প্রিয় নানুজান : কিছু স্মৃতি, কিছু গুণাবলি
আমাদের ৫ম খালাম্মা স্বপ্নে দেখলেনÑ নানাজি (শাইখুল হাদীস আল্লামা আযীযুল হক রাহ.) তাকে বলছেন, ‘তোদের মাকে আর বেশিদিন তোদের কাছে রাখব না! তোরা তোদের মায়ের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখিস না!’
আহ! এই স্বপ্ন শুধুই একটি স্বপ্ন থাকল না, কিছুদিনের মধ্যেই বাস্তব সত্যে পরিণত হয়ে গেল! এখন আমাদের জন্য এটাই কঠিন বাস্তবতা যে, পরম শ্রদ্ধেয় নানাজির পর আমরা প্রিয় নানুজানের বরকতময় ছায়া থেকেও মাহরূম হয়ে গিয়েছি। তিনি সত্যিই চলে গেলেন আপন প্রভুর কাছে। মিলিত হলেন মহান স্বামীর সাথে। নানাজির পর আমরা তাঁরও ছায়া হারালাম! (আল্লাহ মেহেরবান আমাদের প্রতি রহম করুন, দয়া করুনÑ আমরা যেন আল্লাহ্র রহমতের ছায়া থেকে মাহরূম না হই!)
খালাম্মা এ স্বপ্ন দেখলেন, আর তার দেড়-দুই মাসের মধ্যেই গত ২৩-০৪-১৪৪১ হিজরী মোতাবেক ২১-১২-২০১৯ ঈ. তারিখে প্রিয় নানুজান আমাদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। আমি অধম আলকাউসারের গত ডিসেম্বর সংখ্যায় এই সংবাদ জানিয়ে পাঠকবৃন্দের নিকট দুআয়ে মাগফিরাতের আবেদন করেছিলাম। সাথে আরজ করেছিলাম, আল্লাহ পাক তাওফীক দান করলে মুহতারামা, প্রিয় নানুজান সম্পর্কে আরো কিছু কথা লেখার চেষ্টা করবÑ ইনশাআল্লাহ। এ উদ্দেশ্যেই এখন আবার পাঠকের সামনে হাজির হয়েছি, অতি দুর্বল কলম নিয়ে। আল্লাহ পাক তাওফীক দান করুন, কবুল করুন!
বংশ ও পিতা-মাতা
নানুজান ছিলেন খুলনার উদয়পুরের এক বিখ্যাত, সম্ভ্রান্ত ও খুবই দ্বীনদার পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা-মাতা উভয়ে ছিলেন অতি নেককার ও ইবাদতগুযার। সেই সাথে আল্লাহ তাঁদের, বিশেষত নানুর আম্মাকে দান করেছিলেন দানশীলতা ও পরোপকারের গুণ। নানুজানের এক চাচা ছিলেন হাফেজ জামিল আহমাদ রাহ., যিনি অত্র অঞ্চলে কামেল বুযুর্গ হিসাবে খুব প্রসিদ্ধ ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ‘সাহিবে-কারামত’ বুযর্গ ছিলেন, যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ পাক অনেক কারামাতের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
নানুর বড় বোন (যিনি আল্লাহ্র রহমতে এখনো হায়াতে আছেন) হলেন এই পরিবারের নেকী ও বুযুর্গির আরেক বড় নিদর্শন! তাঁকে দেখলে ও তাঁর বিভিন্ন অবস্থার কথা শুনলে কেবল এ অনুভ‚তিই দিলে জাগ্রত হয় যে, এ যুগেও আল্লাহ তাআলা এমন মানুষ দুনিয়ায় রেখেছেন! দুনিয়াতে থেকেও যে আল্লাহ্র কিছু খাঁটি ও বিশেষ বান্দা-বান্দির দুনিয়া ও তার বস্তুসামগ্রীর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকে না, তাঁকে দেখলে এ কথা স্পষ্টতই বুঝে আসে। এতে কোনো অতিরঞ্জন অনুভ‚ত হয় না।
আল্লাহ পাক নানুর এ বোনকে ‘শহীদ’-এরও মা বানিয়েছেন! তাঁর বড় ছেলে হাফেজ মাওলানা নাসির আহমাদ রাহ. আফগান রণাঙ্গনে রুশ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চরম অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ঐ রোগেই ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ পাক তাঁকে পূর্ণ শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন, তাঁর হাশর শহীদানের সাথে করুন।
নানুর আরেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেন তাবলীগ জামাতের বিখ্যাত আমীর মরহুম হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয রাহ.। তাঁরই প্রভাবে নানুজানেরও তাবলীগের মাস্তুরাত জামাতের সাথে সম্পর্ক হয় এবং সারা জীবন তা বজায় থাকে।
‘আব্দুল আযীয’-এর মত নানুর বুযুর্গ আব্বাজানের নামেও ‘আযীয’ শব্দটি রয়েছে। কারণ, তিনি হলেন মাওলানা আযীযুর রহমান। আর নানাজানÑ আযীযুল হক। নানুজানের বিয়ের বরকতে উদয়পুরের দুই ‘আযীয’-এর সাথে যুক্ত হল বাংলার বিখ্যাত আরেক ‘আযীয’! এ কারণেই একসময় লোকেরা বলাবলি করত, উদয়পুরের মানুষের কী ভাগ্য! আল্লাহ পাক তাদেরকে তিন ‘আযীয’ দান করেছেন। আযীযুর রহমান, আব্দুল আযীয ও আযীযুল হক!
আহ্! না জানি সেই দৃশ্য কত সুন্দর, কত পবিত্র ছিল, যখন উদয়পুরে এই তিন মহান বুযর্গ একত্র হতেন এবং পরস্পরে আলাপচারিতায় মশগুল হতেন! আপন আপন সময়ে তাঁদের সকলেই মহান প্রভুর কাছে চলে গেছেন। আল্লাহ পাক তাঁদেরকে এ আয়াতের সুসংবাদপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নিনÑ
فِیْ جَنّٰتِ النَّعِیْمِ، عَلٰی سُرُرٍ مُّتَقٰبِلِیْنَ.
নিআমতপূর্ণ উদ্যানে তারা উঁচু আসনে সামনা-সামনি বসা থাকবে। Ñসূরা সাফফাত (৩৭) : ৪৩-৪৪
মাওলানা আযীযুর রহমান রাহ. নানুর বিয়ের অনেক আগ থেকেই নানাজির খুবই ভক্ত-অনুরক্ত ছিলেন; বরং বলা যায়, তাঁর আশেক ছিলেন। একবার নানাজান উদয়পুরে গেলেন মাহফিলে বয়ান করতে। তখন নানুর বয়স মাত্র তিন বছর। বয়ান শেষে যখন নানাজি চলে আসবেন তখন আযীযুর রহমান সাহেবের বে-হাল অবস্থা! নানাজির বিরহে কান্না করতে লাগলেন। তাঁর এ অবস্থা দেখে লোকেরা বলাবলি করতে লাগলÑ ইস্ মাওলানা সাহেবের যদি বিবাহের উপযুক্ত কোনো মেয়ে থাকত! তাহলে মাওলানা আযীযুল হক সাহেবকে ‘জামাই’ বানিয়ে আটকে ফেলা যেত।
কী অদ্ভুত ব্যাপার! এই ঘটনার প্রায় ১৫/১৬ বছর পর মাওলানা আযীযুর রহমান রাহ. ঠিকই নানাজানকে (আপন মেয়ের সাথে) বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললেন! উদয়পুরবাসীর ভাগ্য, বাংলার বিখ্যাত ‘আযীয’ তাদের আদরের, সম্মানের ‘জামাই’ হয়ে গেলেন। এটা ছিল নানাজানের দ্বিতীয় বিবাহ। এর কিছুকাল পূর্বে তাঁর প্রিয়তমা প্রথমা স্ত্রী (আমাদের ১ম নানুজান, আমার আম্মার আম্মাজান রাহ.) তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আপন প্রভুর কাছে চলে গিয়েছেন!
নানাজানের জীবনে ঘটে গেছে চরম বিয়োগান্তক ঘটনাটি। তারিখ ছিলÑ ১১.১১.৬৩ ঈ.
প্রথম নানুর কিছু হাল-অবস্থা
আমাদের এই নানু ছিলেন আল্লাহ্র ইবাদতে পূর্ণ সমর্পিত, কুরআনের প্রকৃত আশেক, দুনিয়াবিমুখ, সদা আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্তÑ এক মহিয়সী নারী। সদ্য যৌবনেই তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও ইশকে কুরআনের এই অবস্থা ছিল যে, তিনি একটি খাটের চতুর্দিক চাদর দিয়ে ঘিরে একেই আপন নির্জন ‘ইবাদত খানা’ বানিয়ে নিয়েছিলেন। এখানেই তিনি অবস্থান করতেন আর ইবাদত, বিশেষত কুরআন তিলাওয়াতে ডুবে থাকতেন। তাঁর নিয়মিত আমল ছিল প্রতি তিন দিনে এক খতম তিলাওয়াত করা।
একটি বিশুদ্ধ ও বিখ্যাত হাদীসে আছেÑ আল্লাহ পাক কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে যে সাত প্রকার বান্দাকে তাঁর আরশের ছায়াতলে জায়গা দান করবেন তাদের এক প্রকার হলÑ
شَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى.
অর্থাৎ ওই সৌভাগ্যবান যুবক (বা যুবতী), যে বেড়ে উঠেছে মহান আল্লাহ্র ইবাদতের মধ্য দিয়ে। যৌবনে পদার্পণ করেই সে ‘ইবাদাতুল্লাহ’কে আঁকড়ে ধরেছে। অতঃপর এর ভিতর দিয়েই সে জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান পর্বটি অতিক্রম করতে থেকেছে। আমাদের এই নানু ছিলেন তার জীবন্ত নমুনা! হ
(চলবে ইনশাআল্লাহ)