সিয়াম ও রমযান : গুরুত্ব ও ফযীলত
রমযানুল মুবারক। বছরের বার মাসের সর্বাধিক মর্যাদাশীল ও মহিমান্বিত মাস। এ মাসে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীম নাযিল করেছেন, যা সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব এবং মানবজাতির হেদায়েতের দিশারী। এ মাসে তিনি রেখেছেন ‘লাইলাতুল কদর’, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ মাসের দিবসে তিনি ফরয করেছেন সিয়াম, যা ইসলাম ধর্মের মূল পাঁচ ভিত্তির একটি। আর রাতে রয়েছে তারাবীহ্র বিধান, যা আবদ ও মাবূদের মাঝে কিয়ামুল লাইল ও তিলাওয়াতুল কুরআনের মাধ্যমে নিগূঢ় সম্পর্ক স্থাপনের অনন্য মাধ্যম। এ মাসে সুন্নত করা হয়েছে ইতিকাফ, যাতে বান্দা তার রবের ঘরে, তাঁর একান্ত মেহমান হয়ে কিছু সময় গুযরান করে। এ মাসকে ঘিরে হুকুম করা হয়েছে সদাকাতুল ফিত্রের, যাতে গরীবের মুখেও আনন্দের হাসি ফোটে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর পুরস্কার দিবসের বার্তা নিয়ে উদিত হয় ঈদের চাঁদ, যাতে বান্দা তার প্রভুর কাছ থেকে লাভ করতে পারে রহমত ও মাগফেরাতের ইনাম।
এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। খায়র ও বরকতের মাস। তাকওয়া অর্জনের মাস। আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস। নেকী হাছিলের মাস। গুনাহ বর্জন করার মাস। ক্ষমা লাভের মাস। প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার মাস। সংযম-সাধনার মাস। ভ্রাতৃত্ব চর্চার মাস। সহানুভূতির মাস। দেহমন শুদ্ধ ও পবিত্র করার মাস।
এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ পাকের রহমত ও করুণা বান্দার প্রতি অধিক নিবিষ্ট হয়, নেক ও কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়া সহজ হয়। জাহান্নামের কপাটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। গুনাহের তাড়না দমিত হয়। এ মাসে শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে। তার ওয়াসওয়াসা ও কুমন্ত্রণা নিষ্ক্রিয় হয়। এ মাসে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্ত করে থাকেন জাহান্নামের আগুন থেকে। অতএব এ মাস হল আল্লাহমুখী হওয়া, তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়া, তাকওয়া হাছিল করা এবং গুনাহ থেকে পাক-ছাফ হয়ে তাঁর নৈকট্য অর্জনের মোক্ষম সময়। আর তাই রমযানের চাঁদ উঠতেই ঘোষণা হতে থাকেÑ
يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ.
ওহে কল্যাণ-অন্বেষী! নেকীর পথে তুমি আরো বেগবান হও। ওহে অকল্যাণের পথিক! তুমি নিবৃত্ত হও, নিয়ন্ত্রিত হও। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৭৯৫, ২৩৪৯১
মুমিনের জন্য এ মাস নেকী লাভ ও তাকওয়া অর্জনের বসন্ত। এ মাসে সে সংগ্রহ করে তার গোটা বছরের ঈমানী আমলী এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির পাথেয়। সর্বোপরি এ মাস প্রস্তুতি গ্রহণের মাস, তাকওয়ায় বলীয়ান হওয়ার মাস।
পক্ষান্তরে মুবারক এ মাস লাভ করার পরও এর খায়র ও বরকত থেকে গাফেল থাকা, নিজের ঈমান ও আমলের ব্যাপারে উদাসীন থাকা, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও উৎকর্ষের ব্যাপারে বেখবর থাকা অনেক বড় মাহরুমির কথা। আল্লাহ পানাহ, বিশেষ করে এ বরকতময় সময়গুলোতে গুনাহ ও নাফরমানিতে লিপ্ত থাকা এবং প্রবৃত্তির গোলামীতে নিমজ্জিত থাকা অনেক বড় বরবাদি এবং দুর্গতির কারণ। এক বর্ণনায় এসেছেÑ
মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে উত্তম মাস আর নেই এবং মুনাফিকদের জন্য এর চেয়ে ক্ষতির মাসও আর নেই। মুসলমান এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সঞ্চয় করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত এবং মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৩৬৮; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৮৮৪; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস ৪৭৭৯)
বস্তুত মুমিনের শানই হচ্ছে, আল্লাহর দেওয়া রমযানের উপঢৌকনকে সে গনীমত মনে করবে এবং এ থেকে সে বেশি থেকে বেশি উপকৃত হতে সচেষ্ট ও তৎপর থাকবে।
নতুন চাঁদ নতুন উদ্যম : দুআ পড়ে সংকল্প করি
মুমিনমাত্রই রমযানের নিআমত লাভ করবার প্রত্যাশী। সে রমযানকে ইস্তেকবাল করতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে। অতএব যখন রমযানের চাঁদ উদিত হয় তখন নতুন চাঁদ দেখার দুআটা পড়ে নিই এবং পূর্ণ উদ্যমে নতুন সংকল্পে রমযানের কল্যাণ লাভে নিমগ্ন হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখে এই দুআ পড়তেনÑ
اللهُمّ أَهِلّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسّلامَةِ وَالْإِسْلامِ، رَبِّي وَرَبّكَ اللهُ.
আয় আল্লাহ, আপনি এই হিলালকে আমাদের জন্য ঈমান ও ইসলাম এবং শান্তি ও বরকতের সঙ্গে উদিত করুন। (হে চাঁদ!) আমার ও তোমার রব আল্লাহ। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৯৭
আর ২৯ শাবান সূর্যাস্তের পর থেকে রমযানের চাঁদ তালাশ করা ফরযে কেফায়াও বটে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৮১; মারাকিল ফালাহ, পৃ. ২৩৯)
রোযা : গুরুত্ব ও ফযীলত
আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের জন্য রমযান মাসের রোযা ফরয করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.
হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৮৩
এ আয়াতে বলা হচ্ছেÑ ক. ঈমানদারদের জন্য রোযা রাখা ফরয। খ. রোযা কেবল এ উম্মতের উপরই ফরয নয়, পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয ছিল। গ. রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য হল মুমিনগণ যাতে তাকওয়া অর্জন করতে পারে।
তো দেখা যাচ্ছে, রোযার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাকওয়া হাছিল করা।
রমযানের রোযা : ইসলামের ভিত্তিমূলের একটি
ইসলামের মৌলিক যে পাঁচটি ভিত্তি, রমযানের রোযা তার অন্যতম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ
بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ وَأَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزّكَاةِ، وَالحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ.
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। ক. এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ্র রাসূল। খ. সালাত কায়েম করা। গ. যাকাত আদায় করা। ঘ. হজ্ব পালন করা এবং ঙ. রমযানের রোযা রাখা। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬
রোযা : গুনাহ মাফের মাধ্যম
রমযান মাসের রোযা এতটা মহিমান্বিত একটি আমল, যার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দার অতীতের সকল গুনাহ-খাতা ক্ষমা করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِه.
যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমযান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮
তো ঈমান ও ইহতিসাবের উপলব্ধি জাগ্রত রেখে রোযা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল এবং বান্দার গুনাহ মাফের একটা মাধ্যম।
আল্লাহ তাআলার নিকট বান্দার রোযা অত্যন্ত প্রিয়। রোযা ও রোযাদারের ব্যাপারে হাদীসে কুদসীতে চমৎকার বিবরণ এসেছেÑ
قَالَ اللهُ: كُلّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ، إِلّا الصِّيَامَ، فَإِنّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَالصِّيَامُ جُنّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ. وَالّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ. لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا: إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبّهُ فَرِحَ بِصَوْمِه.
অন্য বর্ণনায় এসেছেÑ
يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي. الصِّيَامُ لِي، وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا.
(দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪, ১৯০৪, ৭৪৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১)
এ হাদীসে অনেকগুলো বিষয় একসাথে উল্লেখিত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে কিছু তুলে ধরা হল :
ক. আল্লাহ তাআলা নিজে রোযার প্রতিদান দেবেন
আল্লাহ তাআলার নিকট বান্দার সকল আমল একরকম আর রোযার হিসাব ভিন্ন রকম। আল্লাহ্র নিকট বান্দা আমলের প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোযার প্রতিদান আল্লাহ নিজে বান্দাকে দান করবেন। আল্লাহ কেমন প্রতিদান দেবেন তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন। আমরা শুধু বুঝি, যে প্রতিদান আল্লাহ বিশেষভাবে দেবেন তা তাঁর শান মোতাবেক দেবেন। রোযার ক্ষেত্রে বান্দার জন্য আল্লাহ্র তরফ থেকে এত বড় সম্মান ও পুরস্কার এ জন্য যে, রোযা সাধারণত আল্লাহ্র জন্যই হয়ে থাকে। অন্যান্য আমলের তুলনায় রোযার ক্ষেত্রে রিয়ার আশঙ্কাও কম থাকে। সেজন্যই আল্লাহ বলেছেন, রোযা আমার জন্য। আর এজন্যই আল্লাহ নিজে এর প্রতিদান দান করবেন।
দ্বিতীয়ত রোযাদারের জন্য এত বড় পুরস্কার এজন্যও যে, আল্লাহ তাআলা অন্যান্য সময় তার জন্য যা হালাল করেছেন রোযা অবস্থায় দিনের বেলা কেবল আল্লাহ্র হুকুমের কারণে সে তা থেকে বিরত থাকছে। সে পানাহার ও বৈধ জৈবিক চাহিদা দমন করছে কেবল আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের লক্ষ্যে এবং একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। অথচ এগুলো এমন বিষয়, একমাত্র আল্লাহ্র ভয়, তাঁর প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশা ব্যতীত এ থেকে নিবৃত্ত থাকা সম্ভব নয়।
প্রচÐ গরম। খুব তৃষ্ণা। নামাযের জন্য অযু করছি। কুলি করার জন্য মুখে পানি দিলাম। এ পানি মুখ থেকে বের না করে গিলে ফেললেও দেখার ও বলার কেউ নেই। তবুও মুখের পানি গলার ভেতর না নিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছি। কারণ? আমার এ বিরত থাকা একমাত্র আল্লাহর জন্য। এজন্য আল্লাহ নিজেই এর বিনিময় দান করবেন।
সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, সকল আমলের সওয়াব তো (একরকম) নির্ধারিত। অর্থাৎ প্রতিটি নেকী দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে রোযার বিষয়টি এর ব্যতিক্রম। কেননা রোযা একমাত্র আল্লাহ্র জন্যই হয়ে থাকে। আর তাই এর প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দেবেন।
তো যে আমলের প্রতিদান মহান রাব্বুল আলামীন নিজে দান করবেন সেই প্রতিদান কেমন মহান হতে পারে! আর এমন আমলের প্রতি একজন মুমিনের আগ্রহ কত প্রবল থাকতে পারে!! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই অনুভূতি জাগরূক রেখে সিয়াম সাধনার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।
খ. রোযা ঢাল স্বরূপ
এ হাদীসে রোযাকে ঢাল সাব্যস্ত করা হয়েছে। মুমিনের রোযা তার জন্য ঢাল হবে। অর্থাৎ ঢাল যেভাবে মানুষকে রক্ষা করে তেমনি রোযাও রোযাদারকে রক্ষা করবেÑ তাকওয়া হাছিলের প্রতিবন্ধকতা থেকে, গুনাহ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে, প্রবৃত্তি অবদমিত করার ক্ষেত্রে, কবরে-হাশরে এবং আখেরাতের সকল ঘাঁটিতে, এমনকি জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে রোযা তাকে রক্ষা করবে। তাই রোযাদারের কর্তব্য হল, তার রোযা যাতে ঢাল হয় সেই চেষ্টা করা এবং এ ঢালকে অক্ষুণœ রাখা; বিদীর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করা। হাদীস শরীফে এসেছেÑ
الصّومُ جُنّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا.
রোযা ঢাল স্বরূপ, যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করে ফেলা হয়। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯০, ১৭০০; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ২৫৫৪, ২৫৫৫
জিজ্ঞাসা করা হল, কীভাবে তা বিদীর্ণ হয়? নবীজী বললেনÑ
بِكَذِبٍ، أَوْ غِيبَةٍ.
মিথ্যা অথবা গীবতের মাধ্যমে। Ñআলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪৫৩৬
হাদীস শরীফে আরো এসেছেÑ
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزّورِ وَالعَمَلَ بِهِ وَالجَهْلَ، فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.
যে মিথ্যা ও মূর্খসুলভ বক্তব্য ও আচরণ ছাড়ল না, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোনো প্রয়োজন নেই। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৫৭
নবীজী আরো বলেনÑ
كَمْ مِنْ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلّا الْجُوعُ، وَكَمْ مِنْ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلّا السّهَرُ.
এমন অনেক রোযাদার রয়েছে, তাদের রোযায় ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট ব্যতীত কিছু লাভ হয় না। আবার এমন অনেক রাতের ইবাদতগুযার রয়েছে রাত্রিজাগরণের কষ্ট ব্যতীত তাদের কিছুই লাভ হয় না। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৬৮৫; সুনানে দারেমী, হাদীস ২৭৬২
তো রোযা নামক এ ঢালকে কীভাবে অক্ষুণœ রাখতে হবে; বিদীর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে এ বিষয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছেÑ
وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنّي امْرُؤٌ صَائِمٌ.
যখন তোমাদের রোযার দিন আসে তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না। কেউ যদি ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হয় তাহলে সে (নিজেকে নিবৃত্ত রাখবে এবং) বলবে, আমি রোযাদার। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪
অতএব রোযা কেবল দুই অঙ্গের নয়। হাত-পা, চোখ, কান, মুখ এবং মন মানসসহ শরীরের সকল অঙ্গের ক্ষেত্রেও রোযার আবেদন রক্ষা করা জরুরি। যাতে ঐ দুই নারীর মত না হয়, যারা রোযা অবস্থায় গীবত করেছিল। তখন তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছিলÑ
إِنّ هَاتَيْنِ صَامَتَا عَمّا أَحَلّ اللهُ لَهُمَا، وَأَفْطَرَتَا عَلَى مَا حَرّمَ اللهُ عَلَيْهِمَا.
এরা দু’জন তো আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু ঐ সব কাজ থেকে বিরত থাকেনি, যা আল্লাহ (সবসময়ের জন্য) হারাম করেছেন। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৬৫৩
গ. রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের চেয়েও অধিক প্রিয়
রোযাদার ব্যক্তি দিনভর উপোস থাকে। অনাহারে থাকার দরুন তার মুখে একধরনের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। দুনিয়াবী বিবেচনায় তা দুর্গন্ধ মনে হলেও রাব্বুল আলামীনের নিকট তা মেশকের চাইতেও অধিক প্রিয়। নবীজী বলেনÑ
وَالّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ.
ঐ সত্তার কসম, যার কব্জায় মুহাম্মাদের প্রাণ, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মেশকের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক প্রিয়। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪
তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল, মুখ অপরিষ্কার হওয়ার দরুন যে দুর্গন্ধ ছড়ায় তা এখানে উদ্দেশ্য নয়; বরং মুখ পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে ইসলাম গুরুত্বের সাথে তাকিদ করেছে। রোযা অবস্থায় না খেয়ে থাকার দরুন ক্ষুধার কারণে মুখে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, এখানে তা-ই উদ্দেশ্য।
ঘ. রোযাদারের জন্য বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبّهِ.
রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল, ইফতারের সময়। অপরটি হল, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে (আর তিনি তাকে বিশাল পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন)। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১
রোযাদার দিনভর আল্লাহ্র হুকুমে উপবাস থাকার পর যখন আল্লাহ্র হুকুম মোতাবেক ইফতারি নিয়ে বসে তখন তার মনে অন্যরকম আনন্দ এবং অপার্থিব প্রশান্তির এক ঢেউ খেলে যায়। আর কিয়ামতের ময়দানে যখন সে রবের নিকট থেকে এর প্রতিদান গ্রহণ করবে ঐ মুহূর্তটিও তার জন্য হবে অবারিত আনন্দের।
রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না
রোযাদার ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিকট এতটাই মহব্বতের পাত্র যে, সে কিছু চাইলে আল্লাহ পাক তা ফিরিয়ে দেন না। নবীজী বলেনÑ
ثَلاَثَةٌ لاَ تُرَدّ دَعْوَتُهُمْ: الصّائِمُ حَتّى يُفْطِرَ، وَالإِمَامُ العَادِلُ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ يَرْفَعُهَا اللهُ فَوْقَ الغَمَامِ وَيَفْتَحُ لَهَا أَبْوَابَ السّمَاءِ وَيَقُولُ الرّبّ: وَعِزّتِي لأَنْصُرَنّكِ وَلَوْ بَعْدَ حِينٍ.
তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক. রোযাদারের দুআ ইফতার পর্যন্ত। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ। তিন. মজলুমের দুআ। আল্লাহ এ দুআকে মেঘমালার উপরে নিয়ে যান। এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেন। রব বলেন, আমার ইযযতের কসম, বিলম্বে হলেও আমি তোমাকে সাহায্য করব। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৯৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৪৩
রোযাদারের জন্য রোযা সুপারিশ করবে
কিয়ামতের দিন রোযাদারের জন্য রোযা নিজে সুপারিশ করবে। হাদীসে এসেছেÑ
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُولُ الصِّيَامُ: أَيْ رَبِّ، مَنَعْتُهُ الطّعَامَ وَالشّهَوَاتِ بِالنّهَارِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النّوْمَ بِاللّيْلِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، قَالَ: فَيُشَفّعَانِ .
কিয়ামতের দিন সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, ওগো রব! দিবসে আমি তাকে পানাহার ও (বৈধ) জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, রাতে আমি তাকে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৬২৬; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস ৫০৮১
রোযাদারের জন্য জান্নাতে প্রবেশের বিশেষ ফটক থাকবে
রোযাদার হলেন আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহমান। জান্নাতে প্রবেশের জন্য তার সৌজন্যে বিশেষ ফটকের ব্যবস্থা থাকবে। নবীজী বলেনÑ
إِنّ فِي الجَنّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرّيّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ: أَيْنَ الصّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ.
জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন তা দিয়ে রোযাদাররা প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, রোযাদাররা কোথায়? তখন তারা আসবে। তারা ছাড়া তা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না। রোযাদাররা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর আর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫২
সাহরী : গুরুত্ব ও ফযীলত
রোযার নিয়তে সুবহে সাদিকের পূর্বে যে খাবার গ্রহণ করা হয় তা হল সাহরী। সাহরী খাওয়া সুন্নত। সাহরীতে পেট ভরে খাওয়া আবশ্যক নয়; এক দুই ঢোক পানি পান করেও এ সুন্নত আদায় করা যায়।
সাহরীতে রয়েছে বরকত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ
تَسَحّرُوا فَإِنّ فِي السّحُورِ بَرَكَةً.
তোমরা সাহরী কর। কেননা সাহরীর খাবারে বরকত রয়েছে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৯২৩, সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৫
অতএব সাহরীর খাবার রোযা রাখতে শক্তি যোগায়। তেমনি এতে খায়র ও বরকত এবং পুণ্য ও কল্যাণও নিহিত রয়েছে।
যারা সাহরী গ্রহণ করে তাদের উপর আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হয়
আরেক হাদীসে এসেছেÑ
السّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ، فَلَا تَدَعُوهُ، وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ، فَإِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ.
সাহরী খাওয়াতে বরকত রয়েছে। অতএব তোমরা তা ছেড়ো না; এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী গ্রহণ কর। কেননা যারা সাহরী খায় আল্লাহ তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্য রহমতের দুআ করতে থাকে। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১০৮৬, ১১৩৯৬
সাহরী : আমাদের রোযার একটি বৈশিষ্ট্য
পূর্বেই আমরা উল্লেখ করে এসেছি, রোযা বা সিয়ামের বিধান এ উম্মতের জন্য প্রথম নয়; পূর্ববর্তী উম্মতের উপরও রোযার বিধান ছিল। তবে আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মাঝে সাহরী একটি বিশেষ পার্থক্যরেখা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ
فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ، أَكْلَةُ السّحَرِ.
আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মাঝে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৬
অর্থাৎ আমাদের রোযায় সাহরী খাওয়ার যে গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তা নেই। আমাদের নিকট সাহরী করাটাই একটি স্বতন্ত্র আমল এবং বড় সওয়াবের কাজ।
শেষ ওয়াক্তে সাহরী গ্রহণ করা উত্তম
সাহরী করা যেমন মুস্তাহাব তেমনি তা ওয়াক্তের শেষ দিকে করাও উত্তম। অর্থাৎ সতর্কতামূলক সময় হাতে রেখে সুবহে সাদিকের পূর্ব-নিকটবর্তী সময়ে সাহরী করা ভালো। নবীজী বলেনÑ
إِنّا مَعَاشِرَ الْأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا أَنْ نُعَجِّلَ فِطْرَنَا، وَأَنْ نُؤَخِّرَ سَحُورَنَا.
আমরা নবীগণ এ মর্মে আদিষ্ট হয়েছি যে, সময় হওয়ার সাথে সাথেই ইফতার করব এবং শেষ ওয়াক্তে সাহরী গ্রহণ করব। Ñআলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ১৮৮৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৪৮৮০
সাহাবায়ে কেরামের আমলও এরকম ছিল। হযরত আমর ইবনে মাইমুন আলআউদী রাহ. বলেনÑ
كَانَ أَصْحَابُ مُحَمّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَسْرَعَ النّاسِ إِفْطَارًا وَأَبْطَأَهُ سُحُورًا.
সাহাবায়ে কেরাম সময় হওয়ার সাথে সাথেই দ্রæত ইফতার করতেন আর শেষ ওয়াক্তে সাহরী করতেন। Ñমুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭৫৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৩২
ইফতার : গুরুত্ব ও ফযীলত
অস্তপ্রায় সূর্য। কিছুক্ষণের মাঝে তা হারিয়ে যাবে পশ্চিমাকাশে। সাধ্য অনুসারে ইফতারের আয়োজন সামনে নিয়ে রোযাদার অপেক্ষায় আছে সূর্যাস্তের। হাতে খাবার। পেটে ক্ষুধা। পিপাসাকাতর ক্লান্ত শরীর। তবুও কিছু মুখে দিচ্ছে না। কারণ এখনও আল্লাহ্র হুকুম হয়নি। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! আল্লাহ তাআলার নিকট এ দৃশ্যটি অত্যন্ত প্রিয়। বান্দার এ সময়ের এ অবস্থাকে আল্লাহ পাক বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
ইফতার : রোযাদারের জন্য বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত
ইফতারের সময় বান্দার দেহমনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ.
রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল, ইফতারের সময়। অপরটি হল, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে (আর তিনি তাকে বিশাল পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন)। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১
ইফতার : যে সময় দুআ কবুল হয়
পুরো রমযানই রহমত-বরকতের মাস। তবে কিছু কিছু মুহূর্তে বান্দার প্রতি তা প্রবল বেগে ধাবিত হয়। ইফতারের সময়টিও এমন। তাই এ সময়ের দুআ আল্লাহ পাক বিশেষভাবে কবুল করেন। নবীজী বলেনÑ
إِنّ لِلصّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةً مَا تُرَدّ.
ইফতারের সময় রোযাদারের একটি দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ কমপক্ষে একটি দুআ অবশ্যই কবুল হয়। Ñসুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩
এ হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. ইফতারের সময় এ দুআ করতেনÑ
اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الّتِي وَسِعَتْ كُلّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِي .
আয় আল্লাহ, আমি আপনার সর্বব্যাপী রহমতের ওসিলায় প্রার্থনা করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। Ñসুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩
এজন্য ইফতারের একটি আদব হচ্ছে, সময় হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ইফতার প্রস্তুত করে আল্লাহমুখি হওয়া, বেশি বেশি দুআ-দরূদ পড়া, তওবা-ইস্তিগফার করা। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা।
ইফতার : যে সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয়
ইফতারের মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এ সময়ে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। নবীজী বলেনÑ
إِنّ لِلهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ، وَذَلِكَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ.
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ইফতারের সময় অনেক জাহান্নামীকে মুক্ত করে থাকেন এবং এটা প্রতি রাতে করেন। Ñসুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৩
তাই এ মুহূর্তে নিজের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য, পাশাপাশি সকল মরহুম মুমিন মুসলমানের জন্য মাগফিরাতের দুআয় মশগুল থাকা কাম্য।
সময় হওয়ার সাথে সাথেই ইফতার করি
এতক্ষণ আল্লাহর হুকুম ছিল খাবে না। এখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। এখন বিধান হল, ইফতার করা। তাই আর দেরি নয়, সময় হয়েছে জলদি জলদি ইফতার শুরু করে দিন। পূর্বে উল্লেখ হয়েছে দ্রæত ইফতার করা ছিল নবীগণের বৈশিষ্ট্য। সাহাবায়ে কেরামও দ্রæত ইফতার করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
لاَ يَزَالُ النّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجّلُوا الفِطْرَ.
মানুষ ততদিন খায়র ও কল্যাণের মাঝে
থাকবে যতদিন তারা সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রæত ইফতার করবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৮
অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়Ñ
لَا يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجّلَ النّاسُ الْفِطْرَ، إِنّ الْيَهُودَ وَالنّصَارَى يُؤَخِّرُونَ.
ততদিন দ্বীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতদিন মানুষ দ্রæত ইফতার করবে। কেননা ইহুদী-নাসারারা বিলম্ব করে। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৮৯৪৪
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
إِنّ أَحَبّ عِبَادِي إِلَيّ أَعْجَلُهُمْ فِطْرًا.
সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রæত ইফতারকারী আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৭০০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭২৪১, ৮৩৬০
একবার হযরত মাসরূক রাহ. হযরত আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেনÑ দুইজন সাহাবী। উভয়েই কল্যাণের কাজে খুব অগ্রসর। একজন ইফতার ও মাগরিব দ্রæত শুরু করেন। আরেকজন কিছুটা বিলম্ব করেন। আম্মাজান জিজ্ঞাসা করলেন, তবে দ্রæত করেন কে? বললেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। হযরত আয়েশা রা. বললেনÑ
كَذَلِكَ كَانَ يَصْنَعُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এমনটিই করতেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭০২
তাই সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রæত ইফতার করে নেই।
নামাযের আগেই ইফতার করি
নামাযের পূর্বেই সংক্ষিপ্তভাবে ইফতার সেরে নেওয়া; ইফতারের জন্য বিশাল আয়োজন লাগবেÑ এমনটি নয়। নবীজীর আমলও এমনই ছিল। হযরত আনাস রা. বলেনÑ
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يُفْطِرُ عَلَى رُطَبَاتٍ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ، فَعَلَى تَمَرَاتٍ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের নামায পড়ার পূর্বেই তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করে নিতেন। তাজা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর তাও না থাকলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৭৮৯
খেজুর দিয়ে ইফতার করি
মাত্রই আমরা দেখে আসলাম, নবীজী খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাই খেজুর দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে। নবীজী বলেনÑ
إِذَا أَفْطَرَ أَحَدُكُمْ فَلْيُفْطِرْ عَلَى تَمْرٍ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُفْطِرْ عَلَى مَاءٍ فَإِنّهُ طَهُورٌ.
তোমাদের কেউ ইফতার করলে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। খেজুর না থাকলে পানি দিয়ে। কেননা তা পবিত্র বস্তু। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৫
ইফতারের দুআ পড়ি
ইফতারের সময় হাদীস শরীফে এ দুআ পড়ার কথা এসেছেÑ
اللّهُمّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ.
আয় আল্লাহ! আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছি এবং আপনার রিযিক দিয়েই ইফতার করেছি। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৭৪৪; কিতাবুয যুহদ, ইবনুল মুবারক, হাদীস ১৪১০, ১৪১১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআও পড়তেনÑ
ذَهَبَ الظّمَأُ وَابْتَلّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ.
পিপাসা নিবারিত হল, শিরা-উপশিরা সতেজ হল। আর আল্লাহ চাহে তো সওম-এর সওয়াব প্রাপ্তির খাতায় লিপিবদ্ধ হল। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৭; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৩৩১৫, ১০০৫৮
রোযাদারকে ইফতার করাই
ইসলামে মেহমানদারি ও আপ্যায়নের ফযীলত অনেক। আর যদি সেই আপ্যায়ন হয় রোযাদারকে ইফতার-আপ্যায়ন তাহলে তো তা আরো বেশি ফযীলতের! রোযাদারকে ইফতার করানো অনেক বড় সওয়াবের আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ
مَنْ فَطّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنّهُ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصّائِمِ شَيْئًا.
কেউ যদি কোনো রোযাদারকে ইফতার করায় তাহলে সে ঐ রোযাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে। আর এতে ঐ রোযাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৮০৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৪৬; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৩৩১৬, ৩৩১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭০৪৪, ১৭০৩৩
তারাবীহ্ : গুরুত্ব ও ফযীলত
রমযান মাসের বিশেষ একটি আমল হচ্ছে রাতে ঈশার নামাযের পর বিতরের পূর্বে তারাবীহ্র নামায আদায় করা। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য তা সুন্নতে মুআক্কাদাহ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমযানের দিবসের রোযাকে ফরয করেছেন। আর তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে নবুওতের মাধ্যমে ‘কিয়ামে রমাযান’-এর ঘোষণার মাধ্যমে তারাবীহ্র মতো মূল্যবান এ তোহফা দান করেছেন। বস্তুত তারাবীহ রমযান মাসের এমন একটি বিশেষ ইবাদত, যা রমযান ছাড়া অন্য কোনো মাসে আদায় করা সম্ভবই না। রমযান মাসের অন্যান্য আমল রমযান ছাড়াও আদায় করা যায়। যেমন রমযান মাস ছাড়াও রোযা রাখা যায়, ইতিকাফ করা যায়। কিন্তু রমযান ছাড়া অন্য সময় তারাবীহ আদায় করা যায় না। এমনকি চাঁদ ওঠার পর তারাবীহ্র নামাযের মাধ্যমেই রমযানের মূল আমল শুরু হয়। অতএব রমযান মাসে তারাবীহ্র নামায অত্যন্ত তাৎপর্যমÐিত একটি ইবাদত।
তারাবীহতে কালামুল্লাহ্র সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এর মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মাফ হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে কিয়ামে রমযান আদায় করবে তার বিগত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৯
অতএব তারাবীহর ব্যাপারে যতœবান হওয়া চাই। আর খতম তারাবীহ পড়তে পারলে তো আরো ভাল। তবে তাড়াহুড়া করে তারবীহ নয়; তারাবীহ হতে হবে কুরআনের হকের প্রতি যথাযথ লক্ষ রেখে।
উল্লেখ্য যে, বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। আট রাকাত সংক্রান্ত হাদীসগুলো মূলত তাহাজ্জুদ সম্পর্কে। খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের ইজমা, মারফ‚ হুকমী, সুন্নতে মুতাওয়ারাসা এবং ফুকাহায়ে কেরামের ইজমাÑ প্রত্যেকটি দলীল দ্বারাই প্রমাণিত যে, তারাবীহ্র নামায আট রাকাতে সীমাবদ্ধ মনে করা এবং বিশ রাকাআত মাসনূন হওয়াকে অস্বীকার করা একটি মারাত্মক ভুল। অতএব এ বিষয়ে অনর্থক বাদানুবাদে লিপ্ত হয়ে রমযানের বরকতময় মুহূর্তগুলো নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে দেখুন, মাসিক আলকাউসার, অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৫ ঈ.-এ প্রকাশিত উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘তারাবীর গুরুত্ব, ফযীলত ও রাকাত-সংখ্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি।
তাহাজ্জুদের প্রতি যতœবান হই
তাহাজ্জুদ অত্যন্ত মূল্যবান আমল। কুরআনে কারীমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাহাজ্জুদের বিশেষ হুকুম করা হয়েছে। তাহাজ্জুদের সময় তথা রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ্র রহমত বান্দার প্রতি নিবিষ্ট থাকে। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেনÑ
مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.
আছে কি কেউ, যে আমাকে ডাকবে অমি তার ডাকে সাড়া দিব। কেউ আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দিয়ে দিব। কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।
রাতের দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ফজর পর্যন্ত প্রতি রাতে রাব্বুল আলামীন এভাবে বান্দাকে ডাকতে থাকেন। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮)
এসময় বান্দার উচিত রবের ডাকে সাড়া দিয়ে তাহাজ্জুদের সালাতে মশগুল হওয়া। কারণ, নবীজী বলেছেনÑ
أَفْضَلُ الصّلَاةِ، بَعْدَ الصّلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ، الصّلَاةُ فِي جَوْفِ اللّيْلِ.
ফরয নামাযের পর মধ্যরাতের নামায সর্বোত্তম। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩
রাতের বরকতপূর্ণ এ মুহূর্ত যদি আসে রমযানের মত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাসে! রমযানের রহমত ও মাগফেরাতের সাথে যদি যুক্ত হয় মধ্য রাতের এ খোশখবরি, মহান রবের পক্ষ থেকে দয়া ও ক্ষমার ঘোষণা এবং প্রাপ্তির আহŸান! মুমিনের জন্য এরচে মূল্যবান মুহূর্ত আর কী হতে পারে! তাই রমযান মাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাহাজ্জুদের প্রতি মনোযোগী হওয়াটাই মুমিনের শান। রমযানে তো এমনিতেই সাহরীর জন্য উঠতে হয়। তাহলে আমি কি পারি না আরেকটু আগে উঠে জায়নামাযে দাঁড়াতে! আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়তে! মহান রব দেওয়ার জন্য ডেকে যাচ্ছেন। আমার কি উচিত নয় তাঁর থেকে কিছু নেওয়া! দয়াময় প্রভুর নিকট কিছু চাওয়া! তাঁর মাগফেরাত লাভে ধন্য হওয়া!!
রমযানের একমাসে যদি তাহাজ্জুদের অভ্যাস তৈরি করা যায় তাহলে বাকি এগার মাস সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।
রমযানুল মুবারকে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করি
রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন এ মাসে। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ .
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য হেদায়েতের দিশারী, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের যে এ মাস লাভ করবে, সে যেন তাতে অবশ্যই রোযা রাখে। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৮৫
তাই এ মাসে কুরআনের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
নবীজী রমযান মাসে জিবরীল আ.-কে পুরো কুরআন শোনাতেন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনিতেই নেকী ও কল্যাণের ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। রমযান মাসে এক্ষেত্রে নবীজী আরো অগ্রগামী হতেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে নবীজীর নিকট আসতেন। তিনি নবীজীকে পুরো কুরআন শোনাতেন এবং নবীজীও তাকে কুরআনুল কারীম শোনাতেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২)
ইমাম বুখারী রাহ. উল্লেখ করেন, হযরত ফাতেমা রা. বলেনÑ নবীজী আমাকে চুপি চুপি বলেছেন, জিবরীল প্রতি বছর আমাকে কুরআন শোনান। এ বছর আমাকে তিনি দু’বার শুনিয়েছেন। আমার মনে হয়, আমার ‘সময়’ চলে এসেছে। Ñসহীহ বুখারী (তা‘লীক), অধ্যায় : ‘জিবরীল নবীজীকে কুরআন শোনানো’
তাই তিলাওয়াতে কুরআন, তাদাব্বুরে কুরআন (কুরআনের আয়াত ও হেদায়াত নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা) এবং কুরআনের প্রতি আমলে যতœবান হওয়ার মাধ্যমে এ মাসকে প্রাণবন্ত রাখা ঈমানদারের কর্তব্য।
দুনিয়াবী অন্যান্য ঝামেলা কমিয়ে এ মাসে আমলের প্রতি, যিকির-আযকার ও তওবা-ইস্তিগফারের প্রতি মনোযোগী হওয়া; বিশেষভাবে কুরআন নিয়ে মশগুল থাকা এ মাসের অন্যতম প্রধান আমল।
লাইলাতুল কদর : গুরুত্ব ও ফযীলত
রমযানের পুরো মাস জুড়ে বিরাজ করে রহমত বরকত এবং ক্ষমার ঘোষণা। তবে এ মাসে রয়েছে বিশেষ এক মহিমান্বিত রজনীÑ লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা এ রাতের ব্যাপারে বলেনÑ
لَیْلَةُ الْقَدْرِخَیْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ. تَنَزَّلُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَ الرُّوْحُ فِیْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ ۚ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ، سَلٰمٌ ، هِیَ حَتّٰی مَطْلَعِ الْفَجْرِ۠.
কদর রজনী সহ¯্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই রজনীতে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। Ñসূরা কদর (৯৭) : ৩-৫
তাই এ রাতের অন্বেষণে যেমন আগ্রহী হওয়া জরুরি তেমনি এ রাতে ইবাদত বন্দেগীÑ নফল নামায, তিলাওয়াত, যিকির, তওবা-ইস্তিগফার, দুআ-দরূদ ইত্যাদির প্রতিও আরো যতœবান হওয়া কাম্য।
লাইলাতুল কদর : যে রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে
রমযানের কদর রজনীতে আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীম নাযিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনÑ
اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةِ الْقَدْرِ.
নিশ্চয়ই আমি কদর রজনীতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি। Ñসূরা কদর (৯৭) : ১
আরো ইরশাদ হয়েছেÑ
اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةٍ مُّبٰرَكَةٍ اِنَّا كُنَّا مُنْذِرِیْنَ.
আমি এ (কিতাব) অবতীর্ণ করেছি বরকতপূর্ণ রজনীতে, বস্তুত আমি সতর্ককারী। Ñসূরা দুখান (৪৪) : ৩
এখানে লাইলাতুম মুবারকা বা বরকতময় রজনী বলতে শবে কদর বুঝানো হয়েছে। তো কদর রজনী একদিকে যেমন মহিমান্বিত অপরদিকে তা অত্যন্ত বরকতপূর্ণও বটে।
লাইলাতুল কদর : যে রাতে গুনাহ মাফ হয়
এ রাতে আল্লাহ তাআলার অবারিত রহমত ও করুণা বর্ষিত হয়। নবীজী বলেনÑ
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
...যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম (ইবাদত-বন্দেগী) করবে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২০১৪
তো ঈমান ও ইহতিসাবের উপলব্ধি জাগরূক রেখে লাইলাতুল কদরে কিয়াম (ইবাদত-বন্দেগী) করা বান্দার গুনাহ মাফের একটি বড় মাধ্যম।
লাইলাতুল কদর থেকে বঞ্চিত হওয়া অনেক বড় মাহরূমী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে এত বড় খোশখবরী পাওয়ার পর এ রাতের ক্ষমা ও রহমত লাভের চেষ্টা না করা অনেক বড় বঞ্চনার বিষয়। হযরত আনাস রা. বলেন, রমযান আসলে নবীজী বলতেনÑ
إِنّ هَذَا الشّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلّهُ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلّا مَحْرُومٌ.
এই মহিমান্বিত মাস উপস্থিত। তাতে একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হল সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। Ñসুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ২১০৬; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ২৪২৭
সুতরাং হেলায় না কাটিয়ে কদরের রাতের কদর করা দরকার।
নবীজী শেষ দশকে ইবাদত বাড়িয়ে দিতেন
হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী কদরের রাত সুনির্দিষ্ট নয়। তবে রমযানের শেষ দশকে তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ হিসেবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. নবীজীর শেষ দশকের আমলের বিবরণ দিয়ে বলেনÑ
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য দিনগুলোর তুলনায় রমযানের শেষ দশকে বেশি ইবাদত করতেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭৫
তিনি আরো বলেনÑ
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ،إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ، أَحْيَا اللّيْلَ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ، وَجَدّ وَشَدّ الْمِئْزَرَ.
রমযানের শেষ দশক শুরু হলে নবীজী পূর্ণ রাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন এবং নিজে কোমর বেঁধে ইবাদতে মগ্ন হতেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭৪; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২৪
যেভাবে লাভ করতে পারি শবে কদরের ন্যূনতম ফযীলত
মুমিনমাত্রেরই কর্তব্য হল কদর রজনীর পূর্ণ কদর করা। অন্তত এ রাতে বিলকুল গাফেল না থাকা। রমযান মাসের ফরয নামাযগুলো জামাতের সাথে আদায় করার মাধ্যমে কদর রজনীর ন্যূনতম কদর হতে পারে। হাদীস শরীফে এসেছেÑ
مَنْ صَلّى الْعِشَاءَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنّمَا قَامَ نِصْفَ اللَيْلِ، وَمَنْ صَلّى الصُبْحَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنّمَا صَلّى اللّيْلَ كُلّهُ.
যে ব্যক্তি ইশার নামায জামাতে আদায় করল সে যেন অর্ধ রজনী কিয়াম করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাযও জামাতে আদায় করল সে যেন পূর্ণ রাত নামায পড়ল। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৬
তাই এ মাসে জামাতে নামাযের প্রতি সবিশেষ যতœবান হওয়া জরুরি। তাহলে আশা করা যায় শবে কদরের ন্যূনতম ফযীলত থেকে মাহরূম হব নাÑ ইনশাআল্লাহ।
শবে কদরে কী দুআ করব?
লাইলাতুল কদর যেহেতু বিশেষ রজনী, তাই এ রাতে বিশেষ কিছুই চাওয়া দরকার। তো আমি বিশেষভাবে কী চাইব এবং কীভাবে চাইব? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাও শিখিয়ে দিয়েছেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. নবীজীকে জিজ্ঞাসা করেনÑ ইয়া রাসূলাল্লাহ, যদি আমি জানতে পারি, আজ লাইলাতুল কদর তাহলে আমি কী দুআ করতে পারি? নবীজী বললেন, তুমি বলÑ
اللّهُمّ إِنّكَ عُفُوّ تُحِبّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي.
আয় আল্লাহ! আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতেই ভালবাসেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫১৩
একজন মুমিনের জন্য তার রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অপেক্ষা বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
তাৎপর্যপূর্ণ এ দুআটি কেবল লাইলাতুল কদরের জন্যই নির্ধারিত নয়। পুরো রমযানেই, ইফতারীর সময়, সাহরীর সময় এবং অন্যান্য সময়েও পড়া যায়। এমনকি রমযান ছাড়াও এ দুআ পড়া যায়। নবীজীর শেখানো দুআ যত পড়া যায় ততই লাভ।
লাইলাতুল কদরের তালাশে...
হাদীস শরীফে কদর রজনী নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো সামনে রেখে যা বুঝে আসে, লাইলাতুল কদর লাভের জন্য গোটা রমযান, বিশেষ করে রমযানের শেষ দশক, আরো বিশেষ করে বললে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই শেষ দশকে শবে কদরের অন্বেষণে পূর্ণ মনোযোগী এবং প্রস্তুত থাকা চাই। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
تَحَرّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ.
তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২০২০
আরেক বর্ণনায় এসেছেÑ
الْتَمِسُوهَا فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي الوَتْرِ.
তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদর অন্বেষণ কর। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২০১৬
যেহেতু হাদীসে লাইলাতুল কদর নির্ধারিত করে বলা হয়নি তাই নির্দিষ্ট কোনো রাতে নির্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাঝে তা বেঁধে ফেলা ঠিক নয়। আর লাইলাতুল কদরের জন্য হাদীসে নির্দিষ্ট করে কোনো আমলের কথাও উল্লেখ নেই। তাই বিদআত ও রুসুমাত থেকে দূরে থেকে ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত যাপন করাই শ্রেয়।
সুন্নত ইতিকাফ : গুরুত্ব ও ফযীলত
রমযানের ত্রিশ দিনের শেষ দশদিন অত্যন্ত তাৎপর্যমÐিত। রমযানের একটি বিশেষ আমল হচ্ছে সুন্নত ইতিকাফ। আর তা আদায় করার সময় এটি। রমযানের খায়র-বরকত লাভে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর লাভ করার সম্ভাবনাও বেশি। তাই নবীজী রমযানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্য রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়াহ। সুতরাং আগে থেকে পরিকল্পনা করে আমরা ইতিকাফ করার চেষ্টা করব। তেমনি মহল্লার মসজিদে যেন ইতিকাফ হয় সে বিষয়ে আগে থেকে আলোচনা করব এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করব।
নবীজী সর্বদা রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন
নবীজী প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেনÑ
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتّى تَوَفّاهُ اللهُ عَزّ وَجَلّ، ثُمّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর পর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭২; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২৬
হযরত আবু হুরাইরা রা. বলেনÑ
كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ القُرْآنَ كُلّ عَامٍ مَرّةً، فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرّتَيْنِ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ، وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلّ عَامٍ عَشْرًا، فَاعْتَكَفَ عِشْرِينَ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ.
জিবরীল প্রতি বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার কুরআন শোনাতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর দুই বার শোনান। নবীজী প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯৯৮, ২০৪৪
লাইলাতুল কদর প্রাপ্তিতে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম
পূর্বে যেমনটি উল্লেখ হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলেছেন। কদরের খায়র ও বরকত লাভ করার ক্ষেত্রে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফের গুরুত্ব অনেক। ইতিকাফকারী অন্যান্য আমল করতে না পারলেও শুধু মসজিদে অবস্থান করাটাই একটা বড় আমল। সে যতক্ষণ মসজিদে থাকবে ততক্ষণ তার সওয়াব লেখা হতে থাকবে। আর অন্যান্য আমলের জন্য তো ভিন্ন সওয়াব আছেই। তাই শুধু মসজিদে অবস্থান করার মাধ্যমেই সে সহজে কদরের ফযীলত লাভ করতে পারছে।
সুন্নত ইতিকাফ সম্ভব না হলে দু-এক দিনের জন্য তো ইতিকাফ করা যায়
কর্ম-ব্যস্ততা কিংবা হিম্মতের কমতি বা অন্য কোনো ওযর থাকতে পারে। সুন্নত ইতিকাফ করা যাচ্ছে না। তাই বলে যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকুও করব নাÑ এমনটি নয়। পূর্ণ দশ দিন সুন্নত ইতিকাফ করতে না পারলে নফল হিসাবে যে যতটুকু পারি ততটুকুই আল্লাহর ঘরে অবস্থান করি। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন। তাতেও অনেক ফায়দা। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে কমপক্ষে বেজোড় রাতগুলোতে নফল ইতিকাফের নিয়তে যদি মসজিদে অবস্থান করা হয় তবুও তো কদরের রহমত-বরকত লাভ করার আশা করা যায়। তাই পুরো সময় না পারলেও যে যতটুকু পারি ততটুকু সময় ইতিকাফ করি।
নারীরাও ঘরে ইতিকাফ করতে পারেন
যেসকল বোনের ইতিকাফের জন্য ফারেগ হওয়ার সুযোগ রয়েছে তারাও ইতিকাফ করতে পারেন। স্বামী উপস্থিত থাকলে তার অনুমতি নিয়ে ইতিকাফে বসুন। বাড়িতে নামায-ঘর থাকলে সেখানে বসতে পারেন। নামাযের জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা না থাকলে কোনো জায়গা নির্দিষ্ট করে সেখানে ইতিকাফের জন্য বসতে পারেন। এভাবে মা-বোনরাও ইতিকাফ ও কদরের ফযীলত লাভ করতে পারেন।
আয়েশা রা. বলেনÑ
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتّى تَوَفّاهُ اللهُ عَزّ وَجَلّ، ثُمّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর পর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭২; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২৬
সদাকাতুল ফিতর : গুরুত্ব ও ফযীলত
আল্লাহ তাআলার হুকুমে বান্দা পুরো মাস রোযা রেখেছে। আল্লাহ যেভাবে হুকুম করেছেন সেভাবে রাখতেই চেষ্টা করেছে। কিন্তু মহান আল্লাহ্র মহান হুকুম পালন করা অসহায় বান্দার জন্য কি এত সহজ! আল্লাহ তাআলা বান্দার দুর্বলতা ভালোভাবে জানেন। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জানেন তাঁর উম্মতের দুর্বলতার কথা। তাই রোযা রাখতে গিয়ে যে টুকটাক ভুল হয়ে যায় তার কাফফারা স্বরূপ সদাকাতুল ফিত্রের বিধান দিয়েছেন।
পাশাপাশি রোযার মাধ্যমে রোযাদার কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে উপবাসে থাকা অন্ন-বস্ত্রহীন ভাইগুলোর কষ্ট। আজ রমযান শেষে ঈদের দিন সেই ভাইদের মুখেও যেন ফুটে ওঠে আনন্দের রেখা, তাদের ঘরেও উত্তম খাবারের ব্যবস্থা হয় সেজন্য বিত্তবানদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে সদাকাতুল ফিত্র। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেনÑ
فَرَضَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصّائِمِ مِنَ اللّغْوِ وَالرّفَثِ، وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ، مَنْ أَدّاهَا قَبْلَ الصّلَاةِ، فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ، وَمَنْ أَدّاهَا بَعْدَ الصّلَاةِ، فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصّدَقَاتِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকাতুল ফিতরের বিধান দান করেছেন রোযাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা-কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসাবে। যে ব্যক্তি তা (ঈদের) নামাযের আগে আদায় করবে সেটা গ্রহণযোগ্য সদকা হিসাবে পরিগণিত হবে। আর যে নামাযের পর আদায় করবে সেটা সাধারণ সদকা হিসাবে বিবেচিত হবে। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬০৯
প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যার মালিকানায় মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তার ওপর সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। প্রত্যেকে তার নিজের পক্ষ থেকে এবং নাবালেগ সন্তানের পক্ষ থেকে সদাকাতুল ফিতর আদায় করবে।
অতএব নিজের রোযাকে বিশুদ্ধ করার জন্য এবং ঈদের দিন অসহায় ভাইদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ঈদের নামাযে যাওয়ার আগেই সদাকাতুল ফিত্র আদায় করব।
শাওয়ালের ছয় রোযা
রমযানের পরবর্তী আরবী মাস হচ্ছে শাওয়াল। পয়লা শাওয়াল ঈদের দিন। ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। ঈদের দিন ব্যতীত বাকি দিনগুলোতে ছয়টি রোযা রাখার ফযীলত অনেক। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمّ أَتْبَعَهُ سِتّا مِنْ شَوّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدّهْرِ.
যে ব্যক্তি রমযানে রোযা রাখল। এরপর শাওয়ালে ছয়টি রোযা রাখল। সে পুরো বছর রোযা রাখার সওয়াব লাভ করবে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৪
পূর্ণ এক মাস রোযা রাখার পর শাওয়ালেও এর রেশ থেকে যায়। রোযা না রাখলেও রোযা রোযা মনে হয়। তাই শাওয়াল মাসে এমনিতেই রোযা রাখা সহজ। এ ছয় রোযা ইচ্ছা করলে লাগাতারও রাখা যায়। আবার কয়েকদিন বাদ দিয়ে বাদ দিয়েও রাখা যায়। তাই একটু হিম্মত করে ফযীলতপূর্ণ এ ছয়টি রোযা রেখে পুরো বছর রোযা রাখার সওয়াব লাভ করার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাআলাই উত্তম তাওফীকদাতা।
রমযান যেন হেলায় কেটে না যায়
রমযান যেহেতু খায়র ও বরকতের মাস। তাই এর সময়গুলো অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান। রমযানের সময়গুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত এবং এতে বেশি থেকে বেশি নেক আমলে ব্রতী হওয়া উচিত। বিশেষ করে সময়কে যথাযথ কাজে লাগাতে খুব সচেষ্ট থাকি। অনর্থক সময় নষ্ট হচ্ছে কি নাÑ এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকা দরকার। কারণ নেকী অর্জন ও ফযীলতের মুহূর্তগুলো এভাবে হেলায় কেটে যাওয়া দুর্ভাগ্যের বিষয়।
দুআ-দরূদ, যিকির-তিলাওয়াত, তওবা-ইস্তিগফার, নফল নামায ইত্যাদির মাধ্যমে দিন গুযরান করি। সামাজিক রাজনৈতিক বিভিন্ন গল্পগুজব পরিহার করি। ডিভাইস ব্যবহার সীমিত করি; বরং খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ রাখি।
বুযুর্গানে দ্বীন বলে থাকেন, রোযা রেখে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রয়োজনে বিশ্রাম করুন। কিন্তু অনর্থক গল্পে লিপ্ত হবেন না। কারণ কথায় কথা টানতে থাকে এবং আল্লাহ না করুন, বেশি কথা বললে তা ধীরে ধীরে মিথ্যা, গীবত-শেকায়েত ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে ছুটতে থাকে। দুনিয়াবী কাজকর্ম সীমিত করে আনুন। ইবাদতের প্রতি বেশি মনোযোগ দিন।
রমযানে গুনাহের ধারা অব্যাহত রাখা খুবই খারাপ কথা। যেখানে ঘোষণা হতে থাকে নেকীর কাজে অগ্রসর হতে, অনিষ্ট থেকে নিবৃত্ত হতে, সেখানে গুনাহের ধারা অব্যাহত রাখা অনেক বড় মাহরূমির কারণ। বিশেষ করে অনাচার-পাপাচার ও অশ্লীলতা এবং এমন গুনাহ, যা আল্লাহর ক্রোধকে আরো বাড়িয়ে দেয়, এমন সব বিষয় পুরোপুরি বর্জন করা উচিত। কারণ ফিরে আসার এটাই মোক্ষম সময়। কিন্তু ফিরে না এসে এর অনুভ‚তিও জাগ্রত না হওয়া বহুত বড় বরবাদির বিষয়।
হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিতÑ
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ رَقَى الْمِنْبَرَ، فَلَمّا رَقَى الدّرَجَةَ الْأُولَى قَالَ: آمِينَ، ثُمّ رَقَى الثّانِيَةَ فَقَالَ: آمِينَ، ثُمّ رَقَى الثّالِثَةَ فَقَالَ: آمِينَ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، سَمِعْنَاكَ تَقُولُ: آمِينَ ثَلَاثَ مَرّاتٍ؟ قَالَ: لَمّا رَقِيتُ الدّرَجَةَ الْأُولَى جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَقَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ رَمَضَانَ، فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمّ قَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنّةَ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمّ قَالَ: شَقِيَ عَبْدٌ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ وَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ، فَقُلْتُ: آمِينَ
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমীন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ্র রাসূল! আপনাকে (এভাবে) আমীন বলতে শুনলাম? তখন নবীজী বললেন, আমি যখন মিম্বারে আরোহণ করলাম তখন জিবরীল আগমন করলেন এবং বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে রমযান মাস পেল, আর রমযান গত হয়ে গেল কিন্তু তার গোনাহ মাফ হল না। আমি বললাম, আমীন। তারপর বলল, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে তার মা-বাবাকে অথবা কোনো একজনকে বার্ধক্যে পেল অথচ তারা (মা-বাবা) তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না (অর্থাৎ তাদের খেদমতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।) আমি বললাম, আমীন। তৃতীয় বার বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হল আর সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না। বললাম, আমীন। Ñআলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৫১
ঈদ শপিং
ঈদকে সামনে রেখে যে শপিং-সংস্কৃতি সমাজে চালু হয়েছে এবং তাতে ব্যাপকহারে নারীদের অংশগ্রহণ এবং যে পর্দাহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। দেখা যায়, রমযানের শেষ দিকে এর চাপ আরো প্রবল হয়। আফসোসের কথা হল, যেখানে শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলা হয়েছে এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোমর বেঁধে ইবাদতে মশগুল হতেন, পরিবারের লোকদের সজাগ করতেন তখন আমি কেনাকাটায় ব্যস্ত! তাই ঈদের কেনাকাটা আগে থেকেই সেরে নিই, নারীদের যেন মার্কেটে যেতে না হয় এজন্য পুরুষরা সহায়তা করি এবং শেষ দশকে আমলে মশগুল হই, শবে কদর তালাশে উন্মুখ হই।
আমাদের ঈদ তো অন্যদের উৎসবের মতো নয়। ঈদ হল আল্লাহর নিকট সমর্পিত হওয়ার আনন্দ। আল্লাহ্র মাগফেরাত লাভের আনন্দ। এই ঈদ উদ্যাপন করা যেমন আল্লাহ্র হুকুম, তেমনি এর উদ্যাপনও হতে হবে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক।
ঈদের দিন নতুন পোশাকই পরতে হবে এমন ধারণা সঙ্গত নয়। বরং ঈদের দিনের একটি মুস্তাহাব আমল হল, নিজের কাছে থাকা উত্তম পোশাকটি পরিধান করা। আর আল্লাহ ক্ষমা করুন, বিজাতীয় বসন-ভ‚ষণ ধারণ করা তো ঈদের রূহই নষ্ট করে দেয়। মুসলিম এমনটি করতে পারে না।
তাই ঈদশপিংয়ে সময় বরবাদ না করে নিজের দ্বীন-ঈমানের প্রতি মনোযোগী হওয়াই সচেতন মুমিনের পরিচয়।
রমযানের সম্মান রক্ষা করি
নিজে রোযা রাখতে না পারা এক ধরনের অপরাধ। কিন্তু রমযানের পবিত্রতা নষ্ট করা, রোযা ও রোযাদারের প্রতি সম্মান না দেখানো অনেক বড় ধৃষ্টতা। রাস্তায় প্রকাশ্যে রোযার বেহুরমতি করা, হোটেলগুলোতে পর্দা ঝুলিয়ে দিব্বি নাফরমানিতে লিপ্ত হওয়া, মিডিয়া ও চ্যানেলগুলোতে অশ্লীল প্রোগ্রাম চালু রাখা, সিনেমা হলগুলো যথানিয়মে সচল থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো জাতীয় ও সামাজিক নাফরমানীর অন্তর্ভুক্ত। এরকম জামাতবদ্ধ নাফরমানি আল্লাহ্র ক্রোধ বাড়িয়ে দেয় এবং অনেক বড় দুর্গতি ডেকে আনে। আল্লাহ্র ওয়াস্তে রমযানের সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষার স¦ার্থে এসব গর্হিত আচরণ থেকে নিবৃত্ত হই। ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে এবং পরিবারকে নিয়ন্ত্রণ করি। আল্লাহ তাওফীক দান করুন।
রমযান হোক ফলপ্রসূ
রমযান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস। তাই এ মাসে করণীয় হলÑ তাকওয়া হাছিলে এগিয়ে আসা। কিয়ামুল লাইলের প্রতি যতœবান হওয়া। কুরআন নাযিলের মাস হিসাবে তিলাওয়াতে কুরআন, তাদাব্বুরে কুরআন (কুরআনের আয়াত ও হেদায়াত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা) এবং আমল বিল কুরআনের প্রতি মনোযোগী হওয়া। কুরআনের তালীমের হালকা কায়েম করা। যাদের তিলাওয়াত সহীহ নেই তিলাওয়াত সহীহ করা। বেশি বেশি নফল ইবাদত, দুআ-দরূদ, তওবা-ইস্তিগফার, যিকির-তিলাওয়াত ইত্যাদিতে সময় লাগানো। সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ব চর্চায় ব্রত হওয়া। অধিক পরিমাণে দান সদকা করা এবং সকল প্রকার খায়র ও কল্যাণে এগিয়ে আসা। সংযম বজায় রাখা। প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত করা। নিজের ও পরিবারের ঈমানী আমলী এবং আত্মিক উৎকর্ষের প্রতি মনোনিবেশ করা। মাহে রমযান ও রোযাদারের প্রতি সম্মান বজায় রাখা। রমযানের পবিত্রতা রক্ষা করা। সকল প্রকার গুনাহ পাপাচার এবং অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা।
রমযানের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলোর ব্যাপারে যতœবান হওয়া। যেমনÑ সাহরী, ইফতার, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, শবে কদর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। এ মুহূর্তগুলোর যে বিশেষ আমল রয়েছে তাতে আত্মনিয়োগ করা এবং তওবা-ইস্তিগফার, দুআ-দরূদ, যিকির-তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে সময়গুলোকে কাজে লাগানো। মসজিদগুলো ইবাদতের মাধ্যমে আবাদ রাখা।
এই এক মাসে তাকওয়ার মেহনতের মাধ্যমে গোটা বছরের ঈমানী, আমলী এবং রূহানী যিন্দেগীর পাথেয় সংগ্রহ করা।
রমযান কীভাবে যাপন করতে হয় এজন্য আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের রমযানী যিন্দেগী থেকেও অনেক খোরাক লাভ করা যায়। এ ক্ষেত্রে হযরত শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রাহ. -এর ‘আকাবির কা রমযান’ (এর বাংলা তরজমাও পাওয়া যায়) পড়লেও ফায়দা হবে, ইনশাআল্লাহ। দেখা যাবে যে, আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন রমযান মাসকে কত সাদরে বরণ করতেন! কত গুরুত্বের সাথে এর প্রতিটি মুহূর্তের কদর করতেন!
মোটকথা, রমযান আসে, রমযান যায়। এভাবে জীবনও একদিন শেষ হয়ে যাবে। বুদ্ধিমান তো সে, যে আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। রমযান আসার আগেই মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, আমলের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রমযানকে সামনে রেখে সে প্রস্তুত করে রুটিন। কাজে লাগায় রমযানের বরকতময় প্রতিটি মুহূর্ত। সে অগ্রগামী হয় নেকি ও কল্যাণের পথে, তাকওয়া হাছিলের পথে এবং ব্রত হয় গুনাহ থেকে পাক-ছাফ হয়ে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করার মেহনতে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। রমযানের সমূহ কল্যাণ ও ফযীলত লাভ করে মাগফেরাত ও রহমতে ¯œাত হওয়ার তাওফীক নসীব করুনÑ আমীন।