বাইতুল্লাহর মুসাফির-৭
[পূর্বপ্রকাশিতের পর]
বিমান ছাড়বে রাত আটটায়। জিদ্দা বিমানবন্দরে আমাদের পৌঁছতে হবে অন্তত সাতটায়। সুতরাং আর বিলম্ব করা চলে না, কিন্তু যা চলে না, একে একে তা-ই চলতে শুরু করলো, অর্থাৎ বিলম্বের পর বিলম্ব হতে লাগলো। যিনি ‘আব্দার’ রেখেছিলেন, নিজের গাড়িতে আমাদের জিদ্দা পৌঁছে দেবেন, তার আসতে বেশ বিলম্ব হলো। এতক্ষণ অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনে পড়েনি, তিনি আসার পর মনে পড়লো; একটি সামান ভুলে রয়ে গেছে উপরে। সুতরাং আবার বিলম্ব। সামান এলো, গাড়িতে ওঠবো, তখন দেখা দিলো প্রকৃতির কাছ থেকে প্রাপ্ত সেই ‘অনিবার্য কারণ’, যার সামনে মানুষ বড় অসহায়; সেই সুবাদে আরো কিছু বিলম্ব।
এভাবে তিন তিনটি বিলম্বের বাঁধা পার হয়ে অবশেষে গাড়িতে বসা হলো। ফারুক ভাই পাশে দাঁড়ানো, বিষণ্ণ, বিমর্ষ। সম্ভবত আমাদের, বিশেষ করে আমার ‘নির্বুদ্ধিতা’য় ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হচ্ছেন। তার অশ্রুসজল চোখ থেকে যেন এই মিনতি ঝরে পড়ছে, এখনো সময় আছে ফিরে আসার! এখনো সুযোগ আছে সৌভাগ্যের অাঁচল ধরে রাখার! কিন্তু নিয়তির কাছে মিনতির মূল্য কোথায়!
গাড়ি চলতে শুরু করলো। ফারুক ভাই কান্না সম্বরণের চেষ্টা করলেন এবং হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। যতক্ষণ আমাদের গাড়ি দেখা যায় ততক্ষণ তার হাত নড়ছিলো। আমার মনে হয়, চোখের আড়াল হওয়ার পরো অনেকক্ষণ তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এটা আর কিছু নয়, শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে মুহাববাত।
আমি তার সৌভাগ্যের কথা ভাবছিলাম, তিনি হয়ত ভাবছিলেন আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা। এমনই হয়। জীবনে বারবার এমন হয়েছে, বারবার এমনই হবে। কেউ সৌভাগ্যের নাগাল পাবে, কেউ নাগালের সৌভাগ্য হারাবে।
হঠাৎ লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক ধ্বনি আমাদের চমকে দিলো। বুকের ভিতরটা কেমন তোলপাড় করে উঠলো। হারামের অভিমুখী একটি বাস আমাদের গাড়ি অতিক্রম করলো। মুহূর্তের জন্য ইহরামের সাদা লেবাস চোখের সামনে ঝলমল করে উঠলো এবং অদৃশ্য হয়ে গেলো। সম্ভবত তানঈম থেকে তারা ওমরার ইহরাম বেঁধে এসেছে। আমারও সঙ্গে রয়েছে ইহরামের লিবাস; পরিধানে নয়, শুধু সঙ্গে।
এই ভাগ্যবান লোকগুলো যখন আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করবে, ছাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করবে এবং যামযামের পানিতে প্রাণ শীতল করবে তখন ... তখন আমি থাকবো মক্কা থেকে অনেক দূরে, জিদ্দার মাটিতে, কিংবা বিমানে দূর আকাশে। যারা আসে, কোন না কোন সময় বিদায় তো তাদের নিতেই হয়। আমি জানতাম, আমাকেও একদিন এ পবিত্র ভূমি থেকে বিদায় নিতে হবে, কিন্তু এভাবে! কিসমতের সিতারাকে ডুবিয়ে! এমন অভাগা আর কেউ কখনো এসেছে আল্লাহর ঘরে! হে দয়াময়, দুর্ভাগা বান্দার ডুবে যাওয়া কিসমতের সিতারাকে তুমিই শুধু পারো আবার উদিত করতে!
হঠাৎ গাড়ির চালক বললেন, ‘শেষবারের মত দেখে নিন হারামের মিনার, কী অপূর্ব! রাতে আলো ঝলমল অবস্থায় আরো সুন্দর দেখা যায়।’
আমরা ফিরে তাকালাম এবং তাকিয়ে থাকলাম। ভিতরে আমাদের সর্বস্ব হারানোর বেদনা হু হু করে উঠলো। গাড়ি থামানো হলো না, তাই স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটি দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেলো, সবকিছু চোখের আড়ালে চলে গেলো, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো। ভিতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে এলো।
কিন্তু না, দয়াময় আবার দয়া করলেন। বেদনার আকাশ থেকে যেন তিনি একপশলা সুখের বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। গাড়ির চালক আমাদের সহায়তা করলেন, আমরা দূর থেকে দেখতে পেলাম হেরার পর্বতচূড়া। এখানে হেরার নির্জন গুহায় নাযিল হয়েছিলো আলকোরআনের প্রথম বাণী; তাই এর নাম এখন জাবালে নূর, নূরের পাহাড়। জাবালে নূর সত্যি জাবালে নূর! যারা অন্তর্জ্ঞানী এবং অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী তারা তো সেই নূর অবলোকন করতে পারেন তাদের ভিতরের নূর দ্বারা। আমাদের মত স্থূল দৃষ্টি যাদের, এমনকি তাদেরও অন্তরে নুরানিয়াতের পরশ লাগে জাবালে নূর দেখে।
একসময় আমাদের গাড়ি মক্কার সীমানা অতিক্রম করলো এবং দ্রুত গতিতে জিদ্দা-অভিমুখে ছুটে চললো। স্বপ্নের সবকিছু চলে গেলো পিছনে, সামনে থাকলো শুধু হারানোর বেদনা আর যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস!
কয়েকদিন আগে জিদ্দা থেকে আমাদের বাস যখন রওয়ানা হয়েছিলো, ধীরে ধীরে আমরা তখন মক্কার কাছে এসেছিলাম; আমাদের অন্তরে বাইতুল্লাহর দীদারের ব্যাকুলতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিলো। হৃদয় জুড়ে ছিলো আসন্ন মিলনের আনন্দের অদ্ভুত এক শিহরণ। আর এখন! গাড়ি যত আগে বাড়ছে মক্কা যেন তত দূরে সরে যাচ্ছে। বিচ্ছেদ-বেদনা ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে। হৃদয় জুড়ে যেন বঞ্চনার অদ্ভুত এক দহন।
হে আল্লাহ, এ দূরত্ব যেন শুধু শরীরের হয়, হৃদয়ের নয়। বঞ্চনার এ দহন এবং বিচ্ছেদের এ বেদনা আবার যেন বয়ে আনে মিলনের আনন্দশিহরণ।
সূর্য অস্ত গেলো। রাস্তার পাশে গাড়ি থামানো হলো। মরুভূমির বালুতে দস্তরখান বিছিয়ে খুব সং&&ক্ষপ্ত ইফতার করা হলো, তারপর মাগরিবের নামায আদায় করা হলো। আছরের নামায আদায় করেছিলাম কা‘বামুখী হয়ে, মাগরিব আদায় করলাম কিবলামুখী হয়ে। অনেক পার্থক্য এ দুয়ের মাঝে। তবে দূর থেকেও যারা অন্তরের দৃষ্টিতে অবলোকন করেন বাইতুল্লাহ তাদের কথা ভিন্ন। তাদের তো সারা জীবনের নামায হয় কা‘বামুখী। কিন্তু আমরা! চোখের আড়ালে আমাদের সামনে আর কা‘বা থাকে না, থাকে শুধু কেবলা।
গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করলো এবং ...
এবং যা ঘটলো তা সত্যি অদ্ভুত। আমি ভাবলাম, আল্লাহর কুদরতের কারিশমা বুঝি শুরু হলো এবং কিসমতের সিতারা আবার বুঝি জেগে উঠলো।
হঠাৎ করে গাড়ির ইঞ্জিন বিগড়ে গেলো। বিগড়ানো অবস্থায়ও কিছু দূর চললো। কিন্তু তারপর একদম থেমে গেলো। না নড়ে, না চড়ে; না পিছনে যায়, না আগে বাড়ে। গাড়ির মালিক বিব্রত এবং অপ্রস্ত্তত। আমি কিন্তু মনে মনে প্রস্ত্তত! আল্লাহর যদি ইচ্ছা হয়, আমরা বিমান হারাই এবং হারানো স্বপ্নের কাছে ফিরে যাই তাহলে তো আলহামদু লিল্লাহ! আমার হৃদয় ও আত্মার আকুতি তো সেটাই। কারণ যদিও যুক্তির বিচারে চলে আসার সিদ্ধান্তে একমত ছিলাম, কিন্তু তাতে মনের সায় এবং হৃদয়ের সমর্থন মোটেই ছিলো না। একটি কাঁটা বারবার বিঁধছিলো মনের ভিতরে; ভুল করছি না তো! নিজের কিসমত নিজে বরবাদ করছি না তো!
এখন হঠাৎ নেমে আসা ‘বিপদ’ দেখে মনে হলো, হয়ত এটা আসমানের ইশারা। হয়ত আল্লাহর ইচ্ছা আবার আমাদের আল্লাহর ঘরে ফিরে যাওয়া। আমরা তো জানি না, গায়বের পর্দায় আমাদের জন্য কী লুকিয়ে আছে! আমরা জানি না, এক মুহূর্ত পর কী ঘটবে! তাকদীরের হাতে এমনই অন্ধ আমরা! অবশ্য এটাই বান্দার জন্য কল্যাণকর। তাকদীরের পর্দার আড়ালে থাকার হিকমত সম্ভবত এই যে, আল্লাহ চান, বান্দা সর্বদা আল্লাহর দয়া ও করুণা এবং রহমত ও কুদরতের উপর ভরসা করে চলুক। মানুষের জীবন তাকদীরমুখী না হয়ে যদি তাদবীরমুখী হতো, কিংবা অন্তত তাকদীর যদি মানুষের জানা থাকতো তাহলে আল্লাহর সাথে বান্দার এই যে প্রেম ও ভালোবাসা এবং আত্মসমর্পণ ও পরম নির্ভরতার সম্পর্ক তার কিছুই হতো না। আমাদের জীবন হতো মরুভূমির চেয়ে বিশুষ্ক এবং পশুর চেয়ে অধম। এই যে এখন আমি থেমে যাওয়া গাড়ির ভিতরে তাকদীরের অন্ধকারে ডুবে আছি আর আল্লাহকে ডাকছি; এই যে আমি অজানার এবং অনিশ্চয়তার দোলায় দুলছি, অথচ আমি জানি আমার আল্লাহ সব জানেন এবং আমার আল্লাহ তাই করবেন যাতে রয়েছে আমার কল্যাণ, এই পরম নির্ভরতার শান্তি ও প্রশান্তির কি কোন তুলনা আছে!
যাই হোক গাড়ি তো আর ঠিক হয় না! এদিকে সময়ও থেমে থাকে না! গাড়ির মালিক ভাবছেন, খেদমতের নামে উল্টো তিনি আমাদের ভারি বিপদে ফেলে দিয়েছেন, তাই তার অস্থিরতা ছিলো স্বাভাবিক। গাড়ির সামনের ঢাকনা খুলে তিনি কতক্ষণ কী দেখলেন, তারপর বললেন, ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে, পানি ‘খাওয়াতে’ হবে। ইঞ্জিন পানি খায়, ইঞ্জিনকে পানি খাওয়াতে হয়, আমার জানা ছিলো না। আমি শুধু জানতাম, ইঞ্জিনকে তেল ‘খাওয়াতে’ হয়। কিন্তু কোথায় পানি এই মরুসাগরে! দয়াপরবশ হয়ে একজন গাড়ি থামালেন এবং আমাদের নাজেহাল অবস্থা শুনে বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই। এই সামনে জলাশয়, ঠেলে নিয়ে যাও, পানি পেয়ে যাবে।
পানি তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সময় যে পার হয়ে যাবে! অবশ্য এছাড়া উপায়ও তো নেই। সুতরাং নামো এবং ঠেলো। আমরা নামলাম। যে গাড়ি এতক্ষণ আমাদের টেনে এনেছে, সে গাড়িকেই এখন আমরা ঠেলে নিয়ে চললাম। আমরা গাড়ি ঠেলছি, আর আমাদের পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, সে বড় মনে রাখার মত অবস্থা!
অবশেষে জলাশয়ের দেখা পেলাম। ঠিক বাংলাদেশের জলাশয় নয়, মরুভূমির একটু ঢালু স্থান এবং সেখানে জমে থাকা কিছু পানি। রাস্তা থেকে বেশ কিছু দূরে, আবছা আবছা দেখা যায়। দু’টো তিনটে তাঁবুও দেখা যায়। আমাদের কোন প্রকার সুযোগ না দিয়ে গাড়ির মালিক নিজেই গ্যালন হাতে ছুৃটলেন জলাশয়ের দিকে। আমরা শুধু তাকিয়ে আছি, মাওলানা হামীদুল্লাহ সাহেব ঘড়ির দিকে, আমি দূর আকাশের দিকে। দু’জনই ছটফট করছি পরবর্তী ঘটনার জন্য।
কিছুক্ষণ পর তিনি পানি নিয়ে ফিরে এলেন। জানা গেলো, তাঁবুগুলো দু’টি বেদুঈন পরিবারের। সঙ্গে রয়েছে তাদের মেষপাল। তারা পানি দিতে রাজি নয়। অনেক অনুনয় বিনয় করে আনা গেছে।
ভাবলাম, তবু তো ভালো মানুষ, বিনা যুদ্ধে পানি দিয়ে দিয়েছে! মরুভূমির বেদুঈন তো একসময় রক্ত দিয়ে পানি রক্ষা করতো। জলাশয়ের দাবী নিয়ে বেদুঈনদের গোত্রে গোত্রে কত যুদ্ধ হয়েছে তার কিছুটা আন্দায করা যায় আরব জাহিলিয়াতের কবিতায়। এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই। তারপরো মরুভূমির জীবনে পানি অবশ্যই মূল্যবান। আর কোথাও হোক না হোক, ‘পানির অপর নাম জীবন’, এটা মরুভূমির চিরসত্য। সুতরাং মেহমান-সেবার এত দীর্ঘ সুখ্যাতি সত্ত্বেও কোন বেদুঈন পরিবার যদি তার দখলের পানি দিতে কার্পণ্য করে তাতে দোষের কিছু নেই। এক গ্যালন পানি না চেয়ে দু’টো ছাগল চাইলে বরং খুশি মনে তারা দিয়ে দিতো।
যাক, পানি ঢেলে ইঞ্জিনের মাথা ঠান্ডা করা হলো এবং গাড়ি চলতে শুরু করলো। এখন আমাদের বড় চিন্তা হলো সময়। মাওলানা হামীদুল্লাহ সাহেব বারবার ঘড়ি দেখছেন। গাড়ির মালিক তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, আল্লাহ চাহে তো কোন সমস্যা হবে না, আমরা সময় মতই পৌঁছতে পারবো।
কিন্তু আল্লাহ চাইলেন এবং সমস্যা হলো। ইঞ্জিন আবার গরম হলো এবং ‘ঠান্ডা’ হয়ে গেলো। তখন মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবের মাথা এমন গরম হলো যে, আর ঠান্ডা হয় না। না হওয়াই স্বাভাবিক; ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা পার হয়ে গেছে। গাড়ির মালিক বেচারা কাচুমাচু হয়ে বললেন, বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে! এর আগে তো এমন ‘ট্রাবল’ দেখা দেয়নি। আমি বললাম, দেখুন আল্লাহর ইচ্ছার উপর কারো হাত নেই। আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি।
বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি সচল হলো। অবশ্য ততক্ষণে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আটটার পর ছাড়া বিমানবন্দরে পৌঁছার কোন সম্ভাবনা নেই। মাওলানা হামীদুল্লাহ সাহেব বললেন, বিমানবন্দর পর্যন্ত অবশ্যই যাবো, তারপর যা হয় হবে।
পাম্পস্টেশনে গাড়ি থামে তেল নেওয়ার জন্য, আমাদের গাড়ি থামলো পানি নেওয়ার জন্য। কারণ আমাদের গাড়ির তখন তেলের ক্ষুধা নেই, আছে পানির পিপাসা। গাড়ির চালক এখন বেশ হুঁশিয়ার। পাম্পস্টেশনের সামনে গাড়ি থামাতে থামাতে বললেন, পাঁচ মিনিট দেরি হয় হোক, এখান থেকে পানি নিয়ে নেই, যদি পথে প্রয়োজন পড়ে! এবং কিছু দূর গিয়ে প্রয়োজন পড়লো তাও একবার নয়, দু’বার! শেষপর্যন্ত মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব আর ধৈর্য রক্ষা করতে পারলেন না। তার কথায় গাড়ির চালকের প্রতি কিছুটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়েই গেলো। বেচারা ভদ্রলোক কী আর করবেন! অপরাধীর মত নীরবে শুনে গেলেন। তিনি তো হযরত হাফেজ্জী হুযূরের উৎসর্গিতপ্রাণ মুরীদ, চেয়েছিলেন পীরযাদার খেদমত করে পীরের ফয়েয হাছিল করতে; কিন্তু এখন ‘নেকি বরবাদ গোনাহ লাযিম’ অবস্থা। তবু তিনি এমন কৃতার্থ ভাব দেখালেন, যেন পীরযাদার কটুবাক্যও তার জন্য দুআবাক্য। মাঝখানে আমি পড়ে গেলাম বেশ বিব্রতকর অবস্থায়। আমার বড় মায়া হলো বেচারার জন্য।
যাই হোক, দীর্ঘ পথ আরো দীর্ঘ হয়ে এক সময় তা ফুরোলো এবং আটটার অনেক পরে, নয়টার কিছু আগে আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম মোটামুটি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যে, বাংলাদেশ বিমান এখন ডানা মেলে নিশ্চয় আকাশে।
কিন্তু না, বাংলাদেশ বিমান বলে কথা! ‘উনি’ এখনো বিমানবন্দরের মাটিতে! কারণ ‘ওনার’ও ইঞ্জিনে গোলমাল!
যাচ্ছেলে! কী ক্ষতি ছিলো অন্তত এবার সময় রক্ষা করে আকাশে উড়াল দিলে! আমি অন্তত আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতাম আমাদের ‘বলাকা’র কাছে!
জানা গেলো, পরিবর্তিত সময় হচ্ছে দশটা বিশ। পড়িমরি করে ছুটলাম নির্দিষ্ট কাউন্টারের উদ্দেশ্যে। কাউন্টারে এরিয়ান ট্রাভেলসের কর্মকর্তা সুদর্শন আরব যুবক হাসতে হাসতে আমাদের পাসপোর্ট হাতে নিলো। হাসিটার তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায়, ‘যেমন দেশ তেমন বিমান, আর তেমনই তার যাত্রী।’
তরজমাটা অবশ্য এখন করলাম, তখন তো মনের অবস্থা ছিলো অন্যরকম।
যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই বোর্ডিং কার্ড আমাদের হাতে এসে গেলো এবং সামান বেল্টে চলে গেলো। বাইতুল্লাহর মুসাফির হয়ে গেলাম বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী।
এত কষ্ট করে আমাদেরকে যিনি তার অচল গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিলেন তাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর আগে তিনি বরং আমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন, তার কারণে আমাদের বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে বলে! তো আমরা সানন্দে তার ‘ত্রুটি’ ক্ষমা করে কৃতজ্ঞতা জানালাম। তিনি বিদায় হলেন, আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম।
জীবনের পথে পথে এভাবে কত মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয় এবং কত মানুষের কথা আমরা ভুলে যাই। আসলেই আমরা বড় অকৃতজ্ঞ। এ জীবনে কত মানুষের কত উপকার আমি গ্রহণ করেছি, কিন্তু ক’জনের কথা মনে রেখেছি! এই যে বারবার ‘গাড়ির চালক’ বলছি, এর কারণ, ভদ্রলোকের নাম আমি ভুলে গেছি। জীবনের দীর্ঘ পথে অনেকের কথা আমার মনে থাকা উচিত ছিলো, কিন্তু আমি ভুলে গেছি।
শৈশবের এক দুর্ঘটনায় একজন আমাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছিলেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তিনি আমার ‘আপন’ কেউ নন, কিন্তু তার হাত ধরেই আমার আজকের এ জীবন।
যখন হিফযখানায় পড়ি, এক দুষ্ট ছেলের সঙ্গী হয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে মগবাজারে চলে গিয়েছিলাম। তখন রেললাইন ছিলো পলাশি হয়ে। ছেলেটি আমাকে একা ফেলে নিজের পথে চলে গিয়েছিলো।
রমযান মাস ছিলো। ইফতারের সময় আমি একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। এক সহৃদয় ব্যক্তি আমাকে তার দোকানে এনে ইফতার করিয়েছিলেন, তারপর আমাদের চকবাজারের দোকানে আববার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
জীবনে একবারই হয়েছিলো এঁদের সঙ্গে এবং আরো অনেকের সঙ্গে দেখা। কিন্তু আমি ভুলে গেছি তাদের প্রায় সকলের কথা। আমরা মনে রাখি না, আমরা ভুলে যাই। আল্লাহ তাদের সবাইকে খুশি রাখুন।
যাত্রীরা বিমানে ওঠা শুরু করেছেন। আমরা দ্রুত দু’রাকাত এশার নামায পড়ে নিলাম, তারপর বাসে উঠলাম। বাস বিমানের সিঁড়ির সামনে এসে থামলো এবং যথারীতি একটা হুড়াহুড়ি হলো। এই ভালো মানুষগুলোকে কে বোঝাবে যে, বাংলাদেশ বিমান এত সহজে আকাশে ওড়ে না! আমরা ঘণ্টাভর দেরি করেও বিমান ফেল করতে পারি নি!
ধীরে ধীরে সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করলাম। বিমানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শেষবারের মত বুক ভরে গ্রহণ করলাম আরবদেশের বাতাস, হিজাযের খোশবু। শেষবারের মত তাকালাম দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। দেখা যায় না, তবু তাকিয়ে থাকলাম। হিজায ভূমিকে সেদিন শেষ মুহূর্তে যা দিয়ে আসতে পেরেছিলাম তা ছিলো দু’ফোঁটা চোখের পানি। এ দু’ফোঁটা চোখের পানি যে কত মূল্যবান ছিলো তা বুঝতে পেরেছিলাম কিছু দিন পর। যদি মনে থাকে তাহলে সে কথা পরে বলবো।
বিমান ঢাকায় অবতরণ করলো পরদিন সকাল ন’টায়। আমাদেরকে ‘অভ্যর্থনা’ জানাতে বিমানবন্দরে কেউ ছিলো না। থাকবে কেন? আমরা তো ছিলাম আল্লাহর ঘরের দীর্ঘ চারমাসের মুসাফির! সবাই তো জানেন, আমরা হজ্ব করে হাজী হয়ে দেশে ফিরে আসবো। সেই আমরা যে এখন ঢাকা বিমান বন্দরে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছি তা তো কারো কল্পনায়ও আসার কথা নয়।
দুপুরে বাসায় পৌঁছলাম এবং আম্মাকে, আববাকে চমকে দিলাম। আছরের পর মাদরাসায় গেলাম। হযরত হাফেজ্জী হুযূর নূরিয়ার মসজিদে ইতিকাফে আছেন। শুনলাম, আমাদের এভাবে ফিরে আসায় তিনি খুব ব্যথা পেয়েছেন এবং মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবকে তিরস্কার করেছেন। তখন আর কী করবো! দুরু দুরু বুকে মসজিদে তাঁর খিদমতে হাযির হলাম। সালাম দিলাম, মুছাফাহার জন্য হাত বাড়ালাম। তিনি সালামের জওয়াব দিলেন, মুছাফাহা করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। না ভালো, না মন্দ। এমন কঠিন মুহূর্তেই হয়ত মানুষ বলে, ধরণী দ্বিধা হও! কিন্তু ধরণী দ্বিধা হলো না, আমিও নিজেকে লুকোবার কোন উপায় খুঁজে পেলাম না। অপরাধীর মত মাথা নীচু করে বসে থাকলাম অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে। আমার তখন পূর্ণ বুঝ হয়ে গেছে, জীবনের কত বড় ভুল করে এসেছি! নিজের হাতে নিজের সৌভাগ্যকে কীভাবে দাফন করে এসেছি!
হায়, হযরত যদি তিরস্কার করতেন; কঠিন কোন শাস্তি দিতেন তাহলে কিছুটা অন্তত সান্ত্বনা পেতাম। ভিতরের যন্ত্রণার কিছুটা অন্তত উপশম হতো। আমার চোখের সামনে যেন সব অন্ধকার হয়ে এলো। আশঙ্কা হলো, আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো। ধীরে ধীরে আমি হযরতের ইতিকাফের পর্দাঘেরা স্থান থেকে বের হয়ে এলাম। মসজিদের এক কোণে বসে শুধু চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। গতকাল কোথায় ছিলাম, এখন আমার কোথায় থাকার কথা, অথচ এখন আমি কোথায়! কেন এমন হলো! এত বড় ভুল কেন করতে গেলাম! ভুল যখন বোঝার দরকার ছিলো তখন আমার বুঝ কোথায় ছিলো!
সেদিন ইফতারের আগে মুনাজাতে এমন কান্না এসেছিলো এবং চোখ থেকে অশ্রুর এমন ঢল নেমেছিলো, যা পুরো সফরে কখনো হয়নি। মুসাফির পথে পথে নিজেকে নিঃসঙ্গ ও অসহায় মনে করে, কিন্তু আমি যেন ঘরে ফিরে মুসাফিরের মত নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে গেলাম। নিজেকে মনে হলো লুণ্ঠিত কাফেলার সর্বহারা এক মুসাফির।
মুনাজাতে দু’হাত তুলে চোখের পানিতে বুক ভাসালাম। হে আল্লাহ! বান্দার ভুল যত বড় হোক, গোনাহ তার যত গুরুতর হোক তোমার রহমতের দরজা এবং তাওবার দুয়ার তো কখনো বন্ধ হয় না! হে আল্লাহ, আমার ভুলের জন্য আমি লজ্জিত ও অনুতপ্ত। হে আল্লাহ, আমার গোনাহের জন্য আমি ‘পাশীমান’ ও শারমিন্দা। তুমি মাফ করো হে আল্লাহ! তুমি রহম করো হে আল্লাহ! অনুতপ্ত বান্দার তাওবা কবুল করো হে আল্লাহ!
সেদিন ঈদের চাঁদ উঠলো। মসজিদের ছাদে উঠে সবাই আনন্দ করে ঈদের চাঁদ দেখলো, আমিও দেখলাম, কিন্তু কোথায় নতুন চাঁদের আনন্দ!
আমার স্ত্রী তখন ছিলেন নূরীয়া মাদরাসার পশ্চিমে তার মায়ের বাড়িতে। মাগরিবের পর খুব ভারাক্রান্ত মনে সেখানে গেলাম। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন দরজায় আমার প্রতীক্ষায়। সেদিন অত বেদনার মাঝেও তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কোলে সন্তান, মুখে মাতৃত্বের প্রভা! এ দৃশ্য তো পার্থিব নয়, স্বর্গীয়! এখনো সে দৃশ্য আমার মনে পড়ে এবং একটি কোমল মুগ্ধতা আমাকে স্পর্শ করে।
আমার বিপর্যস্ত চেহারা থেকে হয়ত তিনি অনেক কিছু অাঁচ করে নিলেন। তাই কিছু না বলে, কিছু জিজ্ঞাসা না করে শুধু চোখের সজল দৃষ্টি দিয়ে আমার হৃদয়ের গভীরে সমবেদনার পরশ বুলিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। তাতে অতি বড় বেদনারও উপশম হতে পারতো। কিন্তু সেদিন আমার হৃদয়ের বেদনা ছিলো অন্যকিছুৃ। তাই এমন অন্তর্নিঃসৃত সমবেদনাও যেন বেদনাকে আমার আরো রক্তাক্ত করে দিলো। আমি আরো বেদনার্ত হলাম।
কোলের সন্তানকে তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন। সন্তান হলো চাঁদের টুকরো। আমি আমার চাঁদের টুকরো মেয়েকে কোলে নিলাম, আদর করে চুমু খেলাম, কিন্তু কোথায় শান্তি! কোথায় আনন্দ! কান্না যেন আরো উথলে ওঠে! অপরাধের অনুশোচনা যেন আরো তীব্র হয়!
ঈদের দিনে সবার মনে আনন্দের ঢেউ, আমার মনে শুধু কান্নার ঢেউ। কান্নায় তো বুকের ভার হালকা হয়, কিন্তু আমি যত কাঁদি বুক যেন আরো ভারী হয়, ভিতরের যন্ত্রণা যেন আরো তীব্র হয়। তাহলে আমি কি পাগল হয়ে যাবো! আমার যিন্দেগি কি বরবাদ হয়ে যাবে!
‘লা তাকনাতূ মিররাহমাতিল্লাহ’ এ আশ্বাসবাণী কি আমার জন্য নয়! যে যত বড় গোনাহগার, এ আশ্বাসবাণী তো তার জন্য তত জোরদার! না না, আমার আল্লাহর রহমত থেকে আমি নিরাশ হবো না। অবশ্যই এ রাত পোহাবে, আঁধার শেষে আবার ভোর হবে। সবুজ ঘাসের ডগায় আবার শিশির ঝলমল করবে। আবার আমি সজ্জিত হবো ইহরামের শুভ্র-সুন্দর সজ্জায়। সেই শুভ লগ্ন আমার জীবনে আবার আসবে; অবশ্যই আসবে। কবে? আমি জানি না; আমার আল্লাহ জানেন।
পাহাড়পুরী হুযূরের সঙ্গে দেখা করলাম কিছুটা ভয়ে, কিছুটা নির্ভয়ে। তিনি তাঁর মত করেই আমাকে গ্রহণ করলেন। আফসোস করলেন, তিরস্কার করলেন এবং সান্ত্বনা দিলেন। তিনি বললেন, ভুল এবং অনুতাপ হলো আমাদের জীবনের আলো এবং অন্ধকার। ভুল করে আমরা অন্ধকারে পতিত হই, আবার অনুতাপের সিঁড়ি বেয়ে আলোর জগতে ফিরে আসি। সুতরাং অশ্রুজলের সিঞ্চনে জীবনের ভুল হতে পারে জীবনের ফুল। অদ্ভুত সান্ত্বনা এবং অদ্ভুত তার প্রশান্তি! কষ্টের মুহূর্তে মানুষের জীবনে খুব দরকার প্রিয় মানুষের মুখে এমন অন্তরঙ্গ কিছু সান্ত্বনার!
আববা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। একদিন মাদবর বাজার মসজিদে নামাযের পর মুছল্লিরা যখন একে একে বিদায় হলো, শুধু আববা ছিলেন আর আমি ছিলাম, তখন আববা বললেন, ‘আল্লাহর ঘরের আদব রক্ষায় হয়ত তোমার কোন ত্রুটি হয়েছে। আল্লাহর ঘরে যাওয়া সহজ, অনেকেই যায়, কিন্তু আদব রক্ষা করা কঠিন। খুব কম মানুষই পারে আদব রক্ষা করতে। তবে আল্লাহ তাকেই সতর্ক করেন যাকে তিনি ভালোবাসেন। তুমি যদি কেঁদে কেঁদে চোখের পানি ফেলে ফেলে তাওবা করতে পারো তাহলে আল্লাহর মাগফিরাতের চাদর অনেক প্রশস্ত। বাপ হিসাবে আমি সবসময় দুআ করছি, আল্লাহ যেন তোমাকে মাফ করে দেন এবং কবুল করে নেন।’
এবার শোনো, মায়ের কাছে কী পেলাম! আমি আমার ছাত্রদের প্রায় বলে থাকি, দুনিয়াতে সন্তানের জন্য মা হলেন আল্লাহর রহমতের ‘অাঁচল’। তুমি যত বড় হও, কিংবা যত ছোট; তুমি যত ভালো হও, কিংবা যত মন্দ, মা শুধু জানেন তোমার মাথার উপর মমতার আঁচল ধরে রাখতে। দুর্ভাগা সন্তান অনেক সময় নিজের হাতে মাথার উপরের এই মমতার অাঁচল ছিন্ন করে ফেলে। তারপরো মমতাময়ী মা সেই ছিন্ন আঁচলটুকু ধরে রাখেন সন্তানের মাথার উপর।
প্রিয় পাঠক, তুমি যদি বিশ্বাস করো যে, আমি তোমার কল্যাণকামী তাহলে আমার উপদেশ শোনো, সারা জীবন মায়ের আঁচলের নীচে থাকার চেষ্টা করো। যতদিন তিনি বেঁচে আছেন চোখের পানি দিয়ে তাঁর পায়ের পাতা ভিজিয়ে রেখো, আর মৃত্যুর পর ভিজিয়ে রেখো তাঁর কবরের মাটি! তাহলে আল্লাহ তোমাকে চিরকাল সিক্ত করে রাখবেন তাঁর করুণার শিশিরে।
মায়ের মমতার আঁচল আমাকে সবসময় স্মরণ করিয়ে দেয়, মাতৃমমতা যার দান তিনি কত বড় মেহেরবান! তাঁর মায়া-মমতা কত অফুরান!
চৌদ্দশ বছর আগে মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বেদুঈন মা বলেছিলেন আল্লাহর রাসূলকে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো আমার সন্তানকে আগুনে ফেলতে পারবো না, আল্লাহর মায়া আমার চেয়ে বেশী হলে কীভাবে পারবেন মানুষকে তিনি আগুনে জ্বালাতে!
সেই মায়ের কথায় আল্লাহর রাসূলের চোখে অশ্রু ঝরেছিলো। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, দেখো, আল্লাহ শুধু তাকেই শাস্তি দেন যে হঠকারিতা করে।
আরবের সেই বেদুঈন মাকে আমি দেখিনি, কিন্তু আমার মা তো সেই মমতাময়ী মা! পৃথিবীর সব মা তো সেই মমতাময়ী মা!
সেদিন আমার সীমাহীন অস্থিরতা ও যন্ত্রণার সময় মা আমার মাথার উপর মমতার অাঁচল ধরে বলেছিলেন, মায়ের দুআ আল্লাহ অবশ্যই শোনবেন। ইনশাআল্লাহ তুই আবার আল্লাহর ঘরে যাবি! তুই অনেকবার আল্লাহর ঘরে যাবি!
আমার মনে হলো, এ যেন মায়ের কথা নয়, মায়ের মুখে এ যেন আসমানের কথা! এ যেন আসমান থেকে নেমে আসা
সান্ত্বনা!
একদিন আমার কলিজার টুকরো ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিলাম, সে কেঁদে উঠলো। কিন্তু আমার কাছে তার কান্না সেদিন অন্য রকম মনে হলো। মানুষের যা মনে হয়, সবসময় হয়ত তা সত্য নয়, কিন্তু তাতে সান্ত্বনা তো হয়! তাছাড়া এই মনে হওয়া, সেও তো আল্লাহর ইশারা ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং যা মনে হয় তা বিশ্বাস করা আমার মনে হয় অসঙ্গত কিছু নয়। সেদিন আমার ছোট্ট মেয়ের কান্না আমার জন্য বয়ে আনলো অনেক সান্ত্বনা! মনে হলো তার কান্না আমারই জন্য, আমার ইহরামের সাদা লেবাসে যে দাগ পড়েছে তা মুছে ফেলার জন্য। আবেগে আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, আদর করে চুমু খেলাম। আশ্চর্য! তার কান্না থেমে গেলো! দু’চোখে অবাক চাহনি! ঠোঁট দুটিতে যেন জান্নাতের হাসি! আমার ছোট্ট মেয়ের সেদিনের সেই অবাক চাহনি এবং অপূর্ব হাসি আমি এখনো ভুলিনি, আমি কোন দিন ভোলবো না। কারণ তার চোখের তারায় সেদিন আমি দেখতে পেয়েছিলাম কালো গিলাফের স্নিগ্ধতা! তার ঠোঁটের হাসিতে দেখতে পেয়েছিলাম আবে যামযামের ফোয়ারা!
প্রিয় পাঠক! আমার হৃদয়ে একটি বাগান আছে। সেই বাগানে একটি সাদা ফুল আছে। হৃদয়োদ্যানের সেই প্রস্ফুটিত পুষ্পের স্নিগ্ধ শুভ্রতা এবং পবিত্র সৌরভ, তাতেও আমার জন্য ছিলো অনেক শান্তি ও সান্ত্বনা। কিন্তু আমাকে বেষ্টন করে রাখা এতসব সান্ত্বনার পরো যখন আমি নিজের দিকে তাকাতাম; নিজের মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা ও পাপপঙ্কিলতার কথা ভাবতাম তখন সব শান্তি ও সান্ত্বনা আমার হারিয়ে যেতো হতাশার অন্ধকারে। তখন মনে হতো, এ জীবনে, এই পাপী চোখে হয়ত আর দেখা হবে না আল্লাহর ঘর। হে মূর্খ জাহিল, জাবালে রাহমাতের ময়দান সেকি তোমার জন্য! পিতাপুত্রের কোরবানির পবিত্র ভূমি সেকি তোমার জন্য! আরাফার ময়দানে যুগে যুগে ঝরেছে যাদের চোখের পানি তারা কারা!
ইবরাহীমের দাওয়াতে আখেরি নবীর অনুসরণে যুগে যুগে যারা লাববাইক বলেছেন, মুযদালিফার রাতে আহাযারি করেছেন এবং মিনায়, জামারায় আব্দিয়াতের পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা কারা! তুমি কে?!
অথচ ... অথচ তোমাকেও ডাকা হয়েছিলো! দয়া করে তোমাকেও নেওয়া হয়েছিলো! তুমি কী মর্যাদা রেখেছো সে ডাকের! সে দয়ার! কী হক আদায় করেছো ঘরের মালিকের সে দাওয়াতের?!
কোন মুখে তাহলে আবার তোমার এ আব্দার?! তুমি কি হকদার সে মর্যাদার?!
এভাবে কখনো আশায়, কখনো আশংকায় আমার দিন-রাত চলে যায়। রাতের অন্ধকার যেমন আসে তেমনি আসে দিনের আলো। সন্ধ্যায় যেমন সূর্যের অস্ত হয়, আগামী ভোরে তেমনি হয় সূর্যের উদয়। হৃদয়ের মেঘলা আকাশে কখনো দেখি রংধনু, কখনো শুধু কালো কালো মেঘ। স্বপ্নের ময়ুর কখনো পেখম মেলে, কখনো পেখম গুটিয়ে নেয়। দু’চোখ থেকে কখনো অশ্রু ঝরে, শুধু অশ্রু ঝরে; কখনো চোখের তারায় আশার আলো ঝিলমিল করে। বিরহী হৃদয়ে মেঘ-রোদের আলো-ছায়ার এই যে আসা-যাওয়া তাতে কষ্টের মাঝেও শান্তি ছিলো, সান্ত্বনা ছিলো, কিন্তু যে বেদনা হৃদয়কে অবিরাম দগ্ধ করছিলো তা হলো হযরত হাফেজ্জী হুযূর-এর অসন্তুষ্টি, কিংবা মনোকষ্ট। সেই যে ইতিকাফের শেষ মুহূর্তে মসজিদের পর্দাঘেরা খালওয়াতে হাযির হলাম! না ছিলো শাসন, না ছিলো তিরস্কার! পবিত্র মুখমন্ডলে ছিলো শুধু বেদনা ও বিষণ্ণতার ছায়া, যা আমার জন্য ছিলো অসহনীয়। এ মুখমন্ডলে আমি তো চিরদিন দেখে এসেছি শুধু স্নেহ-মমতার উদ্ভাস!
সেদিন সেখান থেকে সেই যে, ফিরে এলাম ‘তিরস্কারহীনতার’ আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে, তারপর আর ডাক আসে নি, যা আগে কখনো হয় নি। এত দিন আমি গাফলতের পরিচয় দিয়েছি, তিনি বারবার ডেকেছেন, জানতে চেয়েছেন, ‘কীভাবে ভুলে থাকো এই বুড়োকে?! যখন বোঝবে তখন তো পাবে না, আমাকে?!’ এভাবে আমি ভুলে থাকতাম, তিনি মনে রাখতেন, কাছে ডাকতেন, আদর করতেন এবং শাসন করতেন। তাঁর আদরে যেমন গলে যেতাম, শাসনে তেমনি বিগলিত হতাম। কিন্তু এখন! এখন যে আর কোন ডাক আসে না! না সোহাগের, না শাসনের!
আমি বারবার যাই তাঁর খানকায়; কখনো দাঁড়াই বাইরে দরজার গোড়ায়, কখনো কামরার ভিতরে পর্দার আড়ালে। তারপর আর সাহসে কুলায় না; ফিরে আসি বেদনায় আরো বেশী ভারাক্রান্ত হয়ে।
একদিন হঠাৎ শুনি খবর, শুরু হতে যাচ্ছে হযরতের হজ্বের সফর! সে খবর শুনে আমি কি আনন্দিত হলাম, কিংবা বেদনার্ত? জানি না আমি কী হলাম! তবে আমি শুধু কাঁদলাম। কাঁদলাম, আর আকাশের দিকে তাকালাম। এমন কঠিন সময়ে যদি না থাকে আকাশের সান্ত্বনা তাহলে দুঃখে বেদনায় জর্জরিত মানুষ বাঁচতে পারে না। আমার যখন প্রয়োজন হয়, আমি তাকাই মেঘের উপরে নীল আকাশের শূন্যতায়। সেখানে আমার জন্য সান্ত্বনা থাকে, সবার জন্যই থাকে। শুধু খুঁজে নিতে হয় এবং অনুভব করতে হয়।
শুনলাম, হজ্বের আগে হযরত যাবেন ইরান সফরে, তারপর হজ্বের শেষে যাবেন ইরাক সফরে। সফরের উদ্দেশ্য, বলা হলো, দুই মুসলিম দেশের ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধের প্রয়াস চালানো।
আরো শুনলাম, সফরের পুরো আয়োজনে রয়েছেন আমাদের সফরের আমীর মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব! তিনি এখন ভীষণ ব্যস্ত। আজ আসেন ইরানের রাষ্ট্রদূত, কাল আসেন ইরাকের। প্রতিদিন আনাগোনা পরিচিত অপরিচিত বহু মানুষের। তখন অনেক কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হলো এবং আমার আফসোস ও অনুতাপ শতগুণে বেড়ে গেলো; তবে অপরাধী অন্য কাউকে নয়, নিজেকেই আমার মনে হলো।
যেদিন হযরত সফরে রওয়ানা হবেন তার আগের রাত্রে কীভাবে যেন সব ভয়-সংশয় দমন করে হযরতের সামনে হাযির হয়ে গেলাম। সালাম নিবেদন করে একপাশে বসে থাকলাম। হযরতের মোরাকাবার সেই নির্জন কক্ষে তখন শুধু তিনি, আর ...
বুক দুরু দুরু করছে। কিছু বলতে চাই, বলতে পারি না। ভিতরে শুধু কম্পন অনুভব করি। একসময় হযরত জিজ্ঞাসা করলেন, মওলভী আবু তাহের ছাহাব, কুছ ফারমায়েঙ্গে?
অদ্ভুত সম্বোধন! তবু তো সম্বোধন! এবং কতদিন পর! চোখের পানি আর বাধা মানলো না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম হযরতের কদমে। আমার বুক ভিজলো, ভিজলো হযরতের পাক কদম। চোখের পানির মূল্য আল্লাহর কাছে তো অপরিসীম, আল্লাহর পেয়ারা বান্দাদের কাছেও রয়েছে তার মূল্য। হযরত আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমি শুধু অঝোরে কাঁদলাম, কেঁদেই গেলাম। আমার চোখের পানিতে এবার ভিজলো হযরতেরও বুক। হয়ত সেদিন তিনি তাঁর বুকে অনুভব করেছিলেন আমার চোখের পানির উষ্ণতা! কারণ হযরত তখন পরম মমতায় তাঁর হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার মাথায়। আমি শুধু বলতে পারলাম, হযরত! আর তো পারি না, আমাকে শাস্তি দিন, কিন্তু মাফ করে দিন।
আমার মুখের শব্দগুলো চোখের পানিতে ভেজা ছিলো, হয়ত বা হৃদয়ের ক্ষত থেকে ঝরা রক্তেও ভেজা ছিলো। শব্দ যদি রক্তভেজা হয়, কিংবা অন্তত অশ্রুভেজা তাহলে তা কম্পন আনে আল্লাহর আরশে। আর মুমিনের দিল যদি হয় আরশের মত তাহলে মুমিনের দিলেও অনুভূত হয় সে কম্পন।
হযরতের দিলে তখন শাফকাত ও মুহাববাতের কী ঢেউ উঠেছিলো তা তো আমি দেখিনি, বুঝিওনি; শুধু অনুভব করলাম, হযরত আমাকে আরো নিবিড়-ভাবে বুকে চেপে ধরেছেন এবং ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
মুখে হযরত কিছু বললেন না, সবকিছু হলো নীরবে, নিঃশব্দে। হযরতের কলবের ‘ধাড়কান’ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। আল্লাহর নেক বান্দার ‘কলবের যবান’ বোঝার সাধ্য কি আমার! শুধু বুঝলাম, এ কলবে এই অধমের জন্য এখনো আছে একটু ‘নরম গোশা’।
বললাম, হযরত! কাবা শরীফের গিলাফ ধরে দুআ করবেন, আল্লাহ যেন আমার সব ভুল মাফ করে দেন। মুলতাযামে বুক লাগিয়ে বলবেন, আল্লাহ যেন তার অবুঝ বান্দাকে আবার লাববাইক বলার তাওফীক দান করেন।
হযরতের কাফেলা রওয়ানা হলো আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে। সে কাফেলায় শামিল ছিলেন মাওলানা হামীদুল্লাহ, ছিলেন আরো অনেকে; ছিলাম না শুধু আমি। এতে অবশ্য কারো দোষ নেই। যাদের ডাক এসেছে তারাই তো শামিল হবে কাফেলায়! যাদের নামে ডাক নেই তারা কীভাবে শামিল হবে! তারা শুধু চোখের পানি ফেলতে পারে, আর পারে রাতের তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তারকার ঝিলিমিলি ছাড়িয়ে আরো বহু দূর থেকে কোন অদৃশ্য আলোর ইশারা যদি পাওয়া যায়! সেই ‘বহু দূর’ চোখের দৃষ্টিসীমার বাইরে, কিন্তু হৃদয়ের দৃষ্টিসীমার বাইরে তো নয়!
সামান্য একটু কষ্ট অবশ্য হলো এজন্য যে, মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবের সঙ্গে দেখা হলো না; না আমার পক্ষ হতে, না তার পক্ষ হতে। আশা করেছিলাম, যাওয়ার সময় তিনি আমাকে কিছু সান্ত্বনার কথা বলবেন।
আশ্চর্য! এই একটি ভুল জীবনে আমরা বারবার করি। ‘মাটির পুতুল’, আমরা আশা করি তার কাছে কিছু পাওয়ার, যার না আছে দেওয়ার ইচ্ছা, না আছে সাধ্য। আশা করি, এবং নিরাশ হই। অথচ শান্তি ও সান্ত্বনার ডালি সাজিয়ে যিনি প্রতীক্ষায় আছেন আমার জন্য, কখন আমি হাত পেতে দাঁড়াবো তাঁর দুয়ারে! তাঁর কথা আমরা ভুলে যাই।
লালবাগ থেকে রওয়ানা হয়ে হযরতের কাফেলা যখন চোখের আড়ালে চলে গেলো তখন হৃদয়ের গভীর থেকে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হলো, আর হঠাৎ মনে হলো, আমি কেন বিমানবন্দরে যাবো না! কাফেলায় শামিল হতে পারি না, কাফেলাকে বিদায় জানাতেও কি পারি না!
আমার হযরত আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে বিমানে আরোহণ করবেন, বিমান আকাশে ওড়বে, রাতের আকাশে দূর থেকে বিমানের লাল আলো জ্বলবে, নিভবে; সে দৃশ্য তো আমি দেখতে পারি! বঞ্চিত ভিখারির এ অসহায় দৃষ্টি যদি পছন্দ হয়ে যায় ঘরের মালিকের! যদি ফেরেশতারা সুফারিশ করেন! যদি রহমতের দরিয়ায় জোশ আসে! কুদরতওয়ালার কুদরতের কাছে অসম্ভব কী!
আল্লাহর শোকর, এমন একটি চিন্তা অন্তরে তখন উদিত হয়েছিলো, যার সুফল আমি হাতে হাতে পেয়েছিলাম। কোন কিছু আমরা নিজেরা কি চিন্তা করতে পারি?! পারি না, বরং অন্তরে বিভিন্ন চিন্তার উদয় ঘটিয়ে তিনিই আমাদের পথ দেখান, সবসময় যাকে আমরা ভুলে থাকি! একটি অদৃশ্য পর্দার অদৃশ্য আড়াল আছে বলে আমরা তাঁকে বুঝতে পারি না। যারা বুঝতে পারেন, অনেক সময় পর্দার আড়ালও সরে যেতে চায় তাদের সামনে থেকে।
কিছু দূর হেঁটে, কিছু দূর বাসে দাঁড়িয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। ভিতরে যাবো, সে ব্যবস্থা আমার কাছে ছিলো না। আল্লাহর এক বান্দা নিজে থেকে সাহায্য করলেন, আমি ভিতরে গেলাম। সামান্য একটু সাহায্য, কিন্তু আমার জন্য ছিলো অসামান্য। তাই তখনো তাকে অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, এখনো তাকে স্মরণ করি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। তাকে আমি চিনি না, তখনো চিনতাম না, কিন্তু তার উজ্জ্বল ছবি এখনো আছে আমার অন্তরে। তিনি যদি বেঁচে থাকেন, সুখের বৃক্ষ থেকে তার উপর যেন অসংখ্য ফুল ঝরে, কল্যাণের ফুল! যদি মৃত্যুবরণ করে থাকেন, রাতের আকাশ থেকে তার কবরে যেন শিশির ঝরে, করুণার শিশির!
কাফেলার লোকেরা দেখলাম ব্যস্ত চঞ্চল। কেউ কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছেন, কেউ খালি হাতেই এখানে আসছেন, ওখানে যাচ্ছেন। ভাগ্যবানদের দেখলেই চেনা যায়। তাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালনেই থাকে সৌভাগ্যের স্ফুরণ।
মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব ইরানী দূতাবাসের কর্মকতাদের সাথে কথা বলছেন। তাদের এই সময়ের ব্যস্ততায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা ভালো মনে হলো না। ব্যাকুল দৃষ্টিতে আমি শুধু খুঁজতে লাগলাম হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে!
একসময় তাঁকে পেলাম; এবং যে অবস্থায় পাবো বলে ধারণা ছিলো সে অবস্থায়ই পেলাম; নিরিবিলি এক কোণে জায়নামাযে! এটা তাঁর চিরপরিচিত রূপ; নির্জনে যেমন তেমনি কোলাহলের মাঝে; অবসরে যেমন তেমনি ব্যস্ততার ভিতরে।
‘নামায আমার চক্ষুর শীতলতা’- এ বাণীর মর্ম কিঞ্চিৎ যদি উপলদ্ধি করতে চাও তাহলে তোমাকে দেখতে হবে আল্লাহর এই বান্দার নামায-নিমগ্নতা। আমি যদ্দুর জেনেছি, হাদীছের মসনদ এবং নামাযের মুছল্লা, এর চেয়ে প্রিয় স্থান তাঁর জীবনে আর কিছু ছিলো না।
আমি হযরতের খুব কাছে পিছনে বসে থাকলাম। নামাযের পরিবেশেই তো আমরা নামায পড়তে জানি না, তাই ভিন্ন এই পরিবেশে হযরতের নামায পড়া দেখতে থাকলাম। হায়, এ দেখা যদি শুধু চোখের না হয়ে, হতো কলবেরও দেখা! এ দেখা যদি নিছক অবলোকন না হয়ে, হতো হৃদয়ের অনুভব! তাহলে হয়ত আমার নামাযেও হতো কিছুটা প্রাণের সঞ্চার, আমার সিজদায়ও থাকতো শক্তির একটু জোয়ার!
হযরতের নামায শেষ হলো এবং মুনাজাত শুরু হলো। আমার মনে হলো, এ এক অমূল্য সুযোগ! পিছনে বসে আমিও শরীক হলাম হযরতের মুনাজাতে। যারা দেখেছেন তারা জানেন, হযরতের মুনাজাত ছিলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি যখন দু’হাত তুলতেন তখন মুনাজাত ও কান্না হতো একাকার। তিনি মুনাজাত করতেন এবং কাঁদতেন; কাঁদতেন এবং মুনাজাত করতেন। এ মুনাজাত ছিলো আল্লাহর সমীপে বান্দার প্রকৃত আত্মনিবেদন, আবদিয়াতের চরম ও পরম প্রকাশ। তখন মনে হতো, বান্দার এমন আব্দার আল্লাহর দরবারে কবুল না হয়ে পারে না। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম যে, তিনি আমাকে তাওফীক দান করেছেন এখানে আসার এবং বাইতুল্লাহর এই মুসাফিরের আখেরি মুনাজাতে শরিক হওয়ার।
মুনাজাত শেষ হলো, আমি এগিয়ে মুছাফাহা করলাম। কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু উদ্গত কান্নার কারণে বলা সম্ভব হলো না। হযরত হয়ত আমার বলতে না পারা কথা বুঝলেন, তাই সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তবে এতদিন যেমন তেমনি আজও কিছু বললেন না।
রাত একটার সময় হযরত যাত্রী এলাকার ভিতরে প্রবেশ করলেন। ইত্তেফাক পত্রিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক নাযিমুদ্দীন মোস্তান হযরতকে ইরান-ইরাক সফর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু তিনি তো তখন অন্য জগতে! হযরত শুধু নিয়মিত নামায পড়ার উপদেশ দিয়ে আগে বেড়ে গেলেন। সাংবাদিক মোস্তানের সেদিনের মন্তব্য আমার এখনো মনে পড়ে। হযরতের গমন পথের দিকে একদৃষ্টিতে অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বলেছিলেন-
‘সঙ্গের লোকেরা তো যাচ্ছেন ইরান-ইরাক সফরে, কিন্তু তিনি যাচ্ছেন আরো অনেক দূরে। তাঁর জগৎ আমাদের থেকে অনেক ভিন্ন এবং আমাদের জগৎ অনেক নীচে।’
মোস্তান সাহেবের মন্তব্যে আমি চমকে উঠলাম, অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আশ্চর্য! আমরা কাছের মানুষেরা কি তাঁকে এভাবে চিনতে পেরেছি?! তাঁর চারপাশে আমাদের দিনরাতের আচরণ এবং উচ্চারণ কী প্রমাণ করে?! আমার মনে হয়, শুধু এখানে নয়, সবখানে, দূরের মানুষেরা কাছের মানুষের চেয়ে বেশী চিনতে পারে এবং বেশী বুঝতে পারে। কারণ কাছের মানুষের সামনে কিসের যেন একটা পর্দা থাকে!
আমি একদৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকলাম হযরতকে যতক্ষণ দেখা যায়। একসময় হযরত চোখের আড়াল হলেন। আমি বিমানবন্দরের খোলা ছাদে দর্শকদের দাঁড়াবার স্থানে চলে এলাম। বোম্বাইগামী বিমান দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা বিমানে উঠতে শুরু করেছে। হযরতকে অস্পষ্টভাবে দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠতে। তিনি বিমানের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হলেন। মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবকেও দেখতে পেলাম। নিজের অজান্তেই বুকের ভিতর থেকে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হলো। ফারুক ভাইকে খুব বেশী করে মনে পড়লো। তিনি মহাভাগ্যবান। মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবও ভাগ্যবান। দুর্ভাগা শুধু একজন। ফারুক ভাই আল্লাহর ঘরের পড়শী, ইনি আল্লাহর ঘরের যাত্রী, আর আমি! ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে সৈকতে পড়ে আছি’!
রাত তিনটায় বিমান চলতে শুরু করলো, আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। অশ্রু ছাড়া আর কোন সম্বল তো ছিলো না আমার!
না, ছিলো! আমার শেষ সম্বল ছিলো আকাশের অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকা। আমি তাকালাম আকাশের তারাগুলোকে ছাড়িয়ে সেই অসীম শূন্যতার দিকে। আমার ভিতর থেকে তখন বের হয়ে এলো এই নীরব আকুতি- হে আল্লাহ! এখনো আমি আশা ছাড়িনি। এখনো আমি হতাশ হইনি। কখনো আমি হতাশ হবো না। আমি তাকিয়ে থাকবো তোমার রহমতের পানে। ব্যাকুল চিত্তে আমি প্রতীক্ষা করবো তোমার কুদরতের স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশের।
বিমান আকাশে উড়লো এবং বহু দূর চলে গেলো। এখন শুধু লাল আলোর বিন্দুটুকু দেখা যায়; একসময় তাও মুছে গেলো। আমার সঙ্গে থাকলো শুধু আমার দীর্ঘশ্বাস।
হযরতকে যারা বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে গাড়ি ছিলো, তারা চলে গেলেন। আমিও তাদের সঙ্গে যেতে পারতাম স্বচ্ছন্দে, কিন্তু আমি গেলাম না; এমনকি নাযিমুদ্দীন মোস্তানের অনুরোধও রক্ষা করলাম না। বাকি রাতটুকু পড়ে থাকলাম বিমানবন্দরে নামায পড়ার ছোট্ট জায়গাটিতে। একাকিত্ব ও অসহায়ত্বের এক অদ্ভুত অনুভূতি ছিলো তখন আমার সঙ্গী।
আশা ও প্রত্যাশা এবং সংশয় ও নিরাশার মাঝে আরো ক’টা দিন পার হলো। আশা ও প্রত্যাশা হলো আল্লাহর রহমতের এবং কুদরতের। নিরাশা ও সংশয় হলো উপায়হীনতার এবং অসহায়ত্বের।
যিলকদের সম্ভবত চৌদ্দ তারিখ। সারাদিন সবক পড়িয়ে আমি ক্লান্ত শ্রান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত। দেহের অবসাদ ও মনের বিষণ্ণতা যখন একত্র হয় তখন বিপর্যস্ততার চূড়ান্ত হয়। তেমনই বিপর্যস্ত অবস্থা ছিলো তখন আমার। এমন সময়, হাঁ, ঠিক এমন সময় হযরতের ছোট ছাহেবযাদা মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি মাদরাসার নায়েব মুহতামিম এবং হযরত হাফেজ্জী হুযূরের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম। আল্লাহ তাঁর কল্যাণ করুন, তিনি আমাকে ডেকেছিলেন আমারই সৌভাগ্যের জন্য, কিন্তু আমি বিরক্ত হলাম অবসাদ ও বিষণ্ণতার কারণে। শরীরটাকে জোর করে টেনে নিয়ে দফতরে হাযির হলাম। চিরকাল তাঁর মুখে যেন ফুলের সুবাস থাকে, তিনি বললেন, আপনি যদি হজ্বের সফরে যেতে চান তাহলে তার ব্যবস্থা হতে পারে।
শরীরে বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে যাওয়ার কথা শুনেছি, আজ অনুভব করলাম। হাঁ, আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে গেলো। কী বলছেন এই ভালো মানুষটি! তিনি যা বলছেন আমি তাই শুনছি তো! বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যে, এটা স্বপ্ন নয়, সত্য; কল্পনা নয়, বাস্তব।
আবার তিনি আমার কানে মধু বর্ষণ করলেন। মধু বর্ষণ ছাড়া আর কী বলতে পারি! আমার বাংলাভাষায় এর চেয়ে সমৃদ্ধ শব্দ আর কী হতে পারে!
আবেগের উচ্ছ্বাসে আমার তখন বাকরুদ্ধ অবস্থা। আমি শুধু বলতে পারলাম, আলহামদু লিল্লাহ!
তিনি মৃদু হেসে বললেন, তাহলে চলুন আমার সঙ্গে। আমি তাঁর সঙ্গে চললাম। জিজ্ঞাসা করার কথা মনেও হলো না, কোথায় এবং কার কাছে! কারণ আমি তখন স্বপ্নের ঘোরে। আমি তখন মক্কার পথে পথে এবং মদীনার গলিতে গলিতে বিচরণ করতে শুরু করেছি।
নূরীয়া থেকে পায়ে হেঁটে খেয়াঘাট, খেয়া পার হয়ে আরো কিছু দূর পায়ে হেঁটে এবং রিকশায় করে কিল্লার মোড়ে খেলাফত দফতর। সেখান থেকে গাড়িতে করে রওয়ানা হলাম, কোন দিকে তা আমার জানা ছিলো না।
আমি হয়ত স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম, যখন মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব বললেন, নামুন আমরা এসে গেছি তখন দেখি, আমাদের গাড়ি এসে থেমেছে লিবিয়ার দূতাবাসের সামনে। আমি তো অবাক! জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে কী জন্য?! তিনি বললেন, লিবীয় দূতাবাস থেকেই এসেছে আমাদের হজ্বের সফরের দাওয়াত। আমাদের চারজনের টিকিট ভিসা হয়ে গেছে। মাননীয় রাষ্ট্রদূত দুপুরে ফোন করে বললেন, তিনি আপনাকেও দাওয়াত দিতে চাচ্ছেন।
আমার স্বপ্নের বেলুন যেন ফুলে ওঠে আবার ফুটো হয়ে গেলো। দপ করে জ্বলে ওঠা আশার প্রদীপ যেন দপ করেই নিভে গেলো। লিবিয়া মুসলিম দেশ, কিন্তু তার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হলো সমাজতন্ত্র। লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফী সম্পর্কে আমার মনোভাব ছিলো চরম নেতিবাচক, (এখনো তাই)। এ ভদ্রলোক হাদীছ ও সুন্নাহকে অস্বীকার করেন এবং কোরআনকে শরীয়াতের একমাত্র উৎস বলে দাবী করেন। নাদওয়াতুল উলামা লৌখনো থেকে প্রকাশিত আল-রাঈদ এবং আলবা‘ছুল ইসলামী পত্রিকায় গাদ্দাফীর মতবাদের কঠোর সমালোচনা করে তাকে বলতে গেলে মুরতাদ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এমন একটি দেশের অর্থানুকূল্যে হজ্বের সফর করা আমার কাছে অসঙ্গত মনে হলো। আরো মনে হলো, এটা আল্লাহর পক্ষ হতে কঠিন পরীক্ষা এবং এ পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ হতে হবে; ছবর ও ধৈর্যের সাথে আমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
মনে পড়লো হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ)-এর ঘটনা। ১৯৬২ সনে নাদওয়াতুল উলামার পক্ষ হতে তিনি কুয়েত সফরে ছিলেন। হজ্বের মৌসুম ছিলো, আর তাঁর অন্তরে ছিলো হজ্বের বে-ইনতিহা শাওক ও তামান্না। প্রথম হজ্ব করেছেন দীর্ঘ এগার বছর হয়ে গেছে। এরপর আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের ডাক আর আসেনি। তিনি তখন এ আশংকায় সন্ত্রস্ত ছিলেন যে, হয়ত হজ্বের সফরে আদবের খেলাফ কিছু ঘটেছে, যার কারণে বাইতুল্লাহর যিয়ারাত থেকে মাহরূমি তাঁর উপর নেমে এসেছে।
এই যখন মনের অবস্থা তখন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর কাছে সৌদি হজ্বমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দাওয়াত এসে পৌঁছলো যে, আপনি তো কুয়েত পর্যন্ত এসে গেছেন! এখন আমার মেহমান হয়ে হজ্ব করে যান। এ দাওয়াত কবুল করলে আমি শোকরগুজার হবো।
হযরত আলী নদবীর সফরসঙ্গীরা এ দাওয়াতকে গায়বী মদদ মনে করে খুব আনন্দিত হলেন, কিন্তু তিনি ভাবলেন অন্যকিছু। আল্লাহর নেক বান্দাদের নযর থাকে ঘটনার বাইরে নয়, ভিতরে। সেই ভিতরের দিকে নযর রেখে সফরসঙ্গীদের তিনি বুঝিয়ে বললেন, আমার মনে হয়, এটা আল্লাহর পরীক্ষা। আমি এটা পছন্দ করি না যে, আল্লাহর ঘরে যাবো আল্লাহর কোন বান্দার ইহসান ও অনুগ্রহের বোঝা মাথায় করে। আমার তো বিশ্বাস, আমার আল্লাহ আমার জন্য গায়ব থেকে কোন ইন্তিযাম করবেন।
এভাবে চিন্তা করে তিনি সৌদি হজ্বমন্ত্রীর দাওয়াত বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিলেন।
হযরত আলী নদবী বলেন, এর বরকতে আল্লাহ তাআলা আমার জন্য এমন সম্মানজনক রাস্তা খুলে দিয়েছেন যে, এখন প্রায় প্রতিবছর আমার হজ্ব নছীব হয়, এমনকি কোন কোন বছর একাধিকবার বাইতুল্লাহ যিয়ারাতের তাওফীক হয়। আমি ভাবলাম, হযরত আলী মিয়াঁর সামনে ছিলো একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত দাওয়াত, যা গ্রহণ করা তিনি সঙ্গত মনে করেননি; অথচ এখানে তো লিবিয়ার মত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের দাওয়াত; এটা গ্রহণ করা কীভাবে সঙ্গত হতে পারে!
আমার আরো মনে পড়লো মরহূম কবি ফররুখ আহমদের কথা। তিনি আমার আদর্শ কবি। আমি মনে করি, তাঁর জগতে তিনি এক মর্দে মুজাহিদ। তাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি এবং তাঁর কবিতা থেকে আদর্শের প্রেরণা গ্রহণ করি।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান একবার একদল কবি-সাহিত্যিককে সরকারিভাবে হজ্ব করার দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাতে নাম ছিলো ফররুখেরও। কিন্তু আমার প্রিয় কবি কী করলেন?! তিনি এই বলে সরকারি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলেন যে, আল্লাহর ঘর যিয়ারাত করবো, যদি তাওফীক হয়, নিজের খরচে, সরকারের দয়ায় সরকারি খরচে নয়। আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের সুযোগ কবি ফররুখ আহমদের কখনো আর হয়নি, কিন্তু মৃত্যুর পর তিনি একটি অভাবনীয় মর্যাদা লাভ করেছিলেন। যখন তাঁকে কাফন পরানো হচ্ছে তখন নূরানী চেহারার সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তি সেখানে হাযির হলেন এবং একশিশি আতর দিয়ে বললেন, এ আতর মদীনা শরীফ থেকে এসেছে কবির জন্য। এ আতর মেখে কবিকে কবরে শোয়াবেন। এ কথা বলে সেই নূরানী চেহারার মানুষটি বিদায় হলেন। আগে বা পরে কেউ তাঁকে আর দেখেনি। হয়ত এটা ছিলো আল্লাহর পক্ষ হতে কবির সেই ঈমানি গায়রতেরই পুরস্কার।
এদু’টি ঘটনা এবং আরো কিছু ঘটনা স্মরণ করে অন্তরের বেদনা এবং হৃদয়ের সুতীব্র দহন সত্ত্বেও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যথাযোগ্য বিনয়ের সাথে আমি অপারগতা প্রকাশ করবো। আল্লাহ তো অসীম কুদরতের অধিকারী, তাঁর খাযানা তো অফুরন্ত। অবিলম্বে, কিংবা সবিলম্বে অবশ্যই তিনি আমাকে ডাকবেন এবং আমার হজ্বের অন্য কোন ইন্তিযাম করবেন, যাতে দ্বীনী গায়রাতের, কিংবা আত্মমর্যাদার প্রশ্ন নেই।
মাননীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনি বললেন, তোমার সম্পাদনায় বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত আরবী পত্রিকা ‘ইক্বরা’ আমি দেখেছি। এদেশে আরবী ভাষার সেবায় তোমার যে মূল্যবান অবদান সে জন্য আমি অত্যন্ত প্রীত। আমি চাই, লিবিয়া সরকারের পক্ষ হতে তুমি এবছর হজ্বের সফর করো।
আমার জীবনে সেটা সত্যি কঠিন এক মুহূর্ত ছিলো। একদিকে হৃদয়ের আবেগ, একদিকে বিচার-বিবেক। একবার ভাবি, বঞ্চনার নিরন্তর যন্ত্রণা ভোগ করার পর নেমে আসা সৌভাগ্যের সুযোগ নিজের হাতে ঠেলে দেবো! একবার ভাবি, ঈমান ও বিশ্বাসের প্রশ্নে গায়রাত পরিত্যাগ করবো? এটা কি আল্লাহর পছন্দ হবে? আল্লাহ কি এতে সন্তুষ্ট হবেন?
মনের সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মুছে ফেলে মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে সম্বোধন করে আমি বললাম, আমার মত সাধারণ তালিবে ইলমের প্রতি আপনার যে আন্তরিকতা সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ এবং হজ্বের সফরের দাওয়াত পেয়ে আমি গৌরবান্বিত। তবে অনিবার্য কিছু অসুবিধার কারণে চিন্তা করার জন্য আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন।
মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেবকে আল্লাহ তাআলা উত্তম বিনিময় দান করুন। আমি যা বলেছি তা তিনি আশা করেননি; তবু তিনি আমার প্রতি মনঃক্ষুণ্ণতা প্রকাশ করেননি, বরং বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, আমি ভুল করছি।
হাঁ, বড় ধরনের ভুলই ছিলো সেটা আমার। কারণ এত কিছু হলো, কিন্তু একবারও মনে পড়লো না পাহাড়পুরী হুযূরের কথা! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু করলাম নিজে নিজেই করলাম! মানুষ যখন নিজের বুদ্ধিতে চলে তখন এমনই হয়। ভুলের পর ভুল করে যায়, আর ভাবে, ঠিক পথেই সে চলেছে। এটা হলো, শয়তানের নূরানী অস্ত্র। কামিল রাহবারের রাহবারি ছাড়া শয়তানের নূরানী অস্ত্র থেকে রক্ষা পাওয়া সত্যি কঠিন।
আমার কর্তব্য ছিলো পাহাড়পুরী হুযূরকে বিষয়টি জানানো এবং তাঁর কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া, কিন্তু যে মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলাম আল্লাহর ঘর থেকে চলে এসে, সেটারই পুনরাবৃত্তি করলাম এখন হজ্বের দাওয়াত ফিরিয়ে দিয়ে। ফোনে যখন মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে আমার অপারগতার কথা জানালাম, তিনি কিছুটা আহত হলেন, বললেন, দেখো, এটা ছিলো আমার আন্তরিক ইচ্ছা, এখন তোমার সিদ্ধান্তের উপর আমার কিছু বলার নেই।
মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেবের কথা ভেবে অবশ্য খুব খারাপ লাগছিলো। কারণ আমি মনে করি, তিনি আমার বেদনা বুঝতে পেরেছিলেন এবং আমার দুর্ভাগ্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর আন্তরিক ইচ্ছা ছিলো, যে কোন উপায়ে আমার যেন আল্লাহর ঘরে যাওয়া হয়। এবারের হজ্বের জামাতে আমার সফরসঙ্গীদ্বয়ের সঙ্গে আমার নামও যেন লেখা হয়। এটা ছিলো আমার প্রতি তাঁর নিছক আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতা, অন্য কিছু নয়। আমার এ সিদ্ধান্তে তাই তিনি মর্মাহত হলেন এবং সে জন্য আমারও খুব খারাপ লাগছিলো। আমার প্রতি তাঁর এ অনুগ্রহ ও শুভকামনার কথা যখনই মনে পড়ে আমার হৃদয় আপ্লুত হয় এবং আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করি। আল্লাহ তাঁকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
সিদ্ধান্ত তো নিয়ে নিলাম এবং মাননীয় রাষ্ট্রদূতকে তা জানিয়েও দিলাম। কিন্তু মনের ভিতরে একটা কাঁটা খচ খচ করে বিঁধতে লাগলো এবং থেকে থেকে এই ভাবনা পেরেশান করতে লাগলো, ভুল পথে চলছি না তো! পরে আবার পস্তাতে হবে না তো!
অবশেষে মনে পড়লো আমার করণীয়। মাগরিবের পর পাহাড়পুরী হুযূরের খিদমতে হাযির হলাম। তিনি তখন নূরিয়া মাদরাসার খানকাহর একটি কামরায় অবস্থান করতেন। হযরত হাফেজ্জী হুযূর-এর দরবারে যারা আসতেন আত্মশুদ্ধির পাঠ ও দীক্ষা গ্রহণের জন্য, তাছাওউফের পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘সালিকীন’, তাদের জন্য মসজিদের উত্তর দিকে খুব নিরিবিলি পরিবেশে দোতলা ও তিনতলায় কতগুলো ছোট ছোট কুঠুরি ছিলো; একজনের থাকার উপযোগী, যাতে প্রত্যেকে নির্জনতার মাঝে আত্মশুদ্ধির সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। কামরাগুলো ছিলো পূর্ব-পশ্চিম দুই সারিতে এবং উপরের তলায় উঠতে হতো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। নির্জনবাসের অত্যন্ত উপযোগী পরিবেশ ছিলো সেটা। এখন হযরত হাফেজ্জী হুযূর নেই, খানকাহও পড়ে আছে বিরান। এমন কোন বিরান ভূমি দেখেই হয়ত কবি বলেছেন ব্যথিত হৃদয়ের যন্ত্রণাকে বিগলিত করে- বুলবুলি নেই বাগানে আজ কে গাইবে বলো বসন্তের গান!/ ঝরা ফুল, শুকনো গাছের শোকে কাঁদে যে বাগানের প্রাণ!
পাক-ভারত উপমহাদেশে রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার একসময়ের প্রাণকেন্দ্র এমন বহু খানকাহ এভাবে আজ বিরান পড়ে আছে। সে বড় বেদনাদায়ক কাহিনী। কলমের মুখে এসে গেলো, তাই কথাগুলো এখানে লিখে রাখলাম। কারণ আমার পর্যবেক্ষণ এই যে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে খানকাহ এবং খানকাহর আত্মশুদ্ধির জীবন এখন একেবারে অপরিচিত। হয়ত আমার এ ক’টি কথা কারো অন্তরে জাগ্রত করবে নতুন ভাবনা, চেতনা। কবি তো বলেছেন-
‘একটি কাঠি জ্বেলে দেয় একটি প্রদীপ, আলোকিত করে ভবন/ প্রদীপ হতে প্রদীপ জ্বলে আলোকিত হয় ভুবন।’
ফিরে আসি আগের কথায়। পাহাড়পুরী হুযূর বেশ কিছু দিন থেকে খানকাহর একটি কামরায় অবস্থান করছিলেন। আমি তার খিদমতে হাযির হলাম এবং সব ঘটনা খুলে বললাম। আমি লক্ষ্য করলাম, ঘটনা বলে যাচ্ছি, আর তাঁর চেহারা গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে চলেছে। চিরকালের শান্ত কোমল আমার প্রিয় উস্তায হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের সেদিন দেখলাম অন্য এক রূপ। এমন কঠিন তিরস্কার এবং এমন কঠিন শব্দ তাঁর মুখে আগে বা পরে আমি আর কখনো শুনিনি।
যেদিন আববা আমাকে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেদিন থেকে তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে আসছেন। ছাত্রকে উস্তাযের এ অদ্ভুত সম্বোধনের উদ্দেশ্য ও রহস্য এখনো আমি ঠিক বুঝতে পারি না। সেদিনও তিনি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেন, কিন্তু সেই ‘আপনি’ ছিলো অন্যরকম। তিনি বললেন, আপনার মত এমন নির্বোধ আমি আর কাউকে দেখিনি। এভাবে নিজের মতে চলতে থাকলে আমার তো আশংকা হয় ...
মাওলার পক্ষ হতে বারবার সুযোগ আসছে, আর বান্দা ‘নখরা’ করে চলেছে! ...
তারপর হুযূর বললেন সেই ঐতিহাসিক বাক্যটি যা এখনো আমি আমার ছাত্রদের খুব স্বাদ গ্রহণ করে করে শোনাই। হুযূর বললেন, আল্লাহর ঘরে আপনার এভাবে থাকা পছন্দ না, ওভাবে যাওয়া পছন্দ না, তো আল্লাহ কি আপনাকে দুলহা সাজিয়ে পালকিতে চড়িয়ে নেবেন!
আপনি কি জানেন, এভাবে হঠাৎ ফিরে আসায় হযরতের দিলে কত বড় ‘ছাদমা’ হয়েছে! এবং আল্লাহর কত বড় নারাযি আপনি ডেকে আনছেন?!
নিজের ভুল বোঝার জন্য আর কিছু বলার প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু হুযূর তখন জোশ ও জযবার মাঝে ছিলেন। কেননা তিনি তাঁর এই ছাত্র থেকে এমন মূর্খতা ও নিবুর্দ্ধিতা আশা করেন নি। লজ্জায় ও অনুশোচনায় আমি তখন পানি পানি। ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন তৃণকে আশ্রয় করে বাঁচতে চায় আমিও তাই করলাম। কাতর হয়ে বললাম, হুযূর! বোকামি যা করার তা তো করেই ফেলেছি, এখন বাঁচার উপায় কী? আমি কি একবার চেষ্টা করে দেখবো? বান্দার জন্য আল্লাহর রহমতের দুয়ার তো কখনো বন্ধ হয় না!
হুযূর তখন কোমল হয়ে বললেন, অবশ্যই চেষ্টা করেন। আমি দুআ করি, আল্লাহ যেন আপনাকে ভুল সংশোধনের সুযোগ দান করেন।
রাতে মুহূর্তের জন্য আমার দু’ চোখে ঘুম আসেনি। কীভাবে কী হবে বুঝে আসছিলো না। ভিসা প্রদানের শেষ তারিখ আগামীকাল এবং ফ্লাইট দুপুর দু’টোয়, এদিকে আমার অবস্থা ‘শূন্য’!
ফজরের পর মাদবরের বাজার মসজিদে অনেকক্ষণ আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলাম। এমন মুনাজাত জীবনে খুব কমই আমার নছীব হয়েছে। চোখের পানি যেন ছিলো আমার কলিজার গলিত রূপ।
আমার ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিলাম, চুমু খেলাম, আর বললাম, হে আল্লাহ, আমি এই মাসুম বাচ্চার বাপ, এর উছিলায় আমাকে মাফ করো, আমার রাস্তা খুলে দাও।
আম্মা-আববার দুআ সম্বল করে বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা হলাম। আমার সব ভাই আমার প্রিয়, তাদের মাঝে বশির আরো প্রিয়, তাকে বললাম, ব্যাগে করে আমার ইহরামের লিবাস এবং জামাকাপড় নিয়ে তুমি বিমানবন্দরে যাও, আল্লাহ যদি কবুল করেন তাহলে তো সামনে..., আর না হয়...!
লিবীয় দূতাবাসে যখন পৌঁছলাম তখন নয়টা এবং মাননীয় রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত। হায়, আল্লাহ! তিনি এলেন দশটার কিছু আগে। আমার কোন পূর্বনির্ধারিত সময় ছিলো না। সেখানে বামপন্থী মহলের চিন্তাপুরুষ মরহূম আহমদ ছফা ছিলেন এবং তার এ্যাপয়েনমেন্ট ছিলো প্রথম। বোধগম্য কারণেই লিবীয় দূতাবাসের সাথে আহমদ ছাফাদের তখন বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তারপরো মাননীয় রাষ্ট্রদূত দয়া করে সবার আগে আমাকে ডাকলেন। আমি সালাম দিয়ে কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই বললাম, দেখুন, আমি ভুল করেছি। আপনার দাওয়াতকে আমি অসম্মান করেছি। এখন আমি কি আমার ভুল সংশোধনের সুযোগ পাবো?
একজন রাষ্ট্রদূতের অহমিকা নিয়ে তিনি বলতে পারতেন, সুযোগ বারবার আসে না, যাও এখন আর হবে না। কিংবা সুযোগ দিলেও তিরস্কারের ভাষায় কথা বলতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি আমাকে বিদায়ও করলেন না, তিরস্কারও করলেন না। তিনি ছিলেন আরব রক্তের অধিকারী। সুতরাং আরবীয় আভিজাত্যের পূর্ণ প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বললেন, বলো কি তুমি! এ তো আমার জন্য এবং আমার দেশের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়! তোমার টিকিট ও ডলার আমি রেখে দিয়েছি। তুমি যদি রাযি হও তাহলে হজ্বের পর আমার দেশও দেখে আসো, এটা আমি চাই।
আনন্দের আতিশয্যে আমি প্রায় কেঁদে ফেললাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের যতগুলো শব্দ জানা ছিলো সবগুলো তাঁকে বললাম, আর বললাম, ইন্শাআল্লাহ পরবর্তীতে সুবিধামত সময়ে তোমার দেশে যাবো; তোমার দেশ তো আমারও দেশ! তবে এখন শুধু হজ্বের সফরে যেতে চাই।
মাননীয় রাষ্ট্রদূতের হাতে চুমু খেয়ে টিকিট নিলাম। এক হাজার ডলার ছিলো, আমি দু’শ ডলার নিয়ে বললাম, এতেই আমার রাহা খরচ হয়ে যাবে। তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, বললেন, তোমার যেমন ইচ্ছা!
আলী আলগাদামসীর পরে তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন। গাদামসীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা ছিলো। পটিয়া মাদরাসায় আমি যখন শেষ বর্ষের ছাত্র তখন তিনি সেখানে গিয়েছিলেন এবং আমি তাকে সম্বর্ধনা ও মানপত্র দিয়েছিলাম। সেই থেকে পরিচয় এবং পরবর্তীতে অন্তরঙ্গতা। বর্তমান রাষ্ট্রদূতের নাম আলী হোসাইন। তার সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিলো না। একবার শুধু তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযূরের দরবারে এসেছিলেন এবং আমি দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেছিলাম। জানি না এখন তিনি কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন! যেখানেই থাকুন, আল্লাহ তাকে সুখে রাখুন। তার অনুগ্রহ ও আন্তরিকতার কথা আমি কখনো ভোলবো না।
এরপর ভিসা নেওয়ার পালা। তখন বাজে দশটা। ছুটলাম সৌদি দূতাবাসের উদ্দেশ্যে। বহু বছর হলো সৌদি দূতাবাসে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, তাই এখনকার অবস্থা ঠিক বলতে পারবো না; তখন সৌদি দূতাবাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, দারোয়ান থেকে গাড়োয়ান এবং চাপরাশি থেকে অফিসার সবক’টি বাঙ্গালী এমন একটি দলের অনুগত যারা মনে করে, ইকামাতে দ্বীনের জন্য তারাই ‘ভগবানের’ একমাত্র নির্বাচিত দল এবং এ দেশের আলিম সমাজ হলো তাদের পথের কাঁটা।
দূতাবাসের প্রধান ফটকে এসে ‘দারোয়ান সাহেব’কে যখন যথাযোগ্য বিনয়ের সাথে আমার উদ্দেশ্যের কথা জানালাম তখন তিনি ‘ভিসার সময় শেষ’ বলে পত্রপাঠ আমাকে নাকচ করে দিলেন এবং আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কিন্তু আল্লাহ যখন সাহায্য করেন।
[চলবে, ইনশাআল্লাহ]