের নারীরা এবং নবাগত বংশধর সবাই তাঁর শাগরিদ ছিল।
শৈশবে নিজ আগ্রহেই আরবী পড়া শুরু করেন। আপন ভাই এবং ফুফা মাওলানা তলহা হাসানী সাহেবের কাছে যখনই সময় পেতেন তালীমী ফায়দা অর্জন করতেন। তাঁর আরবী জ্ঞান অনেক উন্নত ছিল। তিনি কয়েকটি আরবী কিতাবেরও অনুবাদ করেছেন। ওগুলোর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘রিয়াযুস সালেহীন’। কিতাবটিকে তিনি দুই খÐে অনুবাদ করেছেন এবং নাম দিয়েছেন ‘যাদে সফর’। যা মাকতাবায়ে ইসলাম থেকে কয়েকবার মুদ্রিত হয়ে খুবই সমাদৃত হয়েছে।
মক্কা রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর পক্ষ থেকেও এর কিছু কপি ক্রয় করে বিতরণ করা হয়েছে। সউদী রেডিও সংস্থা তাঁর হাদীসের অনুবাদগুলো কিস্তি আকারে প্রকাশ করেছে। তিনি তাঁর উক্ত তাসনীফী কাজকে আখেরাতে নাজাতের ওসীলা মনে করতেন। আল্লাহ তাআলা এ কাজকে তাঁর জন্য সদকায়ে জারিয়া ও নাজাতের ওসীলা বানিয়ে দিন।
অত্যন্ত মেহনত ও ফিকিরের সাথে তিনি কিতাবটির অনুবাদ করেছেন। কারণ, এক্ষেত্রে শুধু আরবীর যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়; হাদীসের আরো বিভিন্ন শাখার জ্ঞানও প্রয়োজন হয়। তাই অনুবাদের পর প্রথমে ভাই মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীকে দেখিয়েছেন। তারপর পাঠিয়েছেন নদওয়াতুল উলামার শায়খুল হাদীস মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ হালীম আতা ছাহেবের কাছে। এ অনুবাদ তাঁকে প্রতি শব্দে শব্দে শোনানো হয়েছে। উভয় আলেমে-দ্বীনের সম্পাদনা ও সত্যায়নের পর মাওলানা সায়্যেদ সুলাইমান নদভীর কাছ থেকে ভ‚মিকা নেওয়া হয়েছে। এর ফলে অনুবাদটি সবার নিকট গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
মরহুমার রচিত কিতাবাদীর মাঝে শিশুদের জন্য কাসাসুল আম্বিয়া ও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত বিষয়ে ‘হামারে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এবং সাহাবীদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়েও কিছু কিতাব রয়েছে।
বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। ‘বায়ত বাযী’ নামে একটি কিতাব লিখেছেন। কিতাবটিতে তিনি উর্দূ ভাষায় রচিত শিক্ষামূলক প্রজ্ঞাপূর্ণ অনেক কবিতা সংকলন করেছেন।
‘আঞ্জাম বখায়ের’ নামে তাঁর একটি লেখা ‘মাসিক মুসলিমা’য় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হত। একদিকে তা সাহিত্যের পিপাসা নিবারণ করত, আবার ইসলাহ-এর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। তাঁর আরো একটি লেখা ‘মেরী বে-যবা আসতানিয়া’ নামে ধারাবাহিক ছাপা হত। যার দ্বারা ঐ কিতাবগুলোর কথা জানা যায়, যেগুলো থেকে তিনি উপকৃত হয়েছেন এবং তাঁর ইলমী জীবন গঠনে যেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রকাশিত-অপ্রকাশিত প্রবন্ধসমূহের মাঝে নারীদের জন্য ইলমী এবং আখলাকী চরিত্র গঠনে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল খেদমতকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করুন এবং আমাদেরকে তা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।
তথ্যসূত্র : ইয়াদূঁ কে চেরাগ
মাওলানা সায়্যেদ রাবে হাসানী নদভী