সুখী পরিবার : কিছু কথা
একজন কন্যাসন্তান যখন পৃথিবীতে আগমন করে তখন পিতা-মাতার আনন্দের অন্ত থাকে না। বাজারের সুন্দর জামাটা এনে মেয়ের গায়ে পরিয়ে দেন। বাবা মায়ের দিন-রাতের ভাবনা- তার আদরের মেয়েকে কী খাওয়াবেন, কী পরাবেন, কীভাবে সাজাবেন। এভাবে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও আত্মীয়-স্বজন সবার আদর-¯েœহে বেড়ে উঠতে থাকে মেয়েটি।
মেয়েটি যখন বড় হয় তখন সময় হয় পাত্রস্থ করার। মুরব্বীগণ ভাবতে থাকেন- মেয়েকে এখন স্বামীর ঘরে যেতে হবে। যেতে হবে নতুন এক পরিবারে। যার কাছে মেয়েটি যাবে, সে এবং তার পরিবার কেমন আচরণ করবে তার সাথে। সেওবা কেমন মানিয়ে নিতে পারবে নিজেকে এক নতুন পরিবারে, নতুন পরিবেশে। এসব ভেবেচিন্তে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে একসময় মেয়েটিকে তুলে দেন পাত্রের হাতে। শুরু হয় তার নতুন জীবন, নতুন পথচলা।
একটি মেয়ে যখন স্বামীর পরিবারে যায় তখন নিজ পরিবারের জন্য তার মন যে কেমন কাঁদে তা নারীমাত্রই বুঝতে পারে। বাবার বাড়ির সামান্য জিনিসটার কথাও খুব মনে পড়তে থাকে তার।
মেয়েদের নাকি জন্মই স্বামীর ঘরে যাওয়ার জন্য। তাতে আপত্তি নেই কোনো মেয়ের। প্রতিটি নারীর স্বভাবজাত স্বপ্ন- তার স্বামী হবে, সন্তান হবে, নিজের সংসার হবে। কিন্তু সে চিন্তায় থাকে- যে পরিবারে সে যাবে তারা তাকে কেমনভাবে গ্রহণ করবে, কেমন আচরণ করবে তার সাথে। সে চায়- স্বামী ও স্বামী-পরিবারের উত্তম আচরণ ও মমতা। সুতরাং সেখানকার লোকজনের উচিত নতুন বউ হয়ে আসা মেয়েটিকে মায়া-মমতা দিয়ে আপন করে নেয়া। একটু সান্ত¡না, একটু মমতা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো।
তবে আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েটিকে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। কখনও তাকে আল্লাহ যে কাঠামোতে সৃষ্টি করেছেন সেসবের সমালোচনাও কানে আসতে থাকে।
নিজের মেয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে যদি এসবের সম্মুখীন হয় তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়; কিন্তু নিজের বাড়িতে বউ হয়ে আসা মেয়েটির ক্ষেত্রে কি সে কথা আমাদের মনে থাকে! এক নারী যদি অপর নারীর দুঃখ না বোঝে তাহলে কীভাবে হবে সমাধান!
অপরদিকে অনেক বোন আছে, যারা সামান্য সমস্যার কারণে অস্থির হয়ে পড়ে। অথচ ধৈর্য ও অবিচলতার মাধ্যমে পরিস্থিতি খুব সহজেই অনুকূলে চলে আসে। এতে স্বামীও তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে এবং স¦ামীর পরিবারও। তখন স¦ামীও আপন মা-বোনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক অটুট রাখতে পারে।
মোটকথা, উভয় পক্ষ থেকেই যদি ধৈর্য ও হিত কামনার ভিত্তিতে আচরণ হয় তাহলে পরিস্থিতি খুব সহজেই ম্যানেজ করা সম্ভব। একদিকে মেয়েটি যদি একটু ধৈর্য ধরে আর অপরদিকে স্বামীর বাড়ির লোকজনও যদি একটু ভাবে- মেয়েটি এখানে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে নতুন এসেছে, এখানকার নিয়মনীতি অনেককিছুই তার রপ্ত নেই, পিতার বাড়িতে তার কাজ-কর্মের অভিজ্ঞতা নাও থাকতে পারে, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে; তাহলে পরিস্থিতি জটিল হয় না। ভুল সবার মাঝেই আছে। একটু সহনশীল হয়ে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললে ফেতনা তৈরি হয় না। আসলে ন¤্রতা, সহনশীলতা, অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেওয়া, অন্যের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখা এবং ক্ষমা ও উপেক্ষা করার গুণ অর্জন করা কাম্য। হাদীসে এসব গুণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
অনেক সময় বউ ও শ্বশুর বাড়ির লোকদের মাঝে তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে কত বিরাট ঝগড়া বেধে যায়! কখনও কখনও তা কী নির্মম পরিণতি ডেকে আনে! বস্তুত সবাই যদি নিজের প্রাপ্যকে ছাড় দিয়ে অন্যের প্রাপ্য সম্পর্কে সচেতন হই, পুত্রবধুর সাথে সুন্দর ব্যবহার করি এবং পরিবারে অন্যদেরকেও তার সাথে ভালো আচরণের উপদেশ দিই এবং বউ হয়ে আসা মেয়েটিও যদি সহনশীলতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় তখন পারিবারিক জীবন শান্তিময় হয়ে ওঠে।
আসলে সুন্দর ব্যবহার তো সবার সাথেই কাম্য। ইসলাম তো অমুসলিমের সাথেও সুন্দর আচরণ করতে বলে। তাহলে পরিবারের বউ-শাশুড়ি ও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আচরণ কেমন হওয়া চাই! যারা একে অপরের এতটা কাছের, এতটা আপন!
এক ব্যক্তি বলেছিলেন, কোনো বউ মেয়ে হয় না, আর কোনো শাশুড়ি মা হয় না। আসলেই কি বিষয়টি এমন? না, কিছু শাশুড়ি এমন আছেন, যারা বউমা’র জন্য ‘মা’য়ের ভূমিকা পালন করেন। কিছুদিন আগে মাসিক আলকাউসারে (জুন ২০১৯ সংখ্যা) পর্দানশীন পাতায় ‘আমার মা’ শিরোনামে বিনতে হাসান লিখেছিলেন তার মা সম্পর্কে। তিনি ছিলেন একজন দ্বীনদার নারী, একজন আদর্শ শাশুড়ি। বিনতে হাসান বউমা’র সাথে তার মায়ের আচরণ তুলে ধরেন এভাবে-
“পুত্রবধুর ব্যাপারে তার ছিল বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। বড় ভাইয়ের বিয়ের আগেই আমাকে এ ব্যাপারে উপদেশ দিতেন। ননদ-ভাবির কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত আমাকে খুলে খুলে বলতেন। তিনি বলতেন, ভাবিকে ভাবি নয় বরং নিজের বোনের মত ভাববে। (তাই আমি তাকে একবারও ভাবি ডাকিনি; বরং সবসময় আপু ডেকেছি।) তার সাথে ভালো আচরণ করবে। কখনো কর্কশ ভাষায় কথা বলবে না। সে তো নিজের পরিবার রেখে আমাদের কাছে আসবে। আমরাই যদি তার সাথে খারাপ আচরণ করি তাহলে সে কেমন কষ্ট পাবে চিন্তা কর। এগুলো তো হল ভাবি আসার আগের কথা। ভাবি আসার পরে যা হয়েছে তা ছিল আমার ভাবনার অতীত। তিনি নিজের পুত্রবধুর সাথে মেয়ের মত আচরণ করলেন; বরং বললে ভুল হবে না যে, তার থেকেও বেশি। তার কাপড় নিজে ধুয়ে দিতেন। রান্নার ক্ষেত্রেও তাকে সহযোগিতা করতেন। তার মাথায় তেল মেখে দিতেন। কদাচিৎ নয়; বরং যতদিন তিনি সুস্থ ছিলেন নিয়মিত করার চেষ্টা করতেন। কখনো তাকে ধমক দিতেন না। উল্টো আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক করতেন। আর তিনি পুত্রবধুকে নিজ বাড়িতে যেতে কখনো বারণ করতেন না; বরং অনেকসময় নিজেই তাকে বাড়ি পাঠাতেন। এতে আমার রাগ হত। আমি মাকে বলতাম, এখন তো তুমি অসুস্থ । তাকে বাড়ি পাঠালে তোমার সহযোগিতা কে করবে? তিনি বলতেন, মেয়েটা কতদিন হয়েছে বাবা মাকে দেখে না (অথচ দেখা যেত এক সপ্তাহও হয়নি)। যাক কয়েকদিন বেড়িয়ে আসুক। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিতেন না। এজন্য তার উপর আমার ঈর্ষা হত।”
‘ছবর’-তথা অন্যের অপছন্দনীয় বিষয় ও ত্রুটির ক্ষেত্রে সহনশীল হওয়া এবং ‘ইছার’-তথা অন্যের সুবিধা-অসুবিধাকে প্রাধান্য দেওয়ার সাথে সাথে যদি ‘আলআফউ’-তথা ক্ষমা করা এবং ‘আসসফহু’-তথা ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করার মতো গুণাবলির চর্চা করা যায় তাহলে একটি পরিবার বহু অশান্তি ও ফেতনা থেকে সহজেই বাঁচতে পারে। পরিবারটি হয়ে উঠতে পারে সুখী পরিবার।