পেঁ য়া জ
সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে...
গত মাসে দেশের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ছিল পেঁয়াজ। পত্র-পত্রিকা, টকশো আলোচনা, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চায়ের স্টল, ঘরোয়া বৈঠক সবকিছুতেই ছিল পেঁয়াজের ঝাঁজ। ইতিমধ্যে পেঁয়াজের দাম বাংলাদেশে সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। পেঁয়াজের দর আপেল-কমলার দর ছাড়িয়ে গেছে; বরং একপর্যায়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। আপেল-কমলার দর ১২০ থেকে ১৫০; কিন্তু দেশের কোথাও কোথাও পেঁয়াজের দর গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮০ টাকা। পেঁয়াজের এই অগ্নিমূল্যের কারণে টিসিবির উদ্যোগে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ ক্রয় করতে রীতিমত যুদ্ধ করতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা কমমূল্যে ১ কেজি পেঁয়াজ সংগ্রহ করার পর চোখে মুখে যেন ফুটে উঠেছে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। দেশের ইতিহাসে এ এক বিরল চিত্র।
গত মাস জুড়ে পেঁয়াজই যেন ছিল সাধারণ জনগণের সবচেয়ে কাম্যবস্তু। তাইতো বিয়ের অনুষ্ঠানে বরের বন্ধুর পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ দেওয়ার ঘটনাও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। কানাডা প্রবাসী এক ব্যক্তি গত মাসে দেশে এসেছিলেন। দেশের পেঁয়াজের বাজারে ‘আগুন’-এর খবর শুনে তিনি এ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাকেই নিজের জন্য শ্রেয় মনে করেছেন। তাই কানাডা থেকে আসার সময়ই সাথে নিয়ে এসেছেন পেঁয়াজ।
পেঁয়াজের বাজারে বিদ্যমান অস্থিরতার কারণ কী? বাণিজ্যমন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অযোগ্যতা ও উদাসীনতাকে এক্ষেত্রে বড় করে দেখা হচ্ছে। মনে হচ্ছে দায়িত্বশীলগণের এ বিষয়ে শুধু গাফলতি নয়, বরং ধারণারই কমতি ছিল। এত বেশি ব্যবহৃত আমদানী নির্ভর একটি পণ্যের ক্ষেত্রে শুধু একটি দেশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করা বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশই তো পেঁয়াজ রফতানি করে থাকে। এখন যেমন ঐ সব দেশ থেকে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আগে কেন তা করা হল না। একতরফা বন্ধুত্বের খেসারত আর কত দেখতে হবে!
এছাড়া এই অস্থির পরিস্থিতির পিছনে রয়েছে মূলত কিছু মুনাফালোভী অসাধু ও অসৎ ব্যবসায়ীর ভোগবাদী মানসিকতা। মানুষের প্রয়োজন ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এরা। পেঁয়াজ-সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনজীবনকে অস্থির করে তোলার পিছনে এদের দায় অনেক। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ১৫ জনের একটি সিন্ডিকেট চিহ্নিত করেছে, যারা মিয়ানমার থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ আমদানি করে ১১০ টাকা কেজিতে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেছে। রাজশাহীতে একটি গুদাম থেকে ৩০০ বস্তা পেঁয়াজ উদ্ধার করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বস্তার পর বস্তা পেঁয়াজ পচে গেলেও সেগুলো বাজারে ছাড়া হয়নি সংকটকে প্রকট করে তোলার জন্য। ব্যবসা তাদের কাছে সেবা নয়; বরং জনগণকে শোষণের মাধ্যমে রাতারাতি বিলিয়নিয়ার হওয়ার হাতিয়ার। জনগণকে চুষে কংকালসার বানিয়ে নিজেরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াই যেন তাদের জীবনের লক্ষ্য।
সেইসাথে আমাদের অতিমাত্রার অস্থিরতাও ঐসব মুনাফাখোরদের সুবিধার কারণ হয়। পেঁয়াজ ছাড়া আমাদের জীবন চলবে না এমন তো নয়!
তবে হাঁ, ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে। ব্যবসায়ী-দোকানদারদের মধ্যেও অপেক্ষাকৃত কম লাভ করেছেন এমন মানুষও আছেন। এমন একজন ব্যবসায়ী হলেন- মোহাম্মাদ আলী। থাকেন ঢাকার মানিকদীতে। তার ছোট একটা মুদি দোকান। অল্প পরিসরে সাদামাটা ব্যবসা। অনেক পণ্যের পাশাপাশি পেঁয়াজও বিক্রি করেন। পেঁয়াজের দাম আশিতে ঠেকার পর বন্ধুদেশ(?) যখন হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিল তখন অশনি সংকেত দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। তাই পেঁয়াজের বাজারে আগুন লাগার আগেই বেশ কয়েক বস্তা কিনে রেখেছিলেন। ৮০ টাকার পেঁয়াজ এক লাফ দিয়ে উঠল ১৫০ টাকায়। আরেক লাফ দিয়ে উঠল ২০০-এর সিঁড়িতে। উঠতে উঠতে পৌঁছে গেল সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পেঁয়াজ-সিন্ডিকেটের গডফাদাররা দুহাত ভরে টাকা কামালেও মুহাম্মাদ আলীর মধ্যে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। পেঁয়াজের বাজারে যখন দাউ দাউ করে আগুন জ¦লছে, ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি পেঁয়াজ, তিনি তখন সেটা বিক্রি করেছেন ১২০ টাকায়। অর্থাৎ কেজি প্রতি তিনি ছাড় দিয়েছেন ৬০-৮০ টাকা। এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, আসলে আমার কাছে কিছু পেঁয়াজ স্টক করা ছিল। চাইলেই বেশি দামে সেগুলো বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু মনে হল- কী লাভ মানুষকে কষ্ট দিয়ে। একটু অল্প দামে বিক্রি করলেও তো আমার আর লস হচ্ছে না। গ্রাহকদের ন্যায্য সেবা দেওয়ার এটা একটা সুবর্ণ সুযোগও। তাই সেবার নিয়তে কমমূল্যেই পেঁয়াজ বিক্রি করেছি।
ব্যবসার ক্ষেত্রে সেবার মানসিকতা আর জবাবদিহিতার ভয় না থাকা-ই বর্তমান বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। ব্যবসায়ীরা যদি শিক্ষা নেন- স্বল্পপুঁজির একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ আলীর কাছ থেকে তাহলে অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হতে পারে।