Jumadal Akhirah 1441   ||   February 2020

অ নু ক র ণী য়

ইবনে কাসেম

স্বার্থের উপর আদর্শ

‘স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে দেয়’- এ চিরন্তন বাণীর সত্যতা আমরা বাস্তব জীবনে দেখছি যুগ যুগ ধরে। স্বার্থের পথে হেঁটে মানুষ উপলব্ধি শক্তি হারিয়ে ফেলে।  সত্যকে বোঝা ও গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে স্বার্থ। স্বার্থের জন্য মানুষ হারিয়ে ফেলে নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক অনুভূতি। মানবতা যদি কাতরাতে থাকে, আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে তার কান্নায়, অসহায় কণ্ঠস্বরগুলো ডাকতে থাকে বাঁচার আকুতি নিয়ে তখন মানুষ সে অশ্রুভেজা ডাকেও সাড়া দিতে পিছপা হয়, যদি তা স্বার্থে আঘাত হানে। বর্তমান বিশে^ এ বেদনার্ত চিত্রের বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই। সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, লিবিয়া ও মায়ানমারে- মৃত্যু যেখানে মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়, সে সবুজ বাগানগুলো আজ মৃত্যুপুরী! এ বর্তমান সংকটের বড় একটা কারণ হচ্ছে স্বার্থের দাবাখেলা। এ দেশগুলোর জনগণ আজ কিছু ব্যক্তি ও দেশের স্বার্থের বলি।

বাশার আলআসাদের মত খুনী শাসককে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন দেশ এগিয়ে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আঞ্চলিক স্বার্থের টানে। ইসরাইলের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞেও আমেরিকা চোখ বুজে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে স্বার্থের হিসাব করে। তাই তো উইঘুরদের সাথে শত্রুদেশ চীনের বর্বর আচরণে প্রতিবাদ করলেও ফিলিস্তিনীদের সাথে করা একই রকম অমানবিক আচরণে চির নীরব। ফিলিস্তিনের উপর অমানবিক আচরণে চীন কিছুটা সরব হলেও রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় একদম নিশ্চুপ। কারণ মিয়ানমারের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেনে ভাটা পড়–ক- এটা তারা চায় না। গাদ্দাফী-সাদ্দাম হোসেনকে একনায়ক বলে গালি দিলেও একই গুণের (!) অধিকারী মধ্যপ্রাচ্যের অন্য শাসকদের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় আমেরিকা। যেন অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা কোনোভাবেই বন্ধ না হয়। কাশ্মির নিয়ে বিশ্বা যখন ভারতের সমালোচনায় সরব হয়ে উঠেছিল তখন গুজরাটের কসাই খ্যাত লোকটিকে আরেকটি দেশ ডেকে নিয়ে সর্ব্বোচ্চ পদক গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। ভারতমাতাকে সন্তুষ্ট করে তেলের বড় একটা বাজার দখল করার এ যেন সুবর্ণ সুযোগ। হায়রে স্বার্থ! হায়রে লোভের নির্লজ্জ প্রকাশ! বিশ্বা রাজনীতির এসব স্বার্থপর নীতি আজ বিশ্বাকে অগ্নিগর্ভ বানিয়ে রেখেছে।  

তবে এসব স্বার্থ-রাজনীতি থেকে ঊর্র্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থ  থাকা ও সত্যের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। সম্প্রতি তিনি ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক বিতর্কিত নাগরিক বিলের কারণে ভারতের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এটা তাদের জন্য কাটা ঘায়ে লবণ ছিটা দেয়ার মত লেগেছে। ইতিপূর্বে তিনি কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের আচরণকে দখল ও আক্রমণমূলক হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন জাতিসংঘে। সব মিলিয়ে তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠেছে ভারত। তাই বাণিজ্যিকভাবে মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানী বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। এক বিবৃতিতে সলভেন্ট এক্সট্রাকটরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া তার সদস্যদের মালয়েশিয়া থেকে মুখ ফেরাতে নির্দেশনা দেয়। তারা বলেছে, ‘বিপুল পরিমাণ পাম অয়েলের আমদানিকারক হিসেবে আমাদের দেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের ক্ষেত্রে আমাদেরও দায়বদ্ধতা আছে। আপনাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং দেশের সাথে সংহতির অংশ হিসেবে আমাদের উচিত কিছু সময়ের জন্য মালয়েশিয়া থেকে পণ্য ক্রয় এড়িয়ে যাওয়া।’

ভারতের উগ্রবাদী হিন্দু নেতারাও এ পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। দিল্লিতে আরএসএসপন্থী বিশ্লেষক দেশরতœ নিগম বলেছেন, মালয়েশিয়ার জন্য এটাই ভারতের ‘সঠিক দাওয়াই’। আরো নানাভাবে ভারত তাদের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে বলেও সে জানিয়েছে। বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, ‘পাম তেল আমদানি বন্ধ হলে অবশ্যই তাদের অর্থনীতি হোঁচট খাবে।’

‘তাছাড়া প্রতি বছর আট থেকে নয় লাখ ভারতীয় পর্যটক মালয়েশিয়া বেড়াতে যান, তারাও এখন এর বদলে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর- বালি-ভিয়েতনামও বেছে নিতে পারেন।’

ভারতের মত বৃহত্তম বাজার হারানো মালয়েশিয়ার অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় ধাক্কা। এই দুই দেশের বছরে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। ভারতের প্রধান ১৫ বাণিজ্যিক অংশীদারের একটি মালয়েশিয়া। দুই দেশের লেনদেনে মালয়েশিয়ার আয়রোজগারই বেশি। তারা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে পামঅয়েল বড় পণ্য। মালয়েশিয়া বছরে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের পামঅয়েল বিক্রি করে ভারতে।

তবে ভারতের এই বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পর মাহাথির যে মন্তব্য করেছেন তা নিঃসন্দেহে স্বার্থের বিরুদ্ধে আদর্শের অনেক বড় জয়। স্বার্থ ত্যাগ করে কীভাবে সত্য প্রকাশ করতে হয়, আদর্শের উপর অবিচল থাকতে হয়, ভোগ ও মুনাফাকে পাশে ঠেলে কীভাবে মানবতার পাশে দাঁড়াতে হয়- সেই সবক বিশ্বানেতাদের শেখাল তার সাহসী উচ্চারণ। সাংবাদিকদের মাহাথির বলেন, ‘অবশ্যই আমরা উদ্বিগ্ন, কেননা প্রচুর পরিমাণে পাম তেল ভারতে বিক্রি করি, কিন্তু অন্যদিকে আমাদের স্পষ্টভাষী হতে হবে। কিছু অন্যায়ের দিকে গেলে অবশ্যই সেটা আমাদের বলতে হবে। এভাবে যদি আমরা টাকার চিন্তা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা থেকে বিরত থাকি, তাহলে আমি মনে করি, আমাদের ও অন্যান্য ব্যক্তি দ্বারা অনেক ভুল কাজ হয়ে যাবে।’

এই বয়কটের ডাককে তিনি কীভাবে দেখছেন- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এদিন মন্তব্য করেছেন ‘সব সময় সবাইকে খুশি করে চলা সম্ভব নয়।’

ড. মাহাথির বলেন, ‘মালয়েশিয়া একটি বাণিজ্যনির্ভর দেশ। ফলে আমাদের বাজার দরকার, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা দরকার। কিন্তু কখনো কখনো নির্যাতিত মানুষের হয়েও মুখ খুলতে হয়; সেটা কেউ পছন্দ করবে, কেউ আবার করবে না।’

কিন্তু কাশ্মির নিয়ে জাতিসঙ্ঘে করা মন্তব্যের জন্য তিনি কি এখন আফসোস করছেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটাই বলেছি। সেটা থেকে পিছু হটতে বা সেটা পাল্টাতে আমরা রাজি নই।’

‘আমরা মনে করি, জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কাশ্মিরিরা উপকৃত হবে। এটা শুধু ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপার নয়, আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বেরই উচিত জাতিসঙ্ঘে গৃহীত প্রস্তাব মেনে চলা। নইলে জাতিসঙ্ঘ থেকে লাভটা কী?’

মাহাথির ৭০ বছর ধরে রাজনীতিতে আছেন এবং দুই দফায় ২৩ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তবে এসবের বাইরে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের মননশীল এক পরিচিতি আছে বিশ্বজুড়ে। যে পরিচয়ের সুবাদে একালে মালয়েশিয়া ও মাহাথির প্রায় সমার্থক হয়ে আছে। মাহাথির মোহাম্মদের বয়স এখন ৯৪। কিন্তু দেশে-বিদেশে তুমুল সক্রিয় তিনি। রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ক্রমাগত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বলছেন। এসব বিষয়ে ওআইসির অকার্যকারিতার মুখে সর্বশেষ কুয়ালালামপুরে মুসলিম-প্রধান দেশগুলোর সম্মেলন ডেকেছিলেন। এ বয়সেও প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। কখনো রাতও কাটিয়ে দেন কাজের মধ্যে। মাহাথিরের স্ত্রী সম্প্রতি লিখেছেন, মাহাথির যখন ঘুমাতে যাওয়ার কথা, সে সময়ও তিনি সরকারি ডকুমেন্ট নিয়ে বসে থাকছেন। এক রাতে তাকে আমি ভোর ৪/৫টা পর্যন্ত এমন ডকুমেন্ট যাচাই করতে দেখেছি। তিনি ওই রাতে ২০০ ডকুমেন্ট যাচাই করেছেন। আবার সকাল ৭টায় তিনি অফিসে গিয়ে হাজির। এজন্য তার স্বাস্থ্য নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।

যাই হোক, ভারতের আচরণ ও মাহাথিরের মন্তব্য থেকে  মুসলিম বিশে^র শাসকদের অনেক কিছু শেখার আছে। ভারত নিজেদের বৃহত্তম তেল বাজারকে  নিজ স্বার্থ উদ্ধার ও বিরোধী দেশকে শায়েস্তা করার  অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।  তাদের বাজার বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে বিরোধী দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ধাক্কা দিয়ে তাকে মাথা নত করানোর এটি একটি প্রয়াস। মুসলিম শাসকেরা কী পারেন না- মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এজাতীয় উদ্যোগ নিতে?

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাণিজ্য পণ্য হচ্ছে জ্বালানী তেল। তেলের উপরই নির্ভর করে সচল থাকে বিশ্বা অর্থনীতির চাকা। তাই কখনো তেল হয়ে ওঠে ভয়ংকর মারণাস্ত্র থেকেও শক্তিশালী। আর আল্লাহ তাআলা মুসলিম দেশগুলোকে তেল সম্পদের বিপুল নিআমত দান করেছেন। মুসলিম শাসকেরা কি পারেন না নির্যাতিত মুসলমানদের আধিকার আদায়ে একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে? 

মুসলিম দেশগুলো যদি একটি সমন্বিত পদ্ধতিতে তেল বাজারজাত করে এবং তাতে নিজেদের জাতিসত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি নির্ধারন করে তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে বাধ্য। হাঁ, এর জন্য থাকতে হবে আদর্শকে স্বার্থের উপর প্রাধান্য দেয়ার সৎসাহস। এ বিষয়টি আমরা শিখতে পারি মাহাথিরের কাছ থেকে- ‘আমাদের স্পষ্টভাষী হতে হবে। কিছু অন্যায়ের দিকে গেলে অবশ্যই সেটা আমাদের বলতে হবে। এভাবে যদি আমরা টাকার চিন্তা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা থেকে বিরত থাকি, তাহলে আমি মনে করি, আমাদের ও অন্যান্য ব্যক্তি দ্বারা অনেক ভুল কাজ হয়ে যাবে।’ এই সাহসী উচ্চারণ থেকে আমরা পেতে পারি প্রেরণার উপাদান। এভাবে যদি ‘শক্তিশালী দেশগুলো’র বাণিজ্যযুদ্ধের ভয়ে ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের পক্ষে বিশ্বসমাজ উচ্চকিত না হয়,  চীনের ভয়ে উইঘুরদের বিষয়ে, ভারতের বাজার হারানোর ভয়ে কাশ্মিরিদের প্রসঙ্গে, বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে আমেরিকার হত্যাকা- ও সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, মিয়ানমারের বাজার ধরার আশায় রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় উদাসীন থাকি, তাহলে দেশে দেশে শাসকদের স্বার্থবাদী আদর্শই তাদের মানবাধিকার দলনের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। ফলে মানুষের অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথাগত চক্ষুলজ্জার কার্যকারিতাও লোপ পেতে থাকবে। দিন দিন পৃথিবী হয়ে উঠবে স্বার্থবাজদের অত্যাচার ও অসহায়দের হাহাকারের বধ্যভূমি।

 

advertisement