প্রহসন : ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি : শান্তিচুক্তি না যুলুমের বৈধতাচেষ্টা
ইসরাইলের কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংকট ও অস্থিতিশলতা অনেক পুরোনো। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো নিয়ন্ত্রণ ও বৃহৎ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল। এ রাষ্ট্রটি জন্ম নেয়ার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিষবাষ্প ছড়িয়ে আসছে। এ অঞ্চলের মূল অধিবাসী ফিলিস্তিনীদের আপন মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে জোর করে দেশ দখল করার জন্য এমন কোনো অপরাধ নেই, যা ইসরাইল করেনি। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বোমাবর্ষণ ও নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের কারারুদ্ধ করা যেন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের ঘটনা।
ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধান ও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার শিরোনামে এ পর্যন্ত অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগ, ১৯৭৮ সালে ক্যাম্পভেডিভ চুক্তি, ১৯৯১ সালে মাদ্রিদ সম্মেলন, ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি, ২০০০ সালে ক্যাম্পডেভিড চুক্তি, ২০০১ সালে তাবা সম্মেলন, ২০০২ সালে আরব শান্তি উদ্যোগ, ২০০৩ সালের রোডম্যাপ, ২০০৭ সালে অ্যানাপোলিসের আলোচনা এবং ২০১০ সালে বারাক ওবামার উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। তবে এর একটিও সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কেন পারেনি তা নিয়ে নিরপেক্ষ গবেষণা হতে পারে।
সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পও একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত ২৮ জানুয়ারি উন্মোচিত এ কথিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার নাম দেয়া হয়েছে ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব এ চুক্তিকে দেখছেন শতাব্দীর সেরা যুলুম হিসেবে। এর মধ্যে মূলত ইহুদীবাদী আগ্রাসনকে বৈধতা দিয়ে ফিলিস্তিনকে সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ফিলিস্তিন হয়ে উঠবে একটি স্বাধীন জেলখানা। ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং এ অবৈধ দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দেয়ার এটি একটি জঘন্য প্রয়াস। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা বরং সমগ্র অঞ্চলে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ¦লে উঠবে। স্বভাবতই এ শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বসহ ফিলিস্তিনের জনগণ।
মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, জেরুজালেম বিক্রির জন্য নয়। আমাদের অধিকার বিক্রির জন্য নয় কিংবা দরকষাকষির জন্যও নয়। তিনি বলেন, কোনো ফিলিস্তিনী, আরব, মুসলিম কিংবা খ্রিস্টানের পক্ষে জেরুজালেমকে রাজধানী করা ছাড়া ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেয়া অসম্ভব। আমি হাজার বার বলছি- এ পরিকল্পনা মানি না, মানি না, মানি না।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সহিংসতার অবসানে মার্কিন পরিকল্পনাকে অগ্রহণযোগ্য আত্মসমর্পণ বলে আখ্যায়িত করেছেন ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ মালিকি।
তিনি বলেন, যে পরিকল্পনাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শতাব্দীর সমঝোতা হিসেবে আখ্যায়িত করছেন, তা ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগের ন্যায্যতা দেবে।
অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের বাসিন্দা ফিলিস্তিনী মানবাধিকার কর্মী ফখরি আবু দিয়াব আলজাযিরাকে বলেন, যার মালিকানা নেই, তার হাতে তুলে দিচ্ছেন তিনি (ট্রাম্প), যাদের কোনও অধিকারও নেই। তিনি বলেন, এটা পরিষ্কার, নতুন বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করছেন।
ইহুদীদের জন্য নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের অঙ্গীকারের পর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ‘বেলফোর ঘোষণা’ দেয়া হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস আর্থার বেলফোর ওইদিন ফিলিস্তিনী ইহুদীদের জন্য কথিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ব্রিটেনের অবস্থানের ঘোষণা দেন।
ব্রিটেনের এই অঙ্গীকারকে ফিলিস্তিনীদের ওপর নেমে আসা বিপর্যয়ের মূল অনুঘটক হিসেবে দেখা হয়। ব্রিটেনের এই ঘোষণার পর কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনী আরব বিশ্বে গণবিতাড়নের শিকার হন। আধুনিক আরব বিশ্বের ইতিহাসে ব্রিটেনের এই বেলফোর ঘোষণা সবচেয়ে বড় বিতর্কের সৃষ্টি করে।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট অনেক পুরোনো। এ পর্যন্ত অনেক পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হয়েছে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু এর একটাও সফলতার মুখ দেখেনি। ট্রাম্পের এ কথিত শান্তিচুক্তি সে ধারাবাহিকতারই একটি নাটকমাত্র। এর কারণ হিসেবে সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির রবাব আবদুল হাদী বলেন, ‘শতাব্দীর চুক্তিটি ইসরাইলের স্বপক্ষে একটি ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা। শান্তি অর্থ ফিলিস্তিনীদের অধিকার ও আত্মনির্ভরশীলতাকে শ্রদ্ধা জানানো, নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ফিলিস্তিনীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেয়া, শরণার্থীদের নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার দেয়া, বর্ণবাদ ও বৈষম্য দূর করা এবং ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে সমস্ত অপমানজনক কার্যক্রম বন্ধ করা।’ আবদুল হাদী বলেন, ‘যদি এগুলো নিশ্চিত না করা হয় তাহলে তাতে কোনো শান্তি থাকবে না’।
ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরির অনেকগুলো বিষয়ই তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেমন এই চুক্তিতে বলা হয়েছে- একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হবে, ইসরাইল, ফিলিস্তিনী লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও হামাসের সঙ্গে। এতে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের নতুন নাম হবে ‘নতুন ফিলিস্তীন’, যেটি প্রতিষ্ঠিত হবে জুডিয়া, সামারিয়া (পশ্চিম তীর) এবং গাজা এলাকা নিয়ে। জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার যতটুকু এলাকা বর্তমানে ফিলিস্তিনীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ততটুকু স্থান নিয়ে নতুন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। একইসঙ্গে ইসরাইল পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করবে। পশ্চিম তীরে অধিকৃত ইসরাইলী ভূমি এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্ন ভূমি ইসরাইলের দখলে থাকবে।’
‘জোর যার মুল্লুক তার’ বলে বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে। এ যেন তারই বাস্তব রূপ। গত হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনের এ ভূমিতে ইহুদীদের তেমন কোনো বসবাস ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও তাদের সংখ্যা ছিল কম-বেশি পাঁচ হাজার। ইউরোপে ইহুদী নিধন ও জায়নবাদী পরিকল্পনা গ্রহণ করার পর পরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে এসে তারা বসবাস শুরু করে। ১৯১৭-১৯১৮ সালে ইহুদীরা ফিলিস্তিন ভুখ-ের মাত্র ১.৫৬% ভূমির মালিক ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় (১৯১৭-১৯৪৮) বিভিন্ন কলা-কৌশলে ধীরে ধীরে তারা ভূমি দখল করতে থাকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তারা ফিলিস্তিনের মোট ভূমির ৬.৬৭% জায়গা দখল করে নেয় এবং এতে ২৯১ টি কলোনি গড়ে তোলে। জাতিসংঘের ১৮১ নং সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৯ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে জন্ম নেয় এ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। তাতে ফিলিস্তিনের ৫৪% ইসরাইলকে দেয়া হয়। আর আরবদের দেয়া হয় ৪৫% ভূমি। আলকুদস এলাকাকে রাখা হয় আন্তর্জাতিক শক্তির তত্ত্বাবধানে। যা মোট ভূমির ১%। স্বভাবতই আরবরা জাতিসংঘের এ অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। ফলে ইসরাইলের সাথে আরবদের যুদ্ধ বেধে যায়। এ যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের ৭৭% ভূমি দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনের গ্রামসমূহে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ৫৮৫টি ফিলিস্তিনী গ্রামের ৪৭৮টি গ্রামই ধ্বংস করে দেয়। অধিকৃত অঞ্চলসমূহে ইসরাইল তার বসতি বাড়াতে থাকে।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। এ যুুদ্ধে নতুন করে মিসরের সিনাই উপত্যকা ও ফিলিস্তিনের বিশাল অংশ দখল করে নেয় ইসরাইল। এ সময় মসজিদে আকসাও তাদের দখলে চলে যায়। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ৭৮৫৬০১.১৩৫ একর ভূমি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ১২৬৫১৭.৯৫৫ একর ভূমি এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ দু’বছর ৩৭০৬৫.৮০৭ একর ভূমি ইসরাইল গ্রাস করে নেয়। এখনও চলছে ইসরাইলের এ ভূমি আগ্রাসন।
ফিলিস্তিনের ভূমি গবেষণাকেন্দ্র (এলআরসি) এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, ২০১৭ সালে প্রায় ২,৫০০ একর জমি দখল করে নিয়েছে ইসরাইল, ধ্বংস করে দিয়েছে ৫০০ ভবন এবং আটটি নতুন ইহুদী বসতি নির্মাণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদী বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে সামরিক কায়দায় এসব ভূমি দখল করে নেয় ইসরাইল।
ট্রাম্পের এই চুক্তিতে এতদিন পর্যন্ত দখলকৃত পুরো ভূমিই ইসরাইলকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ফিলিস্তিনকে দেয়া হয়েছে মাত্র অল্প কিছু অংশ। এও কি সম্ভব?
এ ভুখ-ে ইসরাইলের অস্তিত্বটাই তো অবৈধ। এরপরও যদি কিছুক্ষণের জন্য বৈধ বলে স্বীকার করে নেয়া হয় তাহলেও ১৯৪৮ সালে স্বীকৃত অংশটুকুই তাদের প্রাপ্য। এর বেশি নয়। কিন্তু ইসরাইল আজ সে সময় জাতিসংঘ স্বীকৃত ফিলিস্তিনী ভুখ-ের প্রায় ৪১% দখল করে আছে আর ট্রাম্পের শান্তিচুক্তিতে বলা হচ্ছে, এ পুরো অংশই পাবে ইসরাইল! পৃথিবীর কোথাও কি এমন বিবেকহীন চুক্তির নযির আছে? এ যেন এমন হল- কোনো এক দাপুটে লোক একজন ধনী ব্যক্তির সব সম্পদ দখল করে নেয়। ফলে নিজের ভিটেমাটি ও অল্প কিছু সম্পদ ছাড়া তার কাছে আর কিছুই রইল না। স্বভাবতই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সে ব্যক্তি তখন প্রতিবাদী হয়ে উঠবে। তখন তৃতীয় একটি পক্ষ এসে তাদের মাঝে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করল এভাবে-
“আচ্ছা সে (দাপুটে লোকটি) যা নিয়েছে নিয়েছে। এটা পুরোটাই তার। এখন তুমি তোমার ভিটেমাটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাক। এটার উপর আর কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। এটা পুরোটাই তোমার। এ বিষয়ে আর বেশি হৈ চৈ করো না। তাহলে এলাকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।”
আমেরিকা ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মাঝে এজাতীয় শান্তিই স্থাপন করতে চাচ্ছে।
এ চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘যারা বর্তমানে ফিলিস্তিনে আছে তারাই স্বাধীন ফিলিস্তিনের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে। বিভিন্ন দেশে থাকা শরণার্থী ফিলিস্তিনীরা স্বাধীন ফিলিস্তিনে আসতে পারবে না।’
যে কোনো দেশে সংকট বা যুদ্ধ শুরু হলে সে দেশের লক্ষ লক্ষ নাগরিক দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে চলে যায়। এটা একটা তিক্ত বাস্তবতা। বর্তমান সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তবে সেই আশ্রিত দেশে তারা নাগরিকের মর্যাদা পায় না। উদ্বাস্তু ও শরণার্থী হয়েই জীবন কাটাতে হয়। এ জীবনটা যে কত কষ্টের তা আমাদের দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখেই আমরা বুঝতে পারি। তবে যুদ্ধ বা সংকট শেষ হয়ে গেলে কিংবা সমাধানের কোনো পথ বেরিয়ে এলে এসব শরণার্থীরা আবার নিজ দেশে ফিরে আসে। তাদের নিজ দেশের নাগরিকের মর্যাদাও বলবৎ থাকে। ৭১-এর যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বহু মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে তারা আবার দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশের নাগরিকের মর্যাদা লাভ করেছে। এটাই পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু এ স্বাভাবিক নিয়ম ও যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে শতাব্দীর সেরা(?) চুক্তিতে। ফিলিস্তিনের প্রায় ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যদি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে তাদের ফিরে আসার অধিকার না থাকে তাহলে তাদের ভবিষ্যত কী হবে? সংশ্লিষ্ট দেশও তাদেরকে নিজ দেশের নাগরিকত্ব দেবে না , ফিলিস্তিনেরও তারা নাগরিক গণ্য হবে না- তাহলে তারা ও তাদের ভবিষ্যতপ্রজন্ম কি এভাবে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী হয়েই মানবেতর জীবন কাটাবে? এটা কি কোনো যুক্তির কথা হতে পারে? এভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অশান্তির জীবনে ঠেলে দেয়ার নামও কি ‘শান্তিচুক্তি’ হতে পারে?
‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’র সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হল, এ চুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘নতুন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সেনাবাহিনী গঠন করতে পারবে না। তারা শুধু পুলিশ বাহিনীর জন্য হালকা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এ নিরাপত্তা চুক্তি ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনীদের মধ্যে হবে। হামাস মিসরীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত অস্ত্রসহ তার সমস্ত অস্ত্র জমা দেবে। সরকার গঠনের পর হামাস সদস্যরা এবং তাদের নেতারা সহযোগী দেশগুলো থেকে সবসময়ের জন্য বেতন পাবেন।’
যে কোনো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হলে কোনো দেশ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই তো বিশে^র প্রতিটি দেশ বার্ষিক বাজেটের বিশাল একটা অংশ ব্যয় করে প্রতিরক্ষা খাতে। যুদ্ধ না হলে এমন কি যুদ্ধের সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ সৈন্যকে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে তৈরি রাখা হয় যুদ্ধের জন্য। উন্নত অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত থাকা সত্ত্বেও প্রতি বছর আরো অস্ত্র উৎপাদন কিংবা কেনা হয় সেনাবহিনীকে সর্বোচ্চ সমৃদ্ধ করার জন্য। কারণ শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছাড়া দেশের অস্তিত্ব সবসময় থাকবে হুমকির মুখে। অথচ ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠনের কথা থাকলেও এ দেশের কোনো সেনাবহিনী না থাকার কথা বলা হচ্ছে। তাহলে কি সেটা কোনো স্বাধীন দেশ হবে, নাকি ইসরাইলেরই একটি প্রদেশ হিসেবে থাকবে? ধরে নিলাম এ শর্ত মেনে নিয়েই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন হল। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি নির্লজ্জ ইসরাইল কখনো এ চুক্তি ভঙ্গ করে পুরো ফিলিস্তিনকেই নিজের ভূমি হিসেবে দাবি করে তাহলে কীভাবে এর মোকাবেলা করা হবে?
চুক্তিতে বলা হয়েছে, ... যদি বিদেশি আক্রমণ হয়, তাহলে ইসরাইল তা মোকাবেলা করবে। এর খরচ অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষ বহন করবে।
আহা! কী দরদী দেশ!! পাশের একটি স্বাধীন (?) রাষ্ট্রে হামলা হবে এরপরও কি বসে থাকা যায়! মানবতারও তো একটা দাবি আছে!! কোনো বাঘ যদি হরিণের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় তাহলে হরিণের যে দশা ঘটবে সেনাবাহিনীহীন স্বাধীন ফিলিস্তিনের হবে সেই দশা।
সত্যিই অবাক হতে হয়। এমন বিবেকহীন কথা কীভাবে তারা শান্তিচুক্তি নামে উপস্থাপন করতে পারল। তাও সেটা নাকি আবার শতাব্দীর সেরা চুক্তি।
আমেরিকা ও ইসরাইলের সম্পর্ক অনেক গভীর- এটা খুবই স্পষ্ট বিষয়। এ অবৈধ রাষ্ট্রটি জন্ম নেয়ার মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল আমেরিকা। অর্থ, অস্ত্র, সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে আমেরিকা আজও ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মার্কিন কংগ্রেস কেভিন ম্যাকাফি তো একবার বলেই ফেলেছেন, ‘ইসরাইলে যদি একটি রকেট পড়ে তাহলে তা আমেরিকায়ও পড়ে।’ যে কোনো বিষয়ে মার্কিন সিনেট দ্বিধাবিভক্ত। ব্যতিক্রম শুধু একটি ক্ষেত্রে। ইসরাইল প্রশ্নে রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাট সব সিনেটেররা একজোট। এরকম স্পষ্টভাবে ইসরাইলের পক্ষপাত করে আমেরিকার জন্য এ সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করার বৈধতা কতটুকু?
আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এক্ষেত্রে এক কাঠি সরেস। পূর্বের মার্কিন প্রেসিডেন্টরা আজ পর্যন্ত যে কাজগুলো করার সাহস পাননি আন্তর্জাতিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে, ট্রাম্প সেগুলো করে যাচ্ছেন কাউকে তোয়াক্কা না করেই।
আর এসব কিছুর নেপথ্যে দেখা হচ্ছে ট্রাম্পের ইহুদী জামাতা কুশনারকে।
মূলত এ শান্তি চুক্তি পুরোটাই প্রস্তুত করেছে ইহুদী কুশনার। ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা ট্রাম্পের জামাতা ইহুদী জ্যারেড কুশনার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত জেসন গ্রিনব্যাটকে সাথে নিয়ে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তাই বলা যায় এটা ট্রাম্প বা আমেরিকার তৈরি শান্তিচুক্তি নয়; বরং ইহুদীদের হাতে তৈরি শান্তিচুক্তি, যাতে কেবলমাত্র ইহুদীবাদী স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; বরং শান্তিচুক্তির নামে ইসরাইলের সকল অন্যায়ের বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে রাখা হয়েছে হাত, পা, চোখ, মুখ বাঁধা একটি ‘স্বাধীন’ নতুন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র! যার কোনো সেনাবাহিনী নেই। কোনো অস্ত্র নেই। নাগরিকদের নিরাপত্তা নেই। উদ্বাস্তু নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরার অধিকার নেই।
যুগ যুগ ধরে নিস্পেষিত হয়ে আসছে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ মানুষ। মাতৃভূমি আজ তাদের জন্য বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিশুদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের আকাশ-বাতাস। কবে শেষ হবে তাদের কান্না?