স্বদেশঃ রক্তের হোলিখেলা দেখতে চায় না কেউ
Abu Tashrif
গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা দখল করেছে চরমপন'ীদের হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও টেণ্ডারবাজিসহ নানা ধরনের সশস্ত্র তৎপরতার খবর। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বার-তেরটি জেলায় এসব সশস্ত্র চরমপন'ীর বিভীষিকাপূর্ণ কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। বহু মানুষ নিজ এলাকা ও ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমিয়েছেন। গত ছয় মাসে চরমপন'ী সর্বহারাদের হাতে তিনশ’রও বেশি বীভৎস ও লোমহর্ষক খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন' আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব চরমপন'ীর সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও স'ানীয় নেতাদের যোগসাজসের কথাও উঠে আসছে। গত ২২ আগস্টের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান শিরোনামই ছিল ‘বেপরোয়া চরমপন'ীরা’। অপরদিকে গত ৩ সেপ্টেম্বরের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সশস্ত্র এসব চরমপন'ীর সংগঠনের সংখ্যা প্রায় বিশটি এবং এ সংগঠনগুলোর প্রায় ৩ হাজার সশস্ত্র ক্যাডার বিভিন্ন জেলায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও খুনের মতো লোমহর্ষক ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটিয়ে চলেছে।
এসব চরমপন'ীর ঘোষিত আদর্শ হচ্ছে সমাজতন্ত্র। বামপন'ী রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত হয়েই তারা এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রেণীশত্রু খতমের নামে সশস্ত্র রাজনৈতিক তৎপরতা চালু করেছিল চরমপন'ীরা। এরপর বছরে বছরে তাদের হাতে সংগঠিত খুনের সংখ্যা এবং তাদের নিজেদের দল-উপদলের সংখ্যা দুটোই বেড়েছে। তাদের দৌরাত্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হলেও দিন দিন এদের শক্তি-সামর্থ ও নৃশংসতা বেড়েছে বৈ কমেনি। এরপরও এদের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু কিংবা রাজধানী কেন্দ্রিক আদর্শিক তত্ত্ব বিতরণকারীদের প্রতি সরকারী উদ্যোগে কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। জেএমবির বোমাবাজির পর থেকে যেভাবে ইসলামী শিক্ষা বিস-ারকারী কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকামী যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে সন্দেহের শিকারে পরিণত করার উদ্যোগ দেখা গিয়েছে, এসব চরমপন'ীর লক্ষ্য ও আদর্শের সূত্র ধরে-এমনকি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকলেও-ঢাকার কোনো ধারার কোনো বাম নেতা বা সংগঠনকে স্পর্শ করা হয়নি। অনেক বিদগ্ধজনের ধারণায়, এজন্যই এসব চরমপন'ীর শেকড়ে হাত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঘোষণা দিয়ে চরমপন'ী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করা হলেও তারা বরাবর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স'ানীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে বলে র্যাব-পুলিশও অনেক সময় তদের ধরতে পারছে না বা ধরেও রাখতে পারছে না। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), পূর্ব বাংলার কামিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (হক), নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মৃনাল), শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি, ছিন্নমূল কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট যুদ্ধ, গণমুক্তি ফৌজ, জাসদ গণবাহিনী, জাসদ গণবাহিনী এ (লাল পতাকা), লাল বাহিনী, ঘামা বাহিনী, টিক্কা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়াও বিভিন্ন দল, উপদল, গ্যাংদলেও বিভক্ত হয়েছে এ সংগঠনগুলো। জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন'ীদের দুই শতাধিক গ্যাংগ্রুপ তৎপর রয়েছে।
এদেশে ইসলামী আইনের নামে বিভ্রানি-র শিকার মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোকের একটি সংগঠন সিরিজ বোমা হামলা চালানো এবং কয়েকজনকে হত্যার পর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়ে যে পরিমাণ মাতামাতি হয়েছে ও হচ্ছে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি অপরাধ করলেও এই চরমপন'ী ইস্যু নিয়ে তার সিকিভাগ মনোযোগও আরোপ করতে দেখা যায়নি। না সরকারী উদ্যোগে, না মিডিয়ার প্রচারে। এতে ক্ষতি হয়েছে দেশের। অতি ক্ষুদ্র একটি দিকে সর্বাত্মক মনোযোগ ও প্রচারণা কেন্দ্রিভূত করায় অপরাধের অন্য এক রাজ্য চরম পর্যায়ে পৌঁছার সুযোগ পেয়েছে। সরলভাবে দেখলে বলতে হয় যে, এ ক্ষেত্রটিতে সরকার ও মিডিয়ার প্রাধান্য নির্ণয়ে এবং পদক্ষেপ পরিচালনায় দূরদর্শিতার অভাব যেমন ধরা পড়েছে তেমনি কিছু বাড়াবাড়িও হয়েছে। আর যদি আদর্শিক ভেদবুদ্ধি ও আন-র্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার সূক্ষ্ম আনুকূল্যের বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা হয় তাহলে বলতেই হবে যে, ইসলামের নাম নিয়ে যেহেতু কিছু খুন-জখমের ঘটনা ঘটে গেছে এবং এ বিষয়ে অবুঝ ও ভুল চিন-ার শিকার কিছু লোক সক্রিয় হয়েছে, সংখ্যায় তারা যা-ই থাকুক তাদেরকে নিয়ে মনোযোগ ও প্রচারের মাত্রাটা তাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যায়ে ভালোমন্দ নির্বিশেষে বহু মাদরাসা ও সংগঠনকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে, তাদের সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত বক্তব্য দিয়ে পরিসি'তি তাতিয়ে তোলা হয়েছে। পশ্চিমানুকূল্য পাওয়ার জন্য প্রশাসন ও মিডিয়ার বড় অংশ এ ক্ষেত্রে সমানতালে ভূমিকা রেখেছে। অথচ বাম চরমপন'ীরা গড়ে প্রতিদিন পাঁচটি করে খুন করলেও, খুন করে মানুষের ছিন্ন মস-ক শহরের মধ্যে ফেলে গেলেও সেদিকটি নিয়ে তেমন কোনো উচ্যবাচ্য হচ্ছে না। যেন এটা কোনো গুরুতর সমস্যাই নয়। উপরন' স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মুখে ইদানীং শুনতে হচ্ছে যে, তাদেরকে আত্মসমর্পণ ও সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
যে কোনো ভালো বা মন্দ আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষ খুন ও সন্ত্রাসী তৎপরতা বিচার ও শাসি-যোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে ডান না বাম, ধর্ম না অ-ধর্ম, জেএমবি না চরমপন'ী-বাস-ব পদক্ষেপে এ ধরনের ভেদরেখা সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যই ভয়ংকর ক্ষতিকর। কিন' এটাই যেন এখন ঘটে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিকে হয়তো কেল্লা ফতেহ হয়ে যাবে, অপরদিকে দ্রুত বিপর্যয়ের খাদ গভীর হবে। এটাতো দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
ধর্মের নামে বোমার আঘাতে নিরীহ মানুষের অনি-মযাত্রা যেমন আমরা দেখতে চাইনি তেমনি শ্রেণীশত্রু খতমের নামে বছরের পর বছর ধরে দেশের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রক্তের হোলি খেলাও দেখতে চায় না কেউ। বেআইনি কাজের সমান-রাল প্রতিরোধ চাই।